রবিশঙ্কর মৈত্রীর ‘মুক্ত মানুষ’ : উন্মুক্ত পাঠ

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৬ ২১:৪৪:৩৮

 আপডেট: ২০১৬-০২-০৬ ২১:৫১:০৭

কালের লিখন:

রবিশঙ্কর মৈত্রীর গ্রন্থ- “মুক্ত মানুষ” কবিতা গল্প বা উপন্যাস কিছুই নয়। মুক্ত মানুষ কোন প্রবন্ধ নিবন্ধ বা জীবনীও নয়। তাহলে কি এই মুক্ত মানুষ? গতানুগতিক ধারার সকল পাঠকের কাছেই এই গ্রন্থ একটা বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষায় আছে। মুক্ত মানুষ গ্রন্থে শব্দের শরীর আছে, আছে প্রতিটি শব্দের নিজস্ব গতি। ভাব আছে, নিজস্ব ভাষা আছে, সঙ্গে আছে ঔৎকর্ষের স্ফীতি।

একজন মৃৎশিল্পী যেমন একতাল কাদা দিয়ে নানারকম জিনিস বানায়, কখনো ফুল-পাখি, কখনো খেলনা বা প্রায় জীবন্ত মনোরম কোন ভাস্কর্য। রবিশঙ্কর মৈত্রীর নিপুণ পারদর্শিতা এখানেই। মৈত্রীর শব্দেরা লব্ধ উপলব্ধ ভেদ করে আরও গভীর আরও অর্থবহ কোন ইঙ্গিত নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। ক্ষণিক বিভ্রমে পাঠক যদি ঝেড়ে ফেলতে চান কোন পাঠ পরবর্তী ভাবনা, সেটা কিছুতেই হয়ে ওঠে না, একটা একটা করে লেখা পড়া মানেই সেটা মর্মমূলে প্রবেশ করা। মুক্ত মানুষ আক্ষরিক অর্থেই মুক্ত মানুষ, যদিও এতে ভাবের দোলাচলে বস্তুনিষ্ঠতার দিকে ধাবমানতা বেশ সুস্পষ্ট। মুক্ত মানুষের ভিতরের পাঠ উন্মোচনের আগে, বেলাবেলি একবার এর দেহ সৌষ্ঠব দর্শন করা যাক।

একশো কুড়ি পৃষ্ঠার কাগজ-কালির কাঠামোটি, একশো গ্রাম অফসেট পেপারে বোর্ড বাঁধাই হয়ে চারু পিন্টুর প্রচ্ছদে যেন দু’হাত প্রসারিত এক মূর্তমান মুক্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। মুক্ত মানুষ প্রকাশ করেছে- পাললিক সৌরভ। বিনিময় মূল্য- ২৫০ টাকা।

একটা ভাব যখন লেখ্যরূপ ধারণ করে তখন এর কিছু অতিক্রমণীয় দিক থাকে, কিছু শব্দে গঠিত হয় অর্থপূর্ণ বাক্য, বাক্যে বাক্যে ঐক্য স্থাপন করে বিস্তৃত হয় ভাবনার সাথে লেখার পরিধি। সুকুমার সৃজনশীলতার প্রভাবে লেখাটি কখনো কবিতা হয়ে উঠে, কখনো গল্প- উপন্যাস বা নিছক স্মৃতিচারণা। এরকম নির্দিষ্ট অর্থপূর্ণ লেখাগুলো যখন গ্রন্থভুক্ত হয়, তখন সবগুলো ভাবনার খণ্ডাংশ মিলেমিশে সমগ্র গ্রন্থটিই একটি পূর্ণাঙ্গ অবয়বে রূপান্তরিত হয়। তখন গ্রন্থের নাম দেখেই তার ভাব বিষয় উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। মুক্ত মানুষ গ্রন্থটির মূলসুর এক, সবখানেই পরিত্যাজ্য অহেতুক ভেক। একজন মুক্ত মানুষের যাবতীয় ভাবনার উপাদানকে যাপিত জীবনের নিষ্ঠা আর লব্ধ অভিজ্ঞতার ঘায়ে ছেনে ছেনে মূল সারবস্তুটুকু মৈত্রী উপস্থাপন করেছেন তার মুক্ত মানুষ গ্রন্থের চরণে চরণে।

