বুকপকেটে রাঙতামোড়া কাঠিলজেন্স

 প্রকাশিত: ২০১৯-০৯-১২ ০৩:২৩:০৬

মনজুরুল হক:

নদীর এই পশ্চিম পাড়ে পায়ে হাঁটা পথ ছিল। যেমনটা হয়। একজন মানুষের পা আড়াআড়ি বা লম্বা যতটুকু জায়গাজুড়ে পা পড়ে ততটুকু ধূসর রঙের মাটি। বাকিটা ঘাস। সেই চিকন মাটির পথ ধরে জলের মত গড়িয়ে হাঁটা যায়। সেই পথটা নেই। পিচ ঢালা পাকা সড়ক এখন। ব্যাটারিচালিত একটা ভ্যান সন্ধ্যের ঠিক আগ দিয়ে এসে থামল। ভ্যান চালক ঘাড় ঘুরিয়ে ইশারায় যেন বলতে চাইল- এইখানে থামব?

ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ভ্যান চলে গেল। ঝুপ করে জায়গাটা সুনসান। একটু শীত শীত করছে। পকেটে হাত পুরো চারপাশটা দেখে নিতে চাইলাম। কোনো কিছুই চেনা মনে হলো না। ধারের কাছে খানিক ঘুরে বিরক্ত দৃষ্টি একটু দূরে যেতে চাইল। একটা বাঁশঝাড়ে বাধা পেয়ে ফিরে এলো। এখানে তো কোনো বাঁশঝাড় ছিল না! রাস্তা থেকে একটু ঢালু হয়ে চাষের জমি নেমে গেছে সামনের বিলে। আধা মাইল দূরে একটা নিঃসঙ্গ তালগাছ ছিল। ঝোপ জঙ্গল আর কলাগাছের ঘন স্যাঁতসেঁতে বাগান শেষে সেই তালগাছটির মাথাটা কেবল দেখা গেল। আর এটিই একমাত্র অচেনা মনে হল না।

আশপাশে কোনো জনমানবের চিহ্ন নেই। মনে হল যেন কোনো মহামারী কবলিত জনপদে এসে পড়েছি! পকেট হাতড়ে সিগ্রেট বের করে ধরালাম। খানিকটা একাকীত্ব কাটল। হাঁটতে হাঁটতে নদী থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছি। আরও একটু এগোতেই সেই উঁচু ঢিবিটা চোখে পড়ল। নীল কুঠির মূল বাড়ির বাইরে একটা ছোট্ট মত কুঠি ছিল। সেটার দেওয়ালে বট গাছ জন্মে এক সময় পুরো দালানটা ঢেকে ফেলে। কালক্রমে মাটিতে দাবতে থাকে এবং ওপরে মাটি জমতে জমতে এক সময় ঢিবি হয়ে ওঠে। ঢিবির পাশে শ্যাওড়া গাছটার নিচে গিয়ে যখন বসলাম ততক্ষণে সূর্য ডুবে গেছে। চল্লিশ বছর আগে এমনই এক সন্ধ্যেবেলা সূর্য ডুবে যাওয়ার অনেক পরেও এখনে বসে ছিলাম মূর্তির মত।

১৯৭১। চিত্রা নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় পঁচিশ বিঘা জায়গা নিয়ে গুরুবরণদের বাড়ি। মূল বাড়িটি এক বিঘার উপর আর বাকি চব্বিশ পঁচিশ বিঘাজুড়ে কলা বাগান। ওই বাড়ির ঠিক কোন লোকটির নাম গুরুবরণ তা জানতাম না। একজনকেই জানতাম এবং চিনতাম সে হল নিবারণী ঠাম্মা। বাড়ির পাশেই একটা দোচালা ঘর ছিল ঠাম্মার। তাকে যে ঠাম্মা বলতে হবে সেও এক ইতিহাসের মত। আমরা নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে ওপারে চলে যেতাম। ওপারটায় ছিল খৈ বাবরা গাছের সারি। গাছগুলো বাঁকা হয়ে নদীতে ঝুঁকে থাকত। মনে হত এই বুঝি হুড়মুড় করে নদীতে ভেঙ্গে পড়বে, কিন্তু পড়ত না। জিলিপির মত প্যাঁচানো সবুজ রঙের ফল। পাকলে গোলাপি লাল হয়ে উঠত। ভেতরে দুধসাদা শাঁস। পাখিদের প্রিয় খাবার। আমাদেরও।

