পিথাগোরাসের গল্পকথা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-০৭ ১৪:৫১:৪১

 আপডেট: ২০১৬-০৭-০৭ ১৪:৫৬:০৭

মাসকাওয়াথ আহসান:

ইন্টেরোগেশান সেলে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে একজন এলিয়েনের। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তাকে নেপচুন গ্রহ থেকে পাঠানো হয়েছে।

গোয়েন্দারা জিজ্ঞেস করে, এটা কী করে সম্ভব! আর নেপচুন উন্নত গ্রহ। সেখান থেকে এসে আপনি এমন অনুন্নত ব্যবহার করেন কীভাবে!

এলিয়েন উত্তর দেয়, আমি এমন ছিলাম না। প্রথম আমার মধ্যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস তৈরি করে আমার স্ত্রী। বিয়ের আগে রবীন্দ্র সংগীত গাইতো। আবার নামাজও পড়তো। আমার খুব ভালো লেগেছিলো। কেউ যদি নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা করে আবার আন্তর্জাতিক ধর্ম চর্চা করতে পারে; তাতে অনেক ঔদার্যের সৌন্দর্য থাকে।

---তারপর

--নেপচুনে গিয়ে সে দেশী ভাবীদের পাল্লায় পড়ে গেলো। সেইখানে কিছুদিন মেলামেশার পর সে নিজস্ব সংস্কৃতি ছেড়ে দিলো। বরফ পড়া রাতে আমি তাকে একটা বর্ষার গান শোনাতে অনুরোধ করলাম। সে বলে বসলো, “গান-বাজনা হারাম।“ যে গানের জন্য তাকে ভালো লেগেছিলো; তাই যদি না থাকে, ভালোবাসা তো জানালা-দরোজা যে দিক দিয়ে পারে পালাবেই। নেপচুনেই তার বড় দুলাভাই মসজিদের ইমাম হয়ে গেলো। আমাকে জোর করে নিয়ে যেতো এক জায়গায়। প্রথমেই এক গ্লাস হালাল ম্যাঙ্গোজুস খাইয়ে দিতো। এরপর ওরা যা বলতো তাই ভালো লাগতো। আমাকে ওরা খিলাফতের স্বপ্ন দেখালো।

একজন সিনিয়ার গোয়েন্দা বলে, দেখুন এলিয়েন ভাই খিলাফত এবং গ্রীসের নগর রাষ্ট্রে শাসন ব্যবস্থায় যে গার্ডিয়ান এঞ্জেলদের প্রত্যাশা করা হয়েছিলো; আজকের পৃথিবীতে অমন আদর্শ অভিভাবক পাবেন কোথায়! তাইতো জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনগণই তাদের নেতা নির্বাচন করুক। নেতা ভালো হলেও কৃতিত্ব জনগণের; নেতা বাঁশ দিলেও জনগণ নিজেই তার জন্য দায়ী। এখানে বলার অবকাশ নাই যে জনগণকে না জানিয়ে কতগুলো গ্র্যান্ড মুফতি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া নেপচুনও সারাক্ষণ ডেমোক্রেসি চাষ করছে।

--নেপচুন খুব সাংঘাতিক গ্রহ। কারণ ঐ যে খিলাফতের স্বপ্ন দেখানো লোকগুলোর মজলিশ সেখানে নেপচুনের গোয়েন্দারা আসতো। ওরাই আমাকে ঢাকায় এসে শিক্ষকতা করার বুদ্ধিটা দেয়। কারণ আমি ঐ সময় খুবই কনফিউজড ছিলাম। ভালো লাগছিলো না আমার স্ত্রীর এই মেটামরফোসিস। এরমধ্যে নিয়মিত ম্যাঙ্গো জুস খেয়ে খিলাফতের স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম একটা সুরম্য হারেম। সেইখানে আলেফ লায়লা আমাকে আঙ্গুর খাওয়াচ্ছে আর মিয়া খলিফা অপূর্ব লাস্যে নাচছে।

একজন গোয়েন্দা বলে, এটা মিডল এজ ক্রাইসিস। তবে এর সঙ্গে খিলাফতের স্বপ্ন মেশানো ভুল হয়েছে। তা নেপচুন থেকে কজন এলিয়েন ঢাকায় এসেছে!

--অসংখ্য। কারণ মাদ্রাসা খুব বেশী স্পট লাইটে এসে গিয়েছিলো। নেপচুনের লোকেরাই বুদ্ধি দেয়, এবার টার্গেট করুন ধনী পরিবারের ছেলেদের। গরীবের ছেলেরা খিলাফতের স্বপ্ন নিয়ে শ্রেণী সংগ্রামে লেগে থাকবেই। কিন্তু বড় লোকের ছেলেদের মাথায় নকশাল আন্দোলনের মত খিলাফত আন্দোলনের হিরোইজম ঢুকিয়ে দিতে পারলেই ব্যাপারটা অনেক ট্রেন্ডি হবে। শাপলা স্কোয়ার দিয়ে খেলাটা জমেনি। গুলশান স্কোয়ার তৈরি হলে সিএনএন “ঢাকা হ্যাজ ফলেন” ফিল্ম-এর স্যুটিং করতে পারবে। দুর্বল গভর্ন্যান্স যেখানে, যেখানে সুশাসন নেই তাকে ফেইল্ড স্টেটের তকমা দিয়ে দেয়া খুব ওয়ান-টুর ব্যাপার।

--তা আপনি কী পড়াতেন!