পাঠসুবিধার্থে কিংবা একই বিষয়ের উপর একাধিক সম্যক ধারণার চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে গ্রন্থটি ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়- আমার পৃথিবী আমার ঈশ্বর। দ্বিতীয় অধ্যায়- দেশ বিদ্বেষ শ্লেষ। তৃতীয় অধ্যায়- প্রেম অপ্রেমের পদাবলি। চতুর্থ অধ্যায়- সুখদুঃখের পদাবলি। পঞ্চম অধ্যায়- আরশিনগর। এবং ষষ্ঠ অধ্যায়- যাত্রী আমি ওরে।

আলোচনার সুবিধার্থে আমরা প্রতিটি অধ্যায় নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা করবো। প্রথমেই আমার পৃথিবী আমার ঈশ্বর।

মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত জীবন ধারণের উপযোগী একমাত্র গ্রহ আমাদের এই পৃথিবী। যদিও বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে এই মহাবিশ্বে জীবন ধারণের উপযোগী আরও গ্রহ আছে এবং এর ব্যাপক অনুসন্ধান এখনো অব্যাহত। মানব প্রজাতি বেঁচে থাকা আর টিকে থাকার দূর্বার আকর্ষণে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছে উন্নতির শিখরে। পৃথিবীর অসংখ্য প্রাণীকুলের মাঝে মানুষ নিজের প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, আর ইন্দ্রিয়(প্রযুক্তি) গুনে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়েছে। মানুষ আধিপত্য করছে সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপর। এত চমৎকার বায়ুমণ্ডলের এই পৃথিবীর প্রতি মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা, মানুষ প্রাণ ভরে উপভোগ করে সৃষ্টির সৌন্দর্য আর অপার মহিমা।

মানুষ ফুলের ঘ্রাণ নেয়, পাখির ডাক শুনে, মানুষ রাত জেগে আকাশের তারা গুনে। মানুষ সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে আর ভাবে এত অনুপম সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা কে? মানুষ মাত্রই চিন্তা করে আমার সৃষ্টিকর্তা কে? এমন কোন মানুষ নেই যার মনে এই প্রশ্ন উদয় হয়নি। সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে মানুষের যাত্রা এখনো অব্যাহত, সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে তৈরি হয়েছে অসংখ্য সম্প্রদায়, ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী আর জাতি, জন্ম নিয়েছে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক মতবাদ, এসব মতবাদকে আমরা ধর্ম বলে থাকি। যেমন- ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম।

এক জরিপে দেখা যায় পৃথিবীতে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার ধর্মীয় মতবাদ আছে, আমাদের এই ছোট বাংলাদেশেও প্রায় শ'খানেক সাম্প্রদায়িক মতবাদ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রত্যেক ধর্মেই একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, প্রত্যেক ধর্মীয়মত তাদের মতো করে সৃষ্টিকর্তার সন্ধান দিয়েছে। মুসলিমদের মতে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ, হিন্দুদের মতে স্রষ্টা ভগবান, খ্রিষ্টানের স্রষ্টা গড, বিজ্ঞানীদের মতে সৃষ্টিকর্তা শক্তি, আত্মতাত্ত্বিকদের মতে সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন সাঁই, দার্শনিকদের মতে সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতি।

