‘ভারতবর্ষ’ গল্পটি তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছে : অঞ্জন আচার্য

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-৩০ ১৬:২৮:৩১

 আপডেট: ২০১৬-০১-৩০ ১৬:৩৪:৫২

সাহিত্য ডেস্ক:

অঞ্জন আচার্য, কবি, গল্পকার। লিখছেন অনেক দিন থেকে। এবারের বইমেলায় আসছে তাঁর গল্পগ্রন্থ। নিজের লেখালেখি, গল্প ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বলছেন সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম’কে।

গত ২০১৫ সালে কত সংখ্যক গল্প পড়েছেন?
অঞ্জন আচার্য : বছরওয়ারি সে সংখ্যা কখনো গুণে দেখিনি, দেখা আসলে সম্ভবও নয়। বই কেনা ও বই পড়ার ক্ষেত্রে আমি কৃপণ নই। প্রতি মাসেই কয়েক হাজার টাকার বই আমাকে কিনতেই হবে। এ ‍না হলে যেন মাসই গড়াবে না। তাই কোনোকালেই এ ব্যাপারে তার হিসাবে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

প্রতিদিনই আমি দিনের যেকোনো একটা সময় কিছু না কিছু পড়ি। এ আমার যাপিত জীবনেরই একটা অংশ। পড়ার জন্য তাই ঠিকই সময় বের করে ফেলি আমি। এমনকি একবার মানিকগঞ্জে পিসতুতো বোনের বিয়েতে গিয়েও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ঠিকই লুকিয়ে বই গুজে বসে পড়েছিলাম। নিদেন পক্ষে একটা কবিতা বা গল্প তো বটেই। পড়াটা মূলত আমার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করার এক ধরনের ওষুধ বলা যেতে পারে। না হলে, বিয়ে বাড়িতে গিয়ে, আর তা যদি হয় গ্রামাঞ্চলে- সেখানেও কি তা করা সম্ভব? বিয়ে বাড়িতে এক ইঞ্চি নীরব জায়গা পেয়ে বই পড়াটা যে কতখানি দুঃসাধ্য কাজ (অনেকের কাছে হাস্যকর ও পাগলামি বৈ কিছু নয়) তা তো প্রকাশবাহুল্য। এত হৈচৈ ও আলোক-রোশনাইয়ের মধ্যেই এই কর্ম আমি সম্পাদন করেছি বৈকি!

গল্পপ্রাপ্তির মাধ্যমগুলো কী ছিল?
অঞ্জন আচার্য : গল্প পড়ার জন্য আমার অন্যতম মাধ্যম হলো বই। কারণ সেটা সহজেই বহনযোগ্য। তবে অনলাইন পত্রিকা, ই-বুক, ছোটকাগজ, দৈনিক পত্রিকা তো আছেই। এই তো সেদিন ঢাকা থেকে বাগেরহাটে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিলাম একা। শিমুলিয়া রুট দিয়ে পদ্মা নদী পার হওয়ার সময় ফেরিতে বসে লাতিন আমেরিকার একটি গল্প সংকলন পড়ছিলাম। পড়ার সময় এতটাই আত্মমগ্ন ছিলাম যে, কখন ফেরি পার হয়ে অপর পাড়ে চলে এসেছে টেরই পাইনি। অবশেষে ফেরির এক লোককে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, আমি কাওড়াকান্দিতে আছি।

কোন কোন গল্পকারের গল্প পড়েছেন?
অঞ্জন আচার্য : এই মুহূর্তে সব লেখকের নাম মনে করা বড়ো দুষ্কর। তবে বাংলাদেশের মধ্যে হাসান আজিজুল হক (পুনঃপাঠ), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (পুনঃপাঠ), শহীদুল জহির (পুনঃপাঠ), সেলিনা হোসেন, শওকত ওসমান (পুনঃপাঠ), শাহাদুজ্জামান, আহমাদ মোস্তফা কামাল, জাকির তালুকদারসহ অসংখ্য নবীন-প্রবীণ গল্পকারের গল্প পড়েছি। নতুনদের লেখা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি। তারা কী নিয়ে ভাবে বা ভাবছে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করি। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে রমাপদ চৌধুরী, দিব্যেন্দু পালিত, অমর মিত্র, বাসুদেব মালাকর, সাত্যকি হালদার, বিতান সিকদার, শীর্ষেন্দু দত্ত, পূজা মৈত্র, সুকুমার রুজ, বিনোদ ঘোষাল, পাপিয়া ভট্টাচার্য, বিভাস রায়চৌধুরী, যশোধরা রায় চৌধুরী, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবুদ্ধ বাগচী, স্বপ্নময় চক্রবর্তীসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান লেখকের গল্প পড়েছি। তাদের লেখনি শৈলী ও বিষয়-ভাবনা নিয়ে ভেবেছি। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা গল্পের বিষয়-বস্তু নিয়ে নিজের মতো পর্যালোচনা করেছি। এর বাইরে অনূদিত সাহিত্যের নাম উল্লেখ করে তো শেষ করা যাবে না। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপের বহু দেশের অনেক গল্প পড়া হয়েছে। চিরায়ত ও হালআমলের গল্প- সবই।

