বর্গমাইলের পদাতিক : ৩৯-৪০

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-২৩ ২৩:৩১:৫৫

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
৩৯
বার-দুয়েক পারাপারের সুবাদে সীমান্তের ফাঁকফোকর সুবোধের কিছুটা জানা হয়ে গেছে। দালালের পেছন পেছন রাতের শেষ প্রহরে চলছে সীমানা লঙ্ঘন। আবছা আলোতেও চোখে পড়লো আন্তর্জাতিক সীমানা নামক হাস্যকর খুঁটিটা। দাঁড়ানোর উপায় নেই। চকিতেই পার হয়ে যেতে হলো জায়গাটা। এই মন্দ আলোতেও দেখা গেল এক ঝাঁক পাখি বুঝি সূর্যের সন্ধানে এপার থেকে ওপারে উড়ে গেল।

বর্ডার পার হয়ে পুরোপুরি এদেশের হয়ে হতে একটা দিন লেগে গেল। কিছুটা নৌকা—কিছুটা হাঁটা-পথ, রিক্সা এবং অতঃপর বাস স্ট্যান্ড। মানুষের অদ্ভুত সহন ক্ষমতা। পারাপার যেন তার মৌলিক অধিকার। প্রাগৈতিহাসিক প্রথাটি সে আজও বজায় রেখেছে। কাঁটাতার বন্দুক গুলি রক্তচক্ষু মৃত্যু কিছুই সে মানে না এখনও। এরা কারা—কোন গোত্রের মানুষ? সুবোধ মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকেই—আমিও কি তাই ?

এখান থেকে ফারাক্কা যাওয়া যায়। কিন্তু সুবোধ কেন ফারাক্কা না গিয়ে শিলিগুড়ির পথে চললো, এই মুহূর্তে সুবোধ ছাড়া আর কেউ জানে না। শিলিগুড়ি যে তার জন্য আদৌ নিরাপদ নয় তাও- তো সুবোধ জানে না। কেন তার এই যাত্রা-পথের বদল ঘটলো। একটা শেষ করা অধ্যায়কে আরেকবার ছুঁয়ে দেখতে—না কি---।

জীবনের ধন কিছুই যেমন ফেলা যায় না, তেমনি জীবনের কোনো অধ্যায়-ই বুঝি শেষ বলা যায় না। জাহানারা সুবোধের এই কাজের ধারাটিকেই কখনো ধরতে পারতো না। শুধু জাহানারা কেন, কেউ-ই নয় বোধ হয়। এমনকি সুবোধ নিজেও কি জানে। নিজেকে একজন বিস্ময় মানুষ ভাবতেও-তো সে পারে না।

নিজের সম্পর্কে এইসব নানা মূল্যায়নের খেলা খেলতে খেলতে একসময় লক্ষ্য করলো যে বাসটা শিলিগুড়ি বাস টারমিনাসে ঢুকে গেল। রাত অনেকটাই, কত হবে, এগারটা? খুব ধারালো দৃষ্টিতে চারপাশ দেখে নিয়ে একটা রিক্সা নিয়ে সুবোধ চললো হিলকার্ট রোড ধরে। চেনা শহর, চেনা রাস্তা। কিছুটা জনবিরল। বেশ শীত লাগছে হাওয়ায়। চাদরে গা মাথা মোড়ানো।

যেতে যেতে একসময় সে পৌঁছে গেল টাউন স্টেশন এলাকায়।

শিলিগুড়ির রেলবস্তি কি তেমনই আছে? রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে এক ঝলক দেখে নিলো সে জায়গাটা। বন্ধ হয়ে গেছে দোকান-পাট। সুবোধ আর দেরি না করে সোজা বস্তির যে কোন মানুষের মতই ঢুকে পড়লো ভেতরে। ঊর্মিলার ঘরে সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় সামান্য চাপ দিতেই শোনা গেল ঊর্মিলার গলা –কে, কে বাইরে কে? উত্তরে যতটা সম্ভব আস্তে সুবোধ বলে উঠলো—আমি সুবোধ। একটুক্ষণ চুপ থেকে কোন প্রতি-উত্তর না দিয়ে দরজা সরিয়ে সুবোধকে দেখে ঊর্মিলা নিষ্পলক ক’মুহূর্ত।
বললো—ভিতরে ঢোক।

