বর্গমাইলের পদাতিক : ৩৫-৩৬

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-২০ ০০:০৯:৪৮

 আপডেট: ২০১৬-১১-২০ ০০:১৩:২৯

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
৩৫
তৃতীয় দিন রাতে কুসুমের ঢাকার ঠিকানা নিয়ে সুবোধ ছেড়ে গেল ময়মনসিং। যাবেই যখন, তখন আর রব্বানী সাহেব বাঁধা দিলেন না। কুসুমকে টেলিগ্রাম করে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন সুবোধকে বিভিন্ন দিক নির্দেশ এবং সতর্কতার কথা। সঙ্গে দিলেন তার কথা মত পাঁচ হাজার টাকা।

চাচী আম্মার কান্না, সাহেবকা’র উৎকণ্ঠা পেছনে পড়ে রইলো—আরও পেছনে পড়ে রইলো অতিথপুর।

ট্রেনে বসে সে ক্রমশ: এই সকল দৃশ্যাবলীকে মনে মনে পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে চললো। কিন্তু না, খানিক পরেই সে বুঝতে পারলো যে কিছুই আর ফেলে যাওয়া যাচ্ছে না। পায়ে পায়ে করুণার মা’মরা ছেলেটি যে পিছু ছাড়ছে না। যে ছেলেটি পাড়াতুতো পিসিমার হাত ধরে এতক্ষণ এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সেও-তো দেখি সঙ্গ নিয়েছে—বলছে আমিও যাব—যাব—যাব ---। কোথায় যাবে?—কোনো প্রশ্ন আর সে শুনতে চাইছে না, কোনো উত্তরও আর সে দিতে চাইছে না—এক কথা শুধু, যাব—যাব।

ছোটবেলা ছেলেটি কি খুব জেদি ছিল? সেই ছেলেটিই আজ যাচ্ছে। এরকম কতবারই-তো সে গিয়েছিল ঢাকা। কই, কেউ কি এমন পিছু নিয়েছিল?

এবার তফাৎ শুধু পুলিশের খাতায় সে ওয়ান্টেড। বাস্তবে এবার পুলিশ পিছু নিতে পারে। নিয়েছে কিনা জানা নেই। এখন মনে মনে আর হাসছে না সুবোধ।

‘খবর পেয়ে গেছি কালকেই।–আব্বার ম্যাসেজ’ –বলতে বলতেই কুসুম এগিয়ে এসে সুবোধের হাতদুটো জড়িয়ে ধরলো। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো শুধু নিজের হাতে ধরা সুবোধের হাতের দিকে। মাথা নিচু। মুখ তুলছে না। নীরবতা ভেঙ্গে সুবোধই জিজ্ঞেস করলো—কেমন আছো? কুসুম—‘ভাল না’ বলে সুবোধকে একপ্রকার টানতে টানতে বসার ঘরের মাঝখানে এনে ছেড়ে দিল। ভাল-তো থাকার কথা নয় সুবোধ !—কিন্তু তুমি,তুমি—খবরটা পাওয়া পর থেকে ঘুমোতে পারিনি। ভোর থেকেই ঘর বারান্দা,ঘর বারান্দা করছি। আব্বার খবর দেয়া না থাকলে কিন্তু তোমাকে চিনতেই পারতাম না। কী চেহারা হয়েছে তোমার !

কুসুমের কথার মধ্যেই সুবোধ বলে উঠলো—আগে এক কাপ চা।

--হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব রেডি নিয়ে আসছি।

চা নিয়ে এসে কুসুম বসতে বসতেই সুবোধ বললো—কী বলছিলে, ভাল না—কেন বলতো?

--ভাল না’ এর অর্থ ভাল না-ই। ভাল থাকতে হলে পৃথিবীতে যা যা সৃষ্টি হওয়া দরকার ছিল, বা যা যা বিলীন হওয়ার দরকার ছিল—তা-তো হয় নি। অন্তত: আমার সাপেক্ষে-তো হয়ই-নি, তাই।

--এ-তো আগের মত কথাই—এখনও রয়ে গেছে দেখছি---

--হ্যাঁ, এখনও সেই সব কথাই—থেকে গেলে আমি কী করতে পারি।

--অন্য কথার জন্ম হয় নি?

--যাক, এসব বাদ দাও—তোমার কথা বল—ঠিক ঠিক ছিলে কোথায় এতকাল?

--হবে, সব হবে,--সব বলার জন্যই-তো এসেছি, বলবো---। কিন্তু অধ্যাপক কোথায়?

--অধ্যাপক! ও-হো, ধ্যাৎ ও-তো সেই তোমাদের শামীম। শামীম হায়দর—মনে নেই, সেবার একুশের কথা? যেবার প্রথম সাক্ষাতেই আমাকে দেখে বলেছিল—ওকে-তো আমি দেখেছি আগে। তারপর সবাই মিলে চেপে ধরাতে ‘কোথায় দেখেছিস’ আর বলতে না পেরে পালিয়েছিলো।–মনে পড়ছে?

--হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে—আসলে পরে আমাকে বলেছিল যে ও নাকি স্বপ্নে দেখেছে।

--আসলে ওসব কিছু নয়, স্মার্ট সাজতে গিয়ে ওটা বলে ফেলে আর সামলাতে না পেরে স্বপ্ন টপ্ন বলছিল।

--ঠিক ঠিক—মনে পড়ছে--। বলে সুবোধ হাসতে লাগলো।

অনেকদিন পর সুবোধ হাসলো। কবে শেষবার সে হেসেছিল মনে নেই। আসলে কুসুম মানেই নানা উন্মাদনার উৎস বরাবর।

--যাক, সে কোথায়—কেমন আছে সে।

--এলেই দেখো,--এখন ঘুমোচ্ছে—লেট রাইজার।

বাইরে শুনশান দুপুর। সদ্য পাওয়া চাকরি, তবু কুসুম আজ আর স্কুলে গেল না। তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে শামীমও বেরিয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার পর পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে সুবোধ। একবার উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে কুসুম। দেখে এসে বসে আছে বারান্দায়। এভাবে বসে থাকার মানুষ কুসুম নয়। তবু আজ তার শুধু বসে থাকতেই ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে পেছনে, অনেক পেছনে ফিরে যেতে। কে যেন হাত ধরে তাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে পাঁচ বছর, দশ বছর আগের পৃথিবীতে। যে পৃথিবীগুলোতে সবাই ছিল। ছিল সুবোধও।

আচ্ছা সুবোধ—এতদিন পর দেখা—তুমি-তো আর চোখে চোখ রাখার খেলাটা খেললে না। কেন বলতো--? আমার কথা কি আর মনে রাখার কোনো প্রসঙ্গ তোমার কাছে নেই? কেমন যেন হয়ে গেছে সব।

শেষের দিকে এত উৎকণ্ঠিত থাকতে যে ভয় হতো। রাজনীতি মনে হয় তোমাকে মাটিতে ধরে রাখতে চায় নি। উৎক্ষেপ করেছে শুধু। আরও ধীর স্থির হওয়া উচিত ছিল। তোমার ধৈর্য এত কম যে---। যতদূর জানি তোমার সঙ্গীরা কেউ দেশ ছাড়ে নি। কেউ ধরা পড়েছে, কেউ এদেশেই আত্মগোপনে থেকেছে। শুধু তুমি—তোমার বোধ হয় রাজনৈতিক সক্রিয়তার বাইরেও মনের ভেতর কিছু একটা ছিল। নেহাত প্রাণ ভয়ে তুমি তোমার আজন্ম চেনা দেশ,মানুষজন ছেড়ে চলে যেতে পারো বলে কখনো মনে হয় নি আমার। তবু তুমি চলে গিয়েছিলে—এই সত্যটা আমি মেনে নিতে পারিনি। আমাদের ভেতর বলা এবং না-বলা অনেক কথা থেকে আমি এর পক্ষে এক কণা সমর্থনও তোমার জন্য খুঁজে পাই নি। যদিও আমরা পরস্পরের কাছে দায়মুক্ত এক স্বাধীন ভালবাসার কথা বলতাম—তবু আমি কষ্ট পেয়েছি, অভিমান করিনি।

যতদূর শুনেছি এখানকার পার্টি—যাদের তোমরা খুব অনুসরণ করতে, তারাও তোমার সম্পর্কে সন্তুষ্ট ছিল না। আশ্চর্য, আমাদের সঙ্গে তাদের অন্তত তোমার ব্যাপারে তফাৎ নেই। ঐ ঘটনার পর ছাত্র-যুব প্রতিরোধ কী সাংঘাতিক আকার নিয়েছিল তার খবর তুমি পেয়েছিলে কিনা জানি না। মনে হয় পাও নি। আমরা সকলে মিলে তন্ন তন্ন করে তোমার সন্ধান করেছি। এক সময়-তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম যে হয়তো---।

