প্রকাশিত: ২০১৬-০১-০৬ ২৩:৪৫:৫৩
আপডেট: ২০১৬-০১-২৮ ১১:৪২:২২
ফরিদ আহমেদ:
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের প্রথম রমরমা ব্যবসা শুরু হয় স্কুল পাঠ্য পুস্তক প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। একে প্রাইমার বলা হতো। এই প্রাইমারের পরেই বাংলা মুদ্রণ শিল্পে চলে আসে নীতিশিক্ষামূলক বই। শুধু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ নয়, স্কুল কলেজে নীতিশিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়ায় এ জাতীয় বই ছাপানোর জন্য বিরাট বাজার তৈরি হয়। চাহিদা ছিল বলেই উনিশ শতকে হিতোপদেশ শুধু গদ্যেই অন্তত ১৯টি অনুবাদ হয়েছে। সমান জনপ্রিয় ছিল বত্রিশ সিংহাসন, তোতা ইতিহাস, বেতাল পঞ্চবিংশতি-র অনুবাদ। স্কুলে স্কুলে পড়ানো হত স্কুল বুক সোসাইটির নীতিকথা, মনোরঞ্জনেতিহাস।
নীতিকথা পড়েন নি, এমন মানুষ সেকালে কমই ছিলেন। প্রথম বছরেই (১৮১৮) বের হয় এর তিনটি সংস্করণ। ১৮৫৫ সালে বেরিয়ে যায় ১৪তম সংস্করণ। মোট মুদ্রণ সংখ্যা লাখের উপরে। মনোরঞ্জনেতিহাস (১৮১৯) এর ১১শ সংস্করণ বের হয় ১৯৫৮ সালে। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অত্যন্ত অত্যন্ত সমাদৃত ছিল বোধোদয়, কথামালা, নীতিবোধ, চারুপাঠ, নীতিসাব, সদাচারদীপক, সদগুণ, ও বীর্য্যের ইতিহাস। বোধোদয়-এর ৮০তম সংস্করণ বেরিয়েছে ১৮৮৩ সালের মার্চে। প্রতি মুদ্রণ ১০০০০ কপি) ১৮৫৭ সালে প্রায় ৮০০০০ কপি নীতিশিক্ষামূলক বই ছাপা হয়। ১৮৫৬-তে ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটির প্রকাশনায় মধুসূদন মুখোপাধ্যায় নীতিশিক্ষামূলক বইয়ের জগতে এক নতুন ধারার আমদানি করলেন। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের কাহিনি তিনি অনুবাদ করলেন বাংলায়। এগুলো দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। পরের দশকগুলোতেও নীতিশিক্ষামূলক বইয়ের হার ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে এর জনপ্রিয়তার কারণে। শুধু গদ্যে নয়, পদ্যেও তখন নীতিশিক্ষার চাহিদা বেশি।
আজকাল এরকম নীতিশিক্ষামূলক বইয়ের ঊনবিংশ শতাব্দীর ওই সময়ের মতো আর কদর নেই। কেউ-ই আর এ ধরনের বই লিখতে চায় না। পাঠকের কাছে যেমন এর চাহিদা নেই, তেমনি চাহিদা নেই প্রকাশকের কাছে।
এই চাহিদাহীনতার সময়ে প্রায় ঐ রকম একটা বই লিখে ফেলেছেন তামান্না সেতু । বইয়ের নাম ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু আগেকার ওই সব নীতিশিক্ষা বইয়ের সাথে এর একটা বড় ধরনের তফাৎ আছে। নীতিশিক্ষার বইয়ে যেখানে মূলত ফোকাস করা হয়েছে ভালো কাজের দিকে, সমাজসম্মত জীবন যাপনের, সেখানে তামান্না সেতু তাঁর বইয়ে আধুনিক জীবনের গল্প বলার চেষ্টা করেছেন, মুক্ত পৃথিবীর আলো-বাতাসের কথা বলতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছেন এমন এক জীবনের কথা, যে জীবন সবাইকে সাথে নিয়ে এগোতে হয়। বড় মানবিক এ জীবন। ঘাস, লতা, পাতা, সোঁদা মাটির গন্ধে ভরা এ জীবন।
আমাদের দেশে মা-বাবারা সন্তান মানুষ করার সনাতন যে ধ্যান-ধারণা পায় বংশানুক্রমিকভাবে, তার বাইরে পা রাখার মতো সাহসিকতা দেখানোর সক্ষমতা রাখে না। সন্তান মানেই তাকে চোখে চোখে রাখতে হবে, তার উন্নতির জন্য তাকে রাতদিন পড়াশোনায় ব্যস্ত করে রাখতে হবে, তার কল্যাণের কথা ভেবে তাকে সরিয়ে রাখতে হবে সমস্ত কিছু থেকে, তার চারপাশে গড়ে তুলতে হবে চিনের প্রাচীরের মতো দুর্ভেদ্য এক প্রাচীর। মুক্ত পৃথিবীর আলো-বাতাস থেকে আড়াল করে রাখার সমস্ত প্রয়াস সেখানে বিদ্যমান। ঘরের সীমাবদ্ধ আঙিনায় আটকে ফেলা হয় বাচ্চাদের অনন্ত আকাশকে। উড়াউড়ি করার জন্য যে ডানা থাকে, তাকে করে দেওয়া হয় অকেজো। যে শিকড় তার গড়ে ওঠার কথা পলিমাটির সাথে, সেটাকে করা হয় রহিত, যে পাললিক সৌরভ তার গায়ে মাখার কথা, সেই সৌরভকে সরিয়ে রাখা হয় তার নাগাল থেকে।
আর এখানেই এসেই তামান্না দেখাচ্ছেন ভিন্নভাবে বাচ্চাকে বড় করার এক ভিন্নতর রাস্তা। তিনি বৈপ্লবিক কোনো চিন্তা-চেতনা নিয়ে আসেন নি, আসেন নি ঝড়ের গতিতে সমাজ সংস্কার করার বিশাল বিশাল বুলি নিয়ে। বরং তাঁর ধারণা বিদ্যমান যে সমাজ আছে তার মধ্যে থেকেই খুব অল্প কিছু পরিবর্তন এনেই আমরা অনেকখানি পাল্টে ফেলতে পারি আমাদের বাচ্চাদের জগতকে। তাদের জীবনের গতিপথকে নিয়ে যেতে পারি এক অন্যরকম উচ্চতায়, আনন্দময় এক ভূবনে।