প্রত্যেকেই নিজ নিজ হাড়িতে চমৎকার ব্যঞ্জন রেঁধে রেখেছে, প্রত্যেকেই তার তার মতো নিজের সৃষ্টিকর্তার স্বপক্ষে দালিলিক প্রমাণ আর যুক্তি উপস্থাপন করছে, তাহলে এই অসংখ্য সৃষ্টিকর্তার ভিড়ে আমি আমার প্রকৃত সৃষ্টিকর্তাকে কিভাবে কোথায় খুঁজে পাবো? খুব ছোট মানবজীবন, দেখতে দেখতেই ফুরিয়ে যায়, একটা কচ্ছপ ২০০ থেকে ৩০০ বছর বাঁচে সেখানে মানুষের গড় আয়ু ১০০ বছরেরও নিচে, অসংখ্য প্রশ্ন মনের মাঝে নিয়ে, উত্তর না জেনে, আত্মবিশ্বাস হীনতায় কেটে যায় ক্ষণিকের এই মানব জীবন। মরার আগে আমরা জানতেও পারি না আমাদের এই পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্য, আমাদের মানবকর্ম কি, আমাদের প্রকৃত ধর্ম কি? অসংখ্য প্রশ্নের বেড়াজালে অনুসন্ধানী মনে, জ্ঞান দিয়ে বিচার করে একটা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরা উচিত। একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগে সময় এসেছে প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার সন্ধান করার, জেনে বুঝে সৃষ্টিকর্তার ভজন পরম আনন্দের। মুক্ত মানুষ মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে সর্বত্র বিরাজমান। তার দৃষ্টি অভ্রান্ত, বোধ রোদের আঁচে প্রখর, চিন্তা গতিশীল, উৎকর্ষে সে মননশীল।

আমার পৃথিবী আমার ঈশ্বর অধ্যায়ের প্রথম দিকেই যখন মৈত্রী উচ্চারণ করেন-

“আমি আপেক্ষিক। আমি নশ্বর। আমার জানাটাই অস্তিত্ব, অস্তিত্বই ঈশ্বর” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ১২)

তখন মুহূর্তে নিজের দিকেই নিবদ্ধ হয় দৃষ্টি। খুব বেশি করে প্রকট হয়ে ওঠে অস্তিত্বের ভাবনা। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আত্মতাত্ত্বিক রূপকাররা পর্যন্ত আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন হয়েছেন, নির্মাণ করেছেন আত্মজিজ্ঞাসামূলক অমিয় সব বাণী।

আত্মতাত্ত্বিক লালন সাঁইজি গাইলেন-

জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা, দেখায় সবাই আসমানে, আছেন কোথায় স্বর্গপুরে, কেউ নাহি তার ভেদ জানে।

কবিয়াল বিজয় সরকার গাইলেন-

আমি জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটি কি। আমরা বহুনামে ধরাধামে কত রকমে ডাকি। / কেউ তোমায় বলে ভগবান, আর গড কেউ করে আহ্বান, কেউ খোদা কেউ জিহুদা, কেউ কয় পাপীয়ান। গাইলাম জনম ভরে মুখস্থ গান,মুখ বুলা টিয়াপাখি।

এই সকল আত্মজিজ্ঞাসার জবাব পেয়ে যাই মুক্ত মানুষ গ্রন্থে-

“মানুষই ঈশ্বরকে মহিমান্বিত করে। ঈশ্বর রথে বসেন, মানুষই তাঁকে যাত্রা করান। এই জগৎসংসারের উচ্চ আসনে একজন চালককে বসাতেই হয়; ঈশ্বর সেই আসন গ্রহণ করেন; মানুষ নিশ্চিন্তে তাঁর রথের রশি ধরে জীবনকে টেনে নিয়ে চলে; শিশুকালে যাত্রা শুরু, উল্টো রথে বৃদ্ধকালে শিশুর মতো ফেরা- এই তো জীবন, এই তো রথ, ঈশ্বরের সঙ্গে এই তো মধুর খেলা।” (মুক্ত মানুষ- ১১ পৃষ্ঠা)

আমার পৃথিবী আমার ঈশ্বর অধ্যায়ের ৪৬ টা লেখায় ভিন্নভাবে উঠে এসেছে একজন মুক্ত মানুষের পৃথিবী ও ঈশ্বর বিষয়ক ভাবনা।

