শৈশবের কোরবানির ঈদ: দাদার বাড়ির স্মৃতি

 প্রকাশিত: ২০২০-০৮-০৭ ০৩:০৬:২৬

ড. মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী:

গত ৩১ জুলাই কানাডার মন্ট্রিয়ালে প্রবাস জীবনের ১৪ তম কোরবানির ঈদ পালন করলাম। প্রতিবারের মত এবারো কোরবানি দেশে দিয়েছি বলে কোরবানি দেয়া সংক্রান্ত বিশেষ কোন কর্মকাণ্ড ছিলনা এখানে। প্রবাসে স্ত্রী, ছেলে, নিজ পরিবারের একাংশ-ছোট ভাই ও তার বউ আর শ্বশুর কুলের মা, বাবা, ভাই-ভাবি আর বাচ্চাদের নিয়ে কোরবানির ঈদের দিনটা সীমিত পরিসরে হলেও বেশ ভালোই কেটেছে। এবার ঈদের দিন ছিল শুক্রবার-ওয়ার্কিং ডে। অফিসের কাজ ছিল, ছুটি নেবার সুযোগ ছিলনা দুপুর পর্যন্ত। তারপরও সকালে অফিসের মিটিং এর ফাকেই আমি আর ছোট ভাই মাহী জামাতে ঈদের নামাজ সেরে ফেলি। দুপুরের পর অফিস শেষ করে আগের রাতে সহধর্মিণীর রান্না করা মজার তেহারি খেয়ে বাসার সামনে ছোটখাটো ঈদ ফটোসেশন শেষ করে সবাই মিলে শ্বশুর বাড়ি অভিমুখে রওনা দেই। ওখানে শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাই, ভাবি আর বাচ্চাদের সাথে আনন্দঘন সময় পার করে বিকেলের দিকে ঈদের গ্র্যান্ড খাওয়াদাওয়া সম্পন্ন করি। এরপর রাতের দিকে শ্বশুর বাড়ির পাট চুকিয়ে এক বন্ধুর বাসায় একটু আনন্দময় সময় কাটিয়ে বাসায় চলে আসি। অন্যসময় হলে ঈদের দিন মোটামুটি ৬/৭ টা বাসায় ঢুঁ মারা হত, সাথে ঈদের নানান রকম খাবারে উদরপূর্তি করে দিনটাকে মহিমান্বিত করার সুযোগ থাকতো। কিন্তু কোভিডের কারণে এবার তা সম্ভব হয়নি। তাই ফোনে বা টেক্সটে সবার সাথে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করেই এবারের ঈদের ইতি।

দিন শেষে বাসায় আসার পরে হঠাৎ করে ছোটবেলার কোরবানি ঈদের কথা মনে পড়ে গেল। বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো! মন চলে গেল ৩০-৩৫ বছর আগে দাদার বাড়িতে কোরবানি ঈদ উদযাপনের দিনগুলোতে! বাড়িতে যাবার স্মৃতি, দাদার বাড়ির পরিবেশ, বাড়িঘর, খাওয়া-দাওয়া, ঈদের দিন সহ ঈদের আগে-পরের কয়েকটা দিনের স্মৃতি সব যেন একসাথে চোখের সামনে এসে ধরা দিল!

ছোটবেলায় জ্ঞানবুদ্ধি আসার পর থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত যতদিন দাদা-দাদু বেঁচে ছিলেন আমাদের একটা নিয়ম ছিল যে রোজার ঈদ মাইজদিতে নানুর বাসায় করা হবে আর কোরবানির ঈদ বিরাহিমপুর ইয়ার বাড়িতে দাদা-দাদুর সাথে। ৮৫ সাল পর্যন্ত মাইজদি থাকায় কোরবানির ঈদের সময় আমরা সবাই মাইজদি হতেই রায়পুর-মাইজদির লোকাল বাসে চেপে বিরাহিমপুরে দাদার বাড়িতে যেতাম।ঢাকায় আসার পরও প্রথম দুবছর সে ধারা অব্যাহত থাকে। কোরবানির ঈদের সময় এলে আমরা প্রথম ঢাকা হতে মাইজদিতে গিয়ে দু-একদিন থাকতাম, তারপর সেখান থেকে বাড়িতে যেতাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ৮৬’র শেষদিকে দাদা-দাদু দুজনেই পরপর মারা যাওয়ায় ঐ বছরই দাদা-দাদুর সাথে বাড়িতে আমাদের শেষ কোরবানির ঈদ করা হয়। অনেক ছোট থাকলেও বাড়ি যাবার সময়ের আর বাড়িতে ঈদের আগে ও পরের টুকরা টুকরা কিছু স্মৃতি এখনো বেশ সতেজ আছে!

