বুকপকেটে রাঙতামোড়া কাঠিলজেন্স-২

 প্রকাশিত: ২০১৯-১১-১৫ ১৬:৪২:৪১

মনজুরুল হক:

এমন প্যাচপেচে বর্ষায় কোনোওমতে পা-টিপে ঘরের ডোয়া বাঁচিয়ে একটু ঢালু হওয়া মাটিতে পা পিছলে পড়ার ভয় জয় করে একেবারে উঠোনের সাথে লাগে লাগে এমন ঘরের বারান্দায় লুডো খেলতে খেলতে চালভাজা আর বিড়িটাই মানায়। সেখানে একটা র‍্যালি সাইকেল বের করে জুলু ভাই বলল- ‘চল নড়াল যাই’। চোখ কপালে আমার! বলে কি! এই বিষ্টিতে? তার সেই একই কথা- ‘রেডি হ’। চল নড়াল যাই’…।

ন’কাকার বাড়ি বেড়াতে এসে বড় ভাইয়ের হুকুম অমান্য করার সাহস হল না। পটাপট রেডি হয়ে গেলাম।স্মার্টনেস দেখানোর জন্য ছাতা নেয়া হল না। যদিও জানা কথা, বাইসাইকেলে ছাতা একটা বিড়ম্বনা। জামরিলডাঙ্গা বাজারকে ‘বাজার’ বলার কোনোও কারণ নেই, বিশেষ করে ১৯৭৮-৭৯ সালের দিকে। কয়েকটা ছোট্ট ছাপড়া মুদি দোকান আর একটা পাটের গুদাম আরও গোটা কতক ঢেউটিন, হাড়ি-পাতিল আর চিটেগুড়ের দোকানকে সঙ্গ দিচ্ছে।ওই বড় ঢেউটিনের দোকানকে ‘ঘর’ বলে। তার চেয়ে বড় কথা, দোকানের বিশেষ পরিচিতি মালিকের নামে- ‘জব্বারের ঘর’ কিংবা ‘সাহাদের ঘর’। চা-টা নেই। বেশী করে স্টার সিগারেট আর ম্যাচ নেয়া হলো। সাথে চিনি বিস্কুট। কিসসু না, বিস্কুটটার গায়ে দানা দানা চিনি মাখানো। সাদা। আমাদের সৌভাগ্য এই বাজারে একটা সাইকেল সারাই দোকান আছে। সেখানে দুই চাকাতেই ‘ফুল পাম্প’ দেয়া হল। আমরা যখন প্যাডেল মারলাম তখন আর বিষ্টি নেই।

আধা ঘণ্টা পর চিত্রা পার হলাম হাইল বাওয়া খেয়া নৌকায়। ওপারে উঠে একটু ভালো আর শুকনো রাস্তা পেয়ে সাইকেলের গতি বাড়ল। এবং জ্যেষ্ঠত্ব ফলিয়ে ভাই আমাকেই চালানোর দায়িত্ব দিয়ে নিজে রডে বসল। ঘন ঘন বাঁশঝাড়, আরও ঘন হয়ে জন্মানো আগাছা আর মাঝে মাঝে আকাশছোঁয়া নারিকেল-সুপারি গাছ পেছনে ফেলে এগুচ্ছি…। কিছুক্ষণ পরই বিষ্টি নামল। একটা দোকানে থামলাম। পকেটের ছোট্ট রুমালে গা-মাথা মুছে সিগারেট ধরানো হল। জুলু ভাই এই ব্যাপারে ভীষণ উদার! চাহিবামাত্র বাহককে সিগারেট বাড়াইয়া দিতে বদ্ধপরিকর!

খড়োরিয়া, বিষ্ণুপুর, গাগৈ, রসুলপুর পার হয়ে এলাম…একটা তিন রাস্তার মোড়ে এসে চা দোকান পেয়ে ভাই আমার দয়া করে চালক বদলের প্রস্তাব দিলেন। চা টা খেয়ে এবার তিনি চালাচ্ছেন। আমি রডে বসেছি। আমাদের পাশাপাশি আর একটি সাইকেলে একজন চলেছেন….