মৈত্রী যখন বলেন-

“মনের মধ্যেই সব আছে, মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোডা সব। মনের মানুষই ঈশ্বর। কিন্তু তাঁকে চিনতে পারি না বলেই আমরা উপাসনালয়ে যাই। উপাসনালয়ে তাঁকে পাই বা না পাই সান্ত্বনা পাই, ঈশ্বরপিপাসু মানুষের সঙ্গ পাই। সঙ্গ বড়ো হলেই সংঘ হয়, আর সংঘ সম্মিলনেই সভ্যতা বিকশিত হয়।”(মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ২০)

তখন নতুন ভাবনা আর বাস্তবিক চিন্তা আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। কিন্তু একথা তো সত্য যে- একজন মুক্ত মানুষ কিছুতেই অন্য মতকে অশ্রদ্ধা করার নৈতিক অধিকার রাখেনা। তখনি মৈত্রীর অনন্য উচ্চারণ-

“যদি নিজের পাকাপাকি বিশ্বাস ভক্তি নাও থাকে তবু তুমি অন্যের বিশ্বাস ভক্তি নিয়ে কোনো মন্তব্য কোরো না। যদি প্রার্থনা নাও করো, তবু একবার পর্যটক হয়েও উপাসনালয়ে যাও। তোমার বিক্ষিপ্ত মনের অশান্ত ঢেউগুলো তীর পাবে নিশ্চয়।”(মুক্ত মানুষ- ২৩ পৃষ্ঠা)

আমার পৃথিবী আমার ঈশ্বর অংশে পৃথিবী এবং ঈশ্বর বিষয়ক ভাবনাগুলো একজন মুক্ত মনের মুক্ত মানুষকে নতুন আর মুক্ত স্বরের গান শুনাবে। মুক্ত মানুষ এর বিস্তৃত মুক্তকথন জীবনলব্ধ জ্ঞানের দিশা দেখিয়ে দিবে সঠিক আর সুনিপুণ পরম্পরার দিক, এটুকু নিশ্চিত প্রাসঙ্গিক।


মুক্ত মানুষ গ্রন্থের দেশ বিদ্বেষ শ্লেষ অধ্যায়ে বৈশ্বিক সীমারেখা স্পর্শ করা এক মুক্তমনা মুক্ত মানুষের দীপ্ত উচ্চারণ-

“দেশ আমার জন্মসনদ, পৃথিবী আমার চারণক্ষেত্র।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ২৯)

এ যেন শেকড়ের গান গাইতে গাইতে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ানো এক চিরকালীন পরিব্রাজকের সজাগ পদছাপ ফেলে যাওয়া, এ যেন সীমার মধ্যেই অসীমের জয়গান। একথা তো উপলব্ধজাত সত্য যে- দেশ মানুষকে ধারণ করে না, মানুষ দেশ কে ধারণ করে। মৈত্রী যখন আবার বলেন-

“মানুষই শুধু দেশ ছেড়ে যায় না; দেশও মানুষকে ছেড়ে চলে যায়।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ২৯)

তখন চিরকালীন মুক্ত পাখির ডানাও বেদনায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে, তখনো বাগানে অস্তকালীন সন্ধ্যা মালতী ফোটে। একটা মন, একটা দেশ, একটা উপলব্ধি দূর থেকে দূরে পরিভ্রমণ করতে থাকে, অথচ পরস্পর সুমধুর দোলাচল দেদিপ্য সূর্যের মতোই প্রাণ সঞ্চার করে যায়, দৃষ্টিসীমার সামগ্রিক পরিমণ্ডল।

দেশ বিদ্বেষ শ্লেষ নিয়ে মুক্তমত দিতে গিয়ে মৈত্রী বলেন-

“একজন রিকশাচালকের সততায় বড়োজোর ভুলে ফেলে যাওয়া ব্যাগটা ফেরত পাওয়া যায়। একজন শিক্ষকের সততায় সত্য সুন্দর মানুষ হবার পথ খুঁজে পায় কিছু শিশু। একজন চিকিৎসকের সততায় কিছু মানুষ সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা একজন নেতার সততায় দেশের অজস্র নাগরিক সুস্থ সুন্দর শুদ্ধ জীবন লাভ করতে পারে।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ২৯)