দাদার বাড়ি যাত্রার পূর্ববর্তী কিছু জড়তা
গ্রামের বাড়ির প্রতি বা দাদা-দাদু, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি টান-ভালোবাসায় কোন কমতি না থাকলেও দুএকটা কারণে ছোটবেলায় বিরাহিমপুরে দাদার বাড়িতে রওনা দেবার আগে কেমন যেন একধরনের জড়তা হতো-তাও মূলত আমাদের ভাইদের মাঝে। প্রথমত: মাইজদি হতে জকসিন পর্যন্ত রাস্তা মাত্র ৩২ কিলোমিটার হলেও কোন এক্সপ্রেস বাস ছিলনা। ফলে লোকাল বাস বা মুড়ির টিন ছাড়া আমাদের আর কোন গতিই ছিলোনা। এই বাসগুলোতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ছিল মোটামুটি ভয়ংকর। রাস্তার অবস্থা ছিল শোচনীয়। মোটামুটি একটা গাড়ি যেতে পারে এরকম চিকন পিচ ঢালা রাস্তা-তাও নানা জায়গায় কার্পেটিং উঠা আর বড় বড় সব গর্ত! উল্টা দিক হতে আরেকটা গাড়ি আসলে দুইটা গাড়িই বামে বা ডানে অনেকটাই কাত হয়ে একটা আরেকটাকে পাস করতো আর গাড়ির ভেতর থেকে আমাদের সবার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার যোগাড়! মাইজদি থেকে জকসিন পর্যন্ত মাইজদি বাজার, এখলাসপুর, চৌরাস্তা, বেগমগঞ্জ, বাংলাবাজার, হাজির পাড়া, বটতলি, মান্দারির রেগুলার বাস স্টপেজে বাসটাতো থামতোই, আবার একটা লম্বা সময় ধরেও বসে থাকতো যাত্রী উঠানোর জন্য। বাসের ভিতরের সবগুলো সিট, মাঝখানের আইল ভরে যাবার পরও ছাদের উপর বা বাসের পিছনে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী ভরানোর আগ পর্যন্ত বাসটির নড়াচড়ার কোন লক্ষণ দেখা যেতনা। এর বাইরে কয়েক মিনিট পরপর এখানে সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী উঠানো-নামানো ছিলো মোটামুটি রেগুলার ঘটনা। তো এই রাস্তার ঝাঁকুনি, কিছুক্ষণ পরপর গাড়ির থামা আর চলা, সেই সাথে গাড়ির ভিতরে মানুষের গাদাগাদি, কন্ডাক্টরের সাথে যাত্রীদের ভাড়া নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি, সিগারেট আর ডিজেল পোড়া গন্ধে বাসে চড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মাথা মোটামুটি গুলিয়ে আসতো। যাত্রার কোন না কোন পর্যায়ে বমি হওয়া ছিল অবধারিত-মাঝে মাঝে বেশ কয়েকবার। তাই পরের দিকে গাড়িতে উঠার আগেই আব্বা আমাদের সবাইকে অ্যাভোমিন খাইয়ে দিতেন। আর আমরাও মোটামুটি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ আর খোলা রাখা-এরকম করেই পার করতাম এই পুরো বাস জার্নিটা। জানালার দিকে আম্মা বসতো, বেশি খারাপ লাগলে বাতাস খাবার জন্য মাঝে মাঝে উনার পাশে বা কোলে গিয়েও বসতাম। এত কিছু করেও অনেক সময় শেষ রক্ষা হতোনা-জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিয়ে হড়হড় করে সব বের করে দিতাম-কয়েক দফায়! শরীর খারাপ লাগতো, কিছুই ভালো লাগতোনা। মাইজদি থেকে জকসিন পর্যন্ত মোটামুটি ঘণ্টাখানেকের রাস্তায় সব মিলিয়ে প্রায় তিন-চার ঘণ্টার মত লেগে যেত। পুরো পথজুড়ে বমি বা মাথাব্যথার ধকলে মোটামুটি অর্ধজ্যান্ত অবস্থায় সবাই জকসিনে বাস হতে নামতাম। লোকাল বাসের এই দু:সহ স্মৃতির কথা ভেবেই মূলত বাড়িতে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা আতংক কাজ করতো।

বাড়ি যাবার প্রতি শৈশবের আরেকটি জড়তা ছিল যে ঈদের সময় মাইজদি থাকলে আনন্দমেলা সহ ঈদের নানারকম অনুষ্ঠান টিভিতে দেখতে পারতাম। কিন্তু গ্রামে কারেন্ট বা টিভি না থাকায় ঐ অনুষ্ঠানগুলা তো মিস হোত! পরে অবশ্য এর একটা সমাধান হয়- প্রায় সময়ই খালারা আমাদের জন্য ঈদের এই অনুষ্ঠানগুলো ক্যাসেটে রেকর্ড করে রাখতেন। ঈদ শেষ করে মাইজদি ফেরত এলে ক্যাসেট প্লেয়ার চালিয়ে ঈদের ঐ অনুষ্ঠানগুলো শুনতাম।

আরেকটা ছোট্ট অস্বস্তির ব্যাপার ছিল। এটা ছিল একটু প্রাকৃতিক। তখনো বাড়িতে মাইজদির মত সুন্দর কমোড বিশিষ্ট স্যানিটারি ল্যাট্রিন ছিলনা। বাড়ি হতে একটু দুরে অনেকটা জঙ্গলের মধ্যে দুইটা সেমি-স্যানিটারি ল্যাট্রিন ছিল যাতে রাতের বেলা যেতে সত্যিই গা ছমছম করে উঠতো। আর ভেতরে ঢুকার পরের অভিজ্ঞতা এখানে নাইবা বললাম। যদিও আমার চাচাতো-ফুফাতো ভাইদের দেখতাম ওই সেমি-স্যানিটারি ল্যাট্রিনগুলোর ধার না ধরে ডাক এলেই পথে-প্রান্তরে বা গাছ-গাছালি বা ঝোপের ভিতরে খুব একটা সংকোচ ছাড়াই প্রাকৃতিক কর্মটি সম্পাদন করে মাটি, আশে পাশের পুকুর বা খাল পাড়ের পানির ব্যবহারে শুচি অর্জন করতেন! কিন্তু বিষয়গুলোতে খুব একটা অভ্যস্ততা বা আগ্রহ না থাকায় বাড়িতে রওনা দেবার আগে আগে এক ধরনের ঋণাত্মক অনুভূতি তৈরি হত। বাড়ি যাবার ব্যাপারে শুরুতে অনেক উত্তেজনা থাকলেও ঠিক যাওয়ার দিন সকাল থেকে আমাদের ভাইদের মন কেমন যেন বিষাদে ভরে উঠতো। গড়িমসি শুরু করতাম, এবার না গিয়ে পারা যায় কিনা-বিশেষ করে ঐ ভয়ংকর বাস জার্নি এড়ানো যায় কিনা। আব্বাকে বলতাম-‘এই বার আমরা না যাই’ বা ‘একবার না গেলে কি হয়’-এইসব! কিন্তু এসব আহাজারিতে কোন রেখাপাত হতোনা আমার কঠিন-হৃদয় আব্বাজানের! বিরস বদনে নানুর বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অবশেষে সেই লোকাল বাসেই চড়তে হত। যাই হোক যাত্রা শুরুর আগের এই জড়তা কিন্তু দাদার বাড়ি পৌঁছানোর পর দাদা-দাদু, চাচা-চাচী, ফুপা-ফুপুর আদর, খাওয়া দাওয়া আর চাচাতো-ফুফাতো ভাই-বোনদের সাথে খেলাধুলার আনন্দে পুরোটাই কেটে যেত!