একদিন নদী সাঁতরে ওপারে গিয়ে বাবরা পেড়ে খাচ্ছি…., তখনই ধপধপে সাদা থান পরা এক সৌম্যকান্তি মানুষ ইশারায় কাছে ডাকল। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। মানুষটা আবার ইশারা করল। আমি এগিয়ে গেলাম ভয়ে ভয়ে। কিন্তু তিনি করলেন কি, মাথায় হাত রেখেই বললেন- ‘ভিজে মাথায় বইসে রইছ, জ্বর হবেনে!’

আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছি।

‘তুমি কি ওপারে মাওলানার নাতি? জামা-কাপড় দেখেই চিনা যায় টাউনি থাহো।'

নাতি কি জিনিস জানি না বলে চুপ করে থাকলাম।

এবার তিনি তার থানের আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দিলেন। কেন যেন আমার খুব ভালো লাগল। ঘুরে দেখি আমার সাথে আর যে দুজন ছিল তারা চলে গেছে! মানুষটা আমার হাত ধরে বললেন-‘ চলো, আমাগে বাড়ি চলো, নাড়ু খাতি দিবানি’।
মন্ত্রমুগ্ধের মত ওই মানুষটার সাথে হাঁটছি… উনি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন… এক সময় লাল রঙের ইটে বানানো বড় উঁচু বাড়িটার ভেতরে চলে গেলাম। আমাকে বারান্দায় বসিয়ে তিনি ঘর থেকে কাচের বয়ামে রাখা নাড়ু বের করে দিলেন। নাড়ু হাতে নিয়েই আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি হাত ধরে টেনে বসিয়ে বললেন- ‘খাও। খাওয়া হলি জল খাইয়ে তারপর যাইয়েনে।‘ আমি ‘আচ্ছা’ বলে নাড়ু খেলাম। খাওয়া শেষ হতেই আমি উঠে হাঁটা শুরু করলে তিনি হেসে বললেন- ‘বইলে গেইলে না? কারো বাড়িত্তে যাবার সময় বইলে যাতি হয়’। আমি ভয়ে ভয়ে ‘গেলাম’ বলতেই আবার হাসলেন। ‘আমি কি হই জানো? আমি মাথা নাড়তে বললেন- ‘আমারে ঠাম্মা বলবা।‘

বাড়ি ফিরে এসেও অনেকক্ষণ ধরে বুড়ি মানুষটার ছবি চোখের ওপর ভাসতে লাগল। আমার গরমের ছুটি শেষ হয়ে আসছিল। মনে হলো শহরে ফিরে যাবার আগে ঠাম্মাকে বলে আসি। পর দিন একা একা ওপারে গেলাম। এদিন আর নদী সাঁতরে যাইনি। চামারবাড়ির খেয়া পার হয়ে গেছি।

গুরুবরণদের বাড়িটা ছিল আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে নদীর ওপারে। কিন্তু চামারবাড়ি খেয়াঘাট আরও ভাটিতে। ইয়া ভুড়িঁঅলা গাট্টাগোট্টা রামবরণ ছিল খেয়াঘাটের মালিক। তাকে বাঘের মত ভয় পেতাম আমরা। খাকি রঙয়ের ঢোলা প্যান্ট আর ভুঁড়ি ঠেলে বেরিয়ে আছে এরকম সার্ট। কোমরে একটা চামড়ার বড় বেল্ট। তাতে সব সময় একটা বড় চাকু গোঁজা থাকত। রামবরণ ছিল গ্রামের চৌকিদার। দিনের বেলা তাকে অতটা ভয় লাগত না। কিন্তু রাতে সে যখন ‘কোই হ্যায়’ বলে হাঁক দিত, আমাদের পিলে চমকে যেত।