নিঃশব্দে ঊর্মিলার গা’ঘেঁষে সুবোধ ঢুকে গেল ঘরে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। ঊর্মিলা কুপি জ্বালাতে গিয়েও জ্বালালো না। বাইরের আলোর পরোক্ষ আভায় চোখ সয়ে গেলে ঘরে মোটামুটি দেখা যায়। তাই ঊর্মিলা সুবোধের কাছে গিয়ে হাত ধরে বিছানার এক কোণে বসিয়ে দিতে দিতে বললো, এখানে বস—বাতি জ্বালাবো না। সুবোধ বসার পর কাছে এসে আস্তে করে ঊর্মিলা খুব দৃঢ় গলায় বলে উঠলো—এখানে আইছিস ক্যান—কী মনে করে—পরিষ্কার কইরা বল?

--বলছি—তুমি—তো দেখছি খুব---

--চুপ—অন্য কথা না—আমার কথার উত্তর দে আগে---।

--দেব, এক গ্লাস জল খাওয়াবে?

--দিতাছি—খাইয়া আইছস—নাকি খাওন লাগব

--না খাইয়া আসছি।

ঊর্মিলা জল আনতে গেল। এখন সুবোধের খুব গরম লাগছে। গলা শুকনো। ঊর্মিলার হাত থেকে জলের গেলাসটা নিয়ে এক নিশ্বাসে শেষ করে দিল। মুখ মুছে তারপর কিছু বলতে গেল। কিন্তু ঊর্মিলা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো দাঁড়া বিছানাটা করে নেই। নিচে বসবি। মাদুর আর কাপড়চোপড় যোগাড় করে ঊর্মিলা নিচে বিছানা করতে লেগে গেল। সুবোধ লক্ষ্য করলো আগের পার্টিশান, চারপাই—কোনোটাই নেই। ঘরটা বেশ বড় লাগছে। বিছানায় বাচ্চাগুলো আগের মতই ঘুমোচ্ছে। বিছানা করার পর ঊর্মিলাও নিচে বসে পড়লো। বললো—এবার বল, আস্তে আস্তে বলবি--।

--কেমন আছো?

--আমি কেমন আছি তাই দিয়া তোর কি—তুই আইলি যে---

--তোমার জন্য

--থাক, নক্সা কথা রাখ—বল ঐ ছুঁড়িটা কই—আছে না মরছে—

--আছে, একটা ছেলে হয়েছে—

--ছাওয়ালটা কার, তোর না অন্য কেউর—

--তোমার কি মনে হয়

--চুপ কর মুখপোড়া

--আচ্ছা চুপ করলাম

--ওরারে নিয়া ওই পারে যা গিয়া

--যাব ভাবছি

--ভাবা-ভাবির কিছু নাই—বাঁচতে চাইলে চইলা যা—এইখানে থাকলে নিজেও মরবি, আমারেও মারবি। তুই কোন সাহসে এইখানে আসলি ক-তো।—তোর জন্য যে আমার থানা পুলিশ কোর্ট কাচারি লইয়া মরণ দশা হইছিল সেই খবর-ত কিছুই জানছ না। এইখানে যে রাতদিন পুলিশের লোকজন ঘুর ঘুর তোর খেয়াল নেই? –তোর নামে থানায় ডাইরি আছে। পুলিশের হাতে পড়লে তুইও শেষ হবি—আমারও সব্বনাশ হবে।--আছস কই এখন—শিলিগুড়িতে লইয়া আইছস নাকি ওইডিরে---ক, মুখ বুইজা আছস ক্যান—

--না, এইখানে না—অনেকদূরেই আছে---আমি সত্যিই কিছুই জানি না—মানে জানার সুযোগও ছিলনা—বিশ্বাস কর। জানলে আমি এইভাবে তোমার কাছে আসতাম না।

--অন্ধকার থাকতেই বাইর হইয়া যাবি—তোরে আমার ঘরে কেউ দেখলে আমারে আর আস্ত রাখবে না।

--ঠিক আছে—

--শুইয়া পড় এখন

--হ্যাঁ,---

ঊর্মিলা উঠে চলে গেল নিজের বিছানায়।

৪০
সুবোধ বুঝতে পারছে এর নাম বাস্তবতা। তার এই অনুচিত কাজের জন্য ঊর্মিলার আর কোন বিপদ হলে সে নিজেকেও ক্ষমা করতে পারবে না।