দাদার বাড়ি যাত্রার প্রথম পর্ব: রায়পুর-মাইজদি লোকাল বাস
রায়পুর-মাইজদির লোকাল বাসটা ছাড়তো মাইজদি পিটিআই স্কুল পেরিয়ে পৌরসভার সামনে শহরের প্রধান বাস স্টেশন হতে। এরপর পুলিশ লাইন, শহীদ ভুলু স্টেডিয়াম, নাপতার পোল পার হয়ে নানুর বাসার সামনে জনতা স’মিলের সামনে এসে বাসটা থেমে আব্বা, আম্মা ও আমাদের তিন ভাই- মিজান ভাইয়া, আমি আর রুমীকে বাসে তুলে নিত ( সর্বকনিষ্ঠ ভাই মাহী তখনো পৃথিবীতে আসেনি)।জানালার পাশে আম্মার কোলে রুমী, মিজান ভাইয়া মাঝখানে আর আব্বার কোলে আমি। অ্যাকসিডেন্টের ঝুঁকি কম বলে আব্বা বাসের বাম দিকেই সাধারণত আমাদের সিট নিতেন। যাই হোক নানুর বাসার পর মাইজদি বাজার ও এখলাসপুরে যাত্রী উঠানোর জন্য অল্প সময়ের জন্য বাসটি থেমে আবার যাত্রা শুরু করে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় এসে পশ্চিম দিকে লক্ষ্মীপুরের দিকে না গিয়ে পূর্বদিকে চৌমুহনী বাজারের দিকে বাঁক নিতো। এরপর করিমপুর রোডে গিয়ে ঘণ্টা খানেকের জন্য স্টার্ট চালু রেখেই বসে থাকতো যাত্রী উঠানোর জন্য।

চৌমুহনীতে এই অপেক্ষার মাঝেই হয়তো দেখা যেত কন্ডাক্টর বা হেল্পারের সাথে সেটিং করে কোন ক্যানভাসার বাসের ভিতরে ঢুকে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বাজারের ‘সর্বনিম্ন’ দামে তার ভাষ্যমতে ’সর্বরোগ-বিনাশী’ এবং ‘সর্বোৎকৃষ্ট’ মলম বা বড়ি অথবা ‘সর্বপোকা-বিনাশী’ দাঁতের মাজনটি বিক্রি করতে। কোন চকলেটওয়ালা হয়তো নাবিস্কো চকলেট বা টফির প্যাকেট হাতে নিয়ে চেষ্টা করছে আমাদের মত বাচ্চা ছেলেমেয়েদের প্রলুব্ধ করতে। কোন কোন বাবা-মা বাচ্চাদের আহবানে সাড়া দিয়ে হয়তো দুই-একটা টফি কিনে দিচ্ছে আবার কেউবা বড় একটা ধমক দিয়ে বিক্রেতাদের বাচ্চাদের সামনে থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। এর মাঝে আবার কোন পাঞ্জাবি পরা হুজুর হয়তো কাঠের একটা দানবাক্স হাতে নিয়ে বাসের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেটে হেটে যাত্রীদের কাছে মসজিদ তৈরির জন্য সাহায্য চাচ্ছে। কোন পান-সিগারেটওয়ালা যাত্রীদের কাছে পান-বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করছে-যাত্রীদের কেউ কেউ সেই সুপারি, জর্দা আর চুন মেশানো আস্ত পান মুখে পুরে নিয়ে পান চিবাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পরপর মনের সুখে জানালা দিয়ে পানের পিক ফেলছে। কেউবা আবার হাতের বিড়ি বা সিগারেট ফটাস করে ধরিয়ে ফেলে মনের সুখে ধোঁয়া ছাড়ছে-সিগারেট পোড়া গন্ধে আর ধোঁয়ায় গাড়ির ভেতরের বাতাসটা অস্বস্তিকর ভারী হয়ে উঠছে। অ্যালুমিনিয়ামের ছোট বাটি বা থালা হাতে কোন ভিক্ষুক হয়তো বাসের জানালা দিয়ে বাইরে থেকে অথবা বাসের ভিতরে ঢুকে যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে। যাত্রীদের কেউ হয়তো ভিক্ষুকের থালায় পাঁচ-দশ পাই বা চার আনা ছুঁড়ে দিচ্ছে। ড্রাইভার সাহেবও আয়েসে একটা সিগারেট ধরিয়ে পান চিবাতে চিবাতে গাড়ির সেটে চালানো গানের তালে তালে পা নাচাচ্ছে। সেইসাথে বাসের হেল্পার সমানে বাসের গায়ে হাত দিয়ে জোরে জোরে বাড়ি দিয়ে বেগমগঞ্জ, বাংলাবাজার, চন্দ্রগঞ্জ, হাজির পাড়া, বটতলী, লক্ষ্মীপুর, দালালবাজার আর রায়পুর বলে বলে পথের যাত্রীদের বাসে উঠার জন্য আহ্বান করছে। কোন কোন যাত্রী আবার ভাড়া নিয়ে বাসের কন্ডাকটরের সাথে জোরে জোরে দর কষাকষি করছে বা তর্ক জুড়ে দিচ্ছে-সবমিলে একটা অস্থির অবস্থা বাসের ভিতরে! বাসের জানালা দিয়ে আমরা করিমপুর রোডের বিভিন্ন রকমের জুতা, কাপড়, ফলের পাইকারি-খুচরা দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এর সাইনবোর্ড, বিড়ি-সিগারেট-জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সহ নানাধরনের বিলবোর্ড দেখতে থাকতাম।বারবার দেখতে দেখতে এই লেখাগুলো একরকম মুখস্থই হয়ে যেত। যাত্রী উঠানোর জন্য এভাবে চৌমুহনীতেই প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে বসে থাকার পর ড্রাইভার সাহেব গদাই লস্করি চালে এক সময় বাসটা ছাড়তেন। এভাবে আস্তে আস্তে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা পর্যন্ত আসার পরেই রায়পুরের উদ্দেশ্যে আসল যাত্রা শুরু হোত।

