জাস্টিন ট্রুডো’র আত্মজীবনী ‘কমন গ্রাউন্ড’-৮

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-১০ ০২:৪৭:০৯

 আপডেট: ২০১৬-০৭-১০ ০৩:২২:০০

মনিস রফিক:

এই পৃথিবীর পাঠশালায় এটাই স্বাভাবিক
আট.
১৯৮৩ সালে নিউ দিল্লীতে কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সম্মেলনে বাবা এবং আমি বাংলাদেশে যাত্রা বিরতি করেছিলাম। কানাডার আর্থিক সহায়তায় তখন বাংলাদেশে একটি বাঁধের প্রকল্পের কাজ হচ্ছিলো। বাবা সেটা পরিদর্শন করতে চেয়েছিলেন। আমরা যখন আমাদের দলবল নিয়ে বিমানবন্দরে নেমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন এক অবিশ্বাস্য ট্রাফিক জ্যামে আমাদের গাড়ী আটকিয়ে গিয়েছিলো। এশিয়ার অন্যতম এক ব্যস্ত শহরের সেই মটর বহরের এক সরকারী গাড়ীর পেছনের সিটে বসে আমি ঠাণ্ডায় জমাট হয়ে যাচ্ছিলাম।

আমাদের চারপাশের সবাই এবং সবকিছুই একবারে নিথরভাবে থেমে ছিল। সবাই অপেক্ষা করছিল কখন ট্রাফিক ছাড়বে আর আবার সবাই চলা শুরু করবে। আমি গাড়ীর ভেতরে বসে জানালা দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। হঠাত একজন বৃদ্ধকে দেখে আমার চোখ আটকিয়ে গেলো। বৃদ্ধটি তার সাইকেল নিয়ে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছিল, মনে হচ্ছিলো আমাদের গাড়ীর বহরটি গেলেই সে তার সাইকেল নিয়ে রাস্তা পার হবে। আমি ভালোভাবে তাকে লক্ষ্য করতে থাকলাম। দেখলাম, বয়সের ভারে তার মুখের চামড়া কুঁচকিয়ে গেছে। তার মুখে ছিলো এক ধরনের বিরক্তির ছাপ। তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম তার স্বাভাবিক চলার পথের এই যে বাধা তা তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছতে দেরী করিয়ে দিচ্ছে।

ঐ মুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে আমার বারবার মনে হচ্ছিলো আমাদের দু'জনের পথ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন এক বেদনাবোধ কাজ করছিলো। আমার মনে হচ্ছিলো, আমার কখনোই তার জীবনের গল্পটা জানা হবে না। সে থাকে কোথায় বা সে যাচ্ছেইবা কোথায়। তার জীবনটাই বা কেমন, জীবন নিয়ে তার ভাবনাটা কি, অথবা তার জীবনের স্বপ্ন, সুখ-দুঃখটায় বা কেমন - এগুলোর কিছুই আমি কখনো জানবো না। কিন্তু আমি এটা উপলব্ধি করছিলাম, এই যে আমার জীবনের স্বপ্ন, দুঃখ-কষ্ট, সুখ যেমন আমার নিজের কাছে মূল্যবান, ঠিক তেমনি তার জীবনের স্বপ্ন, দুঃখ-কষ্ট, সুখ তার কাছেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

যেহেতু হঠাত করেই এই বিষয়টা আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিলো, আমার কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছিলো আমাদের এই গ্রহের অসংখ্য কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আমাদের পরিচয়, আমরা শুধু দু'জন দুই ব্যক্তি। আমাদের প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা মানুষ, আমাদের সবার জীবনই একেবারে আমাদের নিজের নিজের, কারো সাথে কারো কোনো মিল নেই আর আমাদের সবারই নিজ নিজ গল্প আছে।

