ওসমানগঞ্জের ওলি

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-০১ ০০:৪৪:৫৪

মাসকাওয়াথ আহসান:

দূরপ্রাচ্যের এক শিশু ইয়াগাতা। দস্যিপনায় স্কুলে সে দ্রুত নাম করে ফেলে। শিক্ষকদের দিকে পাথর ছোড়া; অন্যের গাড়ীর দিকে পাথর ছোড়া; এ তার নিয়মিত বিনোদন হয়ে দাঁড়ায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইয়াগাতার বাবা-মাকে তাদের ছেলেটির এই দস্যিপনা নিয়ে একটি বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান। প্রধান শিক্ষকের কাছে ইয়াগাতার কাণ্ড-কারখানার ফিরিস্তি শুনে অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করেন তারা। নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ছেলেকে সংশোধনের জন্য এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নেন। বাসায় ফিরে মা অনেক বোঝান, ইয়াগাতা তুমি তো শিম্পাজি নও; মানুষ। তাহলে এমন শিম্পাজির মতো আচরণ করছো কেন!

- মা কথা দিচ্ছি আর এমন হবে না।  বাবা খুশী হয়ে ইয়াগাতাকে আইসক্রিম খেতে নিয়ে যান। আইসক্রিম খেতে খেতে সে পকেট থেকে পাথর বের করে অন্য টেবিলের বাচ্চাদের দিকে ছুঁড়ে মারে। কেউ বুঝতে পারে না; কে পাথর ছুঁড়েছে। ইয়াগাতার বাবা ঠিকই বুঝতে পারেন। খুব হতাশ হয়ে বাচ্চাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন। গম্ভীর মুখে স্টাডিরুমে গিয়ে জেনেটিক্সের বই খুলে বসেন। খুঁজতে চেষ্টা করেন পৃথিবীর কোন কোন এলাকার মানুষ পাথর ছুঁড়ে।  ইয়াগাতার মা গ্রিন টি নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে!

 - ইয়াগাতা তার প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গেছে। আবার পাথর ছুঁড়েছে। মায়ের চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে।

ইয়াগাতার বাবার হাতে জেনেটিক্সের বই দেখে বলেন, বিশ্বাস করো আমাদের পরিবারে কেউ কখনো ঢিল ছুঁড়তো না।

 - আমি জানি। আমার বাবার পোস্টিং ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে। সেখান থেকে ফিরে এসে উনি ছুটির দিনে জঙ্গলে যেতেন ঢিল ছোঁড়ার আনন্দ নিতে। আমিও মাঝে মাঝে যেতাম। ভালই লাগতো ঢিল ছোড়াছুড়ি খেলতে। সম্ভবত: ইয়াগাতার জেনেটিক্সে সেই সুদূর ভারতীয় উপমহাদেশের ঢিল ছোড়ার প্রবণতা পরিবাহিত হয়েছে আমাদের দিক থেকে।

 ইয়াগাতার মা বুদ্ধি দেন, আমরাতো মাঝে মাঝে বুনো সবজি সংগ্রহে বনভূমিতে যাই। ওখানেই না হয় সে পাথর ছুড়ুক। শুরু হয় জঙ্গলে গিয়ে “ইয়াগাতা”-র পাথর ছোড়া কার্যক্রম; যাতে সে লোকালয়ে এ কাজ না করে। কিন্তু ইয়াগাতা ঠিকই তৃতীয় দিনে একজন বন নিরাপত্তাকর্মীর গায়ে ঢিল ছুঁড়ে বসে। ওর মা তাতক্ষণিকভাবে বন নিরাপত্তাকর্মীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ইয়াগাতাকে পাহাড়ের কাছে নিয়ে যান।

