প্রকাশিত: ২০২৩-০৫-০৮ ২২:৪০:৪৭
আপডেট: ২০২৩-০৫-১১ ১১:০০:১২
সিলেটের একটি অনুষ্ঠানে লেখালেখির গল্প শুনিয়েছিলেন সমরেশ মজুমদার
শাকিলা ববি:
২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের বাতিঘরে তার নতুন বই ‘অপরিচিত জীবনযাপন’ প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তার আসার খবরে সিলেট বাতিঘরে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। তার সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকলেও এই প্রথম তাকে দেখলাম। মানুষের ভিড়ে হেঁটে আসা নীল, সাদা, লাল চেক শার্ট পরা মানুষটাকে দেখতে পুরো রোমান্টিক হিরোর মত লাগছিল। তার গল্প বা উপন্যাস খুব একটা না পড়লেও সেদিনের তার লেখক হয়ে উঠার জার্নিটা আমার মনে বেশ দাগ কেটেছিল।
আজ ৮ মে। তিনি নেই, কিন্তু তার মুখ থেকে শোনা তার লেখক হয়ে উঠার গল্পগুলো খুব মনে পড়ছে। আর নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। কারণ তার মুখ থেকে শুনতে পেড়েছে তার লেখক হয়ে ওঠার গল্প।
জলপাইগুড়ির চা বাগানের ১৭ বছরের কিশোর। পড়াশোনার জন্য কোলকাতায় গেলেন। তখন কোলকাতার আকর্ষণের কেন্দ্র ছিলেন উত্তম কুমার, সত্যজিৎ রায়। সেই কিশোর ও তার বন্ধুরা মিলে নাটক করার সিদ্ধান্ত নিল। তৈরি করলেন নাটকের দল। অনামি, অপরিচিত কিছু ছেলেমেয়ের নাটকের দল তাই তাদের নাটকের দলকে বড় কোনো নাট্যকার নাটকের গল্প দিতেন না। কারণ লেখকরা মনে করতেন তাদের গল্প মানুষের কাছে পৌঁছাবে না।
তাই একদিন ওই কিশোরের এক বন্ধু বললেন, তুই একটু চেষ্টা কর না। একটা গল্প লিখ। কিশোর বন্ধুদের কথায় গল্প লিখলেন। কিন্তু তারা বন্ধুরা পড়ে বলল নাটকই হয়নি। তোর দ্বারা নাটক হবে না। তখন ওই কিশোরের রাগ হলো। তার আরেক বন্ধু বলল তুই আগে গল্পটা লিখ, তারপর নাট্যরূপ দে। আবার সে গল্প লিখল। লিখে দলের সবার সামনে পড়ল। আবার সব বন্ধুরা বলল এভাবে নাটক হয় না।
তখন সে জিজ্ঞেস করল কেন। বন্ধুরা বলল তার নাটকের নায়ক ট্রেনে করে যাচ্ছে, সাঁতার কাটছে, এসব মে দেখাব কী করে। হবে না। তখন এক বন্ধু বলল এই লিখা কোনো পত্রিকায় পাঠা ছাপিয়ে দেবে।
এভাবেই লিখা শুরু হয় দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদারের। এখানেই শেষ নয়। নাটকের গল্প না লিখতে পরলেও সমরেশ মজুমদারের লেখক হয়ে ওঠতে অনেক নাটকীয়তা পার করতে হয়েছে।
সমরেশ মজুমদার যখন কোলকাতায়, তখন বাংলায় কোলকাতার সবচেয়ে বড় পত্রিকা ‘দেশ’। ওই পত্রিকায় বাই-পোস্টে ওই লিখাটা পাঠালেন। লেখা পাঠানোর পর মাসের পর মাস পার হয় কোনো খবর নেই ছাপানোর। ছয় মাস থেকে আট মাস গেল কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই।
একদিন হঠাৎ সমরেশ মজুমদার দেশ পত্রিকাতে গিয়ে বললেন আমি একটা গল্প পাঠালাম, আপনারা কি দেখেছেন? তারা বলল গল্পের কী নাম। নাম বলার পর ১ মাস পরে আসার জন্য বলা হলো। একমাস পর আবার গেলেন পত্রিকা অফিসে, তখন বলা হলো ৭ দিন পরে আসতে। ৭ দিন পর অফিসে গেলে জিজ্ঞেস করা হলো এটা তার গল্প কিনা। তখন দেশ পত্রিকা থেকে বলা হলো লেখা ছাপা হবে।
এ কথা শুনে বিস্মিত হলেন সমরেশ মজুমদার। কারণ তখন দেশ পত্রিকায় নামীদামী লেখকদের লেখা ছাপা হয়। তাই তিনি ভাবতে পারেননি সত্যিই তার লেখা ছাপা হবে। তাই তিনি বন্ধুবান্ধবকে এই সংবাদ দিলেন। সবাই খুব খুশি হলো। যদিও বন্ধুরা বিশ্বাস করেনি তারপরও তারা খুশি হলো।
