বর্গমাইলের পদাতিক : ২৪-২৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-০৬ ১৪:৪৩:৪৫

রাজা সরকার:

ব র্গ মা ই লে র প দা তি ক
২৪
ক’দিন বলা সত্ত্বেও সুবোধের আর দুপুর আসা হয় না। একা একা দুপুরে তার কান্নাও পায় মাঝে মাঝে। কিন্তু সুবোধকে কথা দিয়েছে আর কাঁদবে না। কাজের বাড়ির কর্ত্রী, যাকে এখন জাহানারা মাসি বলে ডাকে, আজ এক শাঁখাওলাকে ডেকে তার হাতে একজোড়া শাঁখা পরিয়ে দিল। দুটো লাল চুড়িও কিনে দিল। বললেন—সধবা মানুষের হাত আমি খালি দেখতে পারি না। সুবোধ এলে এগুলো দেখাতে পারতো। এরমধ্যে একদিন বললেন—এই মেয়ে তুই-তো ছুটি নিস না-রে। সপ্তাহে একদিন ছুটি আছে তোর। আর শোন রবিবার করে তুই এখন ছুটি নিবি। রবিবারে বাড়ির সবাই থাকে—কাজ কর্ম আমরা করে নেব। তোর শরীর দেখে-তো আমার সন্দেহ হয়—নিজে-তো কিছু বলিসও না। যাক এমাস থেকে তোর মাইনে আরো পঞ্চাশ টাকা বাড়ানো হলো। ভালো খাওয়া দাওয়া করবি। লজ্জায় কৃতজ্ঞতায় জাহানারা মাথা নিচু করে মাসির পা’এর কাছে বসে থাকে। মাসি মনে মনে ভাবে এই যুগে এমন মেয়ে কোথায়, কার ঘরে জন্মালো—ভগবানের কী লীলা কে জানে !

দেখতে দেখতে আরো ক’মাস চলে গেল। অল্প সময়ের শীত এসে চলেও গেল। তবু রাতের বেলা এখনও ঠাণ্ডাটা যাব যাব করেও যাচ্ছে না। সুবোধের এখন বাড়ি ফেরার কোন ঠিক থাকে না। অনেক সময় বেশ রাত হয়ে যায়। আগে সুবোধকে দিয়ে অনেক অফিসের কাজ করাতো,কিন্তু এখন কিছুদিন যাবত নাকি সারাদিন বাইরে বাইরে কাজ করতে হয়। ঠিকাদারের কাজ কি—কে জানে ! সারাদিন নাকি লোহা সিমেন্টের ট্রাকে করে ওখানে পৌঁছাও, সেখানে পৌঁছাও। সুবোধ প্রায় বিধ্বস্ত। কিন্তু তবু সব কাজে সুবোধ। কিছুটা বিদ্যে বুদ্ধি আর ইংরেজি জানার কারণে প্রথম প্রথম নাকি মালিকের সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু ঠিক মত কাজ হাসিল করার দক্ষতা দেখে পরে সুবোধকে মালিক অনেক কাছের করে নিয়েছে। কিন্তু এই কাছের লোক হওয়ার বিপদ সুবোধ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কারণ তাকে প্রায়ই পুলিশের কাছে প্যাকেট পৌঁছাতে যেতে হয়। এসব অসহ্য মনে হলেও সে কাজ ছাড়তে পারছে না। কারণ সেটা নিরাপদ হবে না অন্তত এখানে থেকে। এসব কারণে প্রায়ই সুবোধ খুব মনমরা থাকে। জাহানারা যতটা সম্ভব তার মানসিক সঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করে। সমস্যার ভাগ নিতে চায়। কিন্তু সুবোধ জানে জাহানারা তার ভার লাঘব করতে পারবে না। তবু তার এই মনোভাব সুবোধকে ভীষণ তৃপ্তি দেয়। মাঝে মাঝে ভাবে এই মেয়েটার মধ্যে এত ভালবাসা লুকিয়ে ছিল !—কোথায় বাংলাদেশের কোন গণ্ড গ্রাম থেকে ভাসতে ভাসতে আসা মেয়ে—কিছুই সে হারায় নি দেখছি। শুনেছি মানুষ নাকি ধ্বংস হতে পারে কিন্তু হারে না। সত্যি তাই? জাহানারাকে দেখে কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। তাই-তো সুবোধ বার বার অবাক হয়, বাইরের থেকে বয়ে আনা সব গ্লানি ওর স্পর্শ পেলেই কেমন দূর হয়ে যায় দেখে।

ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে সুবোধ। ঠিকাদারের বে-আইনি কাজের সুবাদে। সুবোধ কর্মচারী, আইনি বে-আইনি নিয়ে মাথা ঘামানো তার কাজ নয়। কিন্তু কাজের সূত্রে পুলিশের কাছে যাতায়াত তাকেই করতে হয়,--আর ভয়টা সেখানেই। ধীরে ধীরে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির শিকার হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। মাঝে মাঝে ভাবে সেই কবে থেকে সে পুলিশি সংস্পর্শ চেষ্টা করেও এড়িয়ে থাকতে পারছে না। বিপদ-তো একটাই, সে এখনও পুলিশের খাতায় ফেরার। সেটা এখানে এবং ওখানে—দুই দেশেই।

এখন একটা বড় কাজ শুরু হয়েছে কন্‌স্ট্রাকশানের। কাজের সাইটে একদিন মালিক ডেকে বললো—‘একবার শিলিগুড়ি যেতে হবে যে জয়দেব—একটা পেমেন্ট আর কিছু কাগজ পত্র পৌঁছাতে হবে—ওখানকার অফিসে আমি বলে রেখেছি—কোন অসুবিধে হবে না’।

কথাটা বলে মালিক নিয়ম অনুযায়ী কর্মচারীর কথা না শুনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে আর একবার বললো—‘কাল দুপুরে অফিসে এসো একবার, কথা হবে, আর অফিস থেকে টিকিটটাও নিয়ে নেবে’।

মালিকের চলে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে সুবোধ এবার আবার একটা বিপদের ঝুঁকি প্রত্যক্ষ করতে পারলো। শিলিগুড়ি যাওয়ার অর্থ তার কাছে খুব পরিষ্কার। ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকছেই। যাওয়া ঠিক হবে কি হবে না বুঝতে পারছে না। সাইটের ম্যানেজারকে বলে আজ একটু তাড়াতাড়িই সে বেরিয়ে গেল। বঙ্কু ঠিকাদার নামে একজনের কাছ থেকে একটা পেমেন্ট আনার কথা আছে। ক’দিন থেকে দিচ্ছি দেব করছে। তার মালিক, শিবু মিত্তিরও বেশ বিরক্ত। সুবোধের বেশ ক’মাসের পরিচয় বঙ্কু ঠিকাদারের সঙ্গে। তার অভিজ্ঞতা এই লোকটা সম্পর্কে একদম ভাল-না বলা ভুল, বলা ভাল শূন্য। পৃথিবীতে না-মানুষের অনেক সৃষ্টির কথা শোনা যায়। কিন্তু শূন্য মানুষ আসলে আগাছা। সুবোধের ধারণা লোকটার জন্ম অপরাধের গর্ভে। মনে হয় এমন কোন অপরাধ নেই যা সে করে না। যাওয়া আসার সূত্রে এ বিষয়ে সুবোধ জানতে পারে ওর মুখ থেকেই। সে আসলে ঠিকাদার নয়, অথচ নামের সঙ্গে কী করে ঠিকাদার কথাটা জুড়ে গেল সে নিজেই জানে না। বোধ হয় ঠিকাদারদের অবৈধ কাজের সঙ্গী বলেই এটা হয়েছে। তার কাজ সবই অবৈধ। সে নিজেই বলে এবং গর্ব করেই বলে। যে কাজে অবৈধতা দরকার বঙ্কুকে ডাকো, কাজ হয়ে যাবে। সাইটের চৌকিদার কাউকে না-বলার শর্তে একদিন বলেছে যে শোনা যায় সুপারি কিলিং-এর ফাইনান্সারও নাকি সে হয় এবং সোনাগাছিতে মেয়ে-বিক্রির একটা সিন্ডিকেটও নাকি সে চালায়। আজ কী হলো কে জানে—পেমেন্ট পাবে না জেনেই সুবোধের যাওয়া, অথচ যেতে না যেতেই ক্যাশ পেমেন্ট দশ হাজার টাকা কাগজে মুড়ে দিয়ে দিল। এখানে ওখানে টাকা পয়সা আনা-নেয়ার কাজে সুবোধ বিশ্বস্ত। তবু বঙ্কু তাকে সতর্ক করে দিল টাকাটা যেন সে সাবধানে নেয়। সুবোধ বঙ্কুর অফিসের বাইরে এসে এক দলা থুথু ফেলল। মনে মনে কয়েকটা খিস্তি আউড়ে নিলো। নিজের উদ্দেশ্যে না বঙ্কুর উদ্দেশ্যে—কার উদ্দেশ্যে বোঝা মুস্কিল। এখন তাকে আবার অনেকটা পথ ডিঙিয়ে মালিকের অফিসে যেতে হবে।

