প্রকাশিত: ২০২৩-০২-২৫ ১৩:৩৬:১৪
তুষার গায়েন:
বিজ্ঞানের একজন উজ্জ্বল শিক্ষার্থী, ছাত্রাবস্থায় বিজ্ঞান লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ—উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য পাড়ি জমালেন পৃথিবীর অপর গোলার্ধে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, গবেষণা, সংসারধর্ম পালন, পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালন শেষে যখন কেটে গেল চল্লিশ বছর। তিনি ফিরলেন পুনরায় তাঁর বিজ্ঞানময় লেখার জগতে। আশ্চর্য মনে হলেও সত্য যখন তাঁর সতীর্থ লেখক-পাঠক-বন্ধু-স্বজন সবাই ধরে নিয়েছিল যে তাঁর হয়ত লেখার জগতে আর ফেরা হবে না, তিনি ফিরলেন সমকালের অশান্ত পটভূমিতে জগৎশ্রেষ্ঠ একজন বিজ্ঞানীর শান্তির সংগ্রামে উৎসর্গীকৃত জীবনকাহিনী নিয়ে যা কিনা বাংলাভাষী পাঠকের সামনে এত বিস্তৃতভাবে আগে কখনই উন্মোচিত হয়নি।
তিনি স্বপন কুমার গায়েন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি ও বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরির ক্ষেত্রে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের সিটি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী। এবারের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অষ্টম গ্রন্থ, 'শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন'।
এই বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকেই জানা যায়, আইনস্টাইনের যুদ্ধ বিরোধী ঐকান্তিক ও নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা সম্পর্কে, "আইনস্টাইন শুধু শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী নন, একজন মহান মানুষও। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যু, ধ্বংস এবং যুদ্ধোত্তর দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর বিভীষিকার প্রেক্ষিতে ভবিষ্যতের যুদ্ধ বন্ধ করা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিবিধ শান্তি আন্দোলন গড়ে ওঠে। আইনস্টাইন তাঁর সমকালীন শান্তিকামী মনীষীদের সঙ্গে সেসব আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জীবনের শেষ চার দশক জুড়ে তিনি ছিলেন এক অদম্য শান্তি সৈনিক। যুদ্ধ বিরোধিতা, যুদ্ধের প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্মূল করা, নিরস্ত্রীকরণ, জাতিতে জাতিতে সমঝোতা গড়ার জন্য অধিজাতিক সংস্থা গঠন, রিফিউজি পুনর্বাসন, পারমাণবিক অস্ত্র ও শক্তি নিয়ন্ত্রণ, পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্বন্ধে জনসাধারণকে সচেতন করা, স্নায়ুযুদ্ধ রোধ করা এবং শান্তির পক্ষে অন্যান্য উদ্যোগে তিনি সদা সক্রিয় ছিলেন। আমেরিকায় অভিবাসনের পরে সেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, বুদ্ধিজীবীর স্বাধীনতা, ইহুদি বিদ্বেষ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, বর্ণবৈষম্য প্রভৃতি সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ ও সমাধানের জন্য তিনি কাজ করেছেন। এই গ্রন্থে মানবতা ও শান্তির সপক্ষে আইনস্টাইনের চার দশকব্যাপী কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।"
আইনস্টাইনের সময়কাল থেকে আমাদের আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা কিছুই পাল্টায়নি, বরং জটিলতর রূপ পরিগ্রহণ করেছে। পৃথিবীর মঞ্চে এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বৃহৎ পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসময়ে আইনস্টাইনের যুদ্ধবিরোধী লড়াকু ভূমিকা ও বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ আত্মনিয়োগ বর্তমানকালের বিশ্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, লেখক, মানবাধিকার কর্মী ও সচেতন জনগণের জন্য অবশ্য অনুসরণযোগ্য ও দিকনির্দেশনামূলক হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
