কেমন চাই অমর একুশে বইমেলা ২০১৬

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-২৮ ১২:১০:০২

 আপডেট: ২০১৬-০১-২৮ ২১:৫৬:১৯

রেজা ঘটক:

আসন্ন অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারি ২০১৬ কে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ভেতরে আরো সুন্দর ও নান্দনিক এবং লেখক-প্রকাশক-পাঠক-বইপ্রেমীদের মিলনমেলায় পরিণত করার জন্য আয়োজকদের কাছে আমার কিছু সুনির্দিষ্ট চাওয়া আছে। এই চাওয়াগুলোকে কার্যকর করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, প্রকাশক, লেখক, পাঠক, বইপ্রেমী, মিডিয়া ও সাংবাদিকদের প্রতি আমি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

১. অমর একুশে বইমেলাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে। শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর এবং গোটা বইমেলা প্রাঙ্গণকে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় আনা হোক। আমরা দেখেছি প্রতি বছর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১লা ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলা উদ্বোধনের দিন গোটা চত্বরে যে নিরাপত্তা থাকে, পরবর্তী সময়ে বইমেলা যত সামনের দিকে আগায় বইমেলার নিরাপত্তা তত শিথিল হয়। অভিজিৎ রায়দের পুলিশের সামনেই চাপাতির কোপে মরতে হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। ২০০৪ সালে ডক্টর হুমায়ুন আজাদের উপর বইমেলা প্রাঙ্গণের কাছেই হামলা হয়েছে। একইরকম হামলায় গতবছর অভিজিৎ রায় নিহত হন। অভিজিতের স্ত্রী লেখক বন্যা আহমেদ গুরুতর আহত হন। যে ঘটনা একুশে বইমেলার নিরাপত্তাহীনতাকেই সবার আগে সামনে আনে। আমরা একটি সর্বোচ্চ নিরাপদ একুশে বইমেলা চাই।

২. প্রতি বছর টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত যানচলাচল বন্ধের জন্য আবেদন করলেও সেটি কার্যকর হয় না। এ বছর আমরা টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত যানচলাচল মুক্ত দেখতে চাই। মেলা শুরু হবে বেলা তিনটায়, শেষ হবে রাত আটটায়। এই পুরো সময়টা এই জোনটা যানচলাচল মুক্ত রাখার জন্য আবারো বিশেষ অনুরোধ রইল।

৩. এ বছরও একুশে বইমেলা বৃহত্তর পরিসরে দুইভাগে হচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিন ও শিশুতোষ প্রকাশনাসহ সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো থাকছে একাডেমি চত্বরে। আর মূল প্রকাশকরা থাকছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। বইমেলা দুইভাগে হওয়ায় বইপ্রেমীদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। সেজন্য দুই মেলার মাঝখানের জায়গাটা মিলিয়ে দেওয়া হোক। এর ভেতরে কোনো বারোয়ারি দোকান, খাবারের দোকান এগুলো কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না।

৪. সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একুশে বইমেলার অংশে মিনিমাম চারটি গেট করা হোক। যেসব গেটের অন্তত তিনটি দিয়ে প্রবেশ ও প্রস্থান করার সুযোগ রাখা হোক। একটি গেট করা হোক একাডেমিতে যাওয়া-আসার জন্য সরাসরি লিংক। একটা গেট করা হোক সেই লিংক গেটের পাশেই যাতে ইচ্ছে করলে যে কেউ বইমেলা থেকে বাইরে যেতে পারে বা বাইরে থেকে বইমেলায় ঢুকতে পারে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব-উত্তর (ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের দিকে) এবং পূর্ব-পশ্চিম (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ছবির হাটের দিকে) দিকে আরো দুটি গেট করা হোক উদ্যানের দিকে। যে দুটি গেট দিয়ে অনায়াসে বইমেলায় আগত বইপ্রেমীরা বাইরে বা ভেতরে যাবার সুযোগ করা হোক। ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউট গেট, ছবির হাট গেট, টিএসসি এবং দোয়েল চত্বর এই চারদিক থেকে একুশে বইমেলায় প্রবেশ ও প্রস্থানের ব্যবস্থা করা হোক। আমরা দেখেছি, প্রতি বছর বিশেষ করে ১৩, ১৪ ও ২১ ফেব্রুয়ারিতে বইমেলার গেটে প্রচুর ভিড় হয়, কেবল এই গেট সংক্রান্ত ভুল পরিকল্পনার কারণে। চারদিকে গেট থাকলে এই ভিড় অনায়াসে সামাল দেওয়া সম্ভব।

৫. শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত গোটা এলাকায় বারোয়ারি কোনো দোকানপাট বসতে দেওয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। এই বারোয়ারি জিনিসপত্রের দোকানে গোটা বইমেলার মূল জায়গাটি ধীরে ধীরে পানসে হয়ে যাচ্ছে। যে বিষয়টি সম্পূর্ণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর নির্ভর করে। আর প্রতি বছরই এরা কয়েকটা পয়সার ধান্ধায় এই কুকর্মটি করেন। বারোয়ারি দোকান বসতে দিয়ে গোটা বইমেলাপ্রাঙ্গণকে একেবারে অন্যজগতের এক ক্যাচালে পরিণত করা হয়। আমরা চাই, এবার শুরু থেকেই এই বারোয়ারি পণ্যের দোকান বইমেলা চত্বরের আশেপাশে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হোক।

৬. বইমেলার ধূলো অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিবছর আমরা কথা বলি। কিন্তু তারপরেও ধূলো আর যায় না। বইমেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধূলো ব্যবস্থাপনাকে আমরা সক্রিয় এবং কার্যকর দেখতে চাই।