পার করে রামবরণ পয়সা নিত না। সিস্টেম ছিল সারা বছর সবাই বিনা পয়সায় পারাপার হবে। বতরের ধান উঠলে রামবরণ সবার বাড়ি গিয়ে ধান নিয়ে আসবে। তাহলে আর চামারবাড়ি কেন? রামবরণ মুচি। গ্রামে গরু মরলে রামবরণ শকুনের মত টের পেয়ে যেত। সাথে সাথে তার সেই বড় চাকু নিয়ে হাজির। মুহূর্তে গরুর চামড়া খুলে নিত। তারপর গরুটাকে নদীতে ভাসিয়ে দিত। মাছেরা সেই গরুর মাংস খুবলে খুবলে খেতো। এক সময় মাংস খাওয়া হয়ে গেলে ভুঁড়িটা ভেসে উঠত। ওই বস্তুটার নাম বলা হত- ‘মড়ি’! সেই মড়ির ওপর কাক শকুন বসে খুবলে খুবলে খেতো। ওরা খাচ্ছে, আর ভুঁড়িটাও ভাটির টানে দক্ষিণে ভেসে যাচ্ছে….আবার বিকেলের দিকে জোয়ারের টানে উত্তরে ফিরে আসছে…।

শহরে শহরে তখন যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানি সেনারা বাঙালিদের হত্যা করছে। গুলি করছে। বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আমরা এতটুকুই জেনেছিলাম।

ঠাম্মার বাড়ি ঢোকার আগেই দেখলাম বাড়ির সামনেটায় অনেক মানুষ। ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে দেখি এলাহি কাণ্ড! সব জিনিসপত্তর বাঁধাছাঁদা হচ্ছে। সবাই ব্যস্ত। হৈ হৈ চিৎকার। ছোটাছুটি। এর মধ্যে বাড়ির ভেতর থেকে কেউ কেউ করুণ স্বরে কেঁদে উঠছে। ঘাটে তিনটা বড় বড় গওনা নৌকা বাঁধা। সেই নৌকায় মালপত্তর তুলছে। গ্রামটাতে মুসলমান বেশি হলেও নদীর এই পাড়ে বেশির ভাগ হিন্দুর বাস। গুরুবরণের বাড়ির খুব কাছে কোনো বাড়ি ছিল না। বাড়িগুলো ছিল একটু দূরে। সেইসব বাড়ির নারী-পুরুষ সব্বাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই দিনই প্রথম জানলাম ছোটখাট খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ময়লা ধূতি আর কোরা রঙয়ের ফতুয়া পরা কুঁজো হয়ে হাঁটা একটি লোকই গুরুবরণ। এটা ওদের বাড়ি। আমি যাকে ঠাম্মা বলি তিনি গুরুবরণের মা।

সারা বাড়ি সোরগোল। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। সমানে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে মেয়েরা। কেবল একজনের চোখে জল নেই। ঠাম্মা! তার ঘরের বারান্দায় পাথরের মত বসে আছেন। আমি ধীরে ধীরে ঠাম্মার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠাম্মা দেখলেন না। আমি একটু সরে নড়ে দাঁড়ালাম। এবারও দেখলেন না। এবার সরাসরি সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠাম্মা দেখলেন।

‘ও ঠাম্মা, কাইল চইলে যাবো’…

‘যাগে, তা আমারে কতি আইছিস ক্যান’?

আমি অবাক হলাম! ভেবেছিলাম ঠাম্মা আদর করবে! মুখ ভার করে তার পাশেই বসে রইলাম। ঠাম্মা তেমনই নিশ্চুপ। পাথর। সব মালপত্র নৌকায় তোলা শেষ। গুরুবরণ, তার বউ, তিন ছেলে, দুই মেয়ে সবাই ঠাম্মার সামনে এসে দাঁড়ায়। পাঁচটি ছেলে-মেয়ে ধীরে ধীরে ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে। ঠাম্মা। কারো মাথায় হাত দেয় না। বউটা এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। ঠাম্মা নিশ্চল। সবার শেষে গুরুবরুণ নিচু হয়ে ঠাম্মার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যায়…ঠাম্মা চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে!
গুরুবরণের মাথাটা কোলে নিয়ে ডুকরে কাঁদতে থাকে…। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকি। গুরুবরণরা সবাই চলে যাচ্ছে কলকাতা। ঠাম্মা যাবে না। বহুভাবে চেষ্টা করেছিল গুরুবরণ। কিছুতেই মাকে রাজি করাতে পারেনি। তার সেই এক কথা- স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। তার দেশ ছেড়ে যাবেন না। শেষে তাকে রেখেই চলে যাচ্ছে ওরা। এই গ্রামে এবং আশপাশের কয়েকটা গ্রামে যাদের একটু টাকা পয়সা আছে তারা সবাই চলে যাচ্ছে। মেলেটারিরা নাকি এসেই হিন্দু কাটবে!

