আমার মত পার্বতীদের পূজা নেই

 প্রকাশিত: ২০২১-১০-১০ ২৩:০৪:০৫

পিকলু প্রিয়:

অজপাড়া গ্রামের মেয়েটি, নাম তার পার্বতী। মা, বাবা, ভাইকে, নিয়েই পার্বতীদের সংসার! পার্বতীর বড় ভাই প্রকাশ একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন, পার্বতী শহরে একটা দর্জির দোকানে চাকরি করে। টানাটানির সংসার তার মধ্যে বেঁচে থাকার অদম্য যুদ্ধ! তবুও যে অন্ত নেই তাদের নতুন নতুন স্বপ্নের! স্বপ্নই বুঝি মানুষের বেঁচে থাকার চাবিকাঠি।

নতুন আরেক সদস্যের আগমনের সিঁড়িতে পা রাখলো পার্বতীর পরিবার। পার্বতীর ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হলো, তবে সংসারের ক্ষেত্রে পার্বতীর বড় ভাই খুব উদাসীন! তবে এদিকে পার্বতীরও বিয়ের বয়স হয়েছে, তাতে কী বড় ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা, প্রত্যেকটি পরিবারের মেয়েরা চায় তাদের বড় ভাইদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা শেষে করে তাদের বিয়ে হউক। "পুরুষ বা নারী যেই হউক বিয়ে ব্যাপারটা যার যার ব্যক্তি ইচ্ছে স্বাধীন থাকা উচিৎ"।

অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনা ও দারিদ্র্যতার সাথে লড়াই করে পার্বতীদের পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন হলো। নতুন বউ, নতুন সংসার, তার সাথে বদলাতে থাকে পরিবারের প্রাণবন্ততা! যদিও পার্বতী ও তার মা বাবা মেনে নিচ্ছিলেন অনেক কিছুই, কারণ তারা হয়তো বুঝতেন পৃথিবীতে সব থেকে বড় লড়াই, সংসার লড়াই! এই লড়াইয়ে ধ্বংসটাই বেশি থাকে। তবুও যে দিনশেষে টিকে থাকার লড়াই করে যেতে হয়!

চলছে জীবন, চলছে যুদ্ধ, চলছে সংসার, তার মধ্যেই এলো দুর্গাপূজার আমেজ। কত আয়োজন, কত প্রয়োজন, কত স্বাদ-আহ্লাদ, চারদিকে পূজার কেনাকাটার ধূম কত জল্পনা কল্পনা। কিন্তু পার্বতীর পরিবারের পূজার আয়োজন'টা কেমন?

পার্বতীর বড় ভাই আর ভাইয়ের বউ মিলে শহরের বড় শপিং মহলে গেলেন পূজার শপিং করতে। প্রকাশ তার বউয়ের জন্য প্রায় পনেরো হাজার টাকার শপিং করলেন। অথচ প্রকাশের মাসিক আয় বারো হাজার টাকা। এদিকে বাড়িতে বৃদ্ধা মা বাবা ছোট বোন পার্বতীর কথা তারা একটি বারও ভাবলেন না। শপিং শেষে তারা বাড়ি ফিরলেন। শপিং এর বিষয় নিয়ে মা বাবার কাছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কিচ্ছা শুনিয়ে প্রকাশ ও তার বউ নিজ রুমে গেলেন!

মা বাবা বলে কথা, অধিকাংশ মা বাবাই আমৃত্যুই ছেলেমেয়েদের সুখের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করে থাকেন। প্রকাশ আর তার বউ যতটুকু সহজে তাদের বোকা বানিয়ে নিজেদেরকে খুব বুদ্ধিমান ভাবছেন তবে মোদ্দাকথা হলো মা বাবারা বুঝেন না কী সেটাই ভাবা উচিত ছিল! বিষয়টা এমন ছিল যে মায়ের কাছে এসে মামার বাড়ির গল্প বলা হচ্ছে।

এদিকে, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে যখন পার্বতী বাড়ি ফিরলো তখন সে দেখলো রঙ্গমঞ্চের ধারাবাহিক নাটকখানা। মুখ থুবড়ে নীরবে সবকিছু হজম করে নিলো পার্বতী। মনে মনে ভাবলো আজ পঞ্চমী, কাল ষষ্টি, আর যাই হউক পূজাতে মা বাবাকে নতুন কাপড় পরাতেই হবে।

পরের দিন পার্বতী দর্জির মালিক’কে বললো দাদা আমাকে এইবার এক মাসের বেতন অগ্রিম দিতে হবে। দর্জির মহাজন জানতে চাইলেন ক্যানো? পার্বতী বললো বেশ কিছুদিন যাবত শরীরটা খুব অসুস্থ। আপনাকেও বলছি না দোকানে কাজের চাপ বেশি। আজ দোকানে আসার পথে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম প্রায় তিন হাজার টাকার উপরে ঔষধ কিনতে হবে। যদি সুস্থ না থাকি তা হলে কাজ করবো কী করে দাদা। দয়া করে আমাকে এই মাসের বেতনের সাথে অগ্রিম আরেক মাসের বেতন দেন। আমি’তো আপনার এখানেই কাজ করছি। অবশেষে দর্জির মহাজন টাকা দিলেন।