সমরেশ মজুমদার বলেন, এটা আমার জন্য বিস্ময়ের ব্যাপার আমার গল্প দেশ পত্রিকায় ছাপা হবে। যেখানে নামীদামী লেখকদের লেখা ছাপা হয় সেখানে আমার লেখা ছাপা হবে ভাবাই যায় না। বন্ধুবান্ধবকে বললাম তারা সবাই খুশি। তারাও বিশ্বাস করছিল না তারপর খুশি হলো। দেশ পত্রিকা থেকে একটি খাম আসলো। খাম খুলে দেখেন তিনি যে লেখা পাঠিয়েছিলেন তার কপি, আর সঙ্গে একটি চিঠি। লেখা ভবিষ্যতে ভালো গল্প লেখলে পাঠাবেন।
সমরেশ মজুমদার বলেন, কী লজ্জার ব্যাপার বলুন তো। সবাইকে বলছি আমার গল্প ছাপা হবে। কিন্তু ছাপাল না ফেরত পাঠিয়ে দিল। তখন আমার বন্ধুকে বললাম, দেখ ওরা বলল আমার গল্প ছাপা হবে কিন্তু ছাপাল না। বন্ধু বলল তুই ছাড়বি না, গালি দে।
যেই কথা সেই কাজ। সমরেশ মজুমদার কলেজের টেলিফোনের বুথ থেকে কল দিলেন দেশ পত্রিকায়। তখন দেশ পত্রিকায় গল্প দেখতেন বিমল কর। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই ভাই। সমরেশ বললেন, ‘আপনার বললেন লেখা ছাপাবেন, অথচ বাসায় লেখা পাঠিয়ে দিলেন। আপনারা তো মিথ্যাবাদী।’ যা-তা গালাগালি করলেন। বিমল কর চুপচাপ কিছুক্ষণ শোনার পর বললেন, ‘আপনি গল্পটা নিয়ে আমাদের কাছে আসুন।’ এই শুনে ভয় পেলেন সমরেশ। চিন্তা করলেন এতো গালাগালি করলেন অফিসে গেলে যদি পরে পুলিশে দিয়ে দেয়। তারপরও সাহস করে গেলেন পত্রিকা অফিসে। তবে একা যাননি। দল বেঁধে ১৫ জন বন্ধু নিয়ে গেলেন। পরিকল্পনা করলেন যদি পুলিশে দেয় তবে ১৫ জন একসাথে অ্যারেস্ট হবেন।
সমরেশ মজুমদার বলেন, পত্রিকা অফিসে যাওয়ার পর বিমল কর বললেন, ‘আমি পিওনকে বললাম লেখাটা প্রেসে দিতে। সে ভুল করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি আর কাউকে বলিনি এসব কথা। তার পরের সপ্তাহে গল্পটা দেশ পত্রিকায় ছাপানো হলো। তখন নিজের চোখে নিজের গল্প নিজের নাম দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না। দুদিন পর আমার বাসায় একটা মানিঅর্ডার এলো। গল্পটির পারিশ্রমিক বাবদ ১৫ টাকা দেশ পত্রিকা পাঠিয়েছে। আমি আমার বন্ধুদের গিয়ে বললাম। তারা সঙ্গে সঙ্গে হই হই করে কফি হাউজে খেয়ে ফেলল। এক মুহূর্তে ১৫ টাকা শেষ। তখন তারা উৎসাহিত হয়ে বলল তুই আবার লেখ। লেখলে বিনা পয়সায় খাওয়া যাবে।
বন্ধুদের প্রেরণা দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্ধুরা রোজ এসে বলতো লেখছিস। তাদের প্রেরণাতে আমি আবার গল্প লেখলাম। আবার জমা দিলাম। ৩ মাস পরে ছাপা হলো। তখন ৩০ টাকা পেলাম। কিন্তু আমি বন্ধুদের বললাম ১৫ টাকা পেয়েছি। ১৫ টাকা বন্ধুরা খেল ১৫ টাকা আমার বেঁচে গেল।
মূলধারার লেখালেখিতে এভাবে যাত্রা শুরু হলো সমরেশ মজুমদারের। কিন্তু তিনি লেখক হবেন সেটা কখনই ভাবেননি। ওই সময় বছরে ৪টি গল্প ছাপা হলে ১২০ টাকা পেতেন। সেই টাকা থেকে বন্ধুদের ৬০ টাকা দিতেন আর নিজের কাছে ৬০ টাকা রাখতেন। সমরেশ মজুমদারের ভাষ্যমতে এটা বেশ মজার খেলা ছিল তার জন্য।
সমরেশ মজুমদার বলেন, এই খেলা খেলতে খেলতে একটা সময় এলো ১৯৭৫ সাল। দেশ পত্রিকার সম্পাদক বললেন তোমার কাছ থেকে একটা উপন্যাস চাই ১০০ পাতার। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমারতো পাগলের মত অবস্থা, লেখলাম। জমা দিয়ে আসলাম। তিনি বললেন কদিন পর এসে প্রুফ দেখে যেও। প্রুফ দেখলাম। তারপর আমার বাসায় একটা চিঠি আসলো। সমরেশ দেখা করো, জরুরি। আমি ভাবলাম আরও কিছু হয়তো লেখতে হবে।