চৌমুহনী করিমপুর রোড হতে চৌরাস্তায় আসার পথে বাসের জানালা দিয়ে ডেল্টা জুটমিলের হলুদ বিল্ডিংটা চোখে পড়তো। এটা ছিল চৌমুহনীর একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা যা বাসে করে যাবার সময় সবসময়ই চোখে পড়তো। বেগমগঞ্জে বা বাংলাবাজারে এসে বাসটা আবারো স্বল্প সময়ের জন্য থামতো যাত্রী উঠানামার জন্য। বাংলাবাজার দিয়ে যাওয়ার সময় বাস থেকেই রাস্তার ওপাড়ে ডানদিকে কংক্রিটের একটা উঁচু পুল চোখ পড়তো। জানতাম এপথ দিয়েই আমার আলো ভাইয়া-সাহানা আপাদের গ্রামের বাড়িতে যাওয়া যায়( আমার প্রয়াত বড় খালার একমাত্র ছেলে-মেয়ে)। এরপর চন্দ্রগঞ্জ ( পূর্ব ও পশ্চিম) বাজারে এসে বাসটা চৌমুহনির মত আবারো প্রায় ৩০ মিনিট বা ঘণ্টা খানেক বসে থাকতো যাত্রী নেবার জন্য। চন্দ্রগঞ্জ বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় কফিলউদ্দিন কলেজের বিল্ডিং আর মাঠটা চোখে পড়তো আর মনে মনে ভাবতাম আমার মনি নানু ( আমার নানুর ভাই পিন্টু নানার সহধর্মিণী ) কীভাবে মাইজদি থেকে রেগুলার এত ঝামেলা পেরিয়ে এই কলেজে পড়াতে আসেন! যাই হোক চন্দ্রগঞ্জে আরেকটা লম্বা সময় বসে থেকে যাত্রী উঠানোর কাজ সারার পর বাসের গতিশীলতা একটু বাড়তো। পরের স্টপ হাজির পাড়ায় এবং এরপরে বটতলিতেও বাসটি কিছু সময়ের থামতো। বাসের ভেতর হতেই বাইরের মাইকের আওয়াজে শুনতাম হাজির পাড়া বা বটতলি পাকা মসজিদ তৈরির জন্য সাহায্যের আবেদন- কখনো স্বাভাবিক কণ্ঠে আবার কখনোবা সুরে সুরে আল্লাহর ঘরের জন্য সাহায্যের আবেদন। এগুলো ছিল আমাদের শৈশবের বাস জার্নির এক নিত্য দৃশ্য। বটতলির মসজিদটি তৈরির জন্য এই সাহায্য চাওয়া বোধয় আমার শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য পর্যন্তও অব্যাহত ছিল। বটতলি দিয়ে দত্তপাড়া, কাশিপুরে আমার বড় ফুপুর বাড়ি হয়েও বিরাহিমপুরে যাওয়ার একটা রিকশা পথ ছিল। কিন্তু ঐসময় রাস্তাটা অত ভালো না থাকায় বা সময়ও বেশি লাগতো বলে ঐ পথ দিয়ে শীতকালে দুই-একবার ছাড়া খুব কমই যাওয়া হয়েছিল বিরাহিমপুরে।এছাড়া আমাদের সময় মূলত বর্ষাকালে কোরবানির ঈদ পড়তো বলে নৌকা পথের সুবিধার জন্য জকসিন দিয়েই বেশি যাওয়া পড়তো দাদার বাড়িতে। যাই হোক বটতলীর পর মান্দারি বাজারেও বাসটা কিছুক্ষণ থামতো।বাস থেকেই মান্দারি বাজারের সারিসারি রকমারি দোকানগুলো চোখে পড়তো। মান্দারির পর মনে হয় তিন কিলোমিটারের মধ্যেই ছিল জকসিন বাজার। তাই বাস ছাড়ার পরপরই আমরা ব্যাগ-স্যুটকেস গোছানো শুরু করতাম। বসের টিকেটের গায়ে বা ড্রাইভার সিটের পেছনে বাস স্টপের নামগুলো দেখে জকসিনের পরে লক্ষ্মীপুর, দালাল বাজার, বাসাবাড়ি আর রায়পুর (শেষ স্টপ)-এই বাস স্টপগুলোর নামও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঐ আমলে কখনোই অতদূর পর্যন্ত যাওয়ার দরকার পড়েনি। যাই হোক মাইজদি হতে ছাড়ার পর প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা ধরে এই লোকাল বাসে চিড়েচ্যাপটা হবার পরে জকসিনে যখন নামতাম মনে হোত যেন বড় একটা যুদ্ধ জয় করে নামলাম!

দাদার বাড়ি যাত্রার শেষ পর্ব: জকসিন-ইয়ার বাড়ি নৌকা যাত্রা
মাইজদি থেকে বিরাহিমপুরে দাদার বাড়ি যাত্রার শেষ পর্বে জকসিন হতে সরাসরি ইয়ার বাড়িতে যাবার অংশটুকুই ছিল সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়! জকসিন বাজার হতে খাল ধরে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত নৌকা পথের দূরত্ব প্রায় ৫/৬ কিলোমিটারের মত-সময় লাগতো প্রায় ঘণ্টা খানেক। জকসিন বাজারের ছোট ছোট মুদি, চা-পান-বিড়ি-সিগারেট-পরটার দোকানের সারি ধরে একটু আগালেই ডানপাশে খালের উপর ছইওয়ালা নৌকার ঘাট চোখে পড়তো। নৌকার মাঝির সাথে গন্তব্য ঠিক করে হাতের লাগেজ আর ট্রাংক উঠানোর পর আমরাও আস্তে আস্তে নৌকায় চড়ে বসতাম। যে খালটি ধরে নৌকাটি চলতো শোনা যেত লক্ষ্মীপুরের দিকে মেঘনা নদীর সাথে এর সংযোগ ছিল। বর্ষাকালে পানিতে টইটুম্বুর হয়ে উঠতো খালটি-শৈশবের ক্ষুদ্র চোখে অনেক খরস্রোতাই মনে হোত। জকসিনের দিকে খালটি অনেকটাই চওড়া ছিল। আমাদের বাড়ির দিকে খালটি সামান্য সরু হলেও মাঝের কিছু কিছু জায়গায় আবার অনেক চওড়া হয়ে উঠতো। খালের পানি এমন টলটলে পরিষ্কার ছিল যে কোন কোন অগভীর জায়গায় পানির নিচের লম্বা সবুজ গুল্ম, লতাপাতা পরিষ্কার চোখে পড়তো। নৌকা চলার সাথে সাথে আমরা মাঝে মাঝে ছইয়ের ভেতর হতে বের হয়ে এসে নৌকার মাথার উঁচু জায়গাটার সামনে গিয়ে ছই ধরে দাঁড়িয়ে দুইপাশের গাছপালা, গ্রামের ঘর-বাড়ি, পুকুর, গরু-বাছুর দেখতে থাকতাম। নৌকার গতির সাথে ঘরবাড়ির পিছিয়ে পড়ার দৃশ্য ছিল সত্যিই বড় মনো-মুগ্ধকর। কোন কোন জায়গায় হয়তো তীর হতে কেউ খালি হাতে জাল ছুড়ে মারছে, তারপর আস্তে আস্তে জালটা টেনে তুলছে-মুখে চরম উত্তেজনার ছাপ,কী মাছ উঠলো বলে! আবার কোন জায়গায় দেখা যেত খালের দিকে বের হওয়া কোন বাঁশের মাচার উপর ছোট্ট বেড়ার ঘর আর মাচার সামনের দিক হতে V-আকৃতির দুটো লম্বা বাঁশের স্ট্রাকচারের উপর বিশাল বড় জাল পানি হতে বেশ কিছুটা উপরে ঝুলে আছে। ঝুলে থাকা জালটাকে কোন জেলে হয়তো পায়ের কাছের বাঁশের লিভারে আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে খালের পানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে আবার কেউবা আস্তে আস্তে পানিতে ডুবে থাকা জালটা তুলছে-তোলার সময় জালের ভেতরে জ্যান্ত মাছ লাফিয়ে উঠছে। গ্রাম-বাংলার খাল-পাড়ের এই শাশ্বত দৃশ্য এখন চোখে পড়ে কিনা জানা নেই কিন্তু আমার ছোটবেলার কৌতূহলী চোখ এই অভূতপূর্ব দৃশ্য এমনভাবে ধারণ করেছিল যে আজ এত বয়স পেরিয়েও তার ছবি এতটুকু মলিন হয়নি! কোন কোন জায়গায় আমাদের নৌকা হয়তো খালের দুই পাড় সংযোগ করা উঁচু বাঁশের সাঁকো বা কংক্রিটের পুলের তলা দিয়ে যাচ্ছে আর উপর হতে লোকজন কৌতূহলী চোখে দেখছে কে যাচ্ছে নৌকায় করে। পরিচিত লোক হলে পরম আন্তরিকতায় দুচারটা ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছে-কুশলাদি জানছে, কোন বাড়িতে যাচ্ছে বা কবে ফিরা হবে ইত্যাদি।