 - ইয়াগাতা তুমি যদি শিম্পাঞ্জির মতো আচরণ করো; তাহলে তোমার এই জঙ্গলেই থাকা উচিত।

 - আমার জঙ্গলে থাকতেই ভালো লাগবে মা।

 ইয়াগাতার বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেন, ওকে এইখানে রেখে একটু দূরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেই হয়। দেখা যাক কতক্ষণ তার জঙ্গল ভালো লাগে। ইয়াগাতা মনের আনন্দে ডিগবাজী দেয়। পাহাড়ের দিকে ঢিল ছুঁড়ে।

 - এই পাহাড় তুমি এতো লম্বা কেন! খাটো হও-ছোট হও আমার মত।

আবার পাহাড়ের দিকে ঢিল ছোড়ে,

 - এই পাহাড় তুমি দেখছি আমাদের হেডমাস্টারের মত জেদি। খাটো হচ্ছো না কেন!

দূর থেকে ইয়াগাতার এইসব কর্মকাণ্ড দেখে বাবা-মা আর হাসি চেপে রাখতে পারেন না। কিন্তু তারা কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটু অমনোযোগী হতেই দেখেন ইয়াগাতা নেই পাহাড়ের পাশে। দুজন মিলে অনেক খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। মা হাউ-মাউ করে কাঁদতে থাকেন। বাবার মনে হয় যেন হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে আসছে তার। পুলিশে ফোন করতেই ১৩২ সদস্যের একটি দল বনভূমিতে ইয়াগাতাকে খুঁজতে থাকে। ইয়াগাতার মা-বাবা দুজনেই কাঁদতে থাকেন। বাবা বলেন, আমরা কেন যে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অমনোযোগী হলাম। একজন পুলিশ কর্মী এসে সান্ত্বনা দেয়, নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে ওকে। কিন্তু ইয়াগাতা এতো দ্রুত হাওয়া হয়ে গেলো কীভাবে! ওকি স্পাইডার বয়!

ইয়াগাতা পাহাড়ের সুড়ঙ্গ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ে নতুন এক জঙ্গলে। ওসমানগঞ্জ। যমগুম কূপের জন্য খুবই বিখ্যাত। হঠাত সে দেখে একটা স্কুলের হেডমাস্টারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে একদল লোক। একটা নীল পাঞ্জাবী পরা লোক হেডমাস্টারকে কান ধরে উঠবস করতে বলছে। ইয়াগাতার খটকা লাগে। তার স্কুলের হেডমাস্টারকে কখনো সে কান ধরে উঠবস করতে দেখেনি। ওসমানগঞ্জের হেডমাস্টার কান ধরে বসতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু নীল পাঞ্জাবীর লোকেরা তাকে জোরে করে টেনে তোলে।  
ইয়াগাতার মনে হয়, পাহাড়কে ওর চেয়ে খাটো করতে গেলে তাকে কান ধরে উঠবস করাতে হবে।  মনের আনন্দে সে পকেট থেকে একটা পাথর বের করে হেডমাস্টারের দিকে ছুঁড়ে মারে। নীল পাঞ্জাবী পরা লোকটা খুব অবাক হয় এই ছোট অচেনা শিশুটির পারফরমেন্স দেখে। বলেন, ওরে আমাদের শিশু পার্টিতে নিয়া নেও। কয়েকজন মোল্লা বাধ সাধে, এই ছেলে আমগো শিশু আমগো হেফাজতে গাজী হইয়া উঠবো। এক হুজুর আশে পাশের শিশুদের ধমক দেয়, দেইখা শেখো নাবালকেরা; পারবা এই পোলার মতো সাহসী হইতে!

 - অই পোলা তোমার নাম কী!