আমি উপলব্ধি করি, এই পৃথিবীর পাঠশালায় এটাই স্বাভাবিক।

আমি প্রায়ই নিজে নিজে ভাবি, ষোল বছরে পা দেবার আগেই আমার জীবনে যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে গেছে তা হয়তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। হয়তো অনেকেই তাদের জীবনের পথ চলায় এগুলো ভুলে যায়, কিন্তু কিছু জন তো আছে তারা এগুলো ভুলে যায় না, বরং এই সব বিষয় ও ঘটনা তাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন করে দেয় এবং সে মতই তারা তাদের জীবনের ধ্যান-ধারণা বা দর্শনকে সাজিয়ে ফেলে। আমি কিন্তু দ্বিতীয় দলে। বাবার সাথে জীবন চলায় আমার জীবনের জ্বলজ্বল করা স্মৃতিগুলোর মধ্যে যদি আমি বিশেষ কোনোটাকে বেছে নিই তাহলে যেটা আমার কাছে বিশেষভাবে ধরা পড়ে তার স্বরূপ বলতে গেলে বলতে হয়, সেটা আপাতভাবে মনে হতে পারে খুবই সামান্য, কিন্তু এর মধ্যে রয়েছে আমার নিজের মধ্যের এক গভীর দোটানা টানাপোড়ন।

এই টানাপোড়নটা হচ্ছে, এক সুবিধাভোগী বাল্যকাল কাটানো একজনের কাছ থেকে তার আশেপাশের মানুষজন উল্লেখ করার মত কী পেল, আর একজন বয়স্ক জন যার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে একটা জং পরা সাইকেল যা থেকে তাঁর ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তাকে নামতে বাধ্য করা হয়, কিন্তু সে কারো কথায় কর্ণপাত না করে নিজের মত এগিয়ে থাকতে থাকে। আমি কিন্তু আমার জীবন এবং আমার আশপাশকে কখনো একইভাবে খেয়াল ও বিচার করিনি।

এই সময়েই কিন্তু আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে থাকি সাচা'র সাথে আমার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা সর্বোপরি ব্যক্তিত্বের একটা বিরাট ব্যবধান তৈরি হচ্ছে। বর্তমান সময়ের মত তখন থেকেই আমার ভাই পরমভাবে বাবার বুদ্ধিবৃত্তিক ও যৌক্তিক চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণাকে মনে প্রাণে ধারণ করে আসছে। বাবার ও তার ব্যক্তিত্বের ধরণটা বলতে গেলে বলা যায় তাঁরা এমন মানুষ, যারা কদাচিৎ কোনো উপন্যাস জাতীয় বই পড়ে থাকে এবং তাও শুরু করে যখন কোনো উপন্যাস বিশেষভাবে আলোড়ন তোলে বা ওটা যদি বিখ্যাত কোনো ফরাসী দার্শনিকের কোনো লেখা হয়। আমার বাবা কিন্তু টলকিয়েন এর 'লর্ড অব দ্য রিংস' এর মত আধুনিক ক্লাসিক'কেও আমলে নিতেন না। তাঁর মতে এসব বইগুলো মানের দিক দিয়ে সত্যিকারে সাহিত্যের অনেক নীচে।

বাবা আমাকে যেসব বই পড়ার জন্য বলেছেন সেগুলো ছিল, আলেকজান্ডার দুমা'র সাহিত্যকর্ম, অর্থার কোনান ডয়েল এর রহস্য গল্প বা এ ধরনের কিছু। একদিন তিনি এডগার রাইস বারোস এর 'টারজান' পড়ার সময় আমাকে তিরস্কার করেছিলেন। আমি তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা প্রতিবাদের সুরে বলেছিলাম, ওটা একটা ক্লাসিক পর্যায়ের লেখা। আমার কথা শুনে তিনি গোঁ গোঁ করে বলেছিলেন, 'ওটা একটা ক্লাসিক আবর্জনা'।

পড়াশুনার ব্যাপারে বাবার সাথে আমার আবেগ ও আগ্রহের যে বিরোধ ছিল সেটাকে এক ধরনের বিপ্লব বলা যেতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের ব্যাপারে তাঁর মনোভাবকে আমি কখনো মেনে নিতে পারিনি। আমার সেই কিশোর মনে, এটা আমার বোধগম্যই হতো না কেউ অন্য কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হবার পরিবর্তে কিভাবে এত প্রবলভাবে স্টিফেন কিং এর উপন্যাসের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। আমার এই প্রবল আকর্ষণ কিন্তু বাবা ও সাচা ভালোভাবে নিতেন না। তাঁদের মতে, "দ্য স্ট্যান্ড" বা " রিটা হেওর্থ এন্ড দ্য শসব্যাংক রিডেমশন" জাতীয় ক্ষুদে উপন্যাস বই'ই সাহিত্যের এ ধরনের স্বাদ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ফলে সাচা'র জন্মদিনে যখন বাবা-মা তাকে বই দেবার পরিকল্পনা করতেন, তখন তার পছন্দের তালিকায় থাকতো বিভিন্ন ধরনের এনসাইক্লোপিডিয়া বা মানচিত্রের বই। সাচা'র এই পছন্দের বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা তখনই কিন্তু অনুমান করতে পারতাম ভবিষ্যতে সাচা একজন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হবে আর সেও এমনটিই চাইতো।

