মনভাসির টান : জীবনের কলতান

বই আলোচনা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১২ ১৭:৩৫:১৮

কালের লিখন:

মনভাসির টান মূলত মনের টানে ভেসে বেড়ানো এক চিরকালীন পথিকের শেকড় অনুসন্ধানের শাব্দিক পথ-পরিক্রমা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনভাসির টানে ভেসে ওঠে চিরায়ত লোকজ বাংলার নানা রকম অনুষঙ্গ। মনভাসির টান কোনো আরোপিত লেখা নয়, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবের স্ফুরণে নির্মিত হয়েছে প্রতিটি মনভাসির টান। কোথাও কোনো বাহুল্য নেই, শব্দের গায়ে জোর করে শব্দ চাপিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায় নেই, সবুজ বাংলার অবুঝ জীবনের সরল চিত্রকে রূপকল্প হিসেবে নিয়ে রবিশঙ্কর মৈত্রী মনভাসির টানে নির্মাণ করেছেন-- সহজ সরল এক ভাষাশৈলী। যে ভাষা সহজে স্পর্শ করে অনুভূতির অতল, মাটিঘেঁষা ঘ্রাণ নিয়ে হাজির হয় মরমের কাছাকাছি। যেন চারপাশে উড়ছে শঙ্কাহীন মধুমাছি।

একদম মাটির মানুষের মুখনিঃসৃত লোকভাষা সামান্য চাঁদের গর্ভে অসামান্য জোছনার প্লাবন নিয়ে হাজির হয় পাঠকের সামনে। সরলরেখার মতো সাবলীল প্রতিটি বাক্য, মূলকের আভাস দিয়ে যখন রূপকে বিলীন হয়ে যায়, মুহূর্তের জন্য বাংলার নিভৃত কোনো অঞ্চলকে সমগ্র পৃথিবীর সমতুল্য মনে হয়, যেন লোকভাষার এই আবেগ, এই বোধ, এই ক্ষণ, এই পরিস্ফুটন আর মননশীল অনুকল্প, শুধু সামান্য একজনে, এক মানুষে সীমাবদ্ধ নেই, স্থান কাল পেরিয়ে উচ্চদৃষ্টিতে ততোক্ষণে শুরু হয়ে যায় বৈশ্বিক বৃষ্টি। আকার আয়তন যাই হোক শেষ পর্যন্ত জলই সম্বল। মনভাসির টান মানুষের জয়গান, মনভাসির টান জীবনের কলতান। মনভাসির টান মরমে বিদ্ধ মর্মমূলে সামান্য সীমায় অসামান্যের আহবান।  

মন থেকে উচ্চারিত মনভাসির টান অনেকটা এরকম--

‘‘আতকা এমন তাজ্জব উপরে উঠে যাই, কেউ নাগুর না পায়, আচমকা এমন পতিত হই, কেউ আমারে পাতাল ফুঁড়ে না পায়, আমি এমন আজীব জীব, নিজ হস্ত দেখিয়া ভ্যাবাচাকা খাই।
আমার হস্তে ভাগ্যলিখন নাই। পরহস্তে নিজের লিখন তালাশ করে আমার দিন রাত্তির আহ্নিক গতি ত্বরিত হয়।’’ (আতকা এমন তাজ্জব উপরে উঠে যাই-- পৃষ্ঠা ২৮)

উল্লেখ্য, লেখাটি পুনঃপাঠেই মনোমাঝে অদ্ভুত দ্যোতনা জাগে। মনে হয় হাত দুটো প্রসারিত করে এ এক মনঃক্ষুণ্ণ মানুষের হৃদয়ের আকুতি। পরক্ষণেই নির্জলা সত্যের দাপাদাপি মন জুড়ে, মনের ভাষা তো বারবার উচ্চারণের। একবার বললে তার প্রশান্তি ক্ষুণ্ণ হয়, আবেগটা সকাল পেরিয়ে বিকেল অবধি স্থিত হয়ে থাকে, মনের মধ্যে একটা ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণন, যেন-- দিন রাতের ত্বরিত আহ্নিক গতি। যেখানে অনুভবটাই মূল, উপলক্ষে স্থির হয় না সামান্য লাভ-ক্ষতি।