 ইয়াগাতা নাম শব্দটি শুনে ঠাহর করে নেম জানতে চাইছে।
 - ইয়াগাতা।

 - আইজ থিকা তুমি ইয়াগাজী।

এইসব হট্টগোলের মধ্যে ইয়াগাতা দেখে হেডমাস্টার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আচমকা একটা অপরাধবোধ ধাক্কা দেয় তাকে। মনে হয় হয়তো ওর পাথরের আঘাতেই উনি অসুস্থ হয়েছেন। এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে পথ খুঁজে পায়না। শুধু চারিদিকে “অনুভূতি” “অনুভূতি” রব শোনে। মানে কী কে জানে! নীল পাঞ্জাবী বাড়ীতে ফেরার পথে ইয়াগাতাকে সঙ্গে নিয়ে নেয়। সেখানে কচি কলাপাতা পাঞ্জাবী পরা আরেকটি লোক বসে ছিলো।

 -  এইটা জাপানী ছেলে ইয়াগাতা। কোত্থেকে যেন এসে হাজির হয়েছে। খুব সাহসী ছেলে! - তাই নাকি! এমন সাহসী ছেলেই তো চাই। ওকে আমি আমার শিশু পার্টিতে নিয়ে নিতে চাই। কিউট একটা ছেলে।

 - নাহ নাহ ও আমার শিশু পার্টিতে থাকবে। বাড়ীর ওপর তলা থেকে একটি ছেলে ল্যাপটপ হাতে দৌড়ে নেমে আসে।

 - হেডমাস্টারকে কান ধরে উঠবস করানোর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে।

 ইয়াগাতা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে সেই হেডস্যারের ছবি। আবারো অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে সে। বিভিন্ন মিডিয়া থেকে ফোন আসতে শুরু করে। বসার ঘরটাতে; সারা বাড়ীতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নীল পাঞ্জাবী টেলিফোনে একজনকে ধমকাতে থাকে। ইয়াগাতা শুনতে পায় লোকটা বার বার শুটকি না কী যেন বলছে! সে কচিকলাপাতা পাঞ্জাবীকে জিজ্ঞেস করে, - হোয়াট ইজ শুটকি!

-ও কিছু না। পলিটিক্যাল টক।

- ডার্টি টক।

- তা বলতে পারো।
তবে তোমার এই শব্দটা শেখার দরকার নাই। তুমি বলবে, খেলা হবে।

 ইয়াগাতা কয়েকবার প্র্যাকটিস করে, খেলা হবে।    

 এরমধ্যে কয়েকজন লম্বা দাড়িওয়ালা লোক আসে। একজন ইয়াগাতাকে বলে,আসসালামু ওয়ালাইকুম ইয়া গাজী।
 
ইয়াগাতা উত্তর দেয়, -খেলা হবে।

 আরেকজন লম্বা দাড়িওয়ালা নীল পাঞ্জাবীকে বলে, ভাইজান আপনার ওসমানগঞ্জের হেফাজতে আমরা আছি। কচিকলাপাতা পাঞ্জাবী ভাইয়া আছেন; আর সবার উপরে আছেন মুহতারমা; আপনের চিন্তা কী!

- আমার শরীরটা খুব খারাপ। ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। কিনতে ব্যাংককে যেতে পারছি না। একজন হুজুর একটি বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে, যমগুম কূপের পানি। রোগ-শোক-বালা-মুসিবত সব দূর হয়ে যাবে। ইয়াগাতা লক্ষ্য করে পানির রঙ লাল। কিন্তু পানির রঙ সাদা হবার কথা। সে কচিকলাপাতা পাঞ্জাবীকে জিজ্ঞেস করে, ওটা কী ওয়াইন!

