শৈশব: খাতা-কাগজ-পেনসিল-কলম

 প্রকাশিত: ২০২০-০৭-০২ ১৩:০৫:০২

ড. মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী:

খালা-মামাদের স্মৃতি
মাইজদিতে নানার বাড়িতেই সত্তরের দশকের শেষে আর আশির দশকের শুরুতে, আমার এক্কেবারে আন্ডাকালে, লিখা শিখার বহু আগেই খাতা-কলম-কালি-পেন্সিলের সাথে পরিচয়। আমার খালাদের দেখতাম বই পড়ার পাশাপাশি নিয়ম কইরা একটু ‘চিকনা-লম্বাটে’ অথবা ‘চওড়া-চ্যাপ্টা’ খাতায় অংক করতেন, বাংলা-ইংরেজি লিখতেন আর নানা সাবজেক্ট এর ‘নোট’ করতেন। হার্ড কভারের বাইন্ড করা খাতা খুব বেশি দেখি নাই। বরং দোকান থিকা কয়েক ‘দিস্তা’ সাদা কাগজ একসাথে কিনা সেখান থিকাই আলাদা আলাদা কইরা কয়েকটা খাতা সিলাই করতেন! আব্বার কাছ থিকাই প্রথম শুনি ঐ লম্বা খাতাগুলো হইল ‘ফুল স্ক্যাপ’ সাইজ ( যেইটা উত্তর আমেরিকায় লিগ্যাল পেপার) আর চ্যাপ্টা খাতাগুলা হইল ‘ডিমাই’। কয়েকটা খাতারে উনারা বলতেন ‘রাফ খাতা’ যেইটাতে বাংলা, অংক, ইংরেজি সবকিছুই লিখা হইতো। নিউজ বা হোয়াইট প্রিন্টের এই রাফ খাতাগুলা একটু মোটা হইতো, খুব বেশি যত্ন কইরা লিখতে হইতোনা বইলা একটু কাটাকাটিও মনে হয় বেশি থাকতো। হোয়াইট প্রিন্ট কাগজে কালি কলমের ব্যবহার বেশি থাকলেও নিউজপ্রিন্ট এর উপর লেখার জন্য উনারা রেডলিফ বা দেশিয় সস্তা কিছু ‘শীষ’ কলমের ব্যবহার করতেন-‘ওয়ান টাইম ইউজ’ বলপেন বাজারে আসে নাই তখনো। যাই হোক খালাদের নোট করার দিস্তা খাতাগুলা ছিল অনেক পরিষ্কার- সাদা কাগজের উপর কালি কলমের লেখা অনেক বেশি ফুইটা উঠতো, দেখতেও অনেক সুন্দর লাগতো। নতুন পৃষ্ঠায় লিখা শুরুর আগে দেখতাম উনারা খাতার উপরে আর সাইডে কাঠের রুলার দিয়া দুইটা লাইন টাইনা নিতেন। রুলার না থাকলে হাত দিয়া খাতার উপর-নিচ আর সাইড ভাঁজ কইরা নতুন পৃষ্ঠায় লিখা শুরু করতেন। এই রকম রুল ছাড়া সাদা খাতায় উনাদের হাতের লিখা কেমনে এত সোজা থাকতো এইটা ছিল একটা বিস্ময়! ‘রুল’ করা বা ‘লাইন’ টানা দিস্তা খাতা খুব একটা চোখে পড়ে নাই তবে নীল রংয়ের লাইন টানা দুই একটা ছোট সাইজের বাইন্ড করা খাতা দেখছি। এই খাতাগুলার প্রতিটা পৃষ্ঠায় উপরের দুইটা লাইন কেন নীল না হয়া লাল হইতো আর অন্য লাইনের থিকা একটু বেশি কাছাকাছি থাকতো এইটা নিয়া খুব কৌতূহল হলেও পরে জানতে পারি এইটা হইলো গিয়া একটা ‘ডিজাইন’-গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আম্মা মাঝেমাঝে আমাদের দুই ভাইরে দুপুরে খাওয়ানোর পর খালাদেরকে পাটীগণিত-বীজগণিত করাইতে বসতেন। অংক করার সময় উনাদের মুখে ‘এ প্লাস বি হোল স্কয়ার’, ‘প্লাসে প্লাসে প্লাস’ কিন্তু ‘মাইনাসে মাইনাসে প্লাস’ এই ‘সূত্র’ গুলা অনেক শুনছি কিন্তু বুঝতামনা এগুলার মানে কি। মাঝেমাঝে কানে আসতো এই ‘সূত্র’ গুলা না জানলে বীজগণিত বা জ্যামিতি করা যায়না। মনে মনে উনাদের মত ‘সূত্র’ ইউজ কইরা বীজগণিত বা জ্যামিতি করার ইচ্ছা জাগতো। কিন্তু এর আগে তো বড় হইতে হইবো, পড়ালিখা শিখতে হইবো!


মাঝেমাঝে উনারা ‘জ্যামিতি বক্স’ নামে একটা চারকোণা চিকন টিনের বাক্স থিকা কাটা-কম্পাস, পেন্সিল কম্পাস, প্লাস্টিকের ত্রিকোণী আর স্কেল (রুলার) বাইর কইরা ‘জ্যামিতি’ করতেন। খাতার উপর রুলার বসায়া পেন্সিল দিয়া সরল রেখা, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র নানা আকৃতির কত জিনিস যে আঁকতেন! বুঝতাম খালিহাতে এত সোজা কইরা আঁকা সম্ভব না। ‘পেন্সিল কম্পাস’ জিনিসটার প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ হইতো! দুইটা চিকন চকচকে রুপালি কাঁটার একটার মাথা ছিল চিকন সুচের মত চোখা আর অন্য কাঁটাটা ছিল একটু খাটো যার মাথায় গোলমত একটা ছিদ্র থাকতো। ঐ ছিদ্রের মধ্য দিয়া ছোট্ট একটা কাঠপেন্সিল ঢুকায়া চিকন গোল আংটির মত একটা জিনিস ঘুরায়া ঘুরায়া পেন্সিলটারে টাইট করা হইতো। তারপর খাতার মাঝখানে সুচের মত মাথাটা চাইপা ধইরা পেন্সিলওয়ালা কাঁটাটা চাইরদিকে এক পাক ঘুরায়া আনলে সুন্দর গোলমত একটা জিনিস তৈরি হয়া যাইতো। এই ‘জিনিস’ টারে উনারা বলতেন ‘বৃত্ত’।মাঝেমধ্যে বৃত্ত আঁকতে গিয়া পেন্সিল কম্পাস পুরাটা ঘুরানোর আগেই পেন্সিলের শীষটা ‘খুট’ কইরা ভাইঙা যাইতো। মিজাজ খারাপ কইরা উনারা তখন ব্লেইড দিয়া পেন্সিলটার আগাটা আবার একটু চোখা কইরা কম্পাসে বসাইতেন। তারপর খাতার উপর কম্পাসের কাঁটা আর পেন্সিলটারে আগের জায়গায় বসায়া বৃত্ত আঁকাটা কমপ্লিট করতেন। এইখানেও একটা ঝামেলা হইতো- পেন্সিলটা জায়গামত না বসলে অর্ধেক আঁকা বৃত্তের গা ঘেঁইসাই নতুন একটা বৃত্ত তৈরি হয়া যাইতো। আবার পেন্সিলের আগাটা একইরকম চোখা না হইলে জায়গামত বসলেও বৃত্তের এক জায়গা একটু মোটা আর আরেক জায়গা একটু চিকন হয়া পড়তো। বিপত্তি এড়াইতে রাবার দিয়া মুইছা নতুন কইরা আবার বৃত্তটা আঁকতে হইতো। যাই হোক জ্যামিতির এই আঁকাউঁকি শেষ কইরা উনারা উনাদের ‘জ্যামিতি বক্স’ যত্ন কইরা উপরে তুইলা রাখতেন। এই আজব বাক্সটারে মাঝেমাঝে ধইরা দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে পেন্সিল বা কাঁটা কম্পাসে হাত কাইটা যাইতে পারে বইলা সাবধানবাণী শুনানো হইতো। তাই ঐটা আর হাতে নিয়া দেখার সাহস করতামনা। কিন্তু খালি পেন্সিল হাতে পাইলেই মাঝেমধ্যে উনাদের মতন বৃত্ত আঁকার ট্রাই নিতাম। কিন্তু ঘোড়ার ডিম বৃত্ত তো আর হইতোনা-বাঁকা-ত্যাড়া কিছু লাইন, বড়জোর ডিম এর মত কিছু একটা হইতো। হতাশ লাগতো খুব!