নিয়মমতেই তিনি জানতে চাইলেন- কুহানে যাই? আমরাও নিয়ম মেনে বলি- ‘নড়াইল যাই’… তিনি জানতে না চাইলেও আগাম বলি- ‘কাকা বাড়ি যাই.. রাজা কেশব রায়ের বাড়ির কাছে…’

লোকটি মুচকি হাসে। প্যাডেলে জোরে চাপ দেয়। চলে যায়। আমরা দুপুর নাগাদ চিত্রা নদীর পূব পাড়ে হাজির হই। আবার খেয়া পারাপার। নদীর ওপার মানেই নড়াল। এই শহরে আমার প্রথম আসা। বেশ খাড়া উঁচু পাড় বেয়ে সাইকেল ঠেলে উঠে এলাম। ছোট্ট ছিমছাম শহর। পাকা রাস্তায় উঠে সাঁই সাঁই সাইকেল চলছে…..শহরেও সেই গ্রামের আগাছা, বুনো গাছপালা, গোবর, গোয়াল, ধান পচা পানি আর নানাবিধ গন্ধ মিলিয়ে এক অদ্ভুত চেনা চেনা গ্রাম্য গন্ধ!

দুপুর নাগাদ আমরা রাজা কেশব রায়ের বাড়ির কাছে কাকার বাড়িতে হাজির হলাম। মাঝারি, তার চেয়ে একটু বড় এবং একেবারে ছোট তিনখানা ছনের ঘর নিয়ে কাকার বাড়ি। বাঁশের চটা দিয়ে বানানো গেট। সেখান থেকেই সার দেয়া ফুলের গাছ। বাড়ির ভেতর একচিলতে জায়গা উঠোনমত রেখে পুরো বাড়ি বিভিন্ন গাছগাছালিতে প্রায় অন্ধকার। প্রথমেই স্বাগতম জানাল হাসনাহেনা ঝাড়। মাতোয়ারা গন্ধে যেন বলে দিল বিড়ি-সিগারেট বাদ দাওদিকিনি বাপু…. এইখানটিতে এসে বসো…।

কালো পেটানো লিকলিকে গড়নের কাকা বেরিয়ে এলেন। নড়াল ভিক্টোরিয়া স্কুলের হেড মাস্টার। আমি জীবনে এই প্রথম তাকে দেখছি…। ‘অমুকের ছেলে’ পরিচয় পাওয়ার পর জড়িয়ে ধরা, কাকীকে ডাক দেওয়া সবই হলো। গোসল করে খেতে বসার পর একে একে তিনটি বোন আর আমার চেয়ে কবছরের বড় কাকাতো ভাইয়ের সাথে পরিচয়। মেজ মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠে সবার সামনেই বলে বসল- ‘ওমা তুমি দেহি ভাত খাওয়ার সুমায় আঙ্গুল উঁচা করতিছ’! তর্জনী উঁচু হওয়ার বদভ্যেসটা ধরা পড়ায় লজ্জা পেলাম। তা যে এত অকস্মাৎ হবে কে জানত?

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হওয়ার আগেই রূপগঞ্জের এই জায়গায় যেন রাত নেমে আসল। কাকাতো ভাই অরুন নিয়ে চলল বাজারে। ঘোষ কেবিন। হোটেলের নাম ‘ঘোষ-কেবিন’ শুনে বিস্ময় প্রকাশের সুযোগ নেই। কি অদ্ভুত মজার সিঙ্গারা আর ফুলকো লুচি! সন্ধ্যে যত ঘনিয়ে আসছে তত লোক সমাগম বাড়ছে। নড়াল শহরের সব জ্ঞানীগুণী শিল্পী-সাহিত্যিকরা নাকি এখানে আড্ডা দেয়।