আবার কোন কোন সময় দেখা যেত খাল পাড়, উঁচু সাঁকো বা পুলের উপর হতে কোন উচ্ছল দুরন্ত শিশু সম্পূর্ণ উদোম হয়ে কিংবা কোন দামাল কিশোর বা তরুণ লুঙির কাছা মেরে খালের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটছে। আজকের যান্ত্রিক যুগে গ্রামগুলোর শহরায়নের ফলে গ্রামের শিশু-কিশোরের এই উচ্ছলতা, দুরন্তপনা আছে কিনা বলা মুশকিল কিন্তু এই সুখ-স্মৃতিগুলোইতো আমাদের শৈশব আর কৈশোরকে জীবন্ত করে রেখেছে আজো পর্যন্ত! অনেক সময় চোখে পড়তো পানির স্রোতের সাথে দ্রুত গতিতে ছুটে যাচ্ছে ছোট ছোট কচুরিপানা আর ভাসমান লতাপাতা। নৌকার পাশ দিয়ে কখনো হাত নামিয়ে পানির স্রোতকে অনুভব করার চেষ্টা করতাম, কখনোবা পরিষ্কার পানিতে পা ডুবিয়ে দুইপাড়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতাম। কোন অগভীর অংশ দিয়ে যাবার সময় অনেক সময় হাতের স্পর্শে আসতো তলার পিচ্ছিল গুল্মলতা-একটু শিরশিরে অনুভূতি হতো আবার অদ্ভুত রোমাঞ্চও টের পেতাম। এই গুল্মলতার মাঝেই একটা বিশেষ বীট জাতীয় গুল্ম ছিল যেটা আবার খাওয়া যেত তাই অনেক সময় ভাইয়া বা আমি কৌতূহলে টেনে তুলে নিয়ে সবাই মিলে খেতাম। নৌকার গতির বিপরীতে প্রচণ্ড স্রোত থাকলে অনেক সময় নৌকায় একটা শক্ত দড়ি বেঁধে পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে নৌকার সামনে থেকে আরেকজন লোক গুনটা টেনে টেনে মাঝিকে সাহায্য করতো, নৌকাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।দুলকি চালে এগ্রাম সেগ্রাম পেরিয়ে নৌকাটি যখন বালাসপুর নোয়াহাটখোলার পুলের সামনে এসে পৌঁছাতো আমরা বুঝতাম বাড়ির একেবারে কাছেই পৌঁছে গেছি। খালের পশ্চিম পাড়ে এই বালাসপুরেই ছিল আমার ছোট ফুপুর বাড়ি। এই নোয়াহাটখোলার পুলের পাশেই সারিবদ্ধ কয়েকটা চা আর মুদি দোকান ছিল। আমরা তাকিয়ে দেখতাম ওখানে আমার ফুফাজি বা ফুফাতো ভাই-আলম ভাই, ভুট্টু ভাই, ইসমাইল ভাই বা বেলাল কাউকে দেখা যায় কিনা। পুল পেরিয়ে সামনে এগোলেই চোখে পড়তো নোয়াহাটখোলা প্রাথমিক স্কুলের রং ছাড়া পাকা বিল্ডিং, এরপর খালের পূর্ব পাড়ে কালা আর মালা দের বাড়ি পার হয়ে প্রধান খাল হতে ডানদিকে একটা সরু শাখা ধরে নৌকাটি ঢুকে পড়তো আমাদের ইয়ার বাড়ির দিকে। অন্যদিকে বড় খালটি উত্তর দিকে আরও অগ্রসর হয়ে পোদ্দার বাজারের চলে যেত। তো এই সরু শাখা খাল ধরে পূর্বদিকে সামান্য এগুলোই আমাদের বাড়ির দরজা। সরুখালটি ওখান থেকে পূর্ব দিকে আরেকটু অগ্রসর হয়ে একবারে আমার নানার গ্রামের বাড়ি দেওয়ান বাড়িতে গিয়ে শেষ হতো। বর্ষাকালে নৌকা বা তালের কোঁদা দিয়ে কয়েকবার এই সরু খাল দিয়েই দেওয়ান বাড়িতে গিয়েছিলাম। যাই হোক আমাদের নৌকাটি দাদার বাড়ির দরজায় পৌঁছানোর পর বাড়ির কাচারি ঘরের সামনে সরু খালটির সাথে লাগোয়া কোন নারকেল গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা হত নৌকাটি। সাথে সাথে বাড়ির ভেতর থেকে আমার চাচারা, চাচাতো ভাইবোনেরা ছুটে এসে কেউ আমাদের ট্রাংক আর অন্যান্য লাগেজ তুলে নিতেন, চাচাদের কেউ এসে আমাদের ভাইদের কোলে তুলে নিতেন। দাদা-দাদু বের হয়ে এসে পরম স্নেহে আমাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। এইভাবে মাইজদি হতে সকাল ৯/১০টার দিকে যাত্রা শুরু করে দুপুর পেরিয়ে প্রায় আসরের নামাজের কাছাকাছি সময়ে দাদার বাড়িতে এসে পৌঁছাতাম।