লেখা শিখা-হাতেখড়ি-স্লেট-চক
আমার লেখার হাতেখড়ি হয় আম্মার হাতে। আম্মা আমারে আর ভাইয়ারে স্কুলে ভর্তির আগে আগে চাইরকোণা পাতলা কাঠের মত একটা গাঢ় ছাই রংয়ের ‘বস্তু’তে ‘অ’, ‘আ’, শব্দ, বাক্য, ধারাপাত, যোগ-বিয়োগ পূরণ-ভাগ করা শিখান। ওই চাইরকোণা ‘বস্ত’টার নাম ছিল ‘স্লেট’ যার চারদিক দিয়া আবার জাম কালারের একটা বর্ডার থাকতো।এই বর্ডারের ভিতরেই লিখাটা শেষ করতে হইতো। নতুন স্লেট কিনার সময় এর উপর লিখার জন্য ছোট পেনসিলের মত তিনকোণা ছাই কালারের একটা কাঠি দেয়া হইতো। কিন্তু ঐটা আঙুল দিয়া ধরতে একটু কষ্ট হইতো, লিখাও কেমন যানি একটু হালকা ও চিকন লাগতো। তাই ‘চক’ দিয়াই স্লেট এর উপর লিখতাম। বাসায় আম্মার কাছে কাগজের চাইরকোণা একটা বক্সের মধ্যে ১০-১৫ টার মত লম্বা সাদা ‘চক’ থাকতো- দুই একটা চক ভাঙাও থাকতো এর মধ্যে।আম্মা ঐ ভাঙা চকটারেই বাইছা নিয়া আমাদের লিখা শুরু করাইতেন। নতুন চক কেন দিতেছেন না এই নিয়া প্রথম প্রথম অল্প কিছু ক্ষোভ থাকলেও পরে দেখছি যে নতুন লম্বা চক একটু লিখার পরই ‘ঠুস’ কইরা ভাইঙা পড়ে। তাই নতুন, পুরাতন আর ভাঙা চক নিয়া বিশেষ গা করতাম না। যাই হোক স্লেটের একটা বড় অসুবিধা হইলো এইটাতে লিখার জায়গা কম। তাই বেশি কিছু লিখা যায়না বা খাতার মত লিখাটাও লম্বা সময় রাইখা দেওয়া যায়না। একটা কাজ করতাম মাঝে মাঝে- ‘স্লেটে’র জায়গা শেষ হয়া গেলে লেখা আর না মুইছা ঘরের সিমেন্টের ফ্লোরেই লিখাটা কন্টিনিউ করতাম, লেখা শেষ কইরা পরে আম্মারে দেখাইতাম। এই স্লেটগুলার আবার কোন কোন জায়গা স্বাভাবিকের চাইতে একটু বেশি মসৃণ থাকতো- এইখান দিয়া লিখার সময় চকটা একটু পিছলায়া যাইতো। মিজাজ খারাপ কইরা তখন ঐ পিসলা জায়গাটায়ই জোর কইরা চকটা চাইপা ধইরা বারবার লিখার চেষ্টা চালাইতাম। এইরকম করতে গিয়া মাঝেমাঝে ঝুরঝুর কইরা চকের গুড়া লেখার উপর ছড়ায়া পড়তো বা চাপ দেয়া জায়গায় চকের দাগ একটু উঁচা হয়া থাকতো। স্লেটের লিখা মুছার জন্য আমরা একটা কাপড়ের ‘ন্যাকড়া’ ব্যবহার করতাম। বাসাবাড়িতে তখনো স্কুলের মত চকের লেখা মোছার জন্য কাঠের চাইরকোণা ডাস্টারের প্রচলন ছিলনা। যাই হোক ‘ন্যাকড়া’ দিয়া চকের লিখা মোছা গেলেও স্লেটটা কেমন যানি সাদা সাদা হয়া থাকতো। পানি দিয়া ধুইয়া তখন স্লেটটারে পরিষ্কার করতে হইতো। অনেক সময় বেখেয়ালে কংক্রিটের ফ্লোরে পইড়া স্লেটটা ভাইঙা গেলে আরেক দুর্গতি হইতো! এই ভাঙা স্লেট আর জোড়া লাগানো যাইতোনা। এই ঝামেলা দেইখা আব্বা পরের দিকে কাঠের বর্ডার দেয়া কাল রংয়ের টিন এর একটা স্লেট’ কিনা দিসিলেন। কোনভাবে কাঠ খুইলা না আসলে ঐ স্লেট অনেকদিন ধইরা ব্যবহার করা যাইতো।

নতুন লিখা শিখার উত্তেজনায় অনেকটা আজকালকার পোলাপাইনদের মতই যেখানেই চান্স পাইতাম সেখানেই কিছু না কিছু লিখার ট্রাই করতাম। পাকা দেয়ালতো ছিলনা তাই বাসার সামনের মাটির উঠানে গাছের চিকন ডাইলা দিয়া নানা রকম শব্দ লিখা আম্মারে দেখাইতাম। এই শব্দ লিখালিখি বাড়ির ভিতরের পেয়ারা বা সুপারি গাছের গায়েও চলতো। আমার একটা খুতখুতি আসিল ছোটবেলা থিকাই- নিজের লিখার উপর অন্যে কারো লিখাই ভাল্লাগতোনা। এমনকি আম্মাও যদি কিছু শিখাইতে আসতেন বা লেখার কোন ভুল কারেক্ট করতে আসতেন আমি উনারে আমার লিখার উপর না লিখা শূন্যে আঙুল ঘুরায়া দেখাইতে বলতাম কী কারেক্ট করতে হইবো। আম্মার শূন্যে আঙুল ঘুরানো দেইখাই আমি আমার নিজের লিখা কারেক্ট কইরা নিতাম-উনারে আমার লিখার উপরে আর লিখতে দিতাম না। এইসময়ের দিকে ভাইয়া একটা মজার জিনিস শিখাইসিলেন। উনি তখন স্কুলে যান, বড় বড় শব্দ বা বাক্য লিখতে পারেন। একদিন স্কুল থিকা আইসা আমারে দেখান ক্যামনে একটানে কাঠি না তুইলা ‘মহাভারত’ শব্দটা লিখা যায়। আমিও কৌশলটা শিখা এইখানে সেইখানে ‘মহাভারত’ লিখা ভরায়া ফালাইতাম। নিজেরে একটু ‘কাবিল-কাবিল’ মনে হইতো! অক্ষর শিখার এই সময়েই মনে হয় আম্মা একদিন দ্যাখাইসিলেন কীভাবে ‘দ’ অক্ষর লিখা এর সাথে দুই একটা বাড়তি লাইন টাইনা ‘দ-পাখি’ আঁইকা ফালানো যায়। এই দ-পাখিই মনে হয় আমার শিখা প্রথম চিত্রকর্ম! আঁকাউঁকির প্রতি তেমন আগ্রহ কোনদিনই পাই নাই । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্কুলে ভর্তি হইবার পরপরই ড্রয়িং পরীক্ষার জন্য পালতোলা নৌকা, শাপলা ফুল, গোলাপ ফুল, গ্রামের দৃশ্য ইত্যাদি আঁকা শিখতে হইছিল। পরে মেট্রিক পর্যন্তও নানা ক্লাসে ভূগোলের মানচিত্র, বিজ্ঞানের কোষ, ব্যাঙ এর পরিপাক তন্ত্র, টেস্টটিউব, কনিক্যাল ফ্লাস্ক ইত্যাদি অনেক কিছুই ইচ্ছার বাইরে আঁকতে হইসিল। শুধুমাত্র বেশি আঁকতে হইবো বইলাই আব্বার অনেক ইচ্ছা থাকা সত্বেও ইন্টারে বায়োলজির পরিবর্তে পরিসংখ্যান নেই! পড়ালেখায় অংকনমুক্ত হয়া একটু শান্তির পরশ পাইসিলাম!