গুরুবরণ মায়ের কোল থেকে মাথা ছাড়িয়ে নেয়। মাকে জড়িয়ে ধরে ঘাটের দিকে হাঁটতে থাকে। এক সময় সকলেই নৌকায় চড়ে বসে। ঠাম্মা হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। ঠাম্মার পেছনে অজস্র মানুষ। কয়েকজন দুগ্গা দুগ্গা বলে কপালে হাত ঠেকাচ্ছে। প্রথম দুটো নৌকা ছেড়ে দিল। সামনের গোলুইয়ে দুটো টানা দাড়। ছপাৎ করে পানিতে পড়তেই নৌকা ভাটির টানে চলতে শুরু করে। হঠাৎ ঠাম্মা শেষ নৌকাটার গোলুই টেনে ধরে! … ও বরণ যাইসনে বাপ, নাইমে আয়….বরণরে…..আমরা সন্ধ্যার সময় নদীর পাড়ে এসে চিৎকার করে বলতাম-'কে'? ওমনি নদীর ওপার থেকেও কে যেন বলত- 'কে' 'কে' 'কে' 'কে'… ভারী অবাক হতাম। আমদের কথা কে বলে? ঠাম্মা আবার যখন চিৎকার করে বরণরে….. বলল, ওপার থেকেও কে যেন বলে উঠল… বরণরে বরণরে বরণরে….

ও মা, মাগো, তুমারে তো কতবার কলাম চলো, চলো আমাকে সাতে…. তুমি তো শুইনলে না, মা?

ঠাম্মা উত্তর দেয় না। আরও শক্ত করে টেনে ধরে…আরও একটু পরে ছপাৎ করে দুইটা দাড় পানিতে পড়ে। এই চরাট থেকে এক মাঝি লগির খোঁচা দেয়….সমবেত কণ্ঠ আরও জোরে জোরে বলে ওঠে- দুগ্গা দুগ্গা…ঠাম্মার হাতে থেকে নৌকা ছুটে যায়…দুজন বুড়ি মত মানুষ দুপাশ থেকে ঠাম্মাকে টেনে ধরে রাখে। কাচারিবাড়ির বাঁক পর্যন্ত তিনটা নৌকা ছোট হতে থাকে…. এক সময় বাঁক পেরিয়ে নেই হয়ে যায়….কলাবাড়িয়া মহাজন বড়নাল অঞ্চল থেকে ভেসে আসা বট আর রক্ত জবা সাদা থানের পাশে খানিক থামে। ঘূর্ণি জলে ফের ভেসে যায়। কোলাহল থেমে আসে। সেই দুই বুড়ি ঠাম্মাকে টেনে পাড়ে তুলে নিতে চায়…ঠাম্মা এখন আর চিৎকার করছে না। নীরবে চোখের জল গড়াচ্ছে। হঠাৎই তিনি আমাকে দেখলেন। কোলের কাছে টেনে নিলেন। ঠাম্মার শরীর কাঁপছে।

আরও পরে ওই শ্মশানের মত নীরব ঠাণ্ডা ছায় ছায়া অন্ধকার বাড়িতে ঠাম্মাকে রেখে আমি চলে এলাম। পরদিন আমাদেরও চলে যেতে হবে। সারারাত ঠাম্মার মুখটা ভেসে রইল। ঠাম্মা কি খাবে, কে রান্না করে দেবে। এইসব জটিল বিষয় ভেবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম।

খুব ভোরে আমাদের তোড়জোড়। হাসেম মাঝির টাবুরে নৌকা। থানার ঘাটে লঞ্চ। এম.এল পেশোয়ার। কালামিয়া সারেং। টবের টবের…ব্যাগের ব্যাগের….ছলাৎ ছলাৎ….ছোট নদী থেকে বড় নদী।