তামান্না তাঁর বইতে ভবিষ্যতের জন্য যে কথাগুলো বলেছেন, সেগুলো অন্য কেউ বললে হয়তো তেমন কোনো গুরুত্ব থাকতো না। মেকি মনে হতো, মনে হতো বানানো কথা এগুলো। শুধুমাত্র বলার জন্যই বলা। কিন্তু, অনেক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে নিজের জীবন থেকে নেওয়া, বা নিজের জীবনে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে কাজগুলো করেন, সেগুলোকেই তিনি তুলে ধরেছেন অন্যদের জন্য। বাচ্চাদের নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ব্যাপক। নিজের দুটো সন্তান আছে, সেই সাথে বাতিঘরের মতো একটা অপ্রথাগত সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত তিনি। এখানে প্রতিনিয়ত বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাতে হয় তাঁকে। শিশু মনস্তত্ব অপূর্বভাবে বোঝার সক্ষমতা দিয়ে, দেশ এবং দেশের মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা এবং দরদ নিয়ে, বাতিঘরের বাচ্চাদের আনন্দময় এক জগত তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। এরা মাটি দিয়ে খেলে, প্রকৃতির কাছে গিয়ে ধুলোমাটিতে বসে ছবি আঁকে, পাকা ধানের ঘ্রাণ নেয়, তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা বানানো দেখে, ফুলের উপরে বর্ণময় প্রজাপতির বুনো উড়োউড়ি দেখে। বিদ্যালয় বাচ্চাদের জন্য বিভীষিকা নয়, বরং বিনোদনের এক অনন্য জায়গা হতে পারে, সেটা তিনি নিজের হাতে করেই দেখিয়েছেন। সেই তিনি যখন বাচ্চা-কাচ্চাকে কোন জীবন দিতে হবে, বাবা-মাদের সন্তানের সুস্থ বিকাশের জন্য কী করণীয় সেই সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করেন, সেটার গুরুত্ব দিতে হয়। না দিয়ে উপায় থাকে না।
তাঁর বইয়ের শেষ অংশটায় তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেটা হচ্ছে শিশুদের যৌন নিগ্রহ নিয়ে। এটা উন্নত দেশে খুব সিরিয়াস একটা ইস্যু। আমাদের সমাজে এখনো একে আমরা গুরুত্ব দেই না। শিশুরাও যে যৌন নিগ্রহের স্বীকার হতে পারে, এবং সেটা যে শুধুমাত্র অপরিচিত মানুষের দ্বারাই হয় না, বরং অনেক পরিচিত মানুষও বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সেটা করে, এটা আমরা মেনে নেই না বা মনে নেই। চোখ বন্ধ করে রাখলেই তো আর প্রলয় বন্ধ হয় না। তো সেই প্রলয়টাকে দেখানোর চেষ্টা করেছেন তামান্না তাঁর বইয়ে। শিশু যৌন নিগ্রহের বিষয়ে বাবা-মাদের কোন বিষয়গুলোতে সচেতন থাকতে হবে এটাকে বন্ধ করার জন্য, কিংবা ঘটে যাবার পরে বাচ্চার সাথে তাদের আচরণটা কেমন হবে বা হওয়া উচিত, সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি।
বইটা মাত্র গতকাল বের হয়েছে। সবার একটা কৌতূহল থাকতে পারে এই ভেবে যে, যে বই মাত্র গতকাল বের হলো বাংলাদেশে, সেই বইয়ের পাঠ পর্যালোচনা ক্যানাডায় বসে থেকে আমি কীভাবে করছি? পাঠকের কৌতুহলের উত্তর দেই। তামান্নার এই বইয়ের প্রথম পাঠক আমি। বই না বলে পাণ্ডুলিপিই বলা উচিত। তাঁর বইয়ের পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করেছি আমি। ফলে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বইটা পড়া হয়ে গিয়েছে আমার এটি বই আকারে বের হয়ে আসারও আগে।
লেখকের এটা প্রথম বই। প্রথম সন্তান জন্মের তীব্র আনন্দ এবং উচ্ছ্বাসে তিনি ভেসে যাবার কথা এই বই হাতে নিয়ে। সেটা যান তিনি, তাতে আপত্তি নেই কোনো, কিন্তু, এখানেই যেন থেমে না যান তিনি। সমাজকে ভিন্নভাবে দেখার, তাকে বিশ্লেষণ করার এবং সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নিজের চাহিদার দিকে একে বাঁকিয়ে নেবার সাহস, সক্ষমতা এবং প্রত্যয় তাঁর আছে। আছে বলেই, আশা থাকবে যে, তিনি এগিয়ে যাবেন গ্রীবা উঁচু করে উচ্চ থেকে উচ্চতর পাহাড়ে, ডানা মেলে উড়ে যাবেন এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে, সাঁতরে পার হবেন এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্র।
শুভ কামনা তামান্না সেতু, শুভ কামনা স্বপ্নশোভিত সরোজিনী।
ফরিদ আহমেদ : কানাডা প্রবাসী লেখক।
আপনার মন্তব্য