খাতা-কাগজ
‘স্লেট’ এর উপরে লিখার হাতেখড়ি হইলেও স্কুলে ভর্তি হবার আগে আগে আম্মা আমারে আর ভাইয়ারে পেন্সিল দিয়া খাতায় লিখা শিখানো শুরু করেন। এই লিখা শিখার খাতাগুলাও ছিল মূলত সেলাই করা- সাদা বা রুল করা খাতা কিন্তু সাইজ ছিল একটু ছোট, ফুল-স্ক্যাপ কাগজের প্রায় অর্ধেক। আব্বা দিস্তা কাগজ আইনা এই খাতাগুলা সিলাই কইরা দিতেন। ক্লাস টু পর্যন্ত মনে হয় কোন বাইন্ড করা খাতা ইউজ করি নাই। তবে পাড়ার হোসেন মামার দোকানে তখন এক টাকা দামের ১০-১৫ পৃষ্ঠার পিন মারা একটা ছোট পাতলা সাদা খাতা পাওয়া যাইতো যার উপরের মলাটের পুরাটা অংশ জুইড়া ছিল বাংলাদেশের একটা জেলাওয়ারী মানচিত্র। সিলাই করা খাতার কাগজ শেষ হয়া গেলে ঐ চিকনা খাতায় মাঝেমাঝে আমরা অংক করতাম। ঐ খাতার মানচিত্র দেইখাই মনে হয় দেশের অনেকগুলা জেলার নাম জানতে পারি। আম্মাও অনেক সময় ঐ খাতায় আমাদের জন্য নোট করতেন বা রচনা লিখতেন। মিজান ভাইয়ার নোট করার জন্য আম্মা সাধারণত আরেকটু মোটা বাইন্ড করা রুল করা খাতা ব্যবহার করতেন। প্রতিবার ভাইয়ার বার্ষিক পরীক্ষার শেষে ঐনোট খাতাগুলা আম্মা আমার জন্য যত্ন কইরা রাইখা দিতেন। এই রকম একটা বাংলা রচনা খাতা যেইটা আম্মা ভাইয়ার ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার আগে লিখসিলেন সেই খাতা আমি নিজেও ক্লাস ফাইভ বা সিক্স পর্যন্ত পড়ছিলাম।

আব্বা একবার ঢাকা থিকা আমার জন্য ছোট একটা ঘর ঘর ওয়ালা খাতা ( গ্রাফ পেপার এর মত কিন্তু ঘরগুলা একটু বড়) আইনা দিসিলেন অংক করার জন্য। এই ধরনের খাতা মাইজদিতে আমি আর কারো কাছে দেখি নাই এবং নিজেও এইটার পরে জীবনে দ্বিতীয়বার কখনো ব্যবহার করি নাই। পরে ক্লাস থ্রিতে ঢাকায় আসার পর দেখি ঐখানে বেবি, ওয়ান ক্লাসের পোলাপানরা অক্ষর বা সংখ্যা জায়গামত লিখার জন্য এইরকম ঘরঘর করা খাতা ব্যবহার করে। ইংরেজি লিখার জন্য আমাদের সময়ে বিশেষ ধরনের লাইনটানা খাতার প্রচলন ছিল। ইংরেজি অক্ষরগুলা উপর-নিচ কইরা লিখতে হয় বইলা খাতাগুলাতে চাইরটা চাইরটা কইরা লাইন টানা থাকতো। ঐ চাইরটা লাইনের মধ্যেই নিয়ম মাইনা শব্দের অক্ষরগুলা রাখতে হইতো। এইভাবে একেকটা পৃষ্ঠায় মোটামুটি ৭ বা ৮ টা ইংরেজি লাইন লিখা যাইতো। আমার অবশ্য এই খাতায় লিখতে অত ভাল্লাগতোনা। তাই ক্লাস থ্রির পরে এইরকম খাতায় আর ইংরেজি লিখি নাই- সাধারণ রুল করা বা সাদা খাতায়ই ইংরেজি লিখতাম।

মাইজদি পিটিআই স্কুলে ক্লাস ওয়ান আর টুতে থাকতে আমাদেরকে ইউনিসেফ থিকা দুইটা করে চিকন রুল করা খাতা আর দুইটা কইরা পেনসিল দেয়া হইসিল। জীবনে এই প্রথম এত ধবধবা সাদা কাগজের রুল করা খাতা আর ভালো পেনসিল হাতে পাই। লিখলেইতো শেষ হয়া যাইবো তাই কিছু না লিখাই খাতাগুলা বহুদিন উপরে তুইলা রাখছিলাম। পরে একসময় শুধু ঘরে লেখার জন্য এরকম একটা খাতায় লিখতে শুরু করি। এই খাতার উপর গাঢ় পেন্সিলে নিজের হাতের লেখা দেইখাই অনেক মুগ্ধ হইতাম। আরেকটা খাতায় আম্মা ‘রয়েল ব্লু’ কালি দিয়া আমার জন্য বাংলা নোট করতেন। ধবধবা সাদা কাগজের উপর নীল কালির লিখা যে কত সুন্দর কইরা ফুইটা উঠতো বইলা বুঝানো সম্ভব না! বড়কালে এরকম অনেক ভালো কাগজ এর খাতা আর পেনসিল ব্যবহার করছি কিন্তু কোনটাই ছোটকালের ঐ ইউনিসেফের খাতা-পেনসিলের মত এতটা মুগ্ধ করতে পারে নাই!


ছোটবেলার খাতা-কাগজের কাগজের কথা বলতে গেলে আব্বার কথাই বেশি মনে পড়ে। আব্বা তখন চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন চিটাগাং এ। কর্ণফুলি পেপার মিল, পাকশী আর খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল এর ডিলারশিপ ছিল আব্বার। মাইজদিতে আমার নামে বাসার কাছেই আব্বার একটা স্টোর-কাম-অফিস ছিল যেখান থিকা মূলত পাইকারিভাবে বিভিন্ন জায়গায় কাগজ ও স্টেশনারি সরবরাহ হইতো। আমার আর ভাইয়ার লিখার কাগজ মূলত এইখান থিকাই আসতো। আব্বা চিটাগাং থিকা আসলে মাঝেমাঝে উনার সাথে ঐ অফিসে যাইতাম। ঐখানেই প্রথম পরিচিত হই কাগজের ‘দিস্তা’ বা ‘রিম’ এই শব্দগুলার সাথে। ২৪ বা ২৫ টা কাগজের পাতায় এক ‘দিস্তা’ আর ২০ দিস্তায় এক ‘রিম’ হয়- এই শিক্ষা অর্জন করি এখানেই। কাঠের একটা লম্বা শেলফের মধ্যে বড় বড় কাগজের রিম বা প্যাকেটগুলো থরে থরে সাজানো থাকতো। কাগজের রিমগুলার ‘খাকি মোড়ক’ ট্রান্সপোর্টের সময় কোন কোন জায়গায় ছিঁড়া যাইতো- প্যাকেটের ভিতর থিকা কাগজের থোকটা তখন নজরে আসতো। ঐ কাগজের থোকের উপর আঙুল ধইরা উপর-নিচ করতে অনেক আরাম পাইতাম। এই রিমগুলারই কয়েকটারে খুইলা আবার আলাদা আলাদা কইরা ‘দিস্তা’ কাগজ এর থোক বানানো হইতো। এই নতুন দিস্তা কাগজগুলা মাঝেমধ্যে নাকের কাছে নিয়া গন্ধ শুঁকতাম-একেক মিলের কাগজের গন্ধ একেকরকম! আমার নতুন কাগজের গন্ধ সবসময়ই ভালো লাগতো এবং এখনো ভালো লাগে! আব্বার কাছেই প্রথম শুনি যে কর্ণফুলির কাগজ এ কাঁচামাল হিসেবে বাঁশ ব্যবহার করা হয় এবং এই মিল বানানোর সময় এইটাই ছিল এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় পেপার মিল।

হালকা হলদেটে এই কাগজের কোয়ালিটি খুব ভালো ছিল- কালি কলম দিয়া লিখার জন্য বেশ উপযোগী ছিল। অন্যদিকে, পাকশীর কাগজ আখের ছোবড়া দিয়া তৈরি হইতো- কর্ণফুলির কাগজের চাইতে একটু বেশি সাদা হইলেও আমার কাছে একটু পাতলা লাগতো। ফাউন্টেন পেন দিয়া এই কাগজে লিখলে লেখাটা একটু মোটা হয়া যাইতো বা অনেকসময় কালি উল্টা পৃষ্ঠায়ও ছড়ায়া পড়তো। বিপদ এড়ানোর জন্য বলপেন দিয়াই এই কাগজে বেশি লিখা হইতো। খুলনার নিউজপ্রিন্ট কাগজ সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ থিকা তৈরি হইতো। তখনকার নিউজপ্রিন্ট কাগজ কেমন যানি একটু মলিন লাগতো, সহজে ছিঁড়াও যাইতো। কালিকলম দিয়া লিখতে গেলে ঐ কাগজের শহীদ হওয়া শুধু বাকি থাকতো তাই বলপেন ছাড়া আর কোন গতি ছিলনা। আব্বার কাছ থিকা এই তথ্যগুলা স্কুলে ভর্তির আগে থিকাই জানতে পারি। পরবর্তীতে আমরা ঢাকায় আসার পরও নয়াবাজারে আব্বার ব্যবসার জায়গা থিকাই আমাদের স্কুল, কলেজ আর ভার্সিটি লাইফের মোটামুটি সব ধরনের কাগজেরই যোগান হইতো। দরকারমত দেশি-বিদেশি সব কোয়ালিটির কাগজই পায়া যাইতাম। আব্বার ব্যবসার কারণে কাগজ নিয়া আমাদের কোনদিনই চিন্তা করতে হয় নাই।