দাদার বাড়ির দিনগুলো
দাদার বাড়িতে পৌঁছানোর পর হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার করার পর মাটির চুলায় দাদুর রান্না করা টাটকা মাছের বা খোঁয়াড়ের মুরগির ঝাল ঝাল তরকারী, কলাইর ডাল আর মোটা লাল চালের ভাত তৃপ্তির সাথে খেয়ে হালকা একটা ঘুম দিতাম। ঘুম থেকে উঠেই দেখতাম সন্ধ্যা পেরিয়ে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। হারিকেন এর টিম টিমে আলোয় কেমন যেন একটু ঘোর ঘোর লাগতো। যাই হোক ঘুম থেকে উঠে দাদুদের রসুই ঘরের সামনে গিয়ে দেখতাম দাদু আর জেঠি আম্মা রসুই ঘরের বাইরে আলাদা বেড়া দেয়া জায়গায় নতুন করে লেপা মাটির চুলায় রাতের রান্নার আন্জাম করছেন। আম্মাও উনাদের পাশে বসে গল্প করছে আর এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। চারপাশের নিকষ অন্ধকারের মাঝে লাকড়ির চুলার আগুন আর চেরাগের আলোয় উনাদের মুখটাকে কেমন যেন অতি-প্রাকৃতিক মনে হোত! রান্না শেষ করে গরম তরকারির পাতিল ঘরের মধ্যে নিয়ে সন্ধ্যা সাতটা-আটটার মধ্যেই দাদু আর জেঠি আম্মা দাদা, জ্যাঠামিয়া, জ্যাঠাতো ভাই-বোন-রত্না আপা, বকুল, মিলনসহ (জ্যাঠাতো ভাই সুমন বা ফারুক তখনো অনেক ছোট বা জন্মই হয়নি ) আমাদের পুরা পরিবারকে রাতের খাবার পরিবেশন করতেন। মাটির ফ্লোরের উপর চাটাই বিছিয়ে এর উপরই সবাই মিলে একসাথে বসে হারিকেন বা চেরাগের আলোয় রাতের খাবার খাবার সময় কেমন যেন একটু ঘোর ঘোর লাগতো। এছাড়া সারাদিনের নৌকার দুলুনিরও একটা রেশ টের পেতাম, চোখের সামনের সবকিছুই কেমন যেন দুলে দুলে উঠতো। অবশ্য রাতে ভালো করে ঘুমিয়ে সকালে উঠলেই নৌকার এই দুলুনির অনুভুতিটা চলে যেত। যাই হোক, মোটা লাল চালের সাথে মাটির চুলায় রান্না করা ঝাল ঝাল মাছের বা মুরগির তরকারি খেতে বড় অসাধারণ লাগতো। খাওয়ার পর উঠানে বসে আব্বা-আম্মা আর চাচা-চাচীরা কিছুক্ষণ গল্প করে রাতে শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করতেন।

আমার দাদার মুল ঘরটাতে বেড়া দিয়ে আলাদা করা পাশাপাশি দুইটা রুমের ভিতরের রুমে একটা বড় খাট ছিল যেখানে দাদা-দাদু, সাথে বকুল বা মিলন কেউ ঘুমাতো। আর সামনের ঘরে আরেকটা বড় খাটে আমাদের পরিবারের পাঁচজন-আব্বা, আম্মা, মিজান ভাইয়া, আমি আর রুমী পাতালি করে ঘুমাতাম। সামনের রুমের সাথে একটা দোচালা ঘরে (যেটাকে উনারা বলতেন সারবার তল, কেন বলতেন জানিনা) জ্যাঠা- জেঠি আর বাকি চাচাতো ভাইবোনেরা ঘুমাতেন। বাড়িতে আসার পর প্রথমদিনটা মোটামুটি এভাবেই পার হয়ে যেত।


পরদিন খুব সকালেই আব্বা ঘুম হতে তুলে দিতেন। ঘুম ভাঙলেই শুনতে পেতাম কাচারি ঘরে বাড়ির বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সমবেতভাবে হুজুরের সাথে জোরে জোরে আরবি পড়ছে বা কোন সুরা তেলাওয়াত করছে। আমরা ঘরের পাশের পুকুর ঘাটলায় গিয়ে নিমের বা কাল মাজন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার আর চোখ-মুখ ধুয়ে কৌতূহলী হয়ে কাচারি ঘরের দিকে যেতাম। ওখানে গিয়ে দেখতাম কাচারি ঘরের মেঝেতে কয়েকটা চাটাইয়ের উপর বসে আমার চাচাতো ভাইবোনেরা কেউ টুপি পরে বা কেউ মাথায় ঘোমটা দিয়ে রেয়ালের উপর কায়দা, আমপারা বা কোরান শরীফ রেখে হুজুরের সাথে জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে পড়ছে। বাড়ির বাচ্চাদের জন্য সকালে হুজুরের কাছে পড়া বাধ্যতামূলক হলেও বেড়াতে আসতাম বলে আমাদের জন্য ওটা ম্যান্ডেটরি ছিলনা। কাচারিঘরে কিছুক্ষণ ওদের পড়ালেখা দেখে নাস্তা খাবার জন্য আবার বাড়ির ভেতরে চলে আসতাম। দাদার বাড়িতে সকাল বেলা রুটি জাতীয় খাওয়া-দাওয়া বা দুধ চার প্রচলন ছিলনা। এর বদলে দাদু বা জেঠি আম্মা আব্বার প্রিয় পুয়া পিঠা, নারকেলের পিঠা, চিতল পিঠা ইত্যাদি নানারকম পিঠা বানিয়ে নাস্তা হিসেবে পরিবেশন করতেন, সেই সাথে গরম লাল চা। আমিও পিঠাগুলো খেতে পছন্দ করতাম কিন্তু রুটি-ভাজির বদলে পিঠাকে সকালের নাস্তা হিসেবে মেনে নিতে শুরুর দিকে একটু কষ্ট হোত। মজার ব্যাপার হল এই লাইট নাস্তার পরপরই সকাল ১০/১১টার দিকে গরম গরম ভাত ও তরকারি পরিবেশন করা হত, এরপর দুপুরের গোসলের পর একটু বেলা করে আরেক দফা এবং দিনের শেষে সন্ধ্যায় আরেকবার-সবমিলিয়ে তিনবেলা ভাত-তরকারি খাওয়া হোত!