রাতে কেমন একটু ভয় ভয় করছিল। এত অন্ধকার। কারেন্ট আসেইনি এই অঞ্চলে। ঘরে টিমটিমে হ্যারিকেন জ্বলছে। রাত ৮টা বাজতেই যেন রাত দুপুর। মেজ মেয়েটি যার নাম খুকু সে ঘরের মাটির সিঁড়িতে বসে অনর্গল বকে চলেছে…
- জানো আমাগে এই হাসনাহেনা ঝাড়ে একবার সাপ আইছিল। কে দেখছিল জানো? আমি!
তার এই গর্বের কথাগুলো বলতে পেরে বেশ হাসিখুশি মুখটা। জুলু ভাই ধমক দিয়ে বললেন-

-তুই নিজ চোখে দেহিছিস?
- হ, দেহিছিই তো, আব্বারে জিজ্ঞেস করেন…
রাত আরও গভীর হলে হ্যারিকেন কমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি….. আর ঠিক সেই সময় যেন কানের কাছে কেউ চিৎকার করে ওঠে… ও ভাই শুনছেন…..শুনছেন ভাই…..
চমকে উঠি! একটু বিরতি দিয়ে আবার সেই ডাক- ও ভাই শুনতি পাচ্ছেন ভাই…..? এবার শেষ দিকে মনে হলো লোকটার গলা ধরে এসেছিল। কেমন যেন কান্নার মত মনে হলো। আমি ফের কান খাড়া করে অপেক্ষা করছি…..নাহ। আর ডাকছে না। অনেক্ষণ পর তন্দ্রা মত এলো….. একটানা ঝিঝি ডেকে চলেছে….হঠাৎ একটা রাতজাগা কুহক ডেকে ওঠে! আবার ভয় পাই। জুলু ভাইকে ঠেলে তুলি। জুলু ভাই বেশ বিরক্ত হন। পাশ ফিরে শোয়ার সময় বিড় বিড় করে বলেন- রহস্য বই পড়ে পড়ে তোর এই অবস্থা… ঘুমা? আরও বেশ অনেকক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ছি… কতক্ষণ জানি না, হঠাৎ সেই ডাক! এবার অনেকটা দূর থেকে আবছা ভেসে এলো- ও ভাই…শুনছেন? শুনতি পাচ্ছেন ভাই……
কিভাবে কখন ঘুমিয়েছি মনে নেই। পরে আর ডাকেনি। সকালে উঠে প্রথমেই রাতের সেই ডাক নিয়ে মনে মনে ভাবতে থাকি…..কাকা বাড়ি নেই। স্কুলে। কাকীও তার স্কুলে। জুলু ভাই সাইকেল নিয়ে চলে গেলেন চার পাঁচ মাইল দূরের এক বন্ধুর বাড়িতে। তার ঢাকা থেকে বাড়ি আসার কথা। আমার সারাদিন কাটল বাড়ি থেকে বের হয়ে রাজবাড়ীর আশে-পাশের পুরোনো বাড়িঘর আর জঙ্গল দেখে দেখে।

রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আমি গত রাতের সেই ডাক নিয়ে কাকার কাছে জানতে চাইলাম। কাকা কিছুক্ষণ চোখ পিট পিট করে আমাকে দেখলেন।
-তুমি কি কালকে ভয় পাইছিলে?

- না কাকা, তবে কেমন যেন লাগতিছিল। মনে হলো লোকটা পাগল।
- পাগল না ও এক অদ্ভুত মানুষ। গত ত্রিশ-একত্রিশ বছর ধরে ডেকে চলেছে…..
আমি চোখ রগড়ে নড়ে চড়ে বসি। জুলু ভাই এমন ভাব নেন যেন এই গল্প বহুবার শুনেছেন। খুকু, মনি, রানী আপা, অরুন তাদের ঘরে চলে যায়। তারা জানে। কাকী বাসনকোসন গোছগাছ করতে থাকেন। কাকা খাটের রেলিঙে হেলান দিয়ে বসেন। হ্যারিকেনের ম্লান আলো কেমন ভৌতিক ভৌতিক মনে হয়। কালকের ঝিঝি’র সাথে আজ যেন তাদের ছেলেপুলেরাও যোগ দিয়েছে। বেজায় শব্দে ডেকে চলেছে….