মাইজদীর পিটিআই স্কুলে বাইন্ড করা খাতার উপর তেমন কড়াকড়ি না থাকলেও ঢাকায় আমার প্রাথমিক স্কুল আহমেদ বাওয়ানী একাডেমি ও মাধ্যমিক স্কুল গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ক্লাস সিক্স-সেভেন পর্যন্ত স্কুল থিকা নিয়ম কইরা দেওয়া বিশেষ সাদা বা রুল করা বাইন্ড করা খাতা ব্যবহার করতে হইতো। খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও স্কুলের ডিমান্ড অনুযায়ী আব্বা এই খাতাগুলা তখন কিনা দিতেন। ক্লাস এইটের পর অবশ্য এইরকম বাইন্ড করা খাতার আর বাধ্যবাধকতা ছিলনা। মনে আছে ৮৬’র বিশ্বকাপ ফুটবলের পর বাজারে খেলার বা খেলোয়াড়ের বিশেষ কইরা ম্যারাডোনার ছবিওয়ালা কভারের একটু লম্বাটে নিউজপ্রিন্ট খাতা পাওয়া যাইতো। এই ধারায় পরবর্তী কয়েক বছর র্যাম্বো, ম্যাকগাইভার এর ছবিওয়ালা খাতা অনেক জনপ্রিয় হইসিল। আমিও যুগের সাথে তাল মিলায়া, বিশেষ কইরা কভারের রঙিন ছবির লোভে আব্বারে লুকায়া এরকম কয়েকটা খাতা কিনসিলাম!

পেন্সিল-রাবার-স্টেশনারি
মাইজদিতে আব্বার ঐ স্টোরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল পিছনের ঘর যেখানে শেলফের মধ্যে নতুন পেন্সিল, রাবার, পেন্সিল কাটার, জেমস ক্লিপ, স্ট্যাপলার মেশিন, পিন, কাগজ ছিদ্র করার পান্চিং মেশিন, কাঠের ডাঁটওয়ালা লোহার চিকন ফুঁড়ুনি, বই খাতা সিলাইয়ের সুতা, ‘বোফা’ জ্যামিতি বক্স, হলুদ রংয়ের কাঠের রুলার, গ্লু এর অনেকগুলা বক্স থরে থরে সাজানো থাকতো। ঐখান থেকেই আমরা আমাদের ব্যবহারের পেন্সিল, রাবার (ইরেজার), পেন্সিল কাটার, কাঠের রুলার এগুলা বাসায় নিয়া আসতাম।

আব্বার ওখানে গোলাপি, ফিরোজা বা হালকা হলুদ রংয়ের চারকোণা খাজকাটা এক ধরনের রাবার এর গন্ধ এত ভালো লাগতো যে মাঝেমাঝে কামড় দিয়া খাইয়া ফালাইতে ইচ্ছা হইতো। দুই একবার কামড় দিয়াও দেখছিলাম। কিন্তু গন্ধ ভালো হইলেও খাইতে বড় বিস্বাদ লাগতো! অবশ্য এই রাবার দিয়া পেন্সিলের দাগ অত ভালো মুছতোনা তাই শুধু কালেকশনের লাইগাই বাসায় আইনা রাখতাম। সাদা চ্যাপ্টা চারকোণা আরেকধরনের রাবার আসিল যেইটা মাথার তেলমাখা চুলে হালকা কইরা ঘইসা নিউজপেপারের কোনখানে লিখার উপরে চাইপা ধরলে রাবারের উপর ঐ লিখাটা আইসা পড়তো। মাথার তেলে ঘইসা লিখাটারে আবার মুইছাও ফেলা যাইতো। এই ‘কুদরতি’র জন্যই সাদা চ্যাপ্টা রাবারগুলা বেশি ভালো লাগতো। আরেক জাতের চিকন লম্বা রাবার ছিল যেইটার অর্ধেক ছিল সাদা, নরম আর বাকি অর্ধেকটা ছিল একটু কাল মতন শক্ত, যেটা দিয়া বলপেনের লিখাও মুছা যাইতো। কিন্তু এই কালো অংশটা বেশি শক্ত বইলা মুছতে গিয়া অনেক সময় খাতার কাগজও ছিঁড়া যাইতো।

আব্বার ঐখান থিকাই দরকারমত আমি আর ভাইয়া নতুন নতুন পেন্সিল বাসায় নিয়ে আসতাম। এগুলা মনে হয় চাইনিজ পেন্সিল ছিল-কোয়ালিটি অত ভালো ছিলনা, সহজেই শীষ ভাইঙা যাইতো। নতুন পেন্সিল একটা চারকোণা ছোট পেন্সিল কাটারে (শার্পেনার) ঘুরায়া ঘুরায়া গ্রাফাইটের শীষটা বাইর করা হইতো এবং মাথাটাও চোখা করা হইতো। পেন্সিল কাটারের ব্লেইডের মধ্যে দিয়া পেন্সিলটারে ঘুরানোর সাথে সাথে পাতলা কইরা কাটা কাঠ বের হয়ে আইসা রিংয়ের মত তৈরি করতো-দেখতে অনেক সুন্দর লাগতো! এইভাবে কাটলে পেনসিলের আগাটাও অনেক মসৃণ-সুন্দর হইতো আর ধরতেও অনেক আরাম লাগতো। মাঝেমধ্যে অবশ্য পেন্সিলের আগা বেশি চোখা করতে গেলে শিষটা ‘ঠুস’ কইরা ভাইঙা কাটারের ব্লেইড আর প্লাস্টিকের মাঝখানের সরু জায়গাটায় আটকায়া যাইতো। নতুন কইরা পেন্সিলটা আবার শার্প করার আগে ঐ ভাঙা শীষটা চিকন কিছু দিয়া বাইর কইরা নিতে হইতো। বড় বিরক্ত লাগতো তখন! অনেকসময় আবার অতিরিক্ত চাপে কাটারের ব্লেইডের অন্য পাশের প্লাস্টিকটা ভাইঙা গেলে কাটারটা আর ইউজ করা যাইতোনা! বাসায় পেন্সিল কাটার না থাকলে আম্মা মাঝেমধ্যে ‘বলাকা’ বা ‘সেভেন ও’ক্লক’ ব্লেইড দিয়া পেনসিলের আগার কাঠটা কাইটা শীষটা বাইর কইরা দিতেন বা চোখা কইরা দিতেন। কিন্তু আলাদা ব্লেইড দিয়া কাটলে পেনসিলের মাথাটা একটু খাবলা-খাবলা লাগতো-দেখতে আর ভাল্লাগতোনা। এই কাঠ পেনসিলের শেষ মাথায় সোনালি রঙের মেটালের একটা পাতলা পাত গোল কইরা লাগানো থাকতো যার মধ্যে ছোট্ট একটা হালকা গোলাপি রংয়ের রাবার বসানো থাকতো। এই রাবারটা অত ভালো ছিলনা-লিখা মুছতে গেলে প্রায়ই দাগটা সাদা কাগজে ছড়ায়ে পড়তো, ময়লা হয়া যাইতো জায়গাটা। পেন্সিলের লিখা মুছার জন্য আমি আলাদাভাবে সাদা রাবারই ইউজ করতাম। লিখার ফাকে চিন্তা করার সময় মনের অজান্তেই পেনসিলের কাঠে বা পাতলা সোনালি পাতে দাঁত দিয়া হালকা হালকা কইরা কামড় দেয়া ছিল আমার বদভ্যাস। কত পেন্সিলের চেহারা যে এইভাবে নষ্ট করছি হিসাব নাই। পেন্সিলের সোনালি পাতে কামড় দিতে গিয়া চাপ একটু বেশি পইড়া গেলে মাঝেমধ্যে খোল থিকা ঐ ছোট্ট রাবারের টুকরাটা ‘টুপ’ কইরা খুইলা পড়তো। ভিতর থিকা পেনসিলের সমান মাথাটা তখন দেখা যাইতো। অনেক সময় সোনালি পাতটারে চাপ দিয়ে বাঁকায়া ঐ মাথাটা বুইজা দিতাম, নাইলে পাতটা খুইলা পেন্সিলের পিছনের মাথাটারে শার্প কইরা একটা দ্বিমুখী পেন্সিল বানায়ে ফালাইতাম। মাইজদিতে থাকতেই মেঝ নানা মাঝেমাঝে আমেরিকা থিকা আমাদের জন্য হলুদ রংয়ের পেন্সিল পাঠাইতেন। এই পেন্সিল গুলা একটু হালকা লাগতো। এগুলার লিখা একটু হালকা হইলেও লিখাটা অনেক পরিচ্ছন্ন হইতো। গ্রাফাইটের কোয়ালিটি একটু ভালো ছিল বইলা ক্ষয় হইতো খুব কম আর শীষও সহজে ভাঙতো না। এরকম ৩/৪ টা পেন্সিল দিয়া ৬/৭ মাস পর্যন্ত লিখা সম্ভব হইতো। পরবর্তীতে ঢাকায় আইসা 2B, HB, লিড পেন্সিলসহ চিকনমোটা কত পেন্সিলইতো ব্যবহার করছি কিন্তু মাইজদি জীবনের ঐ সস্তা চাইনিজ পেন্সিলের স্মৃতিগুলাই যেন বেশি জীবন্ত হয়া আছে এখনো!