সাচা এবং আমি প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের সাহিত্যের মূল্য নিয়ে তর্কে মেতে উঠতাম। এসব তর্কে আমি তাকে উপলব্ধি করানোর প্রবল চেষ্টা করতাম আমি যে ধরনের কাহিনী গভীরভাবে ভালোবাসি সেগুলোর সত্যিকারের ধরনটা কেমন। আমি অবশ্যই স্বীকার করতাম, এনসাইক্লোপিডিয়া'র মাধ্যমে আমরা তথ্য উপাত্ত সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে পারি, কিন্তু শুধু একটা সুন্দর গল্পই পারে আমাদের অনুভূতি ও আবেগকে অন্যের মনে ছড়িয়ে দিতে। আমি তাকে বুঝানোর চেষ্টা করতাম, কিভাবে সেই গল্পগুলো আমাকে শিখিয়েছিলো অন্যের আবেগ ও অনুভূতির সাথে এক হওয়া যায়।

সেইসাথে কিভাবে সেই গল্পগুলো আমাকে ভালো-মন্দ আর দুঃখ-ভালোবাসা নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছিলো। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার প্রতিই আমার গভীর আগ্রহ ছিলো, কিন্তু আমার বিশেষভাবে ভালো লাগতো ঐ ধরনের গল্পগুলো যেগুলোতে উঠে আসতো সাধারণ কোনো মানুষের কাহিনী যে একটা অসম্ভব শক্তিশালী বা বিস্ময়কর কোনো ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে, যেটাকে নায়কোচিত বলা যায়। কারো বাহ্যিক পরিচয় বা ধন সম্পদ দিয়ে কাউকে বিচার না করা এবং প্রতিজনের ভিতরের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলিকে সম্মান করার যে শিক্ষা বাবা-মা আমাকে দিয়েছিলেন তা যখন নিজে নিজেই ভাবতাম তখনই মধুর সংগীত শোনার যে আনন্দ সেই সুখ মনে প্রাণে উপলব্ধি করতাম।

সেই শিক্ষাটা কিন্তু আমি এখনো আমার জীবনের সাথে ধারণ করি। সত্যিকারের কোনো নেতায় তাঁর আশেপাশের মানুষজনকে নিছক জড় পদার্থ হিসেবে ভাবতে পারেন না। তুমি যদি তোমার চার পাশের মানুষের মধ্যে জিইয়ে থাকা অপার সম্ভাবনাগুলো দেখতে না পাও, তাহলে কোনোভাবেই সেই মানুষগুলোকে ভালো কোনো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে না। হয়তো এই বিশেষ কারণেই, প্রতি মাসে যতই পাহাড় পরিমাণ কাজ থাকুক না কেন একটা বা দুটো উপন্যাস পড়ার মত সময় আমি বের করে নিই।

আমার বড় হবার সাথে সাথে মা'য়ের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছিলো। এবং সেই সময়ই আমি উপলব্ধি করতে থাকি মা'র কাছ থেকে দূরে সরে না থেকে বরং তাঁর যত্ন নেয়া উচিৎ।

আমাদের মা আমাদের ছেড়ে যাবার কয়েক বছর পর একদিন আমার স্কুলে এসেছিলেন। আমি তখন শরীর চর্চার ক্লাসে ছিলাম। আমাকে জানানো হয়েছিলো, মা আমার সাথে দেখা করতে চান। স্কুলের বারান্দায় তিনি আমাকে দেখেই আমার কাছে এসে আমার কাঁধ আঁকড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, "জিমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! সে আর আসবে না। সে যাবার সময় এমনকি তার টেলিভিশনটিও নিয়ে গেছে।"

মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে আর আদর করে আমি তাঁকে আমার সাধ্যমত সান্ত্বনা দিয়েছিলাম। আমি তাঁকে জড়িয়ে রেখেই বারবার বলেছিলাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ওমন ব্যবহারে মা কিছুটা ভালো বোধ করছিলেন। তখন আমার বয়স ছিলো এগারো।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য