২৫
বেলা পড়ে আসছে। এবার উঠতে হবে। শরীরে একটা আলস্য বাসা বেঁধেছে জাহানারা বুঝতে পারে। কিন্তু কারণ বুঝতে পারে না। আজকাল আর বিকেলের দিকে মাসির বাড়িতেও যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু যেতে হয়,কয়েকটা কাজ পড়ে থাকে বিকেলের জন্য।

আজ জাহানারা সবে উঠতে যাবে, এমন সময়ই দরজার ফাঁক দিয়ে একটা মুখ। প্রায় আঁতকে উঠেও জাহানারা সামলে নিয়ে দেখে সুবোধ।

--কী চমকে গেছ খুব?

--হ, তা একটু—কিন্তু অসময়ে আইলা যে—শরীল ঠিক আছে তো? এই বলে জাহানারা এগিয়ে গিয়ে সুবোধের গা’এ হাত দিতে চায়—কিন্তু সুবোধ সেই সুযোগ না দিয়ে জাহানারাকে পাঁজা কোলে করে তুলে নেয়। বলে—

--সময় অসময় বুঝি না। বলতে বলতে জাহানারাকে বিছানায় আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে সে দরজা বন্ধ করে ঘুরে তাকাতেই দেখে জাহানারা উঠে বসে পড়েছে। অবাক চোখে এক দৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

সুবোধ ঘরে ঢুকতেই গন্ধটা জাহানারা পেয়েছিল। জানে এটা মদের গন্ধ। আগেও দু’তিনদিন পেয়েছে। বারবার সুবোধকে বলেও-ছে এই গন্ধটা পেলে আমার শিলিগুড়ির কথা মনে পড়ে। খুব কষ্ট পাই। বলেনি যেটা, সেটা হলো অনতি পুরনো সেই ভয়টা আবার শরীর মনে পাথরের মত আছড়ে পড়তে থাকে। এতো আমার সহ্যেরও বাইরে সুবোধ! তবু সুবোধ বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে কষ্টের কথা কি জোর করে ভোলা যায়—কষ্টের উপর সময়ের প্রলেপ না পড়া পর্যন্ত কষ্ট-তো সহ্য করতে হয়। আর সেই জন্য-তো আমি আছি। প্রতি মুহূর্তেই তুমি মনে করবে সেই কষ্ট আমি তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিই। এভাবেই-তো আমরা একজন আরেক জনের কষ্ট ভাগ করে নিচ্ছি। আর সেই জন্যই-তো আমরা এক সঙ্গে থাকছি—তাই না? আর দোষটা মদের নয়—দোষটা মানুষের।–এভাবে এতো সুন্দর করে সুবোধ বলতে পারে যে জাহানারা সহজেই তার কষ্টের কথা কিছু সময়ের জন্য ভুলতেও পারে।

কিন্তু আজ ব্যাপারটার প্রতিক্রিয়া একইরকম হলো না। অথচ কতদিন দুপুরের দিকে সে সুবোধকে আশা করেছে। কতদিন ভারী হয়ে ওঠা একাকীত্ব নিয়ে একসময় কাজে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে বলে বেরিয়েও গেছে।