৩৬
বছর খানেক আগে একটা উড়ো খবর পাওয়া যায় যে তুমি ওপারেই আছো। আব্বা একদিন বললেন যে মহীন একটা খবর দিয়ে গেল রে সুবোধের ব্যাপারে। মহীন নামে আমাদের এক আত্মীয় আছে, তুমি তাকে চেন, কিশোরগঞ্জের ছেলে। কলকাতা গিয়েছিল কী কাজে--,সে একদিন আব্বাকে খবর দিয়ে গেল যে তোমার মত একজনকে ওপারে ট্রেন থেকে নাকি দেখা গেছে। স্টেশনের কল থেকে পানি নিচ্ছে। কলকাতা থেকে ঐদিকে ট্রেনে সে কোথায় যেন যাচ্ছিলো তখন। স্টেশনের নামটাও ছেলেটা ঠিক বলতে পারে নি। ফারাক্কা না কি একটা বলেছিল। সত্যি মিথ্যা কিছুই বিশ্বাস করিনি। এখন-তো শুনে মনে হচ্ছে সে খুব ভুল কিছু দেখেনি। সবচে বড় কথা সে এটাও কনফার্ম করতে পারে নি যে তুমি ট্রেনের যাত্রী ছিলে নাকি ওখানকারই কেউ ছিলে। ফলে আমরা কোনো উদ্যোগই নিতে আর উৎসাহ পাই নি। যাই হউক, তুমি যে আবার আসতে পেরেছো এটাই এখন সত্য, গভীরতর সত্য আমার কাছে। অবশ্য জানি না এই সময়কালের মধ্যে তোমার কাছে আমাদের পূর্বাশ্রমের কথা এখন আর কতখানি তাৎপর্য বহন করে। তবু জীবন, জীবন-তো সব কিছুরই আধার। মুহূর্তের অনুভবও ফেলে দেয়ার নয়। যেমন ধরো এই যে তুমি, আজ ভোরবেলায় দোরে এসে দাঁড়ালে—আমাদের ঐ আধারিত জীবনের কিছু অনুভবের টানেই-তো। আর এই যে আমি—তোমার আশৈশবের চেনা কুসুম—একসময় ভালবাসার কথাও-তো বলতাম দু’জনে—সবই-তো থেকে যায় সুবোধ। কিছুই-তো ফেলা যায় না। আজ তোমাকে কী রূপে, কী ভাবে আমি নিতে পারি—আমি কি ভুলে যেতে পারবো সেই সব বাল্য-বেলার অঙ্গীকার—পরস্পর একে অন্যকে আবিষ্কারের কথা—ভুলে যেতে পারবো হঠাৎ বোকা হয়ে পরস্পর নির্নিমেষ চেয়ে থাকার মুহূর্তগুলোর কথা?

না, হয়তো কোনোদিনই না। আমরা-তো এভাবেই বেড়ে উঠেছিলাম সবার অলক্ষ্যে। কিন্তু সুবো—কী যে হয়ে গেল---। তুমি বোধহয় জান না আব্বার খুব আকাঙ্ক্ষা ছিল আমি তোমাকে বিয়ে করি। কিন্তু ---না থাক।

বারান্দায় বসে বসে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে কুসুম। মাথা একদিকে সামান্য হেলানো। সেই শ্যামলী মুখ। ঘন কুঁচকানো চুলের এক খণ্ড কালো মেঘ যেন মাথায়। বছর দেড়েকের বিবাহিতা—কিন্তু এখনও যেন গৃহিণী বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, গিন্নি হওয়ার জন্য ও জন্মায় নি—এটা ওরই কথা।

সুবোধ কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই একবার চোখ খুলে দেখলো। বললো—বস।

সুবোধ পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

পাশাপাশি দু’জন বসে,কিন্তু কথা নেই কোনো। এ-ও এক নতুন পরিস্থিতি। একসময় বোধ হয় কথা ছাড়া তারা থাকেনি এক মিনিটও। তবু সুবোধই একসময় নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো—কতক্ষণ বসে আছো? উত্তর না দিয়ে কুসুম উঠে দাঁড়ালো, বললো—চলো, ভেতরে চলো—বাইরে বসা ঠিক হবে না। ঘরে গিয়ে সুবোধ কুসুমের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো—খুব গম্ভীর লাগছে তোমাকে—কী ব্যাপার---।

--গম্ভীর আর হতে পারি কই—সারাক্ষণই-তো মনে মনে কত বকে গেলাম। আসলে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কি---থাক। আর ভালো লাগছে না। বস, চা নিয়ে আসি।

--না না, চা পরে হবে—কী বলতে চেয়েছিলে সেটা বলো।

--আমাকে এভাবে বলতে বলো না—যা এখন বলবো সব খুব ঠিক ঠাক আর বলতে পারবো না। কষ্ট পাব শুধু শুধু—তুমি-তো জান সবটাই, দেখছো-ও চোখের সামনে—আর কী-ই বা থাকতে পারে জানার---

--না না কষ্ট যদি পাও তো বলার দরকার নেই---

--এই-তো সুবোধ—সেই চেনা সুবোধের মত কথা বলছো—তোমাকে কি আর সব বুঝিয়ে বলতে হবে? বলতে বলতে কুসুমের চোখ চিক চিক করে উঠলো। দু’এক ফোঁটা জলও কি গড়িয়ে পড়লো?

কথা শুনতে শুনতে সুবোধ সোফায় বসতে যাবে এমন সময় কুসুম খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে সুবোধকে জড়িয়ে ধরে খুব ধীর গলায় বলতে লাগলো—আমি কি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি সুবোধ?