সারাদিন কাজ করে রাতে বাড়ি ফিরার সময় শপিং মহলে গেলো পার্বতী। মায়ের জন্য একটা শাড়ি, বাবার জন্য একটা পাঞ্জাবি, ভাইয়ের জন্য একটা শার্ট, বউদির জন্য একটা শাড়ি, অবশিষ্ট পার্বতীর হাতে আর মাত্র পঞ্চাশ টাকা। শহর থেকে বাড়ি ফিরতে বাস ভাড়া চল্লিশ টাকা। সারাদিনের পরিশ্রম ক্লান্তিময় শরীর কতশত ইচ্ছেকে ফানুস করে ঘরে ফিরলো পার্বতী। হাসিমাখা মুখ কত উল্লাস মা, বাবা, দাদা, বউদি, এদিকে এসো পূজাতে ৪ দিনের ছুটি পেয়েছি সাথে বোনাসও পেয়েছি তাই সবার জন্য নতুন জামা কাপড় এনেছি। কাল ষষ্টি আমরা সবাই নতুন জামাকাপড় পরে মণ্ডপে যাবো। সবাইকে সবার জামাকাপড় বুঝিয়ে দিলো পার্বতী। হঠাৎ মা আর বাবা পার্বতীকে প্রশ্ন করলেন কি’রে পার্বতী তোর নতুন শাড়ি কোথায়? পার্বতী খুব রাগি ভাব দেখিয়ে বললো আর বলো না শাড়ি থেকে ব্লাউজ পিস কেটে ব্লাউজ বানানোর জন্য সুবোধ দা'র দোকানে দিয়ে এসেছি বলেছেন কাল বিকালে দেবেন। আমাদের দোকানেও কাজের খুব চাপ। বাবা কিছু দিন আগে আমার জন্য যে জামাটা কিনে এনেছিলেন ষষ্টিতে সেটা পরবো এবং তোমাদেরকে নিয়ে বের হবো। প্রথমে বাবার দেওয়া উপহারটা গায়ে লাগিয়ে মণ্ডপে যেতে আমারও খুব ইচ্ছে তাই সুবোধ দা'কে আর তেমন তাড়াহুড়ো করতে বলিনি।

আজ ষষ্টি, পার্বতী ও তার পুরো পরিবার মিলে শহরে মণ্ডপ দেখতে বের হলেন। শহরে খুব বড় একটি পূজার মণ্ডপ আছে সেখানে খুব জাঁকজমকভাবে পূজা হয় সেখানে গেলো তারা। সবাই দুর্গা মাকে প্রণাম করছেন, মনে মনে কত কিছু আশা করছেন, প্রসাদ খাচ্ছেন, আরতি দেখছেন, হইহুল্লোড় করছেন, ছবি তুলছেন, কত রকমের আমোদ ফুর্তি হচ্ছে! পার্বতী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে মনে হচ্ছে চোখের জলে এখনি বন্যা হয়ে যাবে ভিতরে আর্তনাদে সকল ডাকঢোল বন্ধ হয়ে যাবে। পূজামণ্ডপটা একটা পতিত জমিতে রূপ নিবে। হঠাৎ পার্বতীর মা এসে বললেন কিরে তুই এখানে একা একা দাড়িয়ে কী করছিস যা মাকে প্রণাম করে আয়, আরও কত মণ্ডপ দেখার বাকি রয়েছে! পার্বতী মণ্ডপের সামনে গিয়ে দুর্গা মা’কে প্রমাণ করে মনে মনে বললো মা’গো আমার মত পার্বতীদের কোন পূজা নেই, কোন আয়োজন নেই, কোন প্রয়োজন নেই, আছে শুধু বেঁচে থাকার লম্বা একটি দীর্ঘশ্বাস। বিশ্বাস করো প্রতিমা আমার দুর্গা রক্তে মাংসে গড়া আমার 'মা' ভালো থাকো প্রতিমা। প্রণাম শেষে প্রণামী বক্স-এ পার্বতীর অবশিষ্ট দশ টাকা দিয়ে এলো।

তারপর বাবাকে বললো বাবা শরীরটা ভালো বোধ করছি না! আমাকে একশ টাকা দাও আমি বাড়ি ফিরে যাই তোমরা মণ্ডপ দেখে ঘুরে আসো। বাবার কাছ থেকে একশ টাকা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো পার্বতী। পূজামণ্ডপ থেকে তিন মাইল জায়গা পায়ে হেঁটে সেখান থেকে নব্বই টাকা বাস ভাড়া দিয়ে বাড়ি ফিরলো পার্বতী।

দিনশেষে এইভাবেই পার্বতীরা অদৃশ্য লীলাখেলা'কে মুখ বুঝে সয়ে যায়। এইভাবেই অধিকাংশ পার্বতীরা অনেক আমোদ, প্রমোদ, জল্পনা, কল্পনা, অনলশিখায় পুড়িয়ে এগিয়ে যায় নিজ সত্তায়।

পার্বতীদের মত রক্তে মাংসে সাহসে বুদ্ধিতে শত শত স্বয়ং দুর্গার আবির্ভাব হউক।

আপনার মন্তব্য