ওর নাম মোহন। শৈশবে ডানপিটে আর দুঃসাহসী ছিল। তখনও দেশ ভাগ হয়নি। মোহন এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করে আর স্কুলে গেল না। বাড়ির অবস্থাও এমন ভালো ছিল না। স্কুলের লেখাপড়া বাদ দিয়ে ‘বাইরের বই’ পড়ত। সে সময় এই বাইরের বই পড়া ছিল গুরুতর অপরাধ। কার বাড়িতে চাল নেই। কার ছেলে ভর্তি হতে পারছে না। কার জমি কে দখল করেছে তা উদ্ধার করতে হবে। কার মেয়ের বিয়ের টাকা যোগাড় হয়নি, কার ছেলে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গেছে… সেসব দেখার গুরু দায়িত্ব মোহনের।
রাজবাড়ীর তরফদারী কর্মচারী খগেন তরফদারের বাড়ি ছিল ওই রাজবাড়ীর পেছনে। রাজবাড়ীর জায়গাতেই। সময়-অসময়ে রাজ কর্মচারীর ডাক পড়তে পারে বলে সবারই বসবাস রাজবাড়ীর আশ-পাশে। খগেনের একমাত্র মেয়ে সবিতা। বড় দুই ছেলে খুলনায় জজকোর্টে কেরানির কাজ করে। মোহন সবিতার দাদাদের বন্ধু। সেই সুবাদে বাড়িতে অবাধ যাওয়া-আসা ছিল। সবিতা বড় হওয়ার পর একটু একটু বুঝতে পারে তার প্রতি মোহনের দুর্বলতা আছে। একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে নায়েবের ছেলে সলেমান তার দলবল নিয়ে সবিতার পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল। কে যেন মোহনকে খবরটা জানানোর সাথে সাথে মোহন চলে এসেছিল। তার পর বলা নেই কওয়া নেই বাঁশের লাঠি নিয়ে ওই মোহন চার-পাঁচটি ছেলেকে বেদম পিটিয়েছিল। পরে বিচার-সালিশ। কিন্তু মোহন কোনোদিন সবিতাকে কিচ্ছু বলেনি। না একটা চিঠি, না একটা মনের কথা। কোনোদিন পথে-ঘাটেও দূর থেকে তাকিয়ে দেখত না।

৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে গেল। নড়াল থেকে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার কলকাতা চলে গেল। দিঘলিয়া, লোহাগড়া, আশানি, কুমড়ি, বাঁকা-জোকা, খাশিয়াল, পিরোলি, গহরডাঙ্গা, রঘুনাথপুর এসব গ্রাম থেকে শত শত মানুষ রোজ রোজ নড়াল শহরে জমা হয়। সেখান থেকে জমিদার জয়দ্রথ মৈত্রর গোমস্তা কালিকিঙ্কর রায় সবাইকার কলকাতা যাবার ব্যবস্থা করে। কলকাতা, ধানবাদ, এলাহাবাদ, নোয়াখালি, আগরতলা, গৌহাটি এইসব জায়গায় হিন্দু-মুসলমান রায়টের খবর আসছে। সেই সময় নড়াল, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর অঞ্চলগুলোতে প্রায় নব্বই ভাগ হিন্দুর বসবাস। তার পরও তারা পরম্পরায় বুঝে নিয়েছে- এটা এখন আর তাদের দেশ নয়! এটা এখন পাকিস্তান, মানে মুসলমানের দেশ!
এরকম দেশ ছাড়ার তোড়জোড়ের মধ্যে খগেন সাহার পরিবারও কালিকিঙ্করের কাছে ধর্না দেয়। নাম লেখায়। এই খবর মোহনকে জানানোর জন্য সবিতা সন্ধ্যার দিকে রাজবাড়ির পেছনে পথের ধারে বসে থাকে। ও জানে মোহন আরও একটু রাত হলে এই পথে বাড়ি ফেরে। আজও ফিরবে। এবং মোহন ওই পথেই বাড়ি ফেরে….হঠাৎই বৈঁচি গাছের ওপাশ থেকে অন্ধকারে বেরিয়ে আসে সবিতা। দ্রুত মোহনের পাশে পাশে হাঁটতে থাকে….