আব্বা বাড়িতে গেলে প্রায়ই আমাদের পুরানা পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরতেন। এখানে মূলত পুটি, কৈ, খলশে, টাকি আর শৈল মাছ উঠতো। দুই একবার বোয়াল বা রুই মাছও উঠতে দেখেছি। জাল ফেলা ছাড়াও আব্বা-চাচারা পুকুরে ডুব দিয়ে পুকুরের তলা থেকে কৈ, টাকি বা শৈল মাছ তুলে আনতেন। জালের মাছ বা হাতে ধরা মাছ পাড়ে থেকে আমরা বাঁশের খলিতে ভরে রাখতাম। উনারা কিভাবে পানির নিচে এতক্ষণ নি:শ্বাস ধরে রাখতেন, আবার মাছও খুঁজে পেতেন এটা সবসময়ই আমার কাছে ছিল একটা বড় বিস্ময়! একবার এভাবে ডুব দিয়ে মাথা তুলার পর আব্বা দেখেন যে যা তুলেছেন সেটা একটা ধোড়া সাপ। মনে পড়ে টের পেয়ে আব্বা সঙ্গে সঙ্গেই সাপটাকে পাড়ের দিকে ছুড়ে মারেন-দৃশ্যটা দেখে অনেক ভয় পেয়েছিলাম। যাই হোক মাছ ধরা পর্ব শেষ হবার পর খলির মাছের কিছু চলে যেত সরাসরি রসুই ঘরে-তরকারি বা পাতুড়ি রান্না করার জন্য। কিছু মাছ দাদু রেখে দিতেন পরে রান্না করার জন্য। সংরক্ষণের জন্য দাদুকে দেখতাম ঘরের মধ্যে কয়েকটা বড় পাতিলে পানির মধ্যে শিং, শৈল, মাগুর, কৈ বা টাকি মাছ জিইয়ে রাখতেন। এগুলো থেকেই একেক সময় টাটকা শাক-সবজি দিয়ে তরকারি বা পাতুড়ি রান্না করা হোত। কোনদিন রান্না হোত শিং বা মাগুর মাছের সাথে সিমের বীচির তরকারী (স্থানীয় নাম-খাইসসারা), কোনদিন হয়তো অন্য তরকারীর সাথে সুস্বাদু কলাইর বা অড়হরের ডাল (স্থানীয় নাম-হ্যালনের ডাল)। এই তিনটা জিনিসই খেতে দুর্দান্ত লাগতো আমার কাছে- এখনো অসম্ভব প্রিয় তরকারি বা ডালগুলো। দাদুর খাটের নিচে দেখা যেত আলু, সুপারি, ঝুনা নারকেল বা চালের বস্তা। এই রুমেরই সিলিং এর উপরে টিনের চালের নিচে (স্থানীয় নাম-কাঁড়) থাকতো মোটামুটি ধান, চাল, সুপারি, সিমের বিচি, অড়হড় আর কলাইর ডালের একটা বড় স্টক। ঘরে একটা ধানের গোলাও দেখেছি বলে মনে পড়ে যেখানে ধানের সিজন শেষে বছরজুড়ে ব্যবহারের জন্য ধান সংরক্ষণ করা হত।

দাদুর ঘরের সঙ্গে সামনে সম্ভবত একটা পেঁপে গাছ ছিল। ওখান থেকে কাচা পেঁপে পেড়ে অনেক সময় ইলিশ মাছ দিয়ে রান্না করা হত। অনেক মজা লাগতো তরকারিটা। দাদার ঘরের চালের উপরে একটা চাল কুমড়া গাছ ছিল। আমরা গেলে চাল কুমড়াও পেড়ে ডালের সাথে রান্না করা হত। এছাড়া বাড়ির উঠানের পশ্চিম দিকে মাচা করে লাউ আর মিষ্টি কুমড়ার চাষ করা হত। লাউ বা মিষ্টি কুমড়ার সাথে চিংড়ি মাছের তরকারিও ছিল অসাধারণ। শীতকালে গেলে বাড়ির ক্ষেতের বরবটি, মটরশুঁটি আর বড় বড় বিচিওয়ালা সিম, মুলা, পুইশাক, লাল শাক এই তরকারিগুলোও খাবার সুযোগ হত।

যাই হোক মাটির চুলায় দাদু, জেঠি বা আম্মার রান্না করা বাজারের বড় রুই, কাতলা, ইলিশ বা পুকুরের বোয়াল মাছের ঝাল ঝাল করে রান্না করা ঝোলে ভরা তরকারি ছিল অসাধারণ! কখনো আবার বাড়ির খোয়াড়ের পালা মুরগি বা হাঁস জবাই করে টাটকা টাটকা রান্না করে গরম গরম অবস্থায় পরিবেশন করা হত। হাঁসের মাংস আব্বার বিশেষ পছন্দের ছিল বলে দাদু অনেক যত্ন করে রান্না করতেন।মুরগি বা হাঁস ডিম পাড়লে খাবারের সাথে সেগুলাও পরিবেশন করা হত। রাতের খাবারের পর পরিবেশন করা হত বাড়িতে পালা গরুর টাটকা গরম দুধ। বাড়ির পিছন দিকে দাদার একটা গোয়াল ঘর ছিল। সেখানে উনাদের পালা কয়েকটা গরু, বাছুর ও ছাগল দেখেছিলাম। একটা গরু দুধ দিত, সেই দুধ গরম করলে যে সর পড়তো সেই সরসহ টাটকা দুধ খেতে কী যে মজা লাগতো! বাড়িতে অল্প যে কয়দিন থাকতাম খাবারের পর দাদুর হাতে গ্লাসে বা থালায় ঢেলে দেয়া এই সরপড়া দুধ খাওয়া কখনো মিস হতোনা।


বাড়িতে অনেক নারকেল গাছ ছিল। আমরা গেলে হোসেন কাকা, জ্যাঠাতো ভাই মিলন অথবা সার্পাশি বাড়ির লোকমান কাকা নারকেল গাছে উঠে নারকেল আর আমাদের জন্য কচি ডাব পাড়তেন। ডাবের পানি আর সর খাওয়া ছিল আমাদের জন্য দাদার বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ। গরমের দিনে কী যে ভাল্লাগতো খেতে! বাড়িতে থাকার সময় এরকম প্রায়ই গাছ থেকে কচি ডাব পেড়ে খাওয়া হত।