ওই বছর আর আমার গ্রামে আসা হয়নি। পরের বছর শীতকালে এসে দিন পনের ছিলাম। প্রায় প্রতিদিনই ঠাম্মাকে দেখতে যেতাম। স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সেই বড় বাড়িটা এক মুসলমান পরিবার কিনে নিয়েছে। তারাই ঠাম্মাকে তার ঘরে থাকতে দিয়েছে। ২৪ বিঘা জমির কলাবাগান এখন সেই লোকটির।

ক্রমে ক্রমে আর কয়েক বছর কেটে যায়। রামবরণ আরও বুড়ো হয়েছে। এখন আর অত জোরে হাঁক দেয় না। তার ছেলে বাগানে, রামবরণ বলত- বোগানিয়া। সে এখন খেয়া পারাপার করে। আবার ইশকুলে পড়ে। রামবরণ বারান্দায় বসে কাশতে কাশতে হাঁক দেয়- ‘এ বোগানিয়া, হেইন্নে আ তানি….’ বিহারের দ্বরভাঙ্গা থেকে কবে কিভাবে রামবরণ এসেছিল কেউ জানে না।

সেবার গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছি। এসেই পর দিন ঠাম্মাকে দেখতে গেছি। বাড়ি ঢুকেই চমকে উঠেছি! ঠাম্মা ভীষণ অসুস্থ। মরার মত বারান্দায় পড়ে আছে। আমি গিয়ে পাশে বসার পরও চিনতে পারলেন না। এখন এই বাড়ির মালিক মনিন্দির ডাক্তারকে খবর দিয়ে কয়েকবার ডেকে এনেছে। মনিন্দির ডাক্তার মিকশচার বানিয়ে খাইয়েছে। কোনো লাভ হয়নি। ঠাম্মা দিনের পর দিন আরও অসুস্থ হয়েছে।

বাড়ি ফিরে এসে বড়দা আর সেজ কাকাকে ঠাম্মার কথা বললাম। পরদিন তিন মাইল দূরের থানা শহর থেকে আরও বড় ডাক্তার আনা হল। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেল। ক্রমেই তার অবস্থার অবনতি হতে লাগল। গুরুবরণকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। উত্তর আসেনি। গুরুবরণও আসেনি। কলকাতা হয়ত অনেক দূর।

দুদিন পর প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আমি সকালেই একবার ঠাম্মাকে দেখে এসেছি। সন্ধ্যের পর গরমে অতিষ্ঠ হয়ে কয়েজনে গাঙে নাইতে নেমেছি… হঠাৎ রামবরণ হাঁক দিল….! কোয়ি হ্যায়…? আবারও সেই পাড়ে বাড়ি খেয়ে তিন-চার বার কথাটা বাজতে লাগল… কোয়ি হ্যায়….! কিন্তু রামবরণ এই সময় তো হাঁক দেয় না! এখন তো কেবল সন্ধ্যা! আবারও সেই চিৎকার.. কোয়ি হ্যায়…. কোয়ি হ্যায়… মাইকে মাইকো বাঁচাও…..

এই ‘মাইকো বাঁচাও’ মানে আমি বুঝতে পেরেছি! কাউকে কিছু না বলে ঝাঁপ দিলাম। সাঁতরাতে শুরু করেছি….ছোট্ট নদী। এখন চলছে রায় ভাটা.. ভাটা আর জোয়ারের থেমে থাকা সময়। পানি স্থির। ওপাড়ে পৌঁছেই দৌড় শুরু করেছি…..
রামবরণের কণ্ঠ নিচু হয়ে এসেছে… কোয়ি হ্যায়…. মাইকো বাঁচাও…..ভেজা কাপড়ে সপ সপ করে দৌড়ে উঠোন পার হয়েছি। সেই বারান্দায় টান টান হয়ে শুয়ে আছে ঠাম্মা! অচেনা কয়েকটা ছেলে-মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে…. রামবরণ বারান্দার কোণায় বসে বিড় বিড় করে চলেছে- মাইকো বাঁচাও....দূর থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসল। তার পর পরই শাখ বেজে উঠল….। কে যেন একটা লম্বা একটা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ঠাম্মার সিথানে রেখে গেল। আমি ঠাম্মার পাশে গিয়ে বসি। মাথায় হাত রাখি। ঠাম্মা সাড়া শব্দ করে না।

