জাস্টিন ট্রুডো’র আত্মজীবনী ‘কমন গ্রাউন্ড’-৪

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-২১ ১৫:৩৩:০৩

মনিস রফিক:

আমি ছিলাম ম্যাপল তিন
চার
সত্যি কথা বলতে কি, প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হবার ফলে আমার জীবনে এবং আমার আশপাশে এমন কিছু ঘটতো এবং আমাকে এমন কিছু বিধি-নিষেধ মানতে হতো যে ওগুলো আমার কাছে হাস্যকর মনে হতো। এর মধ্যে আমাদের পরিবারের সবাইকে সহজে চেনার জন্য আরসিএমপি (রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ) যে কোড ব্যবহার করতো, সেটার কথা বলা যায়। আমার বাবা ও মা ছিলেন ম্যাপল এক আর দুই, আমার দুই ভাই ছিল চার এবং পাঁচ আর আমি ছিলাম ম্যাপল তিন। বাইরে গেলে আমাদের সব কাজের প্রতি তারা আমাদের প্রতি খেয়াল রাখতেন এবং তাদের অফিসিয়াল কাজ-কর্মে এই কোড নামগুলো ব্যবহার করতেন।

আমি রকক্লিফ পার্ক পাবলিক স্কুলে পড়তাম। স্কুলটি ছিল ৮১ নম্বর সেকশনে আর সেকশন ৭৬ এ ছিল আমার বন্ধু জেফের বাড়ী। আমরা তিন ভাই নিজেদের মত বাইরে বেড়াতে গেলে আরসিএমপি অফিসাররা হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিতেন। আমরা কখন কোন জায়গায় হাঁটছি বা কোথায় লুকোচুরি খেলছি তা মাঝেমধ্যেই তাদের সাথে কথা বলে আমাদের অবস্থানটা তাদেরকের নিশ্চিত করতে হতো। মাঝেমধ্যেই আমার হাসি পাই সেই দিনটার কথা ভেবে যেদিন আমাদের জন্য তারা যে বিশেষ কোড ব্যবহার করতেন সেটা আমি গরমিল করে দিয়েছিলাম বলে। সেদিন নিজের কাছে আমাকে বিজয়ী মনে হচ্ছিল। "আলফা ব্রেভো চার্লি ! তোমরা শুধু প্রতিটি শব্দের প্রথম অক্ষরটি বলো!" আমি এই সংকেতটাকে উলোট পালোট করে দিয়েছিলাম।

২৪ সাসেস্ক এ যখন কোনো জন্মদিনের অনুষ্ঠান হতো, তখন ব্যাপারটা হতো খুবই মজার। ঐ সময় আমাদের বড় বাড়ীটা অন্তত একদিনের জন্য একটা সত্যিকারের আমাদের মনের মতো খেলার জায়গা হতো। যেহেতু সাচা আর আমার জন্ম যীশু খ্রিস্টের জন্ম দিনে, সেহেতু আমাদের জন্মদিন পালনের সাথে সাথে ক্রিসমাস ডে'র অনুষ্ঠান একেকার হয়ে যেত। মধ্য ডিসেম্বর থেকেই আমরা আমাদের ক্লাসের বন্ধুদের দাওয়াত দেয়া শুরু করতাম। আমাদের দু'জনের প্রায় চল্লিশ জন বন্ধু আমাদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতো। আমাদেরকে আমাদের মত আনন্দ করতে দেওয়ার জন্য বাবা তখন তাঁর কাজকর্ম নিয়ে অফিসেই ব্যস্ত থাকতেন। সেই দিনগুলিতে লুকোচুরি খেলায় আমরা খুবই মজা পেতাম। একজন বাদে অন্য সবাই বিভিন্ন কোনা কোঠরে লুকিয়ে পড়তো, তারপর শুরু হতো খোঁজার পালা। যাদেরকে প্রথমে খুঁজে পাওয়া যেত তাদেরকে নিয়ে খোঁজার দল খুঁজতে থাকতো লুকিয়ে থাকার দলকে। আস্তে আস্তে লুকিয়ে থাকার দলের সদস্য সংখ্যা কমতে থাকতো। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলে খুঁজতে থাকতাম শেষ জনকে। আমাদের কাছে খেলাটা খুবই মজার ছিল।

