দ্য সাইকেল অফ মীর কাশিম

রম্যগল্প

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-০৪ ১২:৩২:০৫

অঙ্কন : সত্যজিৎ চক্রবর্তী

মাসকাওয়াথ আহসান:

মীর কাশিম একটা সাইকেলে চড়ে হেভেনের দিকে যেতে থাকে; কিন্তু পথ যেন শেষ হয়না। অথচ বার্গম্যান বলেছিলো; সামান্য পথ; তারপরেই লবিস্টরা এসে হেভেনে নিয়ে যাবে। কিন্তু এ পথ যে ফুরাবার নয়। হঠাত দেখে একটা কুঁড়ে ঘর। জীর্ণ-শীর্ণ একটা লোক বারান্দায় শুয়ে আছে। একটা শাল পেতে আর একটা শাল গায়ে দিয়ে জবুথবু হয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে সাপের মত।

সাইকেল থামিয়ে মীর কাশিম জিজ্ঞেস করে, হেভেনে যেতে আর কত সময় লাগবে বলতে পারেন!

--আমিও হেভেনে পৌঁছাতে পারিনি। তাই এই লিম্বোতে পড়ে আছি।

আদালতে কেস চলছে। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি আমাকে হেভেনে দেবে না হেলে। ঝুলে আছি কয়েক শতক।

--তা আপনি কে?

--মীর কাশিম

--আমিও তো মীর কাশিম; কী আশ্চর্য ব্যাপার!

--আমি নবাব মীর কাশিম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাকে নবাব করেছিলো; মীর জাফরকে সরিয়ে। প্রজাদের কাছে যথেচ্ছ কর নিয়ে কত সম্পদ গড়েছিলাম; অথচ শেষ পর্যন্ত এই শাল-দুটো বেচে আমার দাফন হয়েছিলো। তাই আদালত এ’দুটো শাল আমাকে দিয়েছে এই লিম্বোর কনকনে শীতে কোনমতে বেঁচে থাকতে।

--নবাব আমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ১২৭ টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েছিলাম শত্রু হিন্দু সম্পদ ও মিত্র বিহারী সম্পদ লুণ্ঠন করে। বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছিলাম। সমাজের মধ্যে মীর কাশিমইজম প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। এখন এমন অবস্থা করেছি; মন্দিরে ঢোলের বাড়ি শুনলেই কাশিমইজমের লোকেরা রেগে গিয়ে হামলা করে।

--তুমি তো দেখছি আমার চেয়েও খারাপ লোক হে! তোমার বিচার দ্রুতই হয়ে যাবে। আমার মতো এতো অপেক্ষা করতে হবে না। তুমি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করো।

মীর কাশিম সাইকেল চালিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে পৌঁছে যায়। দৌড়ে আসে বটতলার উকিল গোয়েবলস। সে অপরাধীদের পক্ষে মামলা লড়ে বেশ নাম কামিয়েছে। গোয়েবলস জিজ্ঞেস করে, কী অপরাধ?

--যুদ্ধাপরাধ।

--শাইছে; সেইরেছে। আমাকেই তোমার লবিস্ট নিয়োগ করতে হবে। আমি গোয়েবলস। নাম শুনেছো নিশ্চয়ই। চলো তোমার নামটা নিবন্ধন করি আগে।

আদালতে মীর কাশিমের নাম নিবন্ধন করা হয়। এদিকে লবিস্ট কথাটা শুনেই মীর কাশিমের বুকের মধ্যে আঁতকে ওঠে। এ-ও যদি বার্গম্যানের মতো ডুবিয়ে দেয়!

গোয়েবলস জিজ্ঞেস করে,
--তা তুমি কী করেছিলে!

--একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যার জন্য “ডালিম” গ্যাসচেম্বার তৈরি করেছিলাম। অনেকটা আপনাদের মতোই।

--তুমি মনে হচ্ছে সাকার ব্যাচের লোক! সে-ও আমার মক্কেল; তারও এমন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ছিলো। তা তোমরা জার্মানি থেকে এতো দূরে বাস করে নাৎসি কৌশল শিখেছো; গর্বে বুকটা ফুলে আসছে।

-- আমরা অবশ্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গণহত্যার টুরিস্ট গাইড ছিলাম। আমাকে একটু হেভেনে যাবার ব্যবস্থা করে দিন স্যার। স্ত্রীকে কথা দিয়ে এসেছি;
আবার হবে গো দেখা
এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো।

--কাজটা কঠিন। যুদ্ধাপরাধীদের হেলেই পাঠায় ওরা। খুব চেষ্টা চরিত্র করলে লিম্বোতে কিছুটা সময়ক্ষেপণ করা যায়। দেখি দানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে কথা বলে; ওরা বিবৃতি দিয়ে কিছু করতে পারে কীনা।

মীর কাশিমের মনে হয়, এই লবিস্ট অপেক্ষাকৃত সত্য কথা বলে। অযথা আশার বিনিময়ে টেকাটুকা নেয়না।

গোয়েবলস ফস করে সিগ্রেট ধরিয়ে বলে, তোমাকে আমার ফি নিয়ে ভাবতে হবে না। আদালত কর্তৃপক্ষই কিছু সুবিধাদি দেয়। তাই নবাব মীর কাশিমের শাল দুটো ফিরিয়ে দিয়েছি। এতো ঠাণ্ডার মধ্যে বেচারা বাঁচবে কী করে!

মীর কাশিম হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তাহলে এখানে টেকা-টুকার ঝামেলা নাই। কায়দা করে কেসটা জিততে পারলেই হয়।

হঠাত গোয়েবলস চিৎকার করে, এইখানে দুইটা চা-আনিস আলমগীর!

--এইখানে চায়ের দোকানও আছে!

--হ্যাঁ ঐ আওরঙ্গজেব আলমগীর আর কী! এখানে চায়ের দোকান দিয়েছে।

মীর কাশিমের মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। তারমানে এইখানেও ব্যবসা সম্ভব। কী ব্যবসা করা যায়; সেটাই ভাবনার বিষয়। সে সাহস করে বলে, স্যার এইখানে আমি যদি “অনুভূতি”-র দোকান দিই সেটা কী চলবে!

গোয়েবলস বলে, সেন্টিমেন্টের বিজনেস মানেই শিওর সাকসেস। তুমি তো কামেল লোক হে!

--ধরেন লিম্বো আর হেলে অনুভূতির ব্যবসা করে আমরা অপরাধী জনমতের ঐক্য গড়ে তুলতে পারলে; কে জানে হয়তো বাধ্য হয়ে আমাদের হেভেনে প্রবেশ করতে দেবে আদালত।

--খুব ভালো আইডিয়া। তবে তোমার প্রথম শুনানিটা হোক; তারপর ব্যবসার কথা ভেবো কেমন!

মীর কাশিমের প্রথম শুনানিতে আদালত কক্ষ সমর্থকে কিলবিল করছে। গোয়েবলস একটু অবাক হয়। উত্তেজিত হয়ে সাকা এসে বলে, আমি এই কেস লড়বো!

গোয়েবলস তাকে ধমক দেয়। শুনানি শুরু হয়। মীর কাশিমের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছে ডিসকোর্সবিদ পিয়াস করিম। সে কথা শুরু করে,

--মাননীয় আদালত, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত অস্বচ্ছ আন্তর্জাতিক মানহীন বিচার প্রক্রিয়ার শিকার মি কাশিম। আমার জানামতে তিনি একজন সফল দরবেশ প্রকৃতির ব্যবসায়ী। এখানে পলিটিকাল ডিসকোর্সটিকে অবশ্যই বিবেচনায় নেয়া উচিত।
আদালত ধমক দেয়, কিন্তু এর বিরুদ্ধে গণহত্যার সমস্ত প্রামাণিক দলিল আমাদের কাছে রয়েছে।