--পিথাগোরাসের কথাসাহিত্য।

--এতে কী থাকে! গল্পটা কী!

--নায়কের লক্ষ্য যেহেতু ইসলামকে নির্বাসনে পাঠানো; তাই তাকে ফুটবল খেলতে হবে; ভারতীয় সেলিব্রেটির সঙ্গে সেলফি তুলতে হবে; সব কিছুই ট্রেন্ডি হবে। কিন্তু ম্যাঙ্গোজুস খেলেই তার সেই বান্ধবীকে ভালো লাগবে যে আরব সাকীর মত দেখতে। নায়ক হ্যান্ডসাম হলে সুবিধা হচ্ছে সে যখন খলনায়ক হয়ে মানুষ হত্যা করে; তখন তার প্রতি সিমপ্যাথি তৈরি হয়। সে মারা যাবার পরেও তার সঙ্গে কিছু মেয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে চায়। এটা স্টকহোম সিনড্রোম তৈরি করলেই খিলাফতের সৈনিক বাড়বে।

--তা আর্টিজান হামলায় আপনার ভূমিকা কী!

--সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব তো আপনাদের। পিথাগোরাস বলেছেন, সব যদি তুমিই বলে দাও; তাহলে গোয়েন্দাদের অযথা বেতন দেয়া দরকার কী! আর আমি সব বলে দিলে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রাইভেট ডিটেক্টিভরাও বেকার হয়ে যাবে। ওরা তো দাবী করছে; আমাকে তারাই খুঁজে দিয়েছে।

গোয়েন্দা বলে, ভাই একটা অনুসন্ধান তো গরম গরম জিলাপি ভেজে দেয়া নয়; এতে সময় লাগে। নেপচুনেও গোয়েন্দারা সময় নেয়। যারা আর্টিজান থেকে বেঁচে ফিরেছে সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আপনি একা নন। যে শিক্ষাব্যবস্থা আর সমাজ রচিত হয়েছে তাতে বুদ্ধির বিকাশ হয়নি। এইখানে খুনি বানানোও সহজ; আবার খুনের পর সমস্ত মৃতদেহের রক্ত চেটেপুটে খাওয়া ক্যানিবালের সংখ্যাও অসংখ্য।

আরেকজন গোয়েন্দা জিজ্ঞেস করে, -তো অন্তত: একটা ক্লু দিন! নেপচুনের ইন্টারেস্ট কী!

--যে ইন্টারেস্ট ইরাকে-সিরিয়ায় একই ইন্টারেস্ট বাংলাদেশে।

--বৃটিশ-পাকিস্তানের সেনারা যে বাঙ্গালের দাবড়ানি খেয়ে পালিয়েছে; সেখান থেকে নেপচুন কী কিছুই শেখেনি!

---ঐ যে উনি বললেন শিক্ষা-সংস্কৃতির বারোটা বাজলে, বারোটা পাঁচ মিনিটে সে সমাজ কাঁচের প্রাসাদের মতো ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়েই। স্বয়ং পিথাগোরাসও এ কথা বলেছেন।

গোয়েন্দারা বুঝতে পারে এই লোকের সঙ্গে কথা বললে সে পিথাগোরাসের কথাসাহিত্যের গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে। তাই ক্ষান্ত দেয়।

একজন নিহত জঙ্গির আব্বাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ভদ্রলোক কাঁদছে। সমাজ তার দিকে পাথর ছুঁড়ছে। অথচ তার ছেলেটি হারিয়ে যাবার পর পুলিশে জিডি করা হয়েছিলো। অনেক অনুরোধের পরেও মন্ত্রীরা কেউ পাত্তা দেয়নি। সবাই ভীষণ টোয়েন্টি-টোয়েন্টি খেলছে; আর দেশবাসীকে রূপকল্প ৪২০-এর রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে। মাঝখান থেকে ছেলেও গেলো; খুনি পরিবার হিসেবে ফেসবুকের পশ্চিম ঘুরে সব বুঝে ফেলা “ক্যামনে পারেন ভাইয়া- আপ্পিরা সবাই গালাগাল করছে। বলছে ইংরেজি জানা ছেলেরাই খুনি হয়; ভদ্র ছেলেরাই খুনি হয়। পড়াশুনায় দুর্বল; ইংরেজি না জানা অভদ্র ছেলেরাই দেশপ্রেমিক হয়।