 - ছি ছি ওয়াইন হবে কেন! আমাদের ওসমানগঞ্জের সুবিখ্যাত যমগুম কূপের পানি। এটা মেডিসিনের মতো কাজ করে।

- তাহলে তো আমিও খেতে পারি।

- নাহ নাহ এতো ছোটবেলায় এই পানি তুমি খেতে পারবে না। বড় হও। তুমি নিজেই এই যমগুম কূপের পানি বাড়াতে পারবে। তখন যত খুশী খেও।

 এমন সময় ফোন আসে। চারিদিকে শোরগোল পড়ে গ্যাছে। পার্টির আমেরুল মোমেনিনের ফোন। নীল পাঞ্জাবী ফোন ধরে,  তুমি তো আল্লাহর ওলি হয়ে গেছো; কত মানুষ তোমার জন্য হাত তুলে মুনাজাত করছেন; তুমি আর কথা বলোনা। ওলিদের কথা বলতে নেই। আল্লাহ এখন আমাদের পার্টির সঙ্গে আছেন।
 
কচিকলাপাতা পাঞ্জাবী চিন্তা করে আল্লাহ তো তাদের পার্টির সঙ্গে ছিলেন দুইদিন আগেই। এখন আবার ওদের পার্টির সঙ্গে চলে গেলেন!  ফোনটা শেষ করার পরেই নিজের মধ্যে এক ওলি এসে ভর করে নীল পাঞ্জাবীর। উচ্চস্বরে কলেমা পড়তে থাকে। ইয়াগাতা কচিকলাপাতা পাঞ্জাবীকে জিজ্ঞেস করে, - উনি কী সেইন্ট হয়ে গেলেন।

 - হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। ইয়াগাতা বলে, খেলা হবে। কচিকলাপাতা কোথায় কোথায় যেন ফোন করে হাসপাতালে হেডমাস্টারকে দেখতে যাবার কথা বলে। ইয়াগাতা জিজ্ঞেস করে, হসপিটালে কী হবে!

 -খেলা হবে।

 - আমি কী একটু যেতে পারি।

 -সে ব্যবস্থা করে দিতে পারি যদি আমার দলে থাকো।

  - শিওর।
যমগুমকূপের পানি খেয়ে সোফার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে নীল পাঞ্জাবী। কচিকলাপাতা বের হবার আগে ইয়াগাতাকে বলে, কাল তোমাকে হাসপাতালে পাঠাবো।
- থ্যাংক ইউ। আচ্ছা “অনুভূতি” কী; স্কুলে ভিড়ের মধ্যে শুনেছিলাম।

 -অনুভূতি হচ্ছে ডার্টি পলিটিক্সের ক্যাপিটাল বা মূলধন। বড় হলে সব বুঝে যাবে।

 বিদায় জানানোর সময় ইয়াগাতা কচি কলাপাতা পাঞ্জাবীকে বলে, - খেলা হবে। অনুভূতির খেলা হবে।

- আই এম ইমপ্রেসড ইয়াগাতা।

 ঘরটা ফাঁকা পেয়ে ইয়াগাতা যমগুম কূপের পানি একটু চেখে ওয়াক থু বলে ফেলে দেয়। এতো পানি নয়।এ যে রক্ত। কিন্তু কার রক্ত! পরদিন ইয়াগাতা হাসপাতালে যায়। হেডমাস্টারকে ঝুঁকে সম্মান জানায়। হেডমাস্টারের মনে হয় অনেক দুঃস্বপ্নের ভিড়ে এ বুঝি নেহাত স্বপ্ন। ফুলের মত একটি শিশু ঝুঁকে সম্মান জানাচ্ছে।

 - আমাকে সম্মান জানাচ্ছ কেন। আমি তো ডেড। আমি মরে গেছি। সে পকেট থেকে পাথরগুলো বের করে শিক্ষকের পায়ের কাছে রেখে বলে,

 - টিচার আমি আপনার দিকে একটা পাথর ছুঁড়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিন প্লিজ।

 -  এ যুগে কি কেউ কোন অপরাধ করে ক্ষমা চায়!

 ইয়াগাতা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বলে, -  আমি আর কক্ষনো পাহাড় আর শিক্ষককে খাটো হতে বলবো না।

 হাসপাতালের বিছানায় জীবন্মৃত প্রধান শিক্ষক অদ্ভুত এই অন্ধকারে যেন এক টুকরো অমলকান্তি রোদ্দুরের দেখা পান।         

আপনার মন্তব্য