পর মুহূর্তেই ভেসে আসে খাঁচার ভিতর অচিন পাখির সুর-

“তোমার বিরুদ্ধে কেউ নেই, তুমিও কারো বিরুদ্ধে নও; তবু তুমি অবরুদ্ধ আজ; তুমি তো পাখি নও যে ডানা ঝাপটে মরবে খাঁচার ভিতরে।”(মুক্ত মানুষ-৩১)

বন্ধ খাঁচার ছটফটানি আরও বেশি তৃষ্ণাকাতর করে তোলে কূল সন্ধানী মন। মৈত্রী পরক্ষণেই আবার বলেন-

“আগের দিনে বারান্দারা বড়ো ছিল। হৃদয় ভরা আবেগ ছিলো। বারান্দায় নিরাপদে থাকা ছিল। ঘরে ঘরে বাড়তি লোকের খাবার ছিলো।দিনে দিনে কেমন যেনো হল। মানুষগুলো নিজের মধ্যে নিভে গেল, হৃদয়গুলো শুকনো হল। মানুষ কেনো এমন হলো? আবার হবে। সবই হবে। মনটা সবার বড়ো হবে, ঘরগুলো সব ছোটো হয়ে বারান্দারা বড়ো হবে। ভালোবাসায় ভেসে গিয়ে আবার একটা সবুজ শ্যামল সমাজ হবে।” (মুক্ত মানুষ- ৩৪)

হঠাৎ আমাদের আশাবাদে স্ফীত হয়ে যায় বুক, মনে হয় বেঁচে থাকাই পরম সুখ।

সত্যের আড়ালেও আর একটা ধ্রুব সত্য থাকে, প্রথাসিদ্ধ নিশ্চিত সত্যেরও অনেক ফাঁক ফোঁকর বের হয়ে আসে। যা সময়ের ঘর্ষণে ক্ষয় প্রাপ্ত করে দেয় দীর্ঘদিন লালিত স্থায়ী কথাকেও। যেমন- ক্ষমা মহৎ ধর্ম। মৈত্রী এই সমকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করে যান-

“যদি ক্ষমতা থাকে অপরাধীকে ক্ষমা কোরো না। তোমার ক্ষমাধর্মের জন্য একদিন মানবধর্ম ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৩৬)

একজন মুক্ত মনের পাখিমানব কিছুতেই এই বাণীর অন্য অর্থ করতে পারেন না, সমতাকামী মন ঠিকই সায় দিয়ে উঠে- অহেতুক ক্ষমাধর্মের জন্য মানবধর্ম ধ্বংসের আশংকা শতভাগ।

সুনিপুণ শৃঙ্খলায় মৈত্রী আমাদের মুক্ত মানুষের মুক্ত পায়ের গল্প বলে যান-

“যে কেবল হাঁটা শিখেছে, সেই শিশুও ছুটে দৌড়ে কোথাও যেতে চায়। মা তাকে ধরে বেঁধে আগলে রাখে। একবার দৌড়তে শিখে গেলে মৃত্যুর আগে কেউ আর তাকে থামাতে পারে না।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৩৮)

মুক্ত মানুষের প্রতিটি লেখাই আপন মাধুর্যে সুশ্রী। গুণে রূপে প্রকাশ্য চুপে নানামুখী আয়োজন, যেন একটা ঘরের শতেক জানালা উন্মোচন। পরম সত্যের মতো আমরা শুনতে পাই-

“হৃদয়ে রাজ্য না থাকলে শুধু মুকুট পরে রাজা হওয়া যায় না। স্বভাবে কবিত্ব না থাকলে প্রকৃতি ও মানুষের তোষামোদ করে কবি হওয়া যায় না।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৪২)

দেশ বিদ্বেষ শ্লেষ অধ্যায়ের ৭৭ টা লেখায় নানামুখী ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে দেশ নিয়ে, মাতৃভূমি নিয়ে, এর সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সত্যের মতো প্রগাঢ় উচ্চারণ করা প্রচেষ্টা অব্যাহত একের পর এক। যা মুক্ত মনের মুক্ত মানুষকে দেবে চিরন্তনী উদ্বেগ। সাথে নির্মল প্রশান্তিও।