--না না, কেন, অন্যায় কীসের—কোনো অন্যায়-তো আমি অন্তত দেখছি না---

--আমার কি তোমার জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল না?

--‘উচিত’ অর্থে নয় কুসুম—অপেক্ষা তুমি করতে পারতে কিনা সেটা ছিল সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বিচার্য বিষয়—কিন্তু কুসুম আমরা-তো স্বাধীনতার কথাই বলতাম। চিন্তার স্বাধীনতা—সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা---সম্পর্কের জলাবদ্ধতাকে-তো আমরা অস্বীকারই করেছি তাই না?

--সুবোধ প্লিজ, থাক, আর বলতে হবে না---তুমি কোনো কষ্ট পাওনি এটা বিশ্বাস করতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।

--তা-হলে কীভাবে প্রমাণ হবে যে আমি কষ্ট পাই নি---।

--জানি না, জানি না—শুধু ---

--কী---

--তুমি কি আমাকে একবার গ্রহণ করবে—একবার প্রমাণ করবে যে আমরা যে কথাগুলো বলতাম, সেগুলো আমাদের ছেড়ে যায় না----।

বাইরে রোদ তখন ম্লান হতে শুরু করেছে। কিন্তু সুবোধ আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। কুসুমের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে কথা হাতড়াচ্ছে সে। বৃথা চেষ্টা। বাইরে ওটা কি সাইরেনের শব্দ। সেই শব্দ ঘরেও ঢুকে পড়ছে—দৃশ্যের পর দৃশ্যের বদল ঘটিয়ে—সুবোধের না-বলা কথাগুলো শূন্যে ভাসিয়ে দিচ্ছে—সুবোধ হা করে দেখছে—বলতে পারছে না।

---এইতো সেই শরীর—গলে গলে যাচ্ছে—মোমের মত গলে গলে ছড়িয়ে পড়ছে—বাইরে থেকে ঢুকে পড়া শব্দ তরঙ্গে ভাসছে সব ঘরময়—কিন্তু এটা,এটা কার হৃৎপিণ্ড—কার চোখ এটা—কার পাকস্থলী, জননেন্দ্রিয়—ছিটকে ছিটকে আকাশে উড়ে যাচ্ছে যে। এই ঘরে আকাশ এলো কোত্থেকে—ওহ ! আমরা কি বাইরে, খোলা আকাশের নিচে এসে গেছি—?

শব্দের তীব্রতা একটা স্তর অতিক্রম করার আর কিছুই বোধ হচ্ছে না। এখন শুধু বধিরতা—চারদিক থেকে এক অসামান্য বধিরতাই-তো নেমে আসছে শুধু—নেমে আসছে আকাশ থেকে এক অবিমিশ্র ভাঙনের আর্ত-স্বর।

অসহ্য—আর কতক্ষণ ! আশ্চর্য, এসবের মধ্য দিয়েই কে যেন উড়ে আসছে— হ্যাঁ,কুসুমের বাড়ির দিকেই-তো উড়ে আসছে কেউ—হ্যাঁ, এক রমণীই-তো—খোলা চুল, খোলা আঁচল, টকটকে হলুদ মুখ—হ্যাঁ সাবিনা—সাবিনাই-তো। নেমে এসে ধীরে ধীরে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ালেন। এইতো কাছেই—ছোঁয়া যায় যেন—কিছু বলছেন কি? কিন্তু শোনা যাচ্ছে না কিছুই।

অনেক, অনেকক্ষণ পর—আসলে কিছু মুহূর্তও হতে পারে কিনা কে জানে—একবার যেন শুধু ‘মা’ সম্বোধন শোনা গেল।

সম্বিৎ ফিরলো কুসুমের। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুবোধ। সুবোধের থুতনি ধরে ঝাঁকুনি দিতেই সুবোধ কথা বলে উঠলো—হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী বলছিলে যেন, বলো।

কুসুম অবাক হয়ে সুবোধকে দেখতে লাগলো।

সুবোধ নয় শুধু, এবার কুসুমও আর কোন কথা খুঁজে পেল না। অতঃপর আলো আর অন্ধকারে হারানো ছাড়া তাদের আর কিছু করার থাকলো না।

চেনা অচেনা সুবোধ ও কুসুমের শরীরের রৌদ্র-গন্ধ শুধু ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ক্রমশ: পরস্পর হারাতে হারাতে তারাও হাঁটতে শুরু করলো সেই দিকে, যে দিকে এক শঙ্খ দ্বীপের কল্পনা ছিল তাদের। খুব চেনা পথ তাদের। একসময় তারা পরিষ্কার চিনতে পারলো এই সেই শঙ্খ দ্বীপ। যা বুঝি কোনোদিনও জন্মায় না।
(চলবে)