লাভক্ষতিহীন সর্বজনীন মূল্যায়নকে নিশ্চয় ভালোবাসার ঘরে ফেলা যায়, কিন্তু মনভাসির মনোকথায় দেখি ভালোবাসার এক নবরূপ—

‘‘চালকুমড়ো শাক কবেই শুকায়া গেছে, লাউডগাও শুকনো দড়ি এখন। আচমকা টিনের চালে তাকায়ে দেখি অচেনা পরগাছা সবুজ দম্ভ নিয়া লতায়ে আছে-- তারেই নাকি কে বা কারা ভালোবাসা কয়।’’ (চালকুমড়ো শাক- পৃষ্ঠা ১৪)

মনভাসির টানে ভেসে আসে বিরহকাতর চিরায়ত বাংলার রমণী কণ্ঠ—

“পশ্চিমে ঝুলে গেছে ভানু, এই অবেলায় তুমি কোন দিকে পাও বাড়াও।
কতোকাল একসাথে আছি জড়াজড়ি করে। তোমার জামাকাপড় সেলাই করে করে আমার আঙুলে কড়া পড়ে গেছে। থালা ঘটি বাটি গেলাসেও তোমার ঠোঁটের ছাপ আমি পষ্ট দেখিতে পাই। চালের বাতায় তোমার কাঠি-কলম আর খেরোখাতাগুলি কতো-না যতনে থুইছি গুঁজে। উঠোনের কোণায় কোণায় তুমি বানাইছ থানকুনি পুদিনার সবুজ বিছানা; চালের উপরে তরতাজা শেয়ানা ডগায় কী সুন্দর টগবগে হলুদ কুমড়ো ফুল ফুটিতেছে। চালের গুঁড়ো দিয়ে কুমড়ো ফুলের বড়া ভেজে আমি কার পাতে দিয়া জুড়াব দরশন?” (পশ্চিমে ঝুলে গেছে ভানু- পৃষ্ঠা ১২)

মনভাসির টান জীবন্ত অম্লান ভাবের পরমানন্দ নিয়ে সদা মগ্ন আনন্দ ভ্রমণে। মহীরুহ শুভ্রতা ছড়িয়ে যায় লোকভাষার মাধুর্য ছুঁয়ে লৌকিক রমণে--

‘‘শুদ্ধ না হয়ে কিছুই ছুঁইতে নাই। অশুচি হাতের পরশে গাছও মরে যায়।
ছুঁয়ে ছেনে ঘেঁটে ঘেঁটে অমৃতও হয়ে যায় বিষ। বিষও ছোঁয়াছুঁই-গুণে মন্থনে হয় অমৃত। অশুদ্ধ জলও ধুয়ে ধুয়ে শুচিশুদ্ধ হয়।
মানুষ একবার পাতক হলে, আরবার প্রেমের পরশে সে চাতক স্বভাব পায়-- আজও সম্বৃত হয় অম্বর। আজও তাই মাটির পৃথিবীতে বৃষ্টি নামে; শুদ্ধ বারি সব পাপ ধুয়ে দিবার চায়।’’ (শুদ্ধ না হয়ে কিছুই ছুঁইতে নাই-- পৃষ্ঠা ১৬)

মনভাসির টান অনুভব আর অনুভূতির কোণা কাঞ্চি স্পর্শ করে গেছে মাটির সোঁদা ঘ্রাণ নিয়ে। এঁকে গেছে ভাব ভাবনা আর জীবনদর্শনের সজীব রেখাচিত্র। মৈত্রী যখন বলেন—

‘‘তোমার মুখে ভারী ভাব এলে আমি ডরাই ভাবের অভাবে।
তোমার চোখের ভিতরে পাইছি চন্দ্র সূর্য তারা, হাওর বিল নদী সাগর পাহাড়ও পাইছি। তোমারে দেখে দেখে আমি বাসি জীবনের এঁটোকাঁটা ভুলে গেছি।’’
‘‘তোমার হাতের আঙুলে কতো-না ইশারা আছে। চলনে বলনে কতো মায়া ছড়াও তুমি; যেন পুবালি বাতাসে ভাসে ভেজা গামছার ঘ্রাণ। একদিন তোমার দেখা পেয়ে ভুলে গেছি আমার চলা বলা; আমার সকল পথ তোমার কাছে এসে শেষ হয়ে গেছে।’’
(তোমার মুখে ভারী ভাব-- পৃষ্ঠা ২০)

মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায় মানুষের চিরকালীন ভ্রমণতৃষ্ণার্ত চলন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলার এক অনুপম নৈসর্গিক ছায়াচিত্র, মনে হয়-- এ জীবন, জীবনের প্রতিটি ধাপ কি মায়াময় বিচিত্র। কোথাও কোথাও খুব করে নতজানু হতে চায় মন, কোথাও কোথাও খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে একান্ত নিজস্ব নির্মল আয়োজন।

‘‘যতোটা নজর পায় আমার বাড়ির কামরাঙাগাছ-- আমি তার এক আনাও পাই না তোমার নিকটে। তোমার সোহাগী দুচোখ থেকে যতোটুকু দাম পায় জলপাই-বদলাই আচারওয়ালা-- আমি তার সিঁকিভাগও পাই না। মনোহারী দোকানের সামনে দেখা হলে ভাববাচ্যে কথা বলে তুমি সরে যাও অন্যের নিকটে-- আমি তোমার ভাবসাবের কূলকিনারা না পেয়ে বেভোলা বিদিশা হয়ে এই রাস্তায় সেই রাস্তায় খালি খালি হাঁটি।’’ (যতোটা নজর পায়-- পৃষ্ঠা ২১)

মনভাসির টান খুঁড়ে খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ব বের করার মতো-- প্রতিটি লেখায় ঘটেছে একের অধিক ভাবের প্রকাশ। ধারণ হয়েছে ছোট আলোয় বড়ো কোনো ছায়ার গল্প--

‘‘পাখি জানে কতোটা উঁচুতে গেলে ফিরে আসা যায়-- সে জানে কখন তার ঘর বাঁধতে হবে নিরাপদ ডালে।
আমি তো জন্মমাত্রই ঘোড়াতাড়ায় বাঁধা-- ছুটন্ত পড়ন্ত বাড়ন্ত নিদ্রাহীন আমি বান্ধা ঘরে; ফুটন্ত চোখে আমি অযুত নিযুত স্বপ্ন দেখি-- আকাশটাকে জানলা দিয়ে টেনে আনি।
আমি তো আমার মতো উড়াল দিতে জানি-- আমি তবু পাখির মতো সাধ্বী জীবন খুঁজে মরি।’’
(পাখি জানে-- পৃষ্ঠা ৩৪)

মনভাসির টানে মৈত্রী আকুতিমাখা মনোকল্প রচনা করেন--

‘‘জগতের কতো থান বিথান বিহার করি, কতো কী বিচিত্র স্বাদের আহার করি--এই মুখে আর লাগে না সুখ। বারবার মনে হয়-- আবার আউশের লালচে ফেনা ভাতের কাছে ফিরা যাই।
কে আছ সুজন, আমারে নিয়া তোমার ঘরে ঠাঁই দিবা কিছুদিন? তোমার ঘরের বারান্দার কোণায় থাকে যদি ছোটো একখান খোপ-- বাঁশের মাচায় আটপৌরে শাড়ির কাঁথা, আর একখান কাপাস তুলোর বালিশ যদি পাই-- নিদ্রার জন্য আর কী লাগে আমার?’’ (জগতের কতো থান-- পৃষ্ঠা ৪০)

একই লেখার শেষদিকে আবার উচ্চারণ হয়--

‘‘এই বেলা মিনতি জানায়ে রাখি হে বন্ধু সুজন- দেহে যদি আসে বল; মনও তবে ছল খোঁজে। আচমকা দেহে যদি কাম জাগে; ভেবো না হে- চন্দ্র সূর্যর কিরা গিরা দিয়া বলি- শাল্মমী বৃক্ষের মতোন কঠিন খাড়া হয়ে এই জীবন কাটাব আমি নিষ্কাম ভাবে”। (জগতের কতো থান- পৃষ্ঠা ৪০)