অফিসে যাওয়ার পর আসল চমক পেলেন সমরেশ মজুমদার। তিনি বলেন, অফিসে যাওয়ার পর সম্পাদক বললেন, ‘ধরুন আপনি যদি দেশ পত্রিকার সম্পাদক হতেন আর আপনার হাতে যদি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অপ্রকাশিত একটা উপন্যাস আসতো তখন আপনি কোনটা ছাপতেন শরৎচন্দ্রেরটা নাকি অনামি লেখকের উপন্যাস।’ আমি বললাম শরৎচন্দ্রেরটা ছাপতাম। তখন তিনি বললেন, ‘তাহলে আমার কোনো বিবেকে দায় নেই। আপনার উপন্যাস আমরা ছাপতে পারছি না।’
আমার উপন্যাসের জায়গায় শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ছাপা হলো। কিন্তু আমি পরিচিত জন সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমার উপন্যাস ছাপা হবে। এখন লেখা ছাপা না হলে সবাই বলবে আমি মিথ্যাবাদী তাই আমি কোলকাতা থেকে পালিয়ে গেলাম। দুমাস আমি বাইরে ছিলাম। তখন নভেম্বর মাসের শেষে পত্রিকায় একটিমাত্র উপন্যাস 'দৌড়' ছাপা হলো। এই আমার পথ চলা শুরু হলো।
সমরেশ মজুমদার অভিনয় করতে চেয়েছিলেন তাই নাটকের দল করেছিলেন কিন্তু হয়ে গেলেন লেখক। প্রথম উপন্যাসের জন্য দেশ পত্রিকা থেকে ১০০০ টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু বন্ধুদের বলেছিলেন ১০০ টাকা পেয়েছেন। বন্ধুরা খুশি হলো, বলছিলেন ১০০ টাকা কম দিয়েছে।
ধারাবাহিক উপন্যাস লেখা নিয়ে সমরেশ মজুমদার বলেন, সেই যে যাওয়া শুরু হলো হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ১৯৭৯ সাল এলো। সম্পাদক ডেকে বললেন, এবার তুমি ধারাবাহিক উপন্যাস লেখবে। অনেক দিন ধরে লিখবে। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আমি পারব না। আমি বললাম, আমি ১০০ পাতা লিখতে পারি আমি অনেকদিন ধরে লিখতে পারব না।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন কেন। আমি বললাম আমার মাথায় এতো গল্প নেই। তিনি বললেন তুমি পাগল হয়েছ। এমন অফার পেলে লোকে লাফিয়ে আসে। তুমি বলো পারবে না। আমি বললাম, পারবো না। তখন তিনি বললেন নিজেকে নিয়ে লেখ। এই যে নিজেকে নিয়ে লেখার কথা বললেন সেটা আমাকে ভীষণ আপ্লুত করল। সেই চা বাগান। নদী, ছোট পাঠশালা নিয়ে লেখা শুরু করলাম উত্তরাধিকার।
উপন্যাসের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সমরেশ মজুমদার বলেছিলেন, লিখতে লিখতে উপন্যাসের নায়ক অনিমেষ কোলকাতায় এলো পড়াশুনা করতে। কোলকাতার ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে। ওই সময় অনিমেষর পায়ে পুলিশের গুলি লাগল। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকল। তাকে সবাই জিজ্ঞেস করছে- কে তুমি। সে উত্তর দিতে পারেনি, আমার উপন্যাস শেষ।
লেখক উপন্যাস শেষ করলেও পাঠকদের এই শেষ পছন্দ হয়নি। পাঠকরা বললেন, যেহেতু একটি ছেলে কোলকাতায় পড়তে এসে গুলি খেয়েছে তাই আনন্দবাজার দেশ পত্রিকা সমরেশ মজুমদারে লেখা বন্ধ করে দিতে। জোর করে থামিয়ে দেওয়া হলো তার কলম। অতএব এই পত্রিকা বর্জন করার ডাক আসলো।
সমরেশ মজুমদারের ভাষ্য মতে, ‘লেখকের কণ্ঠ রোধ করা হলো।’ তিনি বলেন, তখন সম্পাদক আমাকে ডেকে বললেন এটা কী। আমি কি তোমাকে বলেছিলাম এখানে শেষ করো। আমি বললাম না। তিনি বললেন, তাহলে আমাকে এই গালাগালগুলো কেন শুনতে হয়। আবার লিখ। আবারো লিখা শুরু করলাম।
ধারাবাহিক লেখার কথা শুনে যিনি মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন না। যিনি বলেছিলেন অনেকদিন লেখার মত এত গল্প নেই তার মাথায়। সেই সমরেশ মজুমদার ৩ মাসের মধ্যে লিখলেন কালবেলা উপন্যাস।
সমরেশ মজুমদার বলেন, তিন মাসের ভিতরে ৩৮ বছর বয়সের একজন লেখকের আরেকটি ধারাবাহিক উপন্যাস বের হলো। তারপর জল গড়াল। এই নাটকের দল তৈরি না করলে হয়তো কোনোদিন লেখক হয়ে ওঠতাম না।
আপনার মন্তব্য