প্রেম অপ্রেমের পদাবলি অধ্যায়ে মুক্ত মানুষের স্বচ্ছন্দ বাণী-

“প্রকৃত প্রেমের অভাব হলেই মানুষ প্রকৃতিপ্রেমিক হয়।” (মুক্ত মানুষ- ৫৬)

প্রকৃতির হাত ধরেই আমরা পরম প্রেমে মগ্ন হয়ে যাই। জেগে উঠে আমাদের ছায়াঘন পরিমণ্ডলের অনুপম সৌন্দর্য আর প্রখর অনুভব। প্রকৃতির পরমবন্ধু কবি জীবনানন্দ তার কবিতায় বললেন- তবুও তো পেঁচা জাগে, গলিত স্থবির ব্যাঙ আরও দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে। সেই দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগার প্রেম দেখতে পাই যখন মৈত্রী বলেন-

“ধেনো মরিচে রাঁধা ইলিশ মাছের ঝোল খেতে খেতে চোখে জল আসে; তবু পাত ছেড়ে ওঠা যায় না। পচা শামুকের কাটা ক্ষতে দাঁতে দাঁত চেপে কষ্ট সয়েও আগুনের ছ্যাঁকা না নিয়ে হাঁটা যায় না। যে দুবেলা জ্বালায় পোড়ায় চেঁচায় প্যাঁচায় তাকেও ছেড়ে যাওয়া না। প্রকৃত স্বাদ আর সাধও যে ঘুরে ফিরে ওই ঝালাপালার মধ্যেই গা-ঢাকা দিয়ে থাকে।”(মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৫৭)

জীবনের গ্লানি টানতে থাকা মন দু’দণ্ডের প্রশ্রয় খোঁজে পায় এখানে। পরক্ষণই ভালোবাসার উল্টো পিঠের বিষাদ এসেও যোগ হয় মনোমনে, যখন মৈত্রী বলেন-

“একদিন মনে হত, তুমিই আমার শেষ গন্তব্য। আজ দেখি কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই, কোথাও ফেরার তাড়না নেই।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৬০)

অসীম শূন্যতা বুকে ধারণ করে প্রেম অপ্রেমের পদাবলি অধ্যায়ের ৩৭টা লেখা ভিন্ন ভিন্ন সত্য জাগানিয়া প্রেম আর হৃদয়ঘটিত ঘটমান সময়ের কথা বলে যায় নির্মোহ সত্যতায়।


সুখদুঃখের পদাবলি অধ্যায়ে প্রথমেই দেখি মুক্ত মানুষের দুঃখের সংজ্ঞায়ন-

“দুঃখের আরেক নাম পাচাটা কুকুর, যতোই তাকে দূর দূর করি, লেজ নেড়ে নেড়ে সে আবার আমার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। আমার কাছে ওর বসে থাকাটাও ভালোই লাগে।”(মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৬৮)

যেন দুঃখ এক চিরকালীন সত্য। এর থেকে মুক্তি নেই কিছুতেই। আবার পরক্ষণেই সুখ স্বর ভেসে আসে মহাধ্যানীর কলম হতে-

“আজ যা আসক্তি কাল তা বিরক্তি। আসক্তি না থাকলে ভক্তি আসে না। ভক্তি এলেই স্থিরতা আসে। স্থির হলেই গভীর জলের দিকে চেয়ে চেয়ে মাছের চলাচল দেখেও দারুণ সুখলাভ হয়।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৬৭)

অস্থির পৃথিবীতে স্থির ছায়াছবির মতো মনের জলে চলে মাছের চলাচল, একান্ত ডুবসাঁতার। সুখদুঃখের পদাবলির ১৩টি লেখা অভিন্ন এক সুখদুঃখের যুগলবন্দী, অনুভবের সাথে যার চলমান সন্ধি।