পঠিত গল্পগুলোর মধ্যে ভালোলাগার গল্পগুলো কী, এবং কী এর কারণ?
অঞ্জন আচার্য : সব গল্পের নাম তো মনে পড়ছে না। তবে রমাপদ চৌধুরীর 'ভারতবর্ষ' গল্পটি মনে খুব দাগ কেটেছে। এছাড়া বাসুদেব মালাকরের ‘তিমিরবসনা’ গল্পটি পড়ে বেশ ভালো লাগে। বলতে গেলে, পশ্চিমবঙ্গের ও বিদেশি সাহিত্যের বেশ কিছু গল্প ভালো লেগেছে। হোর্হে লুইস বোরহেস-এর ‘১৯৮৩ সালের ২৫ আগস্ট’, অক্টাভিও পাজ-এর ‘নীল স্তবক’, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ-এর ‘বালাজারের অপূর্ব অপরাহ্ণ’, ওরহান পামুকের ‘জানালা দিয়ে লেখা’, মিলান কুন্ডেরার ‘এডওয়ার্ড ও ঈশ্বর’, আবেলার্দো কাস্তিলো’র ‘আর্নেস্তোর মা’সহ অনেক অনেক গল্প আছে ভালো লাগার তালিকায়। যেসব গল্প ভালো লেগেছে, অথচ স্মৃতি এ মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, সেগুলোর প্রতিও আমার একই অনুভূতি।

আপনার দৃষ্টিতে সেরা গল্পটি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ
অঞ্জন আচার্য : প্রথমেই বলি, একটি গল্প ভালো লাগার পেছনে আমার নানা ধরনের যুক্তি কাজ করে। কারণ আমি গল্প পাঠ মাত্রই কাহিনী পড়ি না। এর ভাষিক প্রয়োগ, বাক্যগঠন, বিষয়-বৈচিত্র্য, সূচনা ও পরিণতি ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ভাবি। তাছাড়া শিল্পের নান্দনিকতা, প্রাসঙ্গিকতা ও উপযোগিতা তো আছেই। পশ্চিমবঙ্গের শক্তিমান লেখক রমাপদ চৌধুরীর ‘ভারতবর্ষ’ গল্পটি আমাকে তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছে- সে তো আগেই বলেছি। এমন গল্পও একজন লেখক লিখতে পারেন, ভেবে আশ্চর্য হয়েছি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কীভাবে একটি অঞ্চলের সর্বস্ব শুষে নেয়, মানুষগুলোকে মেধা-মননে পঙ্গু করে দেয়, তার এক নির্মম আখ্যান এ গল্পটি। এটি যেন ব্রিটিশদের কাছে অবিভক্ত ভারতবাসীর নৈতিক স্খলনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। গল্পের পটভূমি মাহাতো গ্রামের হতদরিদ্র অথচ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বাবলম্বী, পরিশ্রমী বাসিন্দারা কীভাবে আমেরিকান সৈন্যদের ছুঁড়ে দেয়া পয়সায় একে একে ভিখারিতে পরিণত হয়ে পড়ে তা দেখে শিউরে উঠেছি। এমনকি একমাত্র প্রতিবাদীকণ্ঠ মাহাতো বুড়োকেও শেষে দেখা যায় সাদা চামড়ার সৈন্যদের কাছে হাত পেতে ‘সাব বকশিস-বকশিস’ বলে চিৎকার করতে। গল্পটির শেষ লাইনগুলো মনে রাখার মতো- “...আমেরিকান সৈন্যদের সেই ট্রেনটা অন্যদিনের মতো এবারে আর আন্ডাহল্টে এসে থামল না। প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলোর মতোই আন্ডাহল্টকে উপেক্ষা করে হুস করে চলে গেল। আমরা জানতাম ট্রেন আর থামবে না। ট্রেনটা চলে গেল। কিন্তু মাহাতো গাঁয়ের সবাই ভিখিরি হয়ে গেল। ক্ষেতিতে চাষ করা মানুষগুলো সব- সব ভিখিরি হয়ে গেল।”

বাংলাদেশের চিরায়ত গল্পগুলোর সঙ্গে এর সম্পর্ক কতখানি বলে মনে করছেন?  
অঞ্জন আচার্য : গল্প কোনো পুকুর নয়, যে এক জায়গাতেই তার জল সীমাবদ্ধ থাকবে। বরং গল্পকে আমার কাছে মনে হয় খরস্রোতা নদী। তাই আজ যেসব গল্প চিরায়ত হয়েছে, তা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেই হয়েছে। সময়ই বলে দেবে- আজ যা আছে, কাল কী থাকবে। আবার সেই সময়ই বলে দেবে, কোনটা পিছিয়ে যাবে, কোনটার উত্তরণ ঘটবে। আমি এর বিচারক হতে চাই না। কেবল নিরীহ পাঠক হয়ে থাকতে চাই।

বিদেশি গল্প ও সাম্প্রতিক পঠিত গল্পের সংক্ষিপ্ত তুলনায় কী হতে পারে?
অঞ্জন আচার্য : প্রত্যেক দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ভাষায় বিচিত্রতা আছে। তাই একই প্লাটফর্মে বসে সব ভাষা ও দেশের গল্প বিচার করলে সেটা সুবিচার হবে ‍না। একটি দেশের গল্পকে বিচার করতে হলে সেই দেশের উল্লিখিত বিষয়গুলো আত্মস্থ করা খুবই জরুরি। বাংলা অনুবাদের সুবাদে যেসব বিদেশি গল্প আমি পড়েছি তার সবই যে ভালো তা নয়। এটা অনুবাদের চরম অযোগ্যতা হতে পারে। বরং এর চেয়ে অনেক বাংলা গল্প আমার ভালো লেগেছে। আবার বিদেশি অনেক গল্পের বিষয়-ভাবনা ও বয়নশৈলী দেখে বিস্মিত হয়েছি।

সাহিত্যের জগতে সবসময়ই ভালো-মন্দ লেখা চলবেই। এর মধ্যে ভালোগুলোই টিকে থাকবে, মন্দগুলো ঝরে যাবে- এটাই বাস্তবতা।

আপনার মন্তব্য