ব র্গ মা ই লে র  প দা তি ক ৩৫তৃতীয় দিন রাতে কুসুমের ঢাকার ঠিকানা নিয়ে সুবোধ ছেড়ে গেল ময়মনসিং। যাবেই যখন, তখন আর রব্বানী সাহেব বাঁধা দিলেন না। কুসুমকে টেলিগ্রাম করে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন  সুবোধকে বিভিন্ন দিক নির্দেশ এবং সতর্কতার কথা। সঙ্গে দিলেন তার কথা মত পাঁচ হাজার টাকা। 
চাচী আম্মার কান্না, সাহেবকা’র উৎকণ্ঠা পেছনে পড়ে রইলো—আরও পেছনে পড়ে রইলো অতিথপুর। 
ট্রেনে বসে সে ক্রমশ: এই সকল দৃশ্যাবলীকে মনে মনে পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে চললো। কিন্তু না, খানিক পরেই সে বুঝতে পারলো যে  কিছুই আর ফেলে যাওয়া যাচ্ছে না। পায়ে পায়ে  করুণার মা’মরা ছেলেটি যে পিছু ছাড়ছে না। যে ছেলেটি পাড়াতুতো পিসিমার হাত ধরে এতক্ষণ এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সেও-তো দেখি সঙ্গ নিয়েছে—বলছে আমিও যাব—যাব—যাব ---। কোথায় যাবে?—কোনো প্রশ্ন আর সে শুনতে চাইছে না, কোনো উত্তরও আর সে দিতে চাইছে না—এক কথা শুধু, যাব—যাব। 
ছোটবেলা ছেলেটি কি খুব জেদি ছিল? সেই ছেলেটিই আজ যাচ্ছে। এরকম কতবারই-তো সে গিয়েছিল ঢাকা। কই, কেউ কি এমন পিছু নিয়েছিল? 
এবার তফাৎ শুধু পুলিশের খাতায় সে ওয়ান্টেড। বাস্তবে এবার পুলিশ পিছু নিতে পারে। নিয়েছে কিনা জানা নেই। এখন মনে মনে আর  হাসছে না সুবোধ।  
‘খবর পেয়ে গেছি কালকেই।–আব্বার ম্যাসেজ’ –বলতে বলতেই কুসুম এগিয়ে এসে সুবোধের হাতদুটো জড়িয়ে ধরলো। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলো শুধু নিজের হাতে ধরা সুবোধের হাতের দিকে। মাথা নিচু। মুখ তুলছে না। নীরবতা ভেঙ্গে সুবোধই জিজ্ঞেস করলো—কেমন আছো? কুসুম—‘ভাল না’ বলে সুবোধকে একপ্রকার টানতে টানতে বসার ঘরের মাঝখানে এনে ছেড়ে  দিল। ভাল-তো থাকার কথা নয় সুবোধ !—কিন্তু তুমি,তুমি—খবরটা পাওয়া পর থেকে ঘুমোতে পারিনি। ভোর থেকেই ঘর বারান্দা,ঘর বারান্দা করছি। আব্বার খবর দেয়া না থাকলে কিন্তু তোমাকে চিনতেই পারতাম না। কী চেহারা হয়েছে তোমার !
কুসুমের কথার মধ্যেই সুবোধ বলে উঠলো—আগে এক কাপ চা।
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব রেডি নিয়ে আসছি।
চা নিয়ে এসে কুসুম বসতে বসতেই সুবোধ বললো—কী বলছিলে, ভাল না—কেন বলতো?
--ভাল না’ এর অর্থ ভাল না-ই। ভাল থাকতে হলে পৃথিবীতে যা যা সৃষ্টি হওয়া দরকার ছিল, বা যা যা বিলীন হওয়ার দরকার ছিল—তা-তো হয় নি। অন্তত: আমার সাপেক্ষে-তো হয়ই-নি,  তাই।
--এ-তো আগের মত কথাই—এখনও রয়ে গেছে দেখছি---
--হ্যাঁ, এখনও সেই সব কথাই—থেকে গেলে আমি কী করতে পারি।
--অন্য কথার জন্ম হয় নি?
--যাক, এসব বাদ দাও—তোমার কথা বল—ঠিক ঠিক ছিলে কোথায় এতকাল?
--হবে, সব হবে,--সব বলার জন্যই-তো এসেছি, বলবো---। কিন্তু অধ্যাপক কোথায়?
--অধ্যাপক! ও-হো, ধ্যাৎ ও-তো সেই তোমাদের শামীম। শামীম হায়দর—মনে নেই, সেবার একুশের কথা? যেবার প্রথম সাক্ষাতেই আমাকে দেখে বলেছিল—ওকে-তো আমি দেখেছি আগে। তারপর সবাই মিলে চেপে ধরাতে ‘কোথায় দেখেছিস’ আর বলতে না পেরে  পালিয়েছিলো।–মনে পড়ছে?
--হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে—আসলে পরে আমাকে বলেছিল যে ও নাকি স্বপ্নে দেখেছে।