আমার জীবনের এই দিকগুলো যখন আমার স্কুলের বন্ধুরা দেখতো, তখনই বুঝতাম তাদের অনেকেই আফসোস করতো। মাঝে মধ্যে আমাদের জীবনে এমন কিছু ঘটতো তা আমাদের হতবাক করে দিত। একটা দিনের কথা মনে পড়ছে। সময়টা ছিল জুন মাস।আমার বয়স তখন এগারো। আমি এবং আমার বন্ধু জেফ গিলিন ২৪ সাসেস্ক এর ড্রাইভওয়েতে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। হঠাত আমাদের সামনে একটা গাড়ী এসে থামলো। তারপর গাড়ীর দরজা খুলে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে নামলো। তাঁর কাঁধে ছিল জিম-ব্যাগ। চোখ বড় বড় করে আমরা দু'জন তাঁর দিকে তাকালাম। আমরা চিনতে পারলাম তাকে। ডায়না, প্রিন্সেস অব ওয়েলস। আমি শুনেছিলাম সেই সময় লেডী ডায়না আর প্রিন্স চার্লস কানাডা ভ্রমণ করছেন এবং এটাও শুনেছিলাম, লেডী ডায়না যেকোনো সময় আমাদের ২৪ সাসেস্ক এর পেছনের পুলে সাঁতার কাটার জন্য আসতে পারেন। লেডী ডায়নাকে ঐ অবস্থায় হঠাত দেখেই আমার তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়েছিল তাকে আমাদের সম্মান জানানো উচিত।

জেফ এবং আমি বুঝতে পারছিলাম লেডী ডায়নার জন্য বিশেষ প্রটোকল ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমরা কি করবো, কিভাবে তাকে সম্মান জানাবো! তখন আমাদের শরীরে সাধারণ টি-শার্ট আর জিনস প্যান্ট। আমরা দু'জনেই চুপচাপ ভাবতে থাকলাম, আমরা তাকে গড় প্রণাম করবো, না স্যালুট জানাবো। তারপর এক নিমিষেই এক সাথে দু'জনেই আমাদের সাইকেল দুটো মাটিতে ফেলে আমরা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানালাম। বলা যেতে পারে, আমাদের মত বালকদের কাছ থেকে রাজকুমারীকে ও ধরনের গার্ড অব অনার জানানো ছিল অন্যরকম এক সম্মানের। কিন্তু তারপরও ঐ মুহূর্তটা আমার কাছে ছিল একটু বিব্রতকর। কারণ লেডী ডায়না আমাদেরকে তেমন কোনো পাত্তাই দিলেন না, বরং তাঁর হাবভাবে মনে হলো আমরা অবাঞ্ছিতভাবে তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাচ্ছি। আমাদের দিকে তিনি একটু তাকিয়ে কিছুটা না দেখার ভান করে, চোখের মণিটা একটু ঘুরিয়ে টান টান করে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে পুলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমাদের কোনো অপরাধ হলো কিনা এই ভেবে আমি জেফের দিকে ঘুরে তাকালাম। দেখলাম জেফের চোখ দু'টো চাকতির মত গোল আর বড় হয়ে গেছে। রাজকুমারীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'ও মাই গড, এ কী দেখলাম!'

ঐ সময়েই আরেকটা ঘটনা ঘটেছিল যেটাতেও জেফ জড়িত ছিল। সে আমি আর আমাদের আর কয়েকজন বন্ধু আমাদের মহল্লাতেই প্রতিদিনকার মতই সাইকেল চালাচ্ছিলাম। আমাদের থেকে একটু বেশী পেছনে থেকে এক আরসিএমপি কার আমাদের ওপর নজর রাখছিলো। আমি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়ায় আমার নিরাপত্তার জন্য সেটা সাধারণ একটি বিষয় ছিল। কিন্তু আমি সাধারণত সে সব বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তা বা মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু যখন আমার এক বন্ধু দুষ্টুমি করার জন্য বললো, আমরা লুকিয়ে পড়ি যাতে আরসিএমপি পুলিশ আমাদের খুঁজে না পায়। কথা শেষ না হতেই আমরা সকলে সাইকেল ঘুরিয়ে সটান টান মেরে পার্কের ভিতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে কয়েকটা পেছনের স্ট্রীটে গিয়ে তারপর একটা অব্যবহৃত পথ দিয়ে জেফদের বাড়ীর পেছনের গিয়ে পৌঁছেছিলাম। আমাদের মতলবটা আরসিএমপি অফিসার ধরতে পেরেছিলেন, সেজন্য তিনি যে পথে আমি বাড়ী ফিরি সেই পথে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের খেলা শেষ হলে তিনি আমাকে বাড়ীতে পৌঁছে দেন আর তাঁর দায়িত্বের অংশ হিসেবে এই ঘটনার ওপর একটি লিখিত বিবরণ জমা দিয়েছিলেন।