-আমরা চইলে যাচ্ছি..
-কুথায়? কি কও?
-কইলকেতা। বাবা ওই কিঙ্কর খুড়োর খাতায় নাম লেহাইছে।
-কি কও? ক্যান যাবা? এডা তোমাগে দেশ না?
- জানি না। বাবার কাছে শুনলাম মোছলমানরা নাকি হিন্দুগে কাইটে ফেলতিছে!
- সে তো রায়ট হলি কাটতিছে। এমনি এমনি সব জাগায় কাটতিছে নাহি?
হঠাৎ সবিতার হাত চেপে ধরে মোহন। কেঁপে ওঠে সবিতা! সারা জীবনে এই প্রথম সবিতার হাত ধরেছে মোহন। কতক্ষণ ওরকম ঝিম ধরে দাঁড়িয়েছিল খেয়াল নেই কারো। হাটুরে লোকজনের একটা দল পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সম্বিত ফিরে পায়। আড়াল হয়। তারপর আবার পথে উঠে হাত ছেড়ে দেয়ার আগে মোহন হঠাৎ করেই সবিতার চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে..

- পলায় যাবি সবিতা?
- না, কুথায় পলাব? হিন্দুরে যদি কাইটেই ফেলে তালি পলায় কি করব?
- আমি আছি না?

- তুমিও তো মোসলমান! তুমার লোকজন তো আমারে ধইরে মোসলমান বানায় দেবে!
মোহন চমকে ওঠে! সত্যিই তো। মোহনের মা আর জ্ঞাতিগোষ্ঠী যারা আছে তারা এই মেয়েটাকে আগে মুসলমান করে নেবে, তার পর বিয়ে। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। প্রায় বাড়ির কাছে এসে মোহন সবিতার দুই হাত শক্ত করে ধরে বলে-
- আমিও তুমাগে সাতে কইলকেতা চইলে যাবো..
চকিত বিস্ময়ে দুই জোড়া চোখ খানিকক্ষণ পরস্পরকে নিঃষ্পলক দেখতে থাকে…নিশ্চুপ। কলা গাছের ঝোপ থেকে কয়েকটা বাদুড় ছটফট করে উড়ে যায়…
কখন যে সন্ধ্যে রাত গড়িয়ে মাঝরাত হয়ে গেছে কারো খেয়াল নেই। কাকীমা একবার এসে তেলভর্তি অন্য একটা হ্যারিকেন দিয়ে আগেরটা নিয়ে গেলেন। জুলু ভাই বাইরে যাবার নাম করে সিগারেট ফুঁকে এল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে আছি। কাকা একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন আর তার স্মৃতির খাতা থেকে গড়গড় করে বলে চলেছেন…।

সবিতাদের বাড়ির কাছে এসে মোহন আবারও তার হাত ধরে কথা আদায় করতে চায়-
- বইললে না, আমারে নিবা তুমাগে সাতে?
বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকে সবিতা। যখন মুখ তোলে তখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ!
- তুমার যা যা গুছায়ে নেবার, গুছায়ে রাইখো, আমরা পলায়ে যাবো। কইলকেতা না। অন্য কোনো জায়গায় চইলে যাবো।
বিস্ময় আর খুশী একসঙ্গে খেলা করে মোহনের চোখে। আবেগে সে সবিতাকে জড়িয়ে ধরে। নারী চিরদিনই তার আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সবিতাও পারল। নিশ্চুপ নিষ্কম্প দাঁড়িয়ে থাকল ভাবলেশহীন।