একজন পরমধ্যানীর সত্য কঠোর জীবনব্রত মোহিত করে যায় বাস্তবিক জীবনাচার। নিষ্কাম মনের কামবাসনা সাধনার সৌধে প্রেমে পরাভূত হয়। সহসা কঠিন বৃক্ষের বলয় ধারণ করে হেঁটে যেতে দেখি এক মৌন ঋষিকে।
মুহূর্তে চোখে ভাসে পশ্চিমের অস্তগামী সূর্যের প্রলয়। যে সূর্য বুকে বার্ধক্য ধারণ করে হরণ করে চলেছে দিনের শেষ রোদটুকু, সামনে ঘুটঘুটে ঘন অন্ধকারের হাতছানি। যেন এখানেই জীবনের পরমসমাপ্তি, শেষ বেলায় ক্লান্তির এক ভ্রান্ত কানাকানি। মনভাসির মনোকল্প দিনের যবনিকার পর আবার আলোর আশাবাদ নিয়ে হাজির আমাদের দ্বারে—

“তখন পাখিও চ্যাতন পায় নাই, পুব দিকে সলোক দিছে আর আমি পড়িমরি হাঁটা দিছি-- এই বুঝি ভাটিয়াপাড়া থেকে রাজবাড়ি লোকাল এসে আমারে না নিয়াই নলিয়াগ্রাম ছেড়ে চলে যায়”।  (তখন পাখিও চ্যাতন পায় নাই— পৃষ্ঠা ৩৮)

আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মানুষের বারোমাসি দৌড়ের ইতিবৃত্ত। কে না জানে-- আলোর স্পর্শেই গতি পায় মানুষের হেঁটে চলার ইতিহাস। সকালবেলার অক্ষম দৌড়ের পর যখন একই লেখার শেষে আবার উচ্চারিত হয়—

“কালুখালি জংশন সুনসান পড়ে থাকে। আমি লোহার শীতল বেঞ্চে বসে থাকি, ফিরতি ট্রেনের আশায় আশায়।’’ (তখন পাখিও চ্যাতন পায় নাই- পৃষ্ঠা ৩৮)

কেমন বিষাদাক্রান্ত হয়ে যায় মনভাসির স্বপ্নমগ্ন পাঠকের মন। মনে হয়-- জীবন বুঝি শেষ পর্যন্ত অপেক্ষারই অন্য নাম। যেখানে হাত ধরে বসে থাকে ঘামেভেজা হাত, শীতল বেঞ্চ আর একখানি মানুষের অপেক্ষমাণ প্রতিকৃতি। যে মানুষের ব্যাপ্তি আর উপস্থিতি বিশ্বময় একই রকম।
এ যেন সর্বকালীন অভিমানের কাছে অনুক্ষণের আত্মসমর্পণ। মৈত্রী তার মনভাসির টান-এর প্রতিটি লেখায়, সাধারণ দেহাতি মানুষের অতি সাধারণ জীবন যাপনের পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিনাটি তুলে এনেছেন পরম নিষ্ঠায়। রূপায়ণ করেছেন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার বৈশ্বিক আবেগকে। মনভাসির টান শুধুই কথার পৃষ্ঠে কথার আবাদ নয়। মনভাসি যখন বিভিন্ন ভাবধারায়, অনুভবের শিরায় উপশিরায় একত্রে আহবান করেন সবাইকে, তখন এই লোকজ ভাষার মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে সবটা না শুনে উপায় থাকে না—