পুরা বাড়ির সীমানায় অনেকগুলো তাল আর খেজুর গাছ ছিল। তালের সিজনে কাঁচা তাল পেড়ে তালের শাঁস খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। তাল পাকলে পাকা তাল পেড়ে তালের রস আলাদা করে সাথে কোরানো নারকেল মিশিয়ে চুলায় অনেকক্ষণ ধরে জ্বাল দিয়ে খাবার জন্য পরিবেশন করা হত। সকালের নাস্তায় বা বিকেলে-সন্ধ্যায় কমলা রংয়ের এই তালের রসের সাথে মুরি মিশিয়ে কত যে খেয়েছি ইয়ত্তা নেই। প্লেইন তালের রসে সামান্য একটু তিতকুনে ভাব থাকতো-সামান্য একটু চিনি আর গুড়া দুধ মিশালে জিনিসটা লাগতো অমৃতের মত- আর আমি মূলত এভাবেই তালের রস খেতাম। এই রস ছাড়াও বাড়িতে আবার মজাদার তালের পিঠা রান্না করা হত। এই পিঠাটা আমার অনেক মজাও লাগতো।বর্ষাকালে খেজুর গাছের একটু কাঁচা-পাকা খেজুর মাঝে মাঝে খাওয়া হত। খাওয়ার পর খেজুরের বিচি সুপারি কাটার ছোরতা দিয়ে দুই ভাগ করে এক ধরনের খেলা খেলা হত-নিয়ম ঠিক মনে নাই এখন। তবে খেজুর গাছের বড় আকর্ষণ ছিল শীতকালে। গাছের উপরের দিক একটু ছেঁচে একটা মাটির হাড়ি বসিয়ে সকাল বেলা কুয়াশার মধ্যে রস সংগ্রহ করা হত। গ্রামে এই রসের হাড়ি চুরি করে রস খাওয়ার অনেক মজাদার গল্প প্রচলিত ছিল। যাই হোক খেজুরের রসের সাথে বিশেষ ধরনের চাল আর কোরানো নারকেল মিশিয়ে আমাদের গ্রামে এক অসাধারণ সিন্নি রান্না করা হত-আমরা বলতাম রসের সিন্নি। রসের সিন্নি বা এর সাথে সামান্য মুরি মিশিয়ে খাওয়া ছিল শীতকালের প্রধান নাস্তা- স্বাদও ছিল অসাধারণ। এই রসের সিন্নি খাবার সুযোগ শুধুমাত্র শীতকালে গ্রামের বাড়িতে গেলেই পাওয়া যেত-কোরবানির ঈদের সময় খুব একটা খাওয়ার সুযোগ পাইনি আমরা।

বাড়িতে একটা বেল গাছও ছিল। গরমের দিনে গুড় দিয়ে বেলের শরবত খেতে আব্বা অনেক পছন্দ করতেন। বেলের শরবত আব্বা শুধু নিজেই খেতেন না আমাদেরকেও খাওয়াতেন। শুরুতে দেখতে একটু কেমন কেমন লাগলেও শরবতটা খাওয়ার পর কিন্তু অনেক প্রশান্তি লাগতো।

বাড়ির আম গাছে গরমের সময় অনেক আম ধরলেও আমগুলো থাকতো পোকায় ভরা আর স্বাদও ছিল একটু টকটক। তাই বাড়িতে পাকা আম খাবার খুব একটা সুখকর স্মৃতি নাই। বরং অনেক সময় কাঁচা আম পেড়ে ভর্তা করে খাওয়া হত। বাড়ির উত্তর দিকে শফিক কাকার পুরানো ঘরের পিছনে একটা ডুমুর আর একটা কামরাঙা গাছ ছিল। ঈদের সময় বাড়িতে গেলে এই ডুমুর আর কামরাঙা গাছের ফল পেড়ে খেতাম। কাঁঠালের সিজনে গেলে কাঁঠাল খাওয়া ছিল অবধারিত। কাঁঠাল আব্বার সবচেয়ে প্রিয় ফল-এক বসায় পুরা কাঁঠাল শেষ করে ফেলতে পারতেন। আমার কাছে শক্ত শক্ত কাঁঠাল ( মিষ্টি একটু কম হত) বা অতি নরম ( আশ আশ লাগতো-যদিও অসম্ভব মিষ্টি হতো) কোনটাই অতটা ভালো লাগতোনা। খেলে মাঝামাঝি নরম কাঁঠালই বেশি খাওয়া হত। তাছাড়া কাঁঠালের কষে হাত আঠা আঠা হয়ে যাওয়ায় একরকম অস্বস্তিও লাগতো, যদিও খাবার আগে তেল মেখে নিলে এই অস্বস্তি আর অতোটা থাকতোনা।বাড়িতে সবরি কলার গাছ অতটা দেখি নাই কিন্তু অনেকগুলো আঁটি কলার গাছ ছিল। এই আঁটি কলা অসম্ভব মিষ্টি ছিল কিন্তু বিচির প্রাচুর্যে খাবার আগ্রহ খুব একটা না হোতনা। তবে সিজন মত গেলে কলা গাছের থোড় বা কাঁঠালের মুচি লবণ মরিচ দিয়ে ভর্তা করে খেতে অনেক মজা লাগতো। এসমস্ত ফল ছাড়াও সিজন অনুযায়ী বাড়ির পিছনে জঙ্গলের মধ্যে গাব, চালতা, আমড়া, বেতফল, আমলকি আর জলপাই ফলগুলোও কমবেশি পাওয়া যেত। চালতা দিয়ে আঁচার ছাড়াও একধরনের মজার টক রান্না করে ভাতের সাথে খাওয়া হত। চালতার এই টকটা আমার অনেক পছন্দের ছিল।

সত্যি কথা বলতে কি ঐসময়ে গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িই খাদ্যে মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল- ক্ষেতের ধান, পুকুরের মাছ, গোয়ালের গরু-ছাগল, খোয়াড়ের হাঁস-মুরগি, বাগানের শাক-সবজি, ফলমুল, দুধ, ডিম-কী ছিলনা তখন! দু:খ হয় শহরমুখী হবার প্রবণতায় বা গ্রামের নগরায়নের ফলে এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা এখন আর ওভাবে দেখা যায়না।

আপনার মন্তব্য