আমি এবং আমার বন্ধুরা ভেবেছিলাম অফিসারের সাথে আমরা যা করেছিলাম তা নিছক এক আনন্দ। কিন্তু বাবা বিষয়টা অন্যভাবে নিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি তিনি আমার ওপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমি যখন তাঁর সামনা সামনি হলাম, তিনি রাগে ফেটে গিয়ে বলেছিলেন, 'তুমি কি মনে করেছো এগার বছরের এক পুঁচকে ছেলের পেছনে টিকটিকির মত ঘুরা তাদের কাজ? তাদের কাজ হচ্ছে তোমাকে নিরাপদে রাখা যাতে আমি নিশ্চিন্ত মনে আমার কাজগুলো করতে পারি। আর তুমি ইচ্ছা করে তাদের কাজগুলোকে কঠিন করে দিচ্ছো, তামাশা করার জন্য?' তারপর তিনি আমার দিকে কঠিনভাবে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলেছিলেন, 'এটাতে তাদেরকে যথেষ্ট অসম্মান করা হয়েছে। এটা এক ধরনের বেয়াদবি। আমিতো এভাবে তোমাকে বড় করতে চাইনি'।

আমার ব্যবহার বা আমার কোনো কাজে বাবা কষ্ট পেয়েছেন ছোটবেলায় এটা ভাবলেই আমার মনটা বিষাদে ভরে উঠতো। অন্যান্য ছোট বাচ্চাদের মতই আমি বারবার বাবার কাছে আমার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতাম। উনি আমাকে বুঝাতেন, কিন্তু আমার জন্য বাবা কষ্ট পেয়েছেন, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় ছিল।

আসলে কিছুকিছু সময় এমন কিছু ঘটে যেতো যাতে আমরা প্রত্যাশিত ব্যবহারে সীমানা হয়তো ছাড়িয়ে  যেতাম। আমি জানি না সাচা, মাইকেল বা আমি আমাদের ঐ বয়সে অন্যান্য বালকদের চেয়ে বেশী দুষ্ট ছিলাম কিনা, আমি শুধু এটা জোর গলায় বলতে পারি, আমাদের বাবা মা দু'জনেই আমাদেরকে এমনভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করতেন যে কেউ আমাদের বলতে না পারে যে আমরা অভদ্র বা বেয়াদব। আমরা যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি সেখানে কোনো কিছুর অভাব ছিল না। বাবা মার কাছে আমরা যা চাইতাম সবই পেতাম। সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয় তাঁরা আমাদের কোনো প্রত্যাশায় অপূর্ণ রাখতেন না, কিন্তু আমরা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারি এমন কোনো বিষয়ে তাঁরা আমাদের কখনো প্রশ্রয় দিতেন না।

মা সবসময় ভালো ব্যবহারের প্রতি খুবই গুরুত্ব দিতেন। অফিসিয়াল প্রটোকল বা শিষ্টাচারের সামান্য এদিক ওদিক হলেই তিনি আমাদের বকা দিতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, 'ভালো ব্যবহার তোমাদের সামনে এগুবার জন্য পথ উন্মুক্ত করে দিবে এবং একবার যখন তোমার এই পথ উন্মুক্ত হয়, তখন তুমি সত্যিকারের মানুষ হবার জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারবে।' তিনি আরো বলতেন, 'মানুষের সাথে তোমাদের সব রকম লেনদেন ও ব্যবহারে সব সময় সৎ থাকবে, কখনো অসৎ বা অসাধু হবে না, কোনো কারণে কখনো যদি কারো কাছে অবিশ্বস্ত হয়ে যাও, তাহলে তাঁরা আর কখনো তোমাদের বিশ্বাস করবে না।'

আমার বয়স যখন আট বছর তখন বাবা আমাকে একবার পার্লামেন্ট হিল এ নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার এক রেস্তোরায় আমরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। খেতে খেতেই দেখলাম কিছু দূরে বিরোধী দলের নেতা জো ক্লার্ক একটা টেবিলে বসে আছেন। জো ক্লার্ক সম্পর্কে স্কুলের বন্ধুদের কাছে একটা হাস্যকর কৌতুক শুনেছিলাম। বাবাকে খুশী করার জন্য আমি সেটা তাঁকে বলে ফেললাম। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। বাবা আমার কাছ থেকে তাঁর বিরোধী পক্ষের নেতা সম্পর্কে এমন কৌতুক শোনার পর আনন্দ না পেয়ে বরং মনক্ষুণ্ন হলেন। তারপর বাবা আমার সামনে একটা ছোট বক্তৃতা দিলেন যার মূল বিষয় ছিল, কোনো বিষয় বা মতামত নিয়ে কেউ বিরোধী পক্ষে অবস্থান নিতেই পারে, তুমি তাঁর সেই মত না মানলে তুমিও বিরোধী পক্ষে অবস্থান নিতেই পারো, কিন্তু এর সাথে ব্যক্তি মানুষের কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। আমাদের খাবার শেষ হলে বাবা আমাকে নিয়ে জো ক্লার্ক যে টেবিলে ছিলেন সেই টেবিলে গেলেন। জো ক্লার্ক সেখানে তাঁর মেয়ে ক্যাথরিনের সাথে বসে ছিলেন। বাবা জো ক্লার্ক ও তাঁর মেয়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য