--আসলে ওসব কিছু নয়, স্মার্ট সাজতে গিয়ে ওটা বলে ফেলে আর সামলাতে না পেরে স্বপ্ন টপ্ন বলছিল।
--ঠিক ঠিক—মনে পড়ছে--। বলে সুবোধ হাসতে লাগলো।
অনেকদিন পর সুবোধ হাসলো। কবে শেষবার সে হেসেছিল মনে নেই। আসলে কুসুম মানেই নানা উন্মাদনার উৎস বরাবর।
--যাক, সে কোথায়—কেমন আছে সে।
--এলেই দেখো,--এখন ঘুমোচ্ছে—লেট রাইজার।
বাইরে শুনশান দুপুর। সদ্য পাওয়া চাকরি, তবু কুসুম আজ আর স্কুলে গেল না। তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে শামীমও বেরিয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার পর পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে সুবোধ। একবার উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে কুসুম। দেখে এসে বসে আছে বারান্দায়। এভাবে বসে থাকার মানুষ কুসুম নয়। তবু আজ তার শুধু বসে থাকতেই ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে পেছনে, অনেক পেছনে ফিরে যেতে। কে যেন হাত ধরে তাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে পাঁচ বছর, দশ বছর আগের পৃথিবীতে। যে পৃথিবীগুলোতে সবাই ছিল। ছিল সুবোধও।
আচ্ছা সুবোধ—এতদিন পর দেখা—তুমি-তো আর চোখে চোখ রাখার খেলাটা খেললে না। কেন বলতো--? আমার কথা কি আর মনে রাখার কোনো প্রসঙ্গ তোমার কাছে নেই? কেমন যেন হয়ে গেছে সব। 
শেষের দিকে এত উৎকণ্ঠিত থাকতে যে ভয় হতো। রাজনীতি মনে হয় তোমাকে মাটিতে ধরে রাখতে চায় নি। উৎক্ষেপ করেছে শুধু। আরও ধীর স্থির হওয়া উচিত ছিল। তোমার ধৈর্য এত কম  যে---। যতদূর জানি তোমার সঙ্গীরা কেউ দেশ ছাড়ে নি। কেউ ধরা পড়েছে, কেউ এদেশেই  আত্মগোপনে থেকেছে। শুধু তুমি—তোমার বোধ হয় রাজনৈতিক সক্রিয়তার বাইরেও মনের ভেতর কিছু একটা ছিল। নেহাত প্রাণ ভয়ে তুমি তোমার আজন্ম চেনা দেশ,মানুষজন ছেড়ে চলে যেতে পারো বলে কখনো মনে হয় নি আমার। তবু তুমি চলে গিয়েছিলে—এই সত্যটা আমি মেনে নিতে পারিনি। আমাদের ভেতর বলা এবং না-বলা অনেক কথা থেকে আমি এর পক্ষে এক কণা   সমর্থনও তোমার জন্য খুঁজে পাই নি। যদিও আমরা পরস্পরের কাছে দায়মুক্ত এক স্বাধীন ভালবাসার কথা বলতাম—তবু আমি কষ্ট পেয়েছি, অভিমান করিনি। 
যতদূর শুনেছি এখানকার পার্টি—যাদের তোমরা খুব অনুসরণ করতে, তারাও তোমার সম্পর্কে সন্তুষ্ট ছিল না। আশ্চর্য, আমাদের সঙ্গে তাদের অন্তত তোমার ব্যাপারে তফাৎ নেই। ঐ ঘটনার পর ছাত্র-যুব প্রতিরোধ কী সাংঘাতিক আকার নিয়েছিল তার খবর তুমি পেয়েছিলে কিনা জানি না। মনে হয় পাও নি। আমরা সকলে মিলে তন্ন তন্ন করে তোমার সন্ধান করেছি। এক সময়-তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম যে হয়তো---।
৩৬ বছর খানেক আগে একটা উড়ো খবর পাওয়া যায় যে তুমি ওপারেই আছো। আব্বা একদিন   বললেন যে মহীন একটা খবর দিয়ে গেল রে সুবোধের ব্যাপারে। মহীন নামে আমাদের এক আত্মীয়  আছে, তুমি তাকে চেন, কিশোরগঞ্জের ছেলে। কলকাতা গিয়েছিল কী কাজে--,সে একদিন  আব্বাকে খবর দিয়ে গেল যে তোমার মত একজনকে ওপারে ট্রেন থেকে নাকি দেখা  গেছে। স্টেশনের কল থেকে পানি নিচ্ছে। কলকাতা থেকে ঐদিকে ট্রেনে সে কোথায় যেন  যাচ্ছিলো তখন। স্টেশনের নামটাও ছেলেটা ঠিক বলতে পারে নি। ফারাক্কা না কি একটা বলেছিল। সত্যি মিথ্যা