একজন গোয়েন্দা বলে, তা ঠিক এই সার্টিফায়েড দেশপ্রেম করার জ্বালায়ও তো বাঁচিনা। অবৈধ ভিও আইপি ব্যবসা, ইয়াবা ব্যবসা, রানাপ্লাজা ব্যবসা, গ্যাং-এর ব্যবসা আরো কত কী! তবে আপনার উচিত ছিলো ছেলেকে আরেকটু বাস্তববাদী করে গড়ে তোলা। একটা চিড়িয়াখানার বাঘকে জঙ্গলে ছেড়ে দিলে বন্য কুকুর এসে তাকে খেয়ে ফেলতে পারে; কারণ সে ডিফেন্স মেকানিজম ভুলে গেছে চিড়িয়াখানায় থেকে। এখন আমরা জানতে পারছি অনেকের ছেলেকেই ওরা তুলে নিয়ে গ্যাছে জঙ্গি বানাতে। আমরা খুঁজছি।

--আপনারা আমার জিডিটা যদি গুরুত্বের সঙ্গে নিতেন; তাহলে আর্টিজানের ঘটনার অনেক আগেই এ খবর পেতেন। একটা করে ঘটনা ঘটবে আর এক একটা জিনিস আপনারা উদ্ভাবন করবেন; বাংলাদেশটা কী গবেষণাগার!

--আর বইলেন না ভাই; একদলের মাথা গেছে ঘুষ খাইতে খাইতে; আরেকদলের মাথা গেছে ফর্মালিন মেশানো ভেজাল খেয়ে; ফলে পুরা সিস্টেম ভেজাল আক্রান্ত।

ওদিকে আর্টিজান ট্র্যাজেডির ভিডিও দেখে একে ওকে দোষী প্রমাণ করার “হাঙ্গার গেম” খেলছে ফেসবুকের ডিটেকটিভেরা। এদের সবাই একাধারে গোয়েন্দা, গণক, গদ্যকার, গোবর ছোঁড়া বিশেষজ্ঞ; যাকে বলে গব্যসাচী। চারিদিকে নানা রাজনীতির বাঁধা দাস-দাসীরা যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে কট্টরপন্থার চর্চা করছে। সোশ্যালাইটরা ট্রেন্ডি পশ্চিমা পোষাক পরে ভাবছে বিরাট জাতে উঠে গেছে। তারা এসে সামাজিক পুলিশি করছে, অই ঘোমটা দিছস কা! আবার খিলাফতাটাইটসরা সৌদী পোষাক পরে বেহেশতের পাসপোর্ট কিনেছে। তারা এসে সামাজিক পুলিশি করছে, অই ঘোমটা কই!

আর্টিজান হত্যাকাণ্ডে সফল হয়ে খিলাফতের স্বপ্নে বিভোর দিকভ্রান্তরা ঘন হয়ে আসছে। অন্যদিকে প্রগতির ঠিকাদাররা লাইক আর ফলোয়ারের নেশায় গেম অফ থ্রোণস খেলছে নিজেদের মধ্যেই। কথিত প্রগতির ফাটলের মাঝ দিয়ে ঢুকে পড়ছে ম্যাঙ্গোজুস খাওয়া খিলাফতী রোবটেরা।

গোয়েন্দারা উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে। খিলাফত প্রেম সমিতি আর দেশপ্রেম সমিতির ক্রসফায়ারে জীবন দিচ্ছে অনাম্নী হতদরিদ্র মানুষেরা। অন্যধর্মের মানুষদের হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। সচেতন মানুষেরা বুঝতে পারছে না তারা কী করবে! প্রতিবাদ জানালেই উভয় নরভোজী সমিতি নানান-গ্রহের এজেন্ট বানিয়ে দিচ্ছে। চুপ করিয়ে রাখার এই ভিলেজ পলিটিক্সটা এদের দূষিত রক্তপ্রবাহে। প্রতিবাদকে ধামাচাপা দিতে প্রতিবাদী মানুষদের প্রথমে এজেন্ট বলা; কাজ না হলে বেডরুমের রূপকথার গল্প বলা বদ-অভ্যাস এদের। যৌন অবদমনের স্বীকার এই লিবিডো তাড়িত ভ্যাড় ভ্যাড়ে হাফ গাঁইয়া-হাফ মেট্রোপলিটনের নরভোজী “গান্ধা কইরা দিমু” সমিতির উপমানবেরা চারিদিকে থই থই করছে।

নির্ঘুম একজন সরকারী গোয়েন্দা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে কয়েকটা পাখীর গান শোনে। আকাশের দিকে তাকাতেই দেখে তারারা নির্মল হাসছে। এমনকি লনের দূর্বাঘাসের ওপর বৃষ্টির ছিটে পড়ে আনন্দে ঝলমল করছে। সে স্বগতোক্তির মতো বলে, এরকম হিংস্র-নরখাদক-মৃতের রক্ত চেটে খাওয়া জঙ্গল সমাজে সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছে মানুষের একটু প্রশ্বাস নেয়া। যে জীবন বৃক্ষের, পাখীর, তারার, বৃষ্টি এবং সবুজ ঘাসের; তার সাথে কখনো কী হবেনাকো দেখা!

আপনার মন্তব্য