পরদিন সূর্য ওঠার আগেই সবিতা ঠিক করে রাখা চিত্রা নদীর পাড় ঘেঁষে আরও ২ মাইল দূরের বটতলায় এসে দাঁড়াল। একটা একটা করে ঘণ্টা পার হতে থাকে। মোহন আসে না। সূর্য ওঠে। সকাল হয়। গ্রামের বউ-ঝিরা গাঙে নাইতে আসে। কেউ জলের কলসি নামিয়ে উৎসুক হয়। নানাজনে নানা প্রশ্ন করে। সবিতা নিশ্চুপ। ক্রমে ভিড় বাড়তে থাকে। কানাঘুষো চলে। অনেকেই চিনতে পারে। তার পরও সবিতা জলে চোখ রেখে ঠায় বসে থাকে। সূর্য ঠিক মাথাও ওপর উঠে এলে শান্ত পায়ে উঠে দাঁড়ায়। বাড়ির পথে পা বাড়ায়…

মাহেন্দার শম্ভু আগের রাতে সবিতা-মোহনের কথা শুনে ফেলেছিল ঝোপের আড়াল থেকে। যথারীতি কথাটা নায়েবের ছেলে সলেমানের কানে যায়। গভীর রাতে সলেমান দল ধরে আসে। মোহন মূল বাড়ির বাইরে বাহিরবাড়িতে ঘুমাত। মোহন কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগে সলেমানের দলবল মোহনের মুখ বেঁধে পাজা কোলে করে নিয়ে যায়। বেতাং ঝাড় পার হয়ে অশ্বিনী রায়ের পড়ো বাড়িতে নিয়ে তোলে। মুখে কাপড় বেঁধে রাতের বাকি সময় মোহনকে পেটায় ওরা। হাতের দশটা আঙ্গুলই থেঁতলে দেয়। নাকের একপাশে ধান-কাটা কাঁচি দিয়ে কেটে দেয়।কাঁচির মাথা দিয়ে একটা চোখ খুঁচিয়ে তুলে নেয়। খুব সকালে যখন ওরা মোহকে ফেলে চলে যায় তখন মোহন একটা মাংসের দলা! রক্তাক্ত মাংসপিণ্ড।

সকাল গড়িয়ে দুপুর। মোহনকে কেউ খুঁজতে আসে না। সবিতা দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরলে তাকে ঘিরে ফিসফাস। নগেন বেশী উচ্চবাচ্য করে না, কারণ আজকের রাতটুকু পার হলেই তো ওরা চলে যাবে। ঠিক হয়ে আছে খুব ভোরে গাড়ি আসবে।

শান্ত ধীর স্থির একটা অসহ্য দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে পার হয়। রাতে সবিতা বাড়ির বাইরে ডুংখইর গাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসে থাকে। সারাবাড়ি নীরবে তোড়জোড় চলে। গোছগাছ চলে। ফোঁস ফোঁস করে নারীকন্ঠের কান্না শোনা যায়। পুরুষরা ফিসফিস করে। যদিও এখন কেউ আক্রমণ করবে না তার পরও নগেনদের ভয় কাটে না। দেশটা আর তাদের নাই!

গভীর রাতে সারা গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ঘষে ঘষে সেই পড়োবাড়ির বাইরে আসতে পারে মোহন। পেটে দানাপানি নেই। একটা পা বাড়ানোর শক্তি নেই। তার পরও গড়িয়ে গড়িয়ে এক হাত দুই হাত করে এগোতে থাকে মোহন। সে জানে না সবিতারা আজ ভোরেই চলে যাবে, কিন্তু মনের ভিতর কি যেন কামড় দেয়! কে যেন আস্তে আস্তে কানের কাছে বলতে থাকে…সবিতা চইলে যাচ্চেরে মোহন! ও মোহন উঠে দাঁড়া…. উইঠে দাঁড়া মোহন!