৭. বইমেলা প্রাঙ্গণ ও এর আশেপাশের এলাকায় পর্যাপ্ত লাইন ব্যবস্থা কার্যকর করা হোক। বইমেলা চলাকালীন সময়ে কোনো ধরনের বিদ্যুৎবিচ্ছিন্নতা আমরা মোটেও প্রত্যাশা করি না। গত বছরও বইমেলা চলাকালীন সময়ে কয়েকবার বিদ্যুৎবিভ্রাট ছিল। সবার মধ্যে তখন এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা দেখা গেছে। এটা যেন কোনোভাবেই আর না ঘটে সেদিকে কর্তৃপক্ষের যথাযথ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

৮. সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবছরও বইমেলায় স্টল দেওয়া হয়েছে। একুশে বইমেলায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া যার অনেকগুলোর কার্যত ঝিমানো রোগ ছড়ানো ভিন্ন আর কোনো কার্যক্রম আমরা কখনোই দেখিনি। আগামীতে এসব অকার্যকর প্রতিষ্ঠানকে একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করা হোক।

৯. একাডেমি চত্বরে গতবছর টেলিটকের টাওয়ার বসানো হয়েছে। পাশাপাশি টেলিটকের জন্য স্টল বরাদ্দ করা হয়েছিল। বইমেলায় এসে কেবলমাত্র টেলিটকের সিম কেনার দীর্ঘ লাইন পুরো বইমেলার চরিত্রের সঙ্গে খুবই বেমানান। এ বছর টেলিটক বা কোনো ধরনের মোবাইল কোম্পানিকে বইমেলায় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হোক। সত্যিকারের বইপ্রেমীরা বইমেলায় সিম কেনার জন্য যায় না। এটা আয়োজকদের স্মরণে থাকাটা খুব জরুরি।

১০. প্রতিবছর একাডেমি চত্বরে পুকুরের পাশে খাবারের দোকান দিয়ে বাংলা একাডেমি বইপ্রেমীদের পকেট কাটার ব্যবস্থা করে। বইকেনার টাকা ওই খাবারের দোকানে ফতুর করে অনেকে পরে খালিহাতে বাড়ি যায়। এই গলাকাটা খাবারের দোকানের উপর বাংলা একাডেমির কোনো দায়িত্ববোধ নেই কেন? আমরা চাই একাডেমি খাবারের দোকান যদি দিতেই চায়, নির্দিষ্ট মূল্য তালিকা চারদিকে টানিয়ে দেওয়া হোক। যাতে একজন বইপ্রেমী খাবার কিনবে না সেই টাকায় বই কিনবে আগেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

১১. একুশে বইমেলার শব্দদূষণ সবার জন্য এখন একটা আতংক। এই আতংকে নতুন ভর করেছে কর্পোরেট থাবা। গোটা বইমেলা চত্বরে শব্দদূষণ কমানোর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

১২. প্রতিবছর বইমেলায় আগত টেলিভিশন চ্যানেলগুলো গেটের কাছে এক ধরনের অকারণে ঝামেলা সৃষ্টি করে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট আচরণবিধি কার্যকর বরার উদ্যোগ নেওয়ার সময় এসেছে। বইমেলার পরিবেশ নষ্ট করে চ্যানেলের নিউজ বা কভারেজ বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হোক।

১৩. প্রতিবছর লেখকদের আড্ডার জন্য বইমেলা প্রাঙ্গণে কিছু বসার ঘর বানানো হয়। কিন্তু সেখানে কোনো বছর আমি কোনো লেখককে বসতে দেখিনি। বরং সেই ঘরগুলো মেলায় আগত অন্যান্যদের একটা বিশ্রামের জায়গা হয়। লেখকদের আড্ডাঘরে লেখকদের বসার ব্যবস্থা যাতে টেকসই হয়, সেই উদ্যোগ নেওয়া হোক। আমাদের চ্যানেলগুলো এসব আড্ডাঘরকে ঘিরে বরং নানান কিসিমের আলোচনা, আড্ডা জমাতে পারে। এ বিষয়ে আমার কাছেই অনেক আইডিয়া আছে, বিনা পয়সায় একটাও দেব না।

১৪. বইমেলার আশেপাশে ভিক্ষুকদের উৎপাত প্রায় প্রতিবছরের ঘটনা। একুশে বইমেলা ও তার আশেপাশের এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত করা হোক।

১৫. গতবছর ধর্মান্ধদের উসকানিতে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিয়েছিল বাংলা একাডেমি। এমন কি এক বছরের জন্য একুশে বইমেলায় রোদেলাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মান্ধদের উসকানিতে বাংলা একাডেমির এরকম ব্যবস্থাকে এখনো নিন্দা জানাই। পাশাপাশি ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আর না ঘটে, সেজন্য বাংলা একাডেমিকে আরো সজাগ হবার আহবান জানাই।

আমি মাত্র ১৫টি বিষয় তুলে ধরলাম। এগুলোর প্রতি একুশে বইমেলার আয়োজক, সংস্কৃত মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, লেখক-প্রকাশক-পাঠক ও বইপ্রেমীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। সারা বছর আমরা যে প্রাণের বইমেলার জন্য অপেক্ষা করি, এই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলে আমাদের প্রাণের বইমেলা নিশ্চয়ই নান্দনিকভাবেই জমে উঠবে। বন্ধুরা যদি এর সঙ্গে আর কোনো পয়েন্ট যোগ করতে চান, সেই প্রসঙ্গ আলোচনায় নিয়ে আসুন। আমরা একটি নিরাপদ সফল একুশে বইমেলা দেখতে চাই। এটি আমাদের প্রাণের মেলা। এখানে আপোষ করার কোনো সুযোগ নাই।

আপনার মন্তব্য