ফাউন্টেন পেন-কালির দোয়াত
আমাদের একদম ছোটকালে ‘বলপেন’ এর প্রচলন ছিল কম। খালা-মামা আর বড়দের ‘কালি কলম’ বা ‘ফাউন্টেন পেন’ দিয়াই বেশি লিখতে দেখছি। এই ফাউন্টেন পেন এ আলাদা কইরা ‘কালির দোয়াত’ থিকা নীল বা কালো রংয়ের কালি ভইরা তারপরে লিখতে হইতো। কলমের কালি শেষ হয়া গেলে বারবার কালি রিফিল করা যাইতো বইলা এক একটা কলম লম্বা সময় ধইরা ব্যবহার করা যাইতো। সাদা কাগজের উপর একটা চিকন সোনালি বা রুপালি রংয়ের মেটালিক নিব এর চলাফেরা ক্যামনে কালো বা নীল রংয়ের লিখায় রূপান্তরিত হইতো ঐটা দেখা ছিল একটা বিস্ময়! তরল কালিটা কেমনে ঐ চিকন নিবের মাথা দিয়া বাইর হইয়া আসতো ঐ মেকানিজমতো তখনো জানা ছিলনা! পরে ভার্সিটিতে পড়ার সময় এই জিনিষটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা জানতে পারি (সারফেস টেনশন)! আজকের দিনে ফাউন্টেন পেন এর ব্যবহার পুরাপুরি উইঠা গেলেও আমাদের একেবারে শৈশবে এটাই ছিল লিখার প্রধান মাধ্যম।

আমার আম্মা-খালাদের কাছে ‘ইউথ’, ‘উইংসাংগ’ নামের কয়েকরকমের কালি কলম ছিল। দাম একটু কম ছিল, আবার কোয়ালিটিও খারাপ ছিলনা বইলা বাসাবাড়িতে বা স্কুলের টিচারদেরকে এই কলমগুলাই বেশি ব্যবহার করতে দেখছি। আমি আর ভাইয়াও এই কালি কলমগুলা দিয়াই লেখা শুরু করি। পরে উপরের ক্লাসে উইঠা আমি দুই একটা দামী পাইলট কলমও কিনসিলাম- বাংলা কারকের ‘পাইলটে ভালো লিখা হয়’ এই লাইনে অনুপ্রাণিত হয়া। আমার দেখা ‘ইউথ’, ‘উইংগ সাংগ’ বা ‘পাইলট’ কলমের প্লাস্টিকের খোলগুলো ছিল কালো, মেরুন, লাল, গাঢ় সবুজ, গাঢ় নীল বা সায়ান কালারের আর কলমগুলার সূক্ষ্ম নিব টারে সুরক্ষা করার জন্য থাকতো ঝকঝকে সোনালি বা রুপালি রংয়ের হালকা মেটালিক ক্যাপ। এই ক্যাপগুলার সাথে আবার একি কালারের ক্লিপও থাকতো যার মাধ্যমে শার্টের পকেটে কলমগুলা আটাকায়া রাখা যাইতো।

সাধারণত এই ফাউন্টেন পেনগুলার বডি জুইড়া দুইটা প্লাস্টিকের খোল থাকতো যেগুলারে আবার স্ক্রুর মত ঘুরায়া ঘুরায়া খুলা যাইতো। কলমের নিচের দিকের খোলটা কালি ঢুকানোর পার্ট , আর উপরের খোলটা কালি রিলিজ করার পার্ট আর নিবের একটা বড় অংশকে সুরক্ষা করতো। নতুন কলমে কালি ভরা বা রিফিল করার জন্য কলমের নিচের প্লাস্টিকের খোলটা খোলা হইলে নরম রাবারের সরু-লম্বা কালির থলিটা চোখে পড়তো। এই কালির থলিটা আবার চিকন লম্বা একটা মেটালের কন্টেইনারের মধ্যে সুরক্ষিত থাকতো। কালি ভরার জন্য কালির দোয়াতের ভিতরে কলমের নিবসহ মাথাটা ডুবায়ে ঐ মেটাল কন্টেইনারেরই সরু একটি অংশ বা ক্লিপ দিয়ে রাবারের থলিতে আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে সাকশন এর মাধ্যমে পুরা থলিটাই কালি দিয়া ভইরা ফালানো হইতো। আমাদের বাসায় একটা পুরানা স্টাইলের কালি কলম দেখছিলাম ( ব্র্যান্ডটা ভুইলা গেছি কিন্তু কলমটার গায়ের গাঢ় আর হালকা ছাই রঙের ছোপছোপ ডিজাইনটা এখনো মনে আছে) যেইটাতে এই রবারের থলিটি ছিলনা। একটা প্লাস্টিকের ড্রপার দিয়া কালির দোয়াত থিকা কালি নিয়া কলমের নীচের বা উপরের প্লাস্টিকের খোলের মধ্যে সরাসরি কালি ভরা হইতো। কালি ভরার পরে প্লাস্টিকের খোলটা ভালো কইরা লাগায়া খোলের গায়ে বা নিবের সাথে লাইগা থাকা কালি একটা কাপড় দিয়া মুইছা টেস্ট করা হইতো কলমের নিব দিয়া কালির বড় কোন ফোটা বাইর হয়া আসে কিনা। তা না করলে লেখার সময় অবাঞ্ছিত কালির ফোটা খাতার উপর পইড়া পুরা লেখারই তেরটা বাইজা যাইতো!

ফাউন্টেন পেনের নিবগুলো ছিল সোনালি বা রুপালি রংয়ের মেটালের একটা ছোট পাতের, যার সামনের অংশে পাতটি আবার চুলের মত সরু-চিকন একটা রেখা বরাবর ভাগ হয়া দুইপাশ থিকাই চিকন হয়া সুচালো একটা মাথায় মিলিত হইতো। এই সূচালো মাথায়, পাতটির দুটি অংশেরই একেবারে শেষ প্রান্তে ছোট্ট দুটি বিদ একসাথে লাইগা থাকতো। লিখার সময় মেটাল পাতটার সরু বিভক্ত লাইন ধইরাই কালিটা বাইয়া বাইয়া বিডে গিয়া পৌঁছাইয়া কাগজের উপর লিখা আকারে আবির্ভূত হইতো। নিবের মাথার এই বিডটা ভাইঙা গেলে ঐ নিব আর ব্যবহার করা যাইতোনা। নিবের নীচে কালোমতো একটা ‘ঠেস’ নিবটারে জায়গায় ফিক্সড কইরা রাখতো।এই ঠেসটা নড়বড়ে হয়া গেলে বা ভাইঙা গেলে বা নিবটা জায়গা থিকা সইরা গেলে ভিতর থিকা কালি চুয়াইয়া পইড়া খাতার কাগজ ও লিখারে নোংরা কইরা ফালাইতো। মোটামুটি দুইভাবে নিবগুলারে ডিজাইন করা হইতো- একটা ডিজাইনে নিব এর চওড়া চ্যাপ্টা অংশসহ কালো ঠেস এর বেশির ভাগ অংশই প্লাস্টিকের খোলের বাইরে উন্মুক্ত হয়া থাকতো- পাইলট বা শেফার্ড কলমে এমন দেখছি। আরেকটা ডিজাইনে কলমের নিব আর কালো ঠেসটার বেশির ভাগ অংশই উপরের প্লাস্টিকের খোলের ভিতরে থাকতো- নিবের চিকন চকচকে মাথাটাই শুধু বাইর হয়া থাকতো। ‘ইউথ’ আর ‘উইংগ সাংগ’ কলমে নিবের ডিজাইন অনেকটা এইরকমই ছিল।