একটানা ঝড়ের পর আপাতত সামান্য একটু বিরতি। সুবোধ ঘুমোবেনা ভেবেছিল। কিন্তু শরীরই বোধ হয় একসময় শেষ কথা বলে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বোঝার উপায় নেই। একসময় শরীরে কোন কিছুর স্পর্শ পেয়ে ভেঙে গেল তার ঘুম। টের পেল পাশে শুয়ে আছে ঊর্মিলা। আরো টের পেল যে জেগেই আছে সে। ঊর্মিলার দিকে পাশ ফিরতেই অস্পষ্ট দেখতে পেল ঊর্মিলা চোখ মুছছে। খুব নিচু গলায় বলতে লাগলো—তুই যে কেমন কইরা ঐ কাণ্ডটা করলি—আমারে-ত কইতে পারতিস—বলতে বলতে ঊর্মিলা প্রকৃতই কান্নায় ভেঙে পড়লো। উর্মিলা আর বলতে পারলো না। শরীরের ভেতর জমা কান্না নিয়ে ঊর্মিলা অসহায়ের মত ছট ফট করতে লাগলো। সুবোধ তাকে সান্ত্বনা দিতেও সাহস পেল না। একটু সামলে আবার বলতে শুরু করলো---এই অভাগী মেয়েমানুষটার কথা একবার ভাবলি না। তরে-ত এত পাষণ্ড মনে হয় নি কখনো। সুবোধ আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো—ক্ষমা চাইছি—আমাকে ক্ষমা করে দাও—আমি না বুঝে একজনকে বাঁচাতে গিয়ে আরেকজনকে বিপদে ফেলতে যাচ্ছি—এটা বুঝতে পারিনি ঊর্মিলা, বিশ্বাস করো—মাথায় আসে নি---। ঊর্মিলা আবার ধরা গলায় বলতে শুরু করলো—আমার আফসোস, সব কথাই-ত আমারে কইতিস আর এই কাজটা তুই আমারে না জানিয়ে করতে গেলি---আমি কি তোর শত্রু ছিলাম রে--। সুবোধ আর ঊর্মিলার কথার জবাব দিতে পারলো না। শুধু বোবা মানুষের মত ঊর্মিলাকে জড়িয়ে ধরলো। তার চোখের জল ঊর্মিলার চোখে না পড়ারই কথা। কথা বা কান্না দুটো বন্ধ হলেও কিছু সময় পর সুবোধ অনুভব করলো ঊর্মিলা কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে---সুবোধ আমাকে একটু জোর করে চেপে ধরতো—এত কাঁপছে কেন শরীরটা—

দু’একটা কাক ডাকার আওয়াজ কানে যেতেই সুবোধের ঘুম ভেঙে গেল। টের পেল তার জামা খোলা বুকের উপর ঊর্মিলার হাত। সাবধানে বুক থেকে হাতটা নামিয়ে রেখে ঊর্মিলার গায়ে কাপড় ঢাকা দিয়ে আস্তে করে সে উঠে দাঁড়ালো। জামা প্যান্ট ঠিকঠাক করে চটের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সামান্য কিছু টাকা নিজের কাছে রেখে বাকি সব টাকাটা ঊর্মিলার বালিশের কাছে রেখে দিল। তারপর দরজা সরিয়ে সন্তর্পণে সে বেরিয়ে গেল রাস্তায়।

প্রাতঃভ্রমণার্থীরা এক দুজন করে বেরোতে শুরু করেছে মাত্র। প্রথমে কিছুটা হাঁটার পর একটা রিক্সা পেয়ে গেল সুবোধ। বিষফলের মত এই শহরে গা’এ কিছুদিন ঝুলেছিলাম গো—এখন ভীষণ তাড়া আমার। হালকা কুয়াশায় সুবোধের রিক্সাটা নির্বিঘ্নে হিলকার্ট রোডে মিলিয়ে গেল।
[সমাপ্ত]

আপনার মন্তব্য