আরশিনগর অধ্যায়ে দেখি মৈত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার প্রাণের পড়শিকে। যে পড়শি কাল থেকে কালান্তরে ধাবমান-

“জন্মের চেয়ে মৃত্যু অনেক বড়ো। যে জন্মের ঋণ শোধ করতে করতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়, মৃত্যুর পরেও সে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকে।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৭৬)

এক ফাঁকে মৈত্রী আমাদের জানিয়ে দেন একজন মুক্ত মানুষের দুইটি দোষের কথা-

“সাংঘাতিক বড়ো দুটি দোষ আমার- এক. কেউ একটু ভালোবাসলেই আইসক্রিমের মতো বিগলিত হয়ে যাই। দুই. কেউ একটু মন্দ বললেই নিজেকে আইসক্রিমের কাঠির মতো পরিত্যক্ত মনে করি।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৭৭)

১৩৭টা লেখায় ফুটে উঠেছে নানামুখী মুক্তমত আর মূলে পৌঁছার ইতিবৃত্ত। পরতে পরতে ভাবনা আর চিন্তা জাগানিয়া শব্দের বিচ্ছুরণ আমাদের নিয়ে যায় এক পরিশীলিত মনোভূখণ্ডে। মৈত্রী অমোঘ বাণীর মতো আবার উচ্চারণ করেন-

“ঘরের মধ্যে অতি সাধারণ না হলে বাইরে অসাধারণ হওয়া যায় না।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ৯৩)


যাত্রী আমি ওরে অধ্যায়ে মুক্ত মানুষে আমরা খুঁজে পাই এক অনন্তকালীন পথিক কে, যে সদা পরিভ্রমণে আছে মায়াময় ভূখণ্ড জুড়ে, যার হৃদয়ে একই সাথে প্রেম বিরহ, প্রণয় ঘুরে ফিরে। যে যাত্রী জীবনের সকল পথে অনুসন্ধানী অথচ প্রেমমনস্ক ভাব হৃদয়ে ধারণ করে ধাবমান কালের পথের পান্থ হয়েছেন। এই অধ্যায়ের ১৮টি লেখার ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে আছে নানামুখী ভাবনার স্পন্দন, চিন্তার প্রখরতা, মুক্তির আস্বাদন। রবিশঙ্কর মৈত্রী পরিপূর্ণ মুক্ত মানুষের ছবকে জীবনঘনিষ্ঠ উচ্চারণ করেন-

“আমি কারো জন্য, কোনোকিছুর জন্য অপরিহার্য নই। আমার জন্য এই আকাশ আলো জল বাতাস আর তুমিই অপরিহার্য। মস্ত বিপুল পৃথিবীর কাছে এক হাজার কোটি মানুষও নেহাতই খেলার পুতুল, খেলতে ইচ্ছে না করলে পুতুলগুলো সে যখন তখন জলে ছুড়ে ফেলতে পারে; আমরাও তিনভাগ জলের কাছে মাছের খাবারের চেয়ে বেশি কিছু নই। তবু আমি কোন খেয়ালে ক্রমাগত নিজেকে অপরিহার্য করে তোলার নেশায় মেতে আছি। খেলার সঙ্গী হারালেই পড়ে থাকবে মাটির সানকি, মাদুর বালিশ, ভালোবাসার নালিশখাতার কাগজগুলো বৃষ্টি ভিজে দূর্বাদলে মিশে যাবে।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ১১৮)

শেষ পর্যন্ত মুক্ত মানুষ এর মুক্তমত পরম এক সত্য উচ্চারণ করে বসে-

“একটাই পথ। একই ট্রেন। গন্তব্যও এক। বিরতিহীন। সবাই কিন্তু বেড়াতে যাচ্ছি না।” (মুক্ত মানুষ- পৃষ্ঠা ১১৭)

সহসা ভাবনার চৌহদ্দিতে নাড়া লাগে, পা থমকে যায় ক্ষণিক প্রলয়ে, আবার সে ছুটে চলে মুক্ত মনে মুক্ত মানুষ হয়ে।

আপনার মন্তব্য