দরজা বন্ধ করে আবার কাছে যেতেই জাহানারা বলে উঠলো—

--মুখে গন্ধ পাই য্যান—

--ও-হো—আর বলো না---।সুবোধ আর বলতেও পারলো না। জাহানারা দু হাতে তার জামা ধরে টানতে টানতে বিছানার উপর শুইয়ে দিল। তারপর বলতে লাগলো—আমি কিছু জানি না, জানতাম চাই-ও না—তুমি কইলাম আর ঐ সব খাবা না—খাইলে আমি কইলাম আল্লাহ্‌ তোমারে ছাড়তো না। বলতে বলতে জাহানারা সুবোধের হাতের টানে ঝরে পড়লো সুবোধের বুকের উপর। তবু জাহানারা বলতে লাগলো—হায়, কারে আমি কী কই—কে আমার কথা শুনে—উফ্‌ আর পারি না। একসময় আর কথা বলতেও পারে না জাহানারা।

সন্ধে হয়ে গেছে একটু আগেই। জাহানারা চোখ খুলে দেখে ঘরময় আবছা অন্ধকার। বাইরের সদ্য জ্বলা আলোর রেশ ঘরময় ছড়িয়ে আছে। পাশে সুবোধ ঘুমে বেহুশ।

বিছানা থেকে নেমে এসে একটা অর্ধেক পোড়া মোম জ্বালিয়ে সুবোধকে কিছুক্ষণ ধরে দেখলো সে। এই কি সেই সুবোধ—যাকে সে চেনে অথবা চেনে না—অথচ কি মায়া জড়ানো মুখখানি। শুধু আপনই মনে হয়। জন্মাবধি একজনকে এই আপনার জন ভাবার পরিসর বা সুযোগ কোথায়-ই বা ছিল--। জেগে থাকলে এসব দেখার অবসর হয় না। কিন্তু এখন একটু চোখ ভরে দেখতে গিয়েও কত সংশয়। না, থাক।

জাহানারা দরজা খুলে বাইরে এলো। সামনেই রেললাইন। কিছুক্ষণ পরপরই গাড়ি যায়। কাজের বাড়ি যেতে হলে লাইন পার হয়েই তাকে যেতে হয়। দেরি হয়ে গেছে—আজ আর কাজের বাড়ি যাবে কিনা ভাবছে। শরীরের ক্লান্তি এখন মনেও ছড়িয়ে পড়েছে। আলো ঠিকরানো রেললাইন যেন তা ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম এই রেললাইন দেখে তার বুক কাঁপত। ভয় করত। এখনো করে হয়তো। তবে সয়ে গেছে বলে এখন আর অতটা টের পায় না। আজ আবার কেন সেই ভয়টা এসে উঁকি দিচ্ছে ! মনটা এত ভারীই বা বোধ হচ্ছে কেন? হঠাৎ করে সুবোধের আসাটা তার কাছে কাঙ্ক্ষিত হলেও সুবোধকে দেখে কেমন যেন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। খুব বেশি বুঝতে না পারলেও সংশয় জাগে যে এখানকার বেঁচে থাকার তীব্রতার মধ্যে সুবোধ কি খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে ! তার নিজের শরীরের অবস্থাটার কথাও-তো সুবোধ জানে না। জানানো হয়নি। জানানোর মতো যেন অবসরই নেই। আর জানাবেই বা কী, ভাবলে নিজেরই কেমন অসহায় বোধ হয়। আসলে তারা-তো এখনও ভাসমান। গন্তব্য-হীন ভাসমান জীবনে সন্তানের কথা ভাবতে গিয়ে জাহানারার চিন্তা ভাবনা কেমন জট পাকিয়ে যায়।

এ-সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে জাহানারা হঠাৎ করেই ভীষণ রকম চমকে উঠলো। নিকটবর্তী লাইন দিয়ে ট্রেনটা প্রচণ্ড গতিতে চলে গেল। কিছুটা কেঁপেও উঠলো জাহানারা। রেল লাইনের ধারে ধারে ঘর—সে কি অজান্তে লক্ষণ রেখায় পা রেখেছিল? ভাবার আগেই সে ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে সুবোধের পাশে বিছানায় মুখ গুজে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। তখনও সে কাঁপছে। পেটে সন্তানের ভ্রূণ—এই ভাবনায় জাহানারা ভেতরে ভেতরে এক ভাঙনের মুখে গিয়ে পড়ল। আর কাঁদবোনা—সুবোধকে দেয়া সেই কথার অনেকদিন পর একসময় সে কান্নায় প্রকৃতই বিস্রস্ত হয়ে পড়লো।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য