‘‘কোথায় আছ মা-সকলে; এসো ভাই বোনে। বারান্দায় মাদুর পেতে বসে যাও-- শুনে নাও নতুন বৎসরটা ক্যামন যাবে।
বৈশাখে লম্বা খরা আছে; মাঝে মাঝে শুষ্ক ঝড় হবে; ছিটেফোঁটা বৃষ্টি যা হবে-- ধুলোও মরবে না তাতে।
জ্যৈষ্ঠে প্রবল ঝড় হবে; তৃতীয়ার পরে আছে শুভবৃষ্টিযোগ। এই বৎসর বিলম্বের বৃষ্টি প্রলম্বিত হতে পারে; জমিতে জো আসার সাথে সাথে ধান পাট বুনে দিতে হবে।
আষাঢ়ে অম্বুবাচী, একটানা ঢলের দুর্ভাবনা আছে। অম্বুবাচীর কালে কোদালের কোপ দেয়া যাবে না মা বসুমতির দেহে; জানো তো সকলে-- বসুমতি ভাগ হলে রক্ত বাহির হবে।
শুনে রাখো মনোযোগ দিয়ে-- অম্বুবাচীর পরে বৃক্ষরোপণে জগতের মঙ্গল হবে। শ্রাবণে দ্বিতীয় পক্ষকালে মেঘেরা নিম্নমুখী হবে; অকাতর বৃষ্টিজলে আউশের ক্ষেত ডুবে যেতে পারে; আগে ভাগে কাঁচাপাকা ধান কেটে নিলে কম ক্ষতি হবে।
ভাদ্রে হিমালয় উষ্ণ হতে পারে-- তেরই ভাদ্র হতে যথারীতি বাতাস উত্তরে ঘুরে যাবে। আশ্বিনে হিমালয় কন্যা উমা আসবেন নৌকায় করে।
কার্তিকে খালে বিলে গাঙ্গে মাছের গড়ান হবে, মাছের আধিক্যহেতু এই মাসে মৎস্যভক্ষণ অনুচিত হবে। অঘ্রাণে আমন ধানের ফলন ভালো হবে। এই মাসে শুভবিবাহের শুদ্ধ যোগ আছে।
পৌষে শীতের প্রকোপ হলেও রবিশস্য ভালো হবে; মাঘের শেষে বৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা আছে। পৌষ মাঘে অন্নপ্রাশনের শুভদিন আছে।
ফাগুনে আমের মুকুলগন্ধে মৌমাছি আকুল হবে; এই মাসের দ্বিতীয় পক্ষে বিবাহ ও গর্ভাধান শুভ হবে। চৈত্রশেষে গরম বাতাস তীব্র হলেও নতুন বছরের আগমন শুভ হবে।
এই ক্ষণে সকলের মঙ্গল কামনা করি পঞ্জিকা পাঠ হল সমাপন; করজোড়ে সকলের তরে করি নিবেদন--
মাঙনের চাল ডাল তরকারি তেল নুন দিয়ে খিচুড়ি রান্না হবে এই বাড়িতে-- ত্রুটি যদি হয়ে থাকে কোনো আয়োজনে-- সকলি নিজগুণে ক্ষমা করে-- সকলেই শুদ্ধ মনে বসে যাব পঙ্ক্তিভোজনে।’’ (কোথায় আছ মা-সকলে-- পৃষ্ঠা ৪৩)

পাঠক মাত্রই আলোচ্য লেখার ছত্রে ছত্রে খুঁজে পায় গ্রাম বাংলার অনুপম ঋতুবৈচিত্র্য। এক জীবনের সবকটা অনুভবের মশাল জ্বেলে পরম নিষ্ঠায় বাংলার ধুলোবালি, কাদামাটি আর স্বচ্ছ জলে মাখামাখি করে বেড়ে উঠলেই এরকম গভীর জীবনবোধ সাবলীল সরল ভাষায় বয়ান করা সম্ভব। এখানে আমরা ব্যক্তি মনভাসির লেখকের বাংলা পর্যবেক্ষণ দেখে নতুন করে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হই। এ কথা তো সবাই জানি-- শেকড় ছাড়া বৃক্ষ হিসেবে আমরা মূলত কিছুই নই।

মনভাসির টান সত্যিকারের প্রাণের টান। যেন ভাবের তরঙ্গে কেউ বেয়ে যাচ্ছে লোকভাষার মায়াময় সা¤পান। মনভাসির আকুল টানে মৈত্রী যখন বলেন—

‘‘আমি তো নাই আর আমার সাকিনে-- তবু তুমি একবার যাইও, আমার সিথানের কাছে। জঙ্গল-মঙ্গল সব সাফ হয়ে গেছে, বিষধর সাপটাপ কোথায় গেছে পলায়ে। কোথাও আর কাদাপথ নাই, একবাঁশ ধরনার সাঁকোটাকো উঠে গেছে কবে, সামান্য ঘুরপথে পাকা পুল আছে।’’ (আমি তো নাই আর আমার সাকিনে-- পৃষ্ঠা ৪৭)