পিয়াস করিম চুপ করে যায়। গোয়েবলস ঢোক গিলে বলে, তখন মীর কাশিমের বয়স কম ছিলো। পাকিস্তানের ঘাতকেরা তার ব্রেন ওয়াশ করেছিলো। তার মনের মধ্যে “ডালিম” শব্দ ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। তাই সে ডালিম হোটেলে নির্যাতন শিবির খুলেছিলো। এমনকি পরে ডালিম নামের একটা লোক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলো। পুরোটা পাকিস্তানের ডালিম ষড়যন্ত্র। মীর কাশিম সহজ সরল ছেলে। ওকে মাফ করে দেন।

আদালত উত্তর দেয়, পাকিস্তানের ঘাতকদের এ কারণেই সরাসরি হেলে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু তাদের বয়ানে পাওয়া যায়, মীর কাশিমদের গাইডেন্স না পেলে তারা এতদিন যুদ্ধ চালাতে পারতো না। তারা তো কিছুই চিনতো না; এরা চিনিয়ে না দিলে।

গোয়েবলস বলে, যেহেতু হেনরি কিসিঞ্জার এখনো মর্ত্যে; পাকিস্তানের ঘাতকরা ঠিক বলছে নাকি মীর কাশিমেরা ঠিক বলছে; এটা জানানোর নির্দলীয় সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই মীর কাশিমকে বেনিফিট অফ ডাউট দেয়া হোক।

আদালত বলে, মীর কাশিমেরা অপরাধ করেছে; কিন্তু কখনো স্বীকার করেনি বা অনুতপ্ত হয়নি। উলটো দাপট দেখিয়ে ঘুরেছে স্বাধীন বাংলাদেশে। অথচ একে ক্রমে ক্রমে প্রায় পাকিস্তানের মত একটি অনুভূতির নরকে পরিণত করেছে। এদের লুণ্ঠন আর হত্যা-উচ্ছেদ তো থেমে থাকেনি। উপরন্তু জিহাদকে ফান্ডিং করেছে। সৃষ্টি করেছে কট্টরপন্থার কালো অর্থনীতি।

গোয়েবলস এতোটুকু না ঘাবড়ে বলে, এই মীর কাশিম এতোগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে এসেছে; সেগুলো লুণ্ঠন করবে এ যুগের নতুন মীর কাশিমেরা; আর অন্য ধর্মের মানুষ উচ্ছেদ করে তাদের সম্পদ লুটে নিচ্ছে নিও-মীর কাশিমেরা। আদর্শ-টাদর্শ সব নাথিং বাট ফান। সেখানে শুধু এই মীর কাশিমকে দোষ দিচ্ছেন কেন!

আদালত স্মরণ করিয়ে দেয়, এখানে ১৯৭১ থেকে ২০১৬-র ধারাবাহিক অপরাধী মীর কাশিমের বিচার হচ্ছে। আগামীর মীর কাশিমদের বিচার হবে ভবিষ্যতে। একে বলা হয় মীর কাশিমের দুষ্টচক্র। ঐ একই বাইসাইকেলে করে আগামীর মীর কাশিমেরা প্যাসেজ টু লিম্বোতে প্রবেশ করে এই আদালতে আসবে। তখন তাদের অপরাধের বিচার হবে। আজ যে মীর কাশিমের শুনানি হচ্ছে তার অপরাধ নবাব মীর কাশিমের চেয়ে অনেক বেশী হওয়ায় তাকে লিম্বোতে রাখা যাচ্ছে না। এক্ষুণি তাকে হেলে পাঠানো হোক।
আদালত কক্ষ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসে মীর কাশিম। লবিস্ট গোয়েবলসকে বলে, স্যার আমাকে বাঁচান।

গোয়েবলস আদালত প্রাঙ্গণের বটতলার একটা চেয়ারে এলিয়ে বসে ফস করে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে বলে, হেলে গিয়ে একটা কাঁটা-অলা গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়ো। আমি তো আছিই।

মীর কাশিমকে হেলের পুলিশেরা ধরে নিয়ে যায়।

গোয়েবলস চিৎকার করে, একটা চা-আনিস আলমগীর।

আওরঙ্গজেব আলমগীর দৌড়ে এসে গোয়েবলসকে চা দেয়।

আপনার মন্তব্য