কিছুই বিশ্বাস করিনি। এখন-তো শুনে মনে  হচ্ছে সে খুব ভুল কিছু দেখেনি। সবচে বড় কথা সে এটাও কনফার্ম করতে পারে নি যে তুমি ট্রেনের যাত্রী ছিলে নাকি  ওখানকারই কেউ ছিলে। ফলে আমরা কোনো উদ্যোগই নিতে আর উৎসাহ পাই নি। যাই হউক, তুমি যে আবার আসতে পেরেছো এটাই এখন সত্য, গভীরতর সত্য আমার কাছে। অবশ্য জানি না এই সময়কালের মধ্যে তোমার  কাছে  আমাদের পূর্বাশ্রমের কথা এখন আর কতখানি তাৎপর্য বহন করে। তবু জীবন, জীবন-তো সব কিছুরই আধার। মুহূর্তের অনুভবও ফেলে দেয়ার নয়। যেমন ধরো এই যে তুমি, আজ ভোরবেলায় দোরে এসে দাঁড়ালে—আমাদের ঐ আধারিত জীবনের কিছু অনুভবের টানেই-তো। আর এই যে আমি—তোমার আশৈশবের চেনা কুসুম—একসময় ভালবাসার কথাও-তো বলতাম দু’জনে—সবই-তো থেকে যায় সুবোধ। কিছুই-তো  ফেলা যায় না। আজ তোমাকে কী রূপে, কী  ভাবে আমি নিতে পারি—আমি কি ভুলে যেতে পারবো সেই সব বাল্য-বেলার অঙ্গীকার—পরস্পর একে অন্যকে আবিষ্কারের কথা—ভুলে যেতে পারবো হঠাৎ বোকা হয়ে পরস্পর নির্নিমেষ চেয়ে থাকার মুহূর্তগুলোর কথা? 
না, হয়তো কোনোদিনই না। আমরা-তো এভাবেই বেড়ে উঠেছিলাম সবার অলক্ষ্যে। কিন্তু  সুবো—কী যে হয়ে গেল---। তুমি বোধহয় জান না আব্বার খুব আকাঙ্ক্ষা ছিল আমি তোমাকে বিয়ে করি। কিন্তু ---না থাক।
বারান্দায় বসে বসে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে কুসুম। মাথা একদিকে সামান্য হেলানো। সেই শ্যামলী মুখ। ঘন কুঁচকানো চুলের এক খণ্ড কালো মেঘ যেন মাথায়। বছর দেড়েকের বিবাহিতা—কিন্তু এখনও যেন গৃহিণী বলে মনে  হয় না। হ্যাঁ, গিন্নি হওয়ার জন্য ও জন্মায় নি—এটা ওরই কথা।
সুবোধ কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রাখতেই একবার চোখ খুলে দেখলো। বললো—বস।
সুবোধ পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। পাশাপাশি দু’জন বসে,কিন্তু কথা নেই কোনো। এ-ও এক নতুন পরিস্থিতি। একসময় বোধ হয়  কথা ছাড়া তারা থাকেনি এক মিনিটও। তবু সুবোধই একসময় নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো—কতক্ষণ বসে আছো? উত্তর না দিয়ে কুসুম উঠে দাঁড়ালো, বললো—চলো, ভেতরে চলো—বাইরে বসা ঠিক হবে না। ঘরে গিয়ে সুবোধ কুসুমের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো—খুব গম্ভীর লাগছে তোমাকে—কী ব্যাপার---।
--গম্ভীর আর হতে পারি কই—সারাক্ষণই-তো মনে মনে কত বকে গেলাম। আসলে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কি---থাক। আর ভালো লাগছে না। বস, চা নিয়ে আসি। 
--না না, চা পরে হবে—কী বলতে চেয়েছিলে সেটা বলো।
--আমাকে এভাবে বলতে বলো না—যা এখন বলবো সব খুব ঠিক ঠাক আর বলতে পারবো না।  কষ্ট পাব শুধু শুধু—তুমি-তো জান সবটাই, দেখছো-ও চোখের সামনে—আর কী-ই বা থাকতে পারে জানার---
--না না কষ্ট যদি পাও তো বলার দরকার নেই---
--এই-তো সুবোধ—সেই চেনা সুবোধের মত কথা বলছো—তোমাকে কি আর সব বুঝিয়ে বলতে হবে? বলতে বলতে কুসুমের চোখ চিক চিক করে উঠলো। দু’এক ফোঁটা জলও কি গড়িয়ে পড়লো? 
কথা শুনতে শুনতে সুবোধ সোফায় বসতে যাবে এমন সময় কুসুম খুব কাছে এগিয়ে গিয়ে  সুবোধকে জড়িয়ে ধরে খুব ধীর গলায় বলতে লাগলো—আমি কি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি সুবোধ? 