তীব্র ব্যথা নিয়ে একটু একটু করে মোহন বড় পাকা রাস্তার কাছে যখন পৌঁছোয় তখন পূবদিকটা রাঙা হয়েছে। একটা দুটো করে পাখিরা উড়তে শুরু করেছে। চিকন মাটির পায়ে হাঁটা পথ সোজা মিশেছে পাকা রাস্তায়। মোহন সেই চিকন রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে এগোচ্ছে….একটা সাপ সড় সড় করে চিকন রাস্তা পার হয়ে যায়। রাস্তার পাশের কাঁটাঝোপে মাংস খুবলে ছিঁড়ে যায়…. গুঙিয়ে ওঠে মোহন! পরমুহূর্তে গড়াতে গড়াতে পাশের গর্তে পড়ে যায়। অল্প পানি হলেও থিকথিকে কাদায় শরীরের অর্ধেকটা দেবে যায়…মোহন চিৎকার করে ওঠে! কিন্তু তার গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না! ভয়ে চোখ বিস্ফোরিত….সে তো কাউকে ডাকতে পারছে না! হঠাৎ করে সবিতার মুখটা মনে পড়ে! শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে- সবিতা!!! ডাকটা ফোটে না! ফ্যাসফ্যাস করে শব্দ হয়! আবার চেষ্টা করে… আবার… এক সময় শরীরে আর শক্তি পায় না। মাটিতে মাথাটা কাতে করে ঘুমিয়ে পড়ে…. স্বপ্ন দেখে একটা গওনা নৌকার চাকা আছে! সেই নৌকাটা ওদের দুজনকে নিয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে….জ্ঞান হারায় মোহন।

সবিতাদের বাড়ি থেকে সূর্য ওঠার আগেই সারি দিয়ে সবাই কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসে। সবিতার মা মাটিতে গড় হয়ে প্রণাম করে। ওর বাবা ঘরের বেড়া, এটা সেটা ছুঁয়ে দেখে…সবিতা একবারও পেছন ফিরে দেখে না। সবাই ওই চিকন রাস্তা দিয়েই গাড়িতে গিয়ে ওঠে। ওরা হেঁটে যাওয়ার সময় শব্দ পেয়ে জ্ঞান ফেরে মোহনের। বহু কষ্টে মাথা কাত করে ওদের দেখতে পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসতে চায়.. পারে না। কাদায় আরও দেবে যায়। আবার মুখটা তুলে প্রাণপণে চিৎকার করে….ও ভাই শুনছেন…..কেউ কি শুনতি পাচ্ছেন….. ভাইরে….. ও ভাই….একটি শব্দও ওর মুখ দিয়ে বেরোয় না! ও মনে করে চিৎকার শুনেছে সবাই….অপেক্ষা করে। অনেক পরেও কেউ সাড়া দেয় না। এবার মাথা তুলে মোহন দেখতে পায় গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে…নিঃশব্দ। সেই নৌকা এটা! চাকা লাগানো… এখনই উড়ে যাবে? এবার তার দেহে যত শক্তি আছে সব দিয়ে চিৎকার করে ওঠে…. গোঙানির মত একটু শব্দ হয়….. অক্লান্ত ডাকতে থাকে মোহন…ও ভাই শুনছেন…? শুনতি পাচ্ছেন ভাই?.... ও ভাই শুনছেন…..

শেষ ডাকটা এইমাত্র ডাকল! ৩১ বছর পর! কাকার মাথাটা নিচু হয়ে বুকের সাথে মিশে রয়েছে…আবারও সেই ডাক… ও ভাই শুনছেন…..ক্রমশ: মিলিয়ে গেলো…..ঝটপট শব্দ করে কয়েকটা বাদুড় উড়ে গেল…..অনেক দূরে কোথাও একটা কুকুর করুণ স্বরে কেঁদে উঠল…এবার আর ভয় করছে না….কানের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে…. ও ভাই শুনছেন…. আমার ডাক কি শুনতি পাচ্ছেন ভাই….সবিতা, আমি বেঈমান না… আমি তুমারে ফাঁকি দিই নাই…কেউ একটু ওরে বলেন না ভাই…… ও ভাই শুনছেন……….

আপনার মন্তব্য