ও ঠাম্মা, একবার তাকাও না? দেহ এই যে আমি আইছি ঠাম্মা! শরীরটা আরও ঠাণ্ডা হয়ে আসে। এই বাড়িটা এখন মুসলমানের। তাই কেউ সন্ধ্যেবাতি জ্বালে না। উঠোনের মাঝখানে সেই তুলসি গাছটা নেই। বেদি পড়ে আছে। ধীরে ধীরে আরও লোকজন জড়ো হয়েছে। বিড় বিড় করে গুরুবরণের বাপান্ত করছে সবাই। এমন মানুষ হয়? গেলো তো গেলোই? মা’ডার এট্টু খোজ নেলো না? আমি নিশ্চল ঠাম্মাকে দেখছি। যেন এ ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই। হঠাৎ দেখলাম একটা মাছি ঠাম্মার নাকের ভিতর ঢুকে গেল! আমি তাড়াতে গেলাম! পারলাম না! মাছিটা যাচ্ছে-আসছে….কয়েকজন বুড়ো-বুড়ি ঠাম্মার নাকের কাছে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল- চইলে গেছে!

কলকাতার কোনো এঁদো গলিতে গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা গুরুবরণ আর তার বউ ছেলে-মেয়েরা কেউ জানল না বর্ডারের এই পারে আর একটা দেশ যে রেখে গেছিল সেটা আর নেই! একটা দেশ দুই ভাগ হয়ে এক ভাগ চলে গেছিল। একটা দেশ কলকাতা। আরেকটা দেশ খুলনা। একটা দেশে গুরুবরণ। আরেকটা দেশে ঠাম্মা। নিবারণী বালা।

সারা রাত রামবরণ তার ছেলে বাগাইনে আমি আর কয়েকজন ঠাম্মার পাশে বসে রইলাম। খুব সকালে মহাজন গ্রামের শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই জীবনে প্রথম আমি মড়া পোড়ানো দেখলাম। গায়ে কাটা দিল। চড় চড় করে চামড়া পোড়া শব্দ। রামবরণ তার সেই চাকু দিয়ে চিতার কাঠ নেড়ে দিচ্ছে…। পোড়া কাঠ, ছাই সব ঠেলে নদীতে মিশিয়ে দেওয়া হলো। ঠাম্মা যখন সেই দুধসাদা থান পরে নদীর জলে দাঁড়িয়ে কাসার থালা থেকে প্রসাদ ফুল ভাসিয়ে দিত, সেভাবেই ঠাম্মার চিতার ছাই নদীতে ভেসে গেল। তারপর আমি উঁচু ঢিবিটার উপর গিয়ে বসে ছিলাম। অনেকক্ষণ।

আমার সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যে আরও গাড় হয়েছে। এখনও কোনো জনমানুষ দেখিনি। সেই নিঃসঙ্গ তালগাছটি ছাড়া আর এই ঢিবি ছাড়া কোনো কিছুই আগের মত নেই। আমি কি সারারাত এই ঢিবির উপর বসে থাকব? এই রাতে আমিই বা এখানে কেন এসেছি? এতটা বছর পর? চল্লিশটা বছর পর? কেন? এর কোনো সদুত্তর আমার কাছে নেই।

শুধু গহিনের কোথাও থেকে বারতা পাচ্ছি- হয়ত এটাই আমার গ্রামে শেষবার আসা....এই নুয়ে পড়া বাররা গাছ, ছোট্ট শান্ত নদীটা, রক্তজবার ভেসে আসা, রাতবিরেতে রামবরণের হেঁকে ওঠা-কোয়ি হ্যায়.....টবের টবের.... ব্যাগের ব্যাগের....

যে কেহ মোরে দিয়েছ সুখ,
দিয়েছ তারই পরিচয়-
সবারে আমি নমি...

যে কেহ মোরে দিয়েছ দুঃখ
দিয়েছ তারই পরিচয়-
সবারে আমি নমি...

আপনার মন্তব্য