--না না, কেন, অন্যায় কীসের—কোনো অন্যায়-তো আমি অন্তত দেখছি না--- 
--আমার কি তোমার জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল না?
--‘উচিত’ অর্থে নয় কুসুম—অপেক্ষা তুমি করতে পারতে কিনা সেটা ছিল সেই সময়ে দাঁড়িয়ে বিচার্য বিষয়—কিন্তু কুসুম আমরা-তো স্বাধীনতার কথাই বলতাম। চিন্তার স্বাধীনতা—সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা---সম্পর্কের জলাবদ্ধতাকে-তো আমরা অস্বীকারই করেছি তাই না? 
--সুবোধ প্লিজ, থাক, আর বলতে হবে না---তুমি কোনো কষ্ট পাওনি এটা বিশ্বাস করতেও আমার কষ্ট হচ্ছে।
--তা-হলে কীভাবে প্রমাণ হবে যে আমি কষ্ট পাই নি---।
--জানি না, জানি না—শুধু ---
--কী---
--তুমি কি আমাকে একবার গ্রহণ করবে—একবার প্রমাণ করবে যে আমরা যে কথাগুলো বলতাম,  সেগুলো আমাদের ছেড়ে যায় না----।  
বাইরে রোদ তখন ম্লান হতে শুরু করেছে। কিন্তু সুবোধ আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। কুসুমের  আলিঙ্গনে বাঁধা পড়ে কথা হাতড়াচ্ছে সে। বৃথা চেষ্টা। বাইরে ওটা কি সাইরেনের শব্দ। সেই শব্দ ঘরেও ঢুকে পড়ছে—দৃশ্যের পর দৃশ্যের বদল ঘটিয়ে—সুবোধের না-বলা কথাগুলো শূন্যে ভাসিয়ে  দিচ্ছে—সুবোধ হা করে দেখছে—বলতে পারছে না।
---এইতো সেই শরীর—গলে গলে যাচ্ছে—মোমের মত গলে গলে ছড়িয়ে পড়ছে—বাইরে থেকে ঢুকে পড়া শব্দ তরঙ্গে ভাসছে সব ঘরময়—কিন্তু এটা,এটা কার হৃৎপিণ্ড—কার চোখ এটা—কার পাকস্থলী, জননেন্দ্রিয়—ছিটকে ছিটকে আকাশে উড়ে যাচ্ছে যে। এই ঘরে আকাশ এলো কোত্থেকে—ওহ ! আমরা কি বাইরে, খোলা আকাশের নিচে এসে গেছি—?  
শব্দের তীব্রতা একটা স্তর অতিক্রম করার আর কিছুই বোধ হচ্ছে না। এখন শুধু বধিরতা—চারদিক থেকে এক অসামান্য বধিরতাই-তো নেমে আসছে শুধু—নেমে আসছে আকাশ থেকে  এক অবিমিশ্র ভাঙনের আর্ত-স্বর। 
অসহ্য—আর কতক্ষণ ! আশ্চর্য, এসবের মধ্য দিয়েই কে যেন উড়ে আসছে— হ্যাঁ,কুসুমের বাড়ির দিকেই-তো উড়ে আসছে কেউ—হ্যাঁ, এক রমণীই-তো—খোলা চুল, খোলা আঁচল, টকটকে হলুদ মুখ—হ্যাঁ সাবিনা—সাবিনাই-তো।  নেমে এসে ধীরে ধীরে বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ালেন। এইতো কাছেই—ছোঁয়া যায় যেন—কিছু বলছেন কি? কিন্তু  শোনা যাচ্ছে না কিছুই। 
অনেক, অনেকক্ষণ পর—আসলে কিছু মুহূর্তও হতে পারে কিনা কে জানে—একবার যেন শুধু ‘মা’ সম্বোধন শোনা গেল।
সম্বিৎ ফিরলো কুসুমের। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুবোধ।  সুবোধের থুতনি ধরে ঝাঁকুনি দিতেই সুবোধ কথা বলে উঠলো—হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী বলছিলে যেন,  বলো। 
কুসুম অবাক হয়ে সুবোধকে দেখতে লাগলো।  
সুবোধ নয় শুধু, এবার কুসুমও আর কোন কথা খুঁজে পেল না। অতঃপর আলো আর অন্ধকারে হারানো ছাড়া তাদের আর কিছু করার থাকলো না। 
চেনা অচেনা সুবোধ ও কুসুমের শরীরের রৌদ্র-গন্ধ শুধু ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ক্রমশ:  পরস্পর হারাতে হারাতে তারাও  হাঁটতে শুরু করলো সেই দিকে, যে দিকে এক শঙ্খ দ্বীপের কল্পনা ছিল তাদের। খুব চেনা পথ তাদের। একসময় তারা পরিষ্কার চিনতে পারলো  এই সেই  শঙ্খ দ্বীপ। যা বুঝি কোনোদিনও জন্মায় না। (চলবে)

আপনার মন্তব্য