আমাদের এক্কেবারে ছোটকালে কোন অনুষ্ঠানে, জন্মদিনে, বিয়েতে বা পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো করলে ‘ফাউন্টেইন পেন’ উপহার দেবার প্রচলন ছিল। এইরকম অনেক উপহারের ‘ইউথ’, ‘উইংগ সাংগ’ আর ‘হিরো’ কলম আম্মা আলমারিতে রাইখা দিতেন- বড় হইয়া আমরা ইউজ করতে পারমু এই বইলা। চকচকে সোনালি রংয়ের সুন্দর ডিজাইনের একটা কলমের কথা মনে আছে যেইটার ক্যাপসহ নিচের খোল পুরাটাই ছিল উজ্জ্বল সোনালি রংয়ের ছোপছোপে ডিজাইনের ( সম্ভবত ‘উইং সাংগ’ এরই আরেকটা ভ্যারাইটি- ক্লিয়ার মনে নাই)। কলমটা মনে হয় কেউ আমাদের উপহার দিসিল। আম্মারেও কয়েকদিন ঐ কলমটা ইউজ করতে দেখছি-লেখার কোয়ালিটিও মনে হয় ভালো ছিল। আমার চাইতে বড় ছিল বইলা উপহারের কলমগুলা মিজান ভাইয়াই বেশি ইউজ করছে। অনেক সময় আম্মা নিজেও আমাদের নোট করার জন্য এই কালিকলমগুলা ব্যবহার করতেন। কয়েকটা কলম আম্মা আমার খালাদেরও দিয়া থাকতে পারেন। আমার নিজের সময়ে আইসা ঐ ‘উপহার’ এর কলম আর বেশি হাতে পাই নাই। ‘ইউথ’ কলমের কালো, গাঢ় সবুজ বা সায়ান কালারের প্লাস্টিকের খোলের নিচের দিকটা একটু গোলমত ওভাল শেইপের হইতো। এই কলমের নিব আর ক্যাপটাও ছিল রুপালি। রঙিন প্লাস্টিকের খোলের উপর রুপালি রংয়ের ক্যাপ এর এই ডিজাইনটা একটু শৈল্পিক লাগতো বইলা ‘৮৬ সালে পুরান ঢাকার বাবুবাজারের জনতা লাইব্রেরি থেকে ২০ টাকা দিয়ে জীবনের প্রথম যে ফাউন্টেইন পেনটা কিনি সেটাও ছিল গাঢ় সায়ান কালারের একটা ‘ইউথ’ কলম। অন্যদিকে ‘উইংগ সাংগ’ কলমের প্লাস্টিকের খোলগুলো ছিল একটু মোটা- কালো বা মেরুন রংয়েরই বেশি হইতো। নিব বা ক্যাপ হইতো সোনালি রংয়ের। মাঝেমাঝে কলমের নিচের খোলের শেষ মাথায় সোনালি রংয়ের ছোট্ট একটা লাইনিং থাকতো, আর উপরের খোলের কলম ধরার জায়গাটা একটু খাজের মত থাকতো-এতে ধরতে সুবিধা হইতো। ভাইয়া এই কলম দিয়াই বেশি লিখতেন । ‘উইং সাংগ’ কলমের কোয়ালিটি বা স্থায়িত্ব ‘ইউথ’ কলমের চাইতে সামান্য ভালো ছিল বইলা দামটাও সবসময় ৫ টাকা বেশি পড়তো। এই রকম একটা মেরুন রংয়ের ‘উইং সাংগ’ কলম আমার প্রথম ‘ইউথ’ কলম কিনার কিছুদিন পরেই ঐ জনতা লাইব্রেরি থিকাই ২৫ টাকা দিয়া কিনা কালেকশন বাড়াইছিলাম। এই দুইটা কলম দিয়াই ক্লাস ফোর এর দিকে আমার ফাউন্টেইন পেনে লিখা শুরু হয়। এর কিছুদিন পরে ৪০ বা ৫০ টাকা দিয়া একটা ইন্ডিয়ান ‘হিরো’ কলমও কিনি। এইটার লিখাও অনেক সুন্দর হইতো। যাই হোক জীবনে প্রথম ‘পাইলট’ কলম ব্যবহারের সুযোগ হয় ক্লাস ফাইভে। ক্লাস ফোরের পরীক্ষার রেজাল্টের পর আব্বা মনে হয় আমার পিড়াপিড়িতেই ১০০ না ১৫০ টাকায় একটা কালো রংয়ের প্লাস্টিকের বডি আর সোনালি ক্যাপ এর পাইলট কলম কিনা দেন। এইটা আমার খুব পছন্দের কলম ছিল যেইটা দিয়া আমি নোট করতাম, হোমওয়ার্ক করতাম। মাঝেমাঝে পরীক্ষার সময়ও কলমটা ব্যবহার করতাম। পরে মনে হয় ক্লাস সিক্সের শেষদিকে হাত থিকা পইড়া গিয়া কলমের বাইর হয়া থাকা নিবটা একেবারে ভাইঙা যায়। ভাঙা কলমটা অনেকদিন স্মৃতি হিসেবে রাইখা দিসিলাম।বলপেনের দাপটে একসময় ঐ পাইলট কলমের কথাও ভুইলা যাই।

আগেই বলেছি ফাউন্টেইন পেন এ লিখা অনেক সুন্দর হইলেও কলমের কোয়ালিটি ভালো না হইলে কালি লিক কইরা কাগজের উপর পইড়া পুরা লেখাটাই বরবাদ কইরা দিতো। শার্ট বা প্যান্টের পকেটে রাখলে মাঝেমাঝে কালি বাইর হইয়া জামা কাপড়ের সর্বনাশ হয়া যাইতো। এই বিপদ অবশ্য বাজারের প্রচলিত কোন কোন বলপেনেও হইতো। কালি কলমের কালি ধুইয়া ফালানোর চান্স থাকলেও বলপেনের কালি মোটামুটি স্থায়ী হয়া বইসা থাকতো। যাই হোক ফাউন্টেন পেনের আরেকটা প্রধান অসুবিধা ছিল ভুল কইরা হাত থিকা পইড়া গেলে কলমের নিবটা বাঁইকা যাইতো বা ভাইঙা যাইতো। বাঁইকা যাওয়া নিবটারে তখন চিমটা দিয়া একটু চাপ দিয়া সোজা কইরা লিখার উপযোগী করা হইতো। কিন্তু নিবের মাথার গোলমত ছোট বিডটা ভাইঙা গেলে ঐকলম আর ব্যবহার করা যাইতোনা। মাঝেমাঝে কলমের প্লাস্টিক এর খোলটাও ফাইটা যাইতো। তখন কোন পুরানা কোন নষ্ট কলমের ভালো খোল দিয়া ঐটারে রিপ্লেইস করা হইতো। এই জন্য কোন কারণে একটা কালি কলম ব্যবহারের অযোগ্য হইয়া পড়লেও বা কোন অংশ ভাইঙা পড়লেও ঐটারে রাইখা দেয়া হইতো যাতে ভবিষ্যতে ঐটার কোন পার্ট রে কাজে লাগানো যায়। এইভাবে অনেক সময় পুরানা কলমের বিভিন্ন পার্ট জোড়া লাগায়া শর্টকাটে একটা নতুন কলমও তৈরি হইয়া যাইতো।