দুই
বিজ্ঞানী-অধ্যাপক-লেখক স্বপন কুমার গায়েন আমার বড়দা, আট ভাইবোনের পরিবারে জেষ্ঠ্যতম। আমাদের পরিবারে বেশ কয়েকজন আমরা লেখালেখি-সাহিত্যচর্চার সাথে জড়িত এবং আমাদের অবসর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম বই। আমাদের এই বইপড়া ও সাহিত্যচর্চার আদর্শ হিসেবে আমরা বড়দাকেই পেয়েছি, কারণ তিনি পাইওনিয়ার, তিনি সবকিছু শুরু করেছিলেন। তাঁর দেখাদেখি আমরাও অনুপ্রাণিত হয়েছি, লেখালেখির জগতে এসেছি। আমার বাবা গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন সংগ্রামী মানুষ, বলা যায় প্রমিথিউস, তাঁর গ্রামের প্রথম গ্রাজুয়েট যিনি শিক্ষা বঞ্চিত কৃষক সন্তানদের মনোজগতে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। স্নেহশীল ও রাগী পিতার শাসন ও প্রেরণা ছিল আমাদের ভালো করে লেখাপড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে যাতে সম্মানের সাথে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি। আমরা তাঁর দিক নির্দেশনা যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করেছি। বড়দা নিজে ছিলেন তুখোড় ছাত্র, বরিশালের ভান্ডারিয়া বেহারী ইন্সটিটিউশন (স্কুল) থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান অধিকার করেন যা ঐ ছোট্ট মফস্বল শহরে শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্রদের জন্য অভাবিত আনন্দের কারণ হয়েছিল। তারপর খুলনার সরকারি ব্রজলাল মহাবিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশুনা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স শেষ করে, এক বছর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর ১৯৭৮ সালে উচ্চ শিক্ষার্থে পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যানেটিকাট থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয়সমূহ: কঠিন অবস্থার লেসার, লেসার স্পেকট্রোস্কোপি, অপটিক্যাল বায়োমেডিক্যাল ইমেজিং, ননলিনিয়ার অপটিক্স এবং ন্যানোফোটোনিক্স।
আমাদের জন্য একাডেমিক পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট করার চাপ ও প্রেরণা শুধু বাবার দিক থেকেই নয়, বড়দার দিক থেকেও ছিল সমান মাত্রায় এবং তিনি ছিলেন আমাদের উদাহরণ। কিন্তু বড়দা একাডেমিক পড়াশোনার বাইরেও আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছিলেন পৃথিবীর বিশাল জ্ঞানরাজ্যের দিকে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পিতৃগৃহে আসবাবপত্র তেমন কিছু ছিল না, কিন্তু ছিল আলমারি ভরা বই। এই আলমারি বড়দার তৈরি যার ভিতর ছিল দেশ-বিদেশের বিখ্যাত মনীষী, লেখকদের সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে লিখিত বইয়ের সমৃদ্ধ সম্ভার। আমরা তাঁর ছোট ভাই-বোনেরা বড় হয়ে উঠেছি এই বই দেখে, বই পড়ে। আমি যখন স্কুলের ছোট ক্লাসের ছাত্র, তখন বড়দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। সেখান থেকেই নিয়মিত আমাদের পড়াশোনার খোঁজ-খবর নিতেন, ঢাকা থেকে বিভিন্ন বইপত্র ও উপহার কিনে পাঠাতেন। কৃশকায় দেহ নিয়ে দারুণ কর্মব্যস্ত ছাত্রজীবন কেটেছে তাঁর—ট্যুইশানি করে নিজের একাডেমিক পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন ও ভালো রেজাল্ট করেছেন। দেশের বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকা এবং দৈনিক পত্র-পত্রিকার সাহিত্য, বিজ্ঞান ও ছোটদের পাতায় লিখেছেন। জনপ্রিয় মাসিক 'বিজ্ঞান সাময়িকী' এবং বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটির 'বুলেটিন দ্য ফিজিসিস্ট'-এর সঙ্গে সম্পাদনা সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমি যখন স্কুলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, ১৯৭৭ সালে 'মুক্তধারা' প্রকাশনী থেকে বড়দার প্রথম বই 'স্বাতীর কীর্তি' প্রকাশিত হয়। এটি একটি সায়েন্স ফিকশন যেখানে দেখা যায় লেখকের ছোট্ট মেয়ে স্বাতী, বিজ্ঞান সম্পর্কিত দারুণ সব কর্মকাণ্ড করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। এই বইয়ের প্রথম গল্পটি হচ্ছে এরকম যে দেশের জীববিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের ডিম থেকে সফলভাবে একটি ডাইনোসরের জন্ম দেন, যার নাম ডানো। ডানো হেঁটে চলে বেড়ায় বটে, কিন্তু কোনো খাবার খায় না; শত চেষ্টা করেও কেউ তাকে খাওয়াতে পারে না। স্বাতী বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে যেই ডানোকে খাবার দেয়, অমনি সে খাবার খেতে শুরু করে এবং স্বাতীর সাথে দারুণ খাতির জমে যায়। এরপর থেকে স্বাতী ডানোর পিঠে চড়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। বিজ্ঞানী মহলে হৈ চৈ পড়ে যায়।
আমার মনে আছে বইটির পুরো প্রচ্ছদ জুড়ে ডাইনোসরের পিঠে উৎফুল্ল ছোট্ট মেয়ে স্বাতীর ছবি কল্পনায় দারুণ আনন্দ সঞ্চার করত। বড়দার বই পড়ার সূত্র ধরেই ছোটদের জন্য লেখা বিভিন্ন বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞানের বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়। ঐ সময়ে মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'কপোট্রনিক সুখ দুঃখ' বইটি পড়ে খুব আলোড়িত হয়েছিলাম। এভাবে ধীরে ধীরে যাদের লেখা পড়ার আগ্রহ ও সুযোগ তৈরি হয় তাদের মধ্যে আলী আসগর, আলী ইমাম, মুহাম্মদ ইব্রাহিম, আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দিন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত বলতে হয়, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক বইপত্র লেখার পাশাপাশি গড়ে উঠেছিল বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলন যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল শিশু-কিশোর-তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটানো যার সাথে বড়দা অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
আমেরিকা যাওয়ার পরের বছর ১৯৭৯ সালে 'মুক্তধারা' থেকে প্রকাশিত হয় বড়দার আরও চারটি বই; 'বার্নার্ডের তারা', 'বিজ্ঞানে বড় মানুষ বড় কাজ', 'আশ্চর্য আর আশ্চর্য', 'কত অজানারে'। একই প্রকাশনী থেকে ১৯৮৪ সালে 'বিচিত্র বিজ্ঞান ও পরমাণু জগৎ'। শিশু একাডেমি ১৯৮১ সালে প্রকাশ করে তাঁর সপ্তম বই, 'জীবের কথা জীবনের কথা'। চল্লিশ বছরের অধিক সময় পার হওয়ার পর, এবারের একুশের বইমেলায় 'অনুপম প্রকাশনী' থেকে এলো বড়দার সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার বই, 'শান্তির সৈনিক আইনস্টাইন' যার বিষয়বস্তুর সার-সংক্ষেপ আগেই উল্লেখ করেছি। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে দারুণভাবে খুশি যে, বড়দা তাঁর লেখার জগতে ফিরে এসেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী বই নিয়ে। আমার বিশ্বাস বইটি পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে এবং লেখক বহু বছরের বরফ-নৈঃশব্দ্য ভেঙে বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক নতুন নতুন বই উপহার দেবেন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন যে আমার এই লেখা প্রচলিত অর্থে বইটির কোনো রিভিয়্যু অথবা লেখক সম্পর্কে মূল্যায়ন নয়, বরং একজন পাঠক ও লেখকের অনুজ হিসেবে আমার অভিব্যক্তি মাত্র।
আগ্রহী পাঠকরা বইটি সংগ্রহ করতে পারেন একুশের বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত 'অনুপম প্রকাশনী', প্যাভিলিয়ন-১৯ অথবা রকমারি অনলাইন বুকশপ থেকে।
আপনার মন্তব্য