এখন দেখি এই ফাউন্টেন পেনগুলাতে কীধরনের কালি ব্যবহার করা হইতো। মাইজদিতে থাকতে ‘ডিয়ার’ আর ‘ডায়মন্ড’ নামে দুইটা দেশি ব্র্যান্ড এর কালির প্রচলন বেশি দেখছি। ‘ইউথ’ কালিও মাঝেমাঝে ব্যবহার হইতো কিন্তু এর দাম ছিল একটু বেশি। একটা ছোট খাটো চারকোণা পুরু কাচের বোতল বা দোয়াতের এর মধ্যে কালো বা রয়েল ব্লু কালারের তরল কালি ভরা থাকতো আর দোয়াতের মুখে কালো বা নীল রংয়ের একটা শক্ত স্ক্রু-ক্যাপ টাইট কইরা লাগানো থাকতো। মুখ খোলা রাখলে কালির পানি আস্তে আস্তে উইড়া গিয়া দোয়াতে মাঝেমাঝে তলানি পড়তো। তাই কালি ভরার আগে ভালো কইরা দোয়াতটা ঝাঁকাইয়া নেয়া হইতো। দোয়াতের কালি বেশি শুকায়া গেলে মাঝে মাঝে পানি যোগ কইরা কালির পরিমাণ বাড়ানো হইতো। পানির পরিমাণ আবার বেশি হয়া গেলে কালিটা আবার একটু হালকা হয়া যাইতো। সেই সাথে কলমের লেখাও একটু হালকা হয়া যাইতো। এই অবস্থায় কালিটা শুধু ঘরের রাফ খাতায় লেখার কাজে ব্যবহার করা যাইতো। কিন্তু নোট করতে হইলে বা পরীক্ষা থাকলে নতুন কইরা আবার কালির দোয়াত কিনতে হইতো। ‘ডিয়ার’ কালির রং কালো ছিল আর এইটার দামও ছিল সবচাইতে কম । সেই তুলনায় ‘ডায়মন্ড’ কালির কোয়ালিটি একটু বেটার ছিল আর এই কালি ‘কালো’ আর ‘রয়েল ব্লু’ দুই রংয়েরই হইতো। আম্মা-খালাদের এই ‘ডায়মন্ড’ ব্র্যান্ডের কালিই বেশি ইউজ করতে দেখছি। পরে ভাইয়ারেও এই দুইরকমের কালিই ব্যবহার করতে দেখছি। ভাইয়া আবার মাঝেমধ্যে ‘ ইউথ’ ব্র্যান্ডের ‘ব্লু-ব্ল্যাক’ কালি দিয়াও লিখতেন।কিন্তু ‘ইউথ’ কালি বিদেশি বইলা দাম একটু বেশি আসিল তাই সবসময় ঐটা ইউজ করা সম্ভব হইতোনা। আমার নিজের কাছে ‘রয়েল ব্লু’ কালিই বেশি ভালো লাগতো। সাদা খাতার উপর ‘রয়েল ব্লু’ কালিটাই বেশি ফুইটা উঠতো- কালো বা ব্লু-ব্ল্যাক কালি অত ভাল্লাগতোনা। আম্মাও আমাদের নোট লেখার সময় নীল রংয়ের কালিই বেশি ইউজ করতেন। বাসায় এই দুই-তিনটা কালারের কালির বাইরে অন্য রংয়ের কালি খুব একটা দেখি নাই। পরে মাইজদি পিটিআই স্কুলে ভর্তি হইলে স্যারদের কাছে ‘ডায়মন্ড’ ব্রান্ড এর সবুজ আর লাল রংয়ের কালিও দেখছিলাম। মিজান ভাইয়াও একবার ‘ডায়মন্ড’ একটা সবুজ রংয়ের কালি কিনা আনসিলেন। সেই সবুজ কালিতে লিখা কিছু খাতা আর নোট এর স্মৃতি আজও মনে পড়ে। হাতের লিখা খারাপ হইয়া যাইবো বলে ক্লাস থ্রি’র আগে কালি কলম ব্যবহারের অনুমতি পাই নাই। কিন্তু ঐ রংবেরংয়ের কালি দিয়া লিখার লোভ কোনদিন সামলাইতে পারি নাই। শুরুর দিকে লুকায়া লুকায়া খালাদের খাতার মধ্যে উনাদের কালি কলম দিয়া দাগ টাইনা দেখছি কেমন লাগে-অর্থপূর্ণ কিছুই হইতোনা কিন্তু কলম দিয়া দাগ টানতে পারসি এইটা ভাইবাই অনেক মজা লাগতো। কলম দিয়া দাগ টানার সময় কেউ দেইখা ফালাইলে হাত থেকে কলমটা সরায়া ফালাইতো-মনটা অনেক খারাপ হইতো তখন। ক্লাস থ্রিতে ঢাকায় আসার পর যখন কালি কলম ব্যবহারের অনুমতি পাই তখন দেখলাম যে ঢাকায় মাইজদির ওই ‘ডিয়ার’ বা ‘ডায়মন্ড’ ব্র্যান্ড এর কালি পাওয়া যায়না। মাইজদি ছাইড়া আসার সাথে সাথে এই কালি দুইটাও যেন জীবন থিকা একরকম হারায়া যায়। কিন্তু সাদা-কালো কাগজের প্যাকেটে ‘ডিয়ার’ কালির আর সাদা-নীল কাগজের প্যাকেটের ‘ডায়মন্ড’ কালির দোয়াতের কথা স্মৃতির পাতা আজও ধইরা রাখসে। যাই হোক ঢাকায় আইসা মূলত ‘ইউথ’ এর ‘রয়েল ব্লু’ কালি দিয়াই আমার ফাউন্টেন পেনে লিখা শিরু হয়। মাঝে মাঝে ‘ইউথ’ এর কালো কালিও ব্যবহার করতাম। ক্লাস এইট নাইনের দিকে ফাউন্টেন পেন দিয়া যখন শুধু নোট করতাম তখন কয়েকবার ‘প্যালিক্যান’ এর কালো বা নীল রংয়ের কালিও ইউজ করসিলাম। আমার হাতের লেখা মোটামুটি সুন্দরই ছিল ছিল ঐ সময় - ক্লাসের ‘দেয়াল’পত্রিকা লিখা, নামডাকার খাতায় ছাত্রদের নাম উঠানো বা পরীক্ষার রিপোর্ট কার্ড লিখার দায়িত্ব ক্লাসে মোটামুটি আমারেই দেয়া হইতো। জীবনে অনেক রকম কলম আর কালি ব্যবহার করছি কিন্তু ‘পাইলট’ কলম আর ‘প্যালিকেন’ এর নীল কালির কম্বিনেশনে ধবধবে সাদা কাগজে হাতের লেখা যেভাবে ফুইটা উঠতো- নিজের লিখা আর কিছুতেই এর চাইতে সুন্দরভাবে পাই নাই! ক্লাস থ্রি-ফোরের দিকেই আস্তে আস্তে ইকোনো, রাইটার এই বলপেনগুলা বাজারে আইসা পড়ে এবং আরও কিছু পরে উন্নত মানের জেল পেন আইসা ফাউন্টেন পেন এর ভাত পুরাপুরি মাইরা দিল। আজকের দিনেতো কলম দিয়া লেখাই উইঠা যাইতেছে- ফাউন্টেন পেন তো এখন ইতিহাস! কিন্তু আমার কাছে এখনো মনে হয় ফাউন্টেন পেনে হাতের লেখার প্রকৃত সৌন্দর্য ও শৈল্পিক উপস্থাপন যেভাবে সম্ভব হইতো আজকের দিনের বলপেন বা জেলপেনে অতটা ‘শৈল্পিকতা’ তুলে ধরা বোধ হয় সম্ভব না।

বলপেন-শীষকলম-জেলপেন
আগেই বলছি ছোটবেলায় মামা-খালাদের ফাউন্টেন পেনেই লিখতে দেখছি বেশি। তবে মাঝেমাঝে উনারা দুই-একটা বলপেনও ইউজ করতেন, মূলত নিউজপ্রিন্টে লিখার জন্য। ওয়ান-টাইম ইউজ বলপেন তখনো বাজারে আসে নাই। উনারা উনাদের বলপেনগুলারে বলতেন ‘শীষ’ কলম। প্লাস্টিকের শক্ত একটা খোলের ভিতর চিকন-লম্বা বলপেনের কালির একটা ‘শীষ’ থাকতো। ঐ শীষটার কালি শেষ হয়া গেলে খালি শীষটা ফালায়া দিয়া নতুন কইরা একটা শীষ ভইরা ব্যবহার করা যাইতো। বাজারে আলাদা কইরা বলপেনের শীষ এর পাতা মোটামুটি সস্তায় পাওয়া যাইতো। দেশিয় কয়েকটা সস্তা শীষ কলম চোখে পড়লেও উনাদেরকে বিদেশি কালো বা নীল রংয়ের ‘রেডলিফ’ কলমেই বেশি লিখতে দেখছি। এই কলমের দাম একটু বেশি হইলেও ‘কোয়ালিটি’ অনেক ভালো ছিল। মোটামুটি তাড়াতাড়ি লিখা যাইতো, লিখা বেশি মোটা হইতোনা আবার কালিও খুব একটা ছড়াইতোনা। এই কলমের রিফিল শীষ এর পাতাও কমদামে পাওয়া যাইতো। এই ‘রেডলিফ’ কলম পরবর্তীতে আমিও অনেক ব্যবহার করছি।

৮৪-৮৫ সালের দিকেই মনে হয় বাজারে প্রথম দেশে তৈরি ওয়ানটাইম ইউজ ‘ইকোনো’ কলম আসে আর ‘রাইটার’ কলম আসে সম্ভবত ৮৬ সালের দিকে। ৮০’র দশক এর মাঝামাঝি হতে পুরা নব্বই দশক এর শেষ পর্যন্ত ছিল এই ‘ইকোনো’ ও ‘রাইটার’ কলমের জয়জয়কার।কলমগুলার দাম অনেক সস্তা হওয়ায় (মাত্র তিনটাকা)আর রাস্তার পাশের টংয়ের দোকানেও পাওয়া যাইতো বইলা শুধু ছাত্রছাত্রীই না সর্বশ্রেণির মানুষের কাছেই সাধারণ ব্যবহারের কলম বলতে ছিল এই ইকোনো বা রাইটার কলম। আমার প্রথম ইকোনো কলমটা ছিল নীল রংয়ের-৮৫ সালে মনে হয় দুই বা আড়াই টাকা দিয়া কিনসিলাম। নীল প্লাস্টিকের কলমটার দৈর্ঘ্য বরাবর ছয়টা ধারে ছয়টা লম্বা সাদা লাইন এর ডিজাইনের এইরকম কালারফুল কলম আগে কখনো দেখি নাই। এই রকম লাল, সবুজ, হলুদসহ আরও কয়েক কালারের ইকোনো কলম পাওয়া যাইতো যা আমি শুরুর দিকে খুব মনোযোগ দিয়া কালেক্ট করতাম। পরে অতিরিক্ত সহজলভ্য হয়া যাওয়ায় আলাদা কইরা আর কালেকশনের দরকার পড়ে নাই। এই কলমগুলো আমরা নিউজপ্রিন্ট বা হোয়াইট প্রিন্ট সবধরনের কাগজেই নিত্যদিনের লেখায় ব্যবহার করতাম। স্কুলে ক্লাস সিক্স সেভেনের দিকে এই ইকোনো বা রাইটার পেন দিয়া আমরা ক্লাসের টেবিলের উপর নিজেদের উদ্ভাবিত ‘কলম-ফাইট’ খেলতাম। কেরামের গুটির মত আঙুল দিয়ে টোকা দিয়া একজন আরেকজনের কলমরে টাচ করার ট্রাই করতাম। যে তার কলমের ক্যাপের মাথা দিয়া আরেকজনের কলমের বডিতে সরাসরি বা ৯০ ডিগ্রি কোনে হিট করতে পারতো সেই জিততো।এই কলমগুলা দিয়া শুরুর দিকে লেখা একটু স্লো হইলেও মাঝখানে লেখার স্পিড বাইড়া যাইতো কিন্তু শেষের দিকে কলমগুলো একটু ‘কালি-বমি’ করতো বইলা পরীক্ষার সময় আমি অত ব্যবহার করতাম না। আমার কাছে লিখা চিকন হয় কিন্তু তাড়াতাড়ি লিখা যায় এরকম কোয়ালিটির বলপেনই বেশি ভাল্লাগতো। মাঝেমাঝে দুইএকটা চিকন মাথার ইন্ডিয়ান ল্যান্সার বলপেন এদিক সেদিক থিকা পাইতাম-ঐগুলার কোয়ালিটিও ভালো ছিল। কিন্তু কলমগুলা অত সহজলভ্য না হওয়ায় বা শেষ হয়া গেলে রিফিল করা যাইতোনা বইলা পরীক্ষার সময় ‘রেডলিফ’ বলপেনেই আমার আস্থা ছিল বেশি। এই রেডলিফ কলম দিয়াই আমি আমার মেট্রিক আর ইন্টার পরীক্ষা দিসিলাম।

৮০-৯০ এর দশকে মেঝ নানা আমেরিকা থিকা আসার সময় বিক, পেপার ম্যাট, স্ট্যাড্টলার এইধরনের অসংখ্য ওয়ানটাইম ইউজ কলম নিয়ে আসতেন।উনার লম্বা আত্মীয়ের লিস্ট এ আমরাও ভাগেযোগে ৪/৫ টা কলম পাইতাম। বিদেশি বইলা এগুলারে যদিও একটু যত্ন কইরা রাইখা দিতাম কিন্তু লেখা একটু মোটা এবং স্লো হইতো বইলা আমার লিখতে অত ভাল্লাগতোনা। একবার একটা বলপেন পাইছিলাম যেইটার মধ্যে কালো, নীল, সবুজ, আর লাল চার কালারেরই শীষ ছিল। এইরকম বাহারি কলম উপহার পাইলে পোলাপাইনরে দেখানোর জন্য ক্লাসে নিয়া যাইতাম। উনার কাছ থিকা কিছু লাল, নীল, সবুজ আর কালো রংয়ের সাইনপেনও পাই যেগুলা পরীক্ষার সময় হাইলাইট করার জন্য ব্যবহার করতাম। ক্লাস ফাইভের দিকে নানা মনে হয় ‘পাইলট’ এর কালো আর নীল রংয়ের কয়েকটা জেল পেন আমারে দিসিলেন।বলপেনের মত স্টাইল কিন্তু লিখা হয় ফাউন্টেইন পেনের মত এজাতীয় কলম তখনো ঢাকায় খুব একটা দেখি নাই। এই রকম একটা নীল রংয়ের জেলকলম দিয়াই আমি ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিসিলাম এবং এরপরে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি পরীক্ষার সময়ও ঐ কলম ব্যবহার করি। দু:খ লাগছিল অনেক কলমটা যখন শেষ হয়া যায়। সে দু:খ কিছুটা মিটে যখন ক্লাস সিক্স এর দিকে আমরা পুরান ঢাকার সৈয়দ হাসান আলী লেনে বাসা শিফট করি। ঐ এলাকায় ছিল বড় বড় প্রেস, খাতা বাইন্ডিং এর কারখানা, আর ছিল খাতা-কলম আর স্টেশনারির বড় বড় দোকান। এর পাশেই ছিল নয়াবাজারের কাগজ মার্কেট। এখান থিকাই মূলত সারা বাংলাদেশে কাগজ, খাতা, কলম, পেন্সিল আর অন্যান্য স্টেশনারি দ্রব্য সরবরাহ করা হইতো।বাড়ির নিচেই এরকম একটা বিশাল মার্কেট থাকায় কলম, পেন্সিল, লিড পেন্সিল, সাইনপেন, জ্যামিতিবক্স, রুলার ও অন্যান্য স্টেশনারি কিনতে আমারে কোনদিন নিউমার্কেট, নীলক্ষেত বা বাংলাবাজারে যাইতে হইতোনা।এই সৈয়দ হাসান আলী লেন থিকাই ৮৮ সালের শেষদিকে ৩৫ টাকা দিয়া জীবনের প্রথম ‘পাইলট’ এর একটা নীল রংয়ের জেল পেন কিনি। তখনকার দিন হারে কলমটার দাম বেশি ছিল বইলা নরমাল বলপেন বা ফাউন্টেনপেনেই আরও কিছুদিন আস্থা রাখসিলাম। তারপরও সুযোগ পাইলেই বাসার নিচের দোকানগুলাতে গিয়া একটু আনকমন জেলপেন বা সাইনপেন কিনা আনতাম। ৯০ এর দশকের শেষ দিকে বাজারে সস্তায় ইন্ডিয়ান বা চাইনিজ জেলপেন এমনকি ইউনিবল বা পাইলটের জেলপেনও অনেক সহজলভ্য হয়ে পড়ায় কলমের প্রতি আগের আকর্ষণ অনেকাংশেই কইমা যায়। এখনতো চাইলেই নিজের ইচ্ছামত নানা রংয়ের নানা ডিজাইনের বলপেন, জেলপেন কিনতে পারি। কিন্তু শৈশবের মত কলম নিয়া সেরকম উত্তেজনা আর পাইনা!

মোটামুটি বলা যায় চোখের সামনেই দেখছি ফাউন্টেইন পেন একসময়কার রমরমা অবস্থা কিভাবে বলপেন এবং নানারকমের জেলপেনের সহজলভ্যতায় ও ব্যবহারে ক্রমশ হতদরিদ্র হয়া পড়ে। বর্তমান প্রজন্মের অনেকে আদৌ জানেইনা ফাউন্টেন পেনই ছিল এক সময়ের লিখার প্রধান মাধ্যম। আসলে প্রযুক্তির উন্নয়নে আজকালকার পোলাপানরা লেখাপড়ার বেশির ভাগইতো তো করে কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেটে। খাতা-কাগজে লিখার প্রবণতাও কইমা আসছে-হয়তো একসময় ফাউন্টেন পেনের মত এগুলাও অতীতের একটা বিষয় হয়া দাঁড়াইবো। কে জানে!

আপনার মন্তব্য