তখন স্মৃতিময়তা আচ্ছন্ন করে প্রচ্ছন্ন মনের দেয়াল, আপন মনে জাগে এক বৈরি খেয়াল। হঠাৎ মনে হয় জীবন বুঝি সব হারানোর গল্প। সময় বুঝি অনেক কিছুই মুছে দেয় নিষ্ঠুর নিষ্ঠায়। শুধু ছাপ আর তাপ রয়ে যায় মহাকালের পৃষ্ঠায়। মনভাসির মগ্ন টানে ক্রমবর্ধমান ভাবের দোলাচলে মৈত্রী যখন বলেন—

‘‘তুমি যে কথা কও, মনে হয় পাখিরাও ফেল। তোমার কথা শুনিবার পরে কোনো শ্রুতি আর কানে ধরে না। তোমার গান ছাড়া আর কোনো তাল লয় কাছে বাজে না।
তুমি যে ভালোবাস-- এ আমার সাধনার ফল। শেকল ছাড়াই বান্ধা আমি, তুমিই আসন। তোমাতেই ভক্তি আমার, তোমাতেই ভজন পূজন। তোমারেই বাসি ভালো— আমার আর কিছু ভালোমন্দ নাই।
তুমি মত তুমি পথ, তুমিই রথ-- আমি অনুগামী। কে না জানে-- একবার অনুগামী হলে, কেউ আর বহুগামী হয় না।’’ (তোমার গন্ধ পেলাম আর অন্ধ হলাম-- পৃষ্ঠা ২২)

নিশ্চিতভাবেই এক মহামতি সত্যের মুখে দাঁড়ায় আমাদের দৈনন্দিন বোধ। কেন ফ্যাকাসে লাগে প্রাত্যহিক দীপ্ত রোদ। মনোকল্পে গল্প করে অল্প আলোর প্রতিরোধ। ভাবনার সীমারেখা চৈতন্যের দেয়াল ছুঁয়ে বোধের কার্নিশে দোল খায়।

মনভাসির টানে আবার আমরা ফিরে যাই সেই চিরকালীন পথিকের কাছে। যে পথিক বাংলার শ্যামলরূপ বুকে ধারণ করে প্রত্যহ ছুটে চলেছে দিগন্তের ছায়া ভালোবেসে। যার ভ্রমণ যৌক্তিক, নয় শুধু মিছে অভ্যাসে। যে খাঁটি হয়ে পরিপাটি শুভ্রতা ভালোবাসে, মানুষ হয়ে মানুষের জন্য কাঁদে-হাসে—

‘‘মাটির জগৎ ভ্রমিয়া আমি এই জানিলাম-- গাছপালা লতাপাতা জন্মের ঋণ শোধ করে যায় মা মাটির নিকটে। মানুষ মাতৃঋণ শোধ না করে নিজেরে ছড়ায়ে মরে বিকটে প্রকটে।’’  (জগতের পথে পথে-- পৃষ্ঠা ৩২)

এ যেন পরম সত্যের চরম উপলব্ধি। মানুষ দেশ মাতৃকার ঋণ শোধ না করে বিকটে প্রকটে মরে যায় মরার আগেই। ডুবে যায় এক চিরকালীন অন্ধকারের ঘুমে। তখনো মনভাসি জেগে থাকে একরাশ মায়া আর বুকের উষ্ণ ওমে—

‘‘তুমি ঘুমাও না, রাতও ঘুমায় না। তুমি ঘুমাও, আমার দিনও ঘুমায়া যায়। তুমি ঘুমাও, পাছে তোমার নিদ-ব্যাঘাত হয়, আমি জানলার খিল লাগাই।  
তুমি ঘুমাও-- জগৎ তোমারে পাহারা দেয়।’’ (তুমি-- পৃষ্ঠা ২৪)

এ যেন শুদ্ধতার বলয়ে শুভ্রতার আচ্ছাদন। কেমন কেমন করে উঠে মনভাসির ভাসা ভাসা মন। সবখানেই মানুষের একাত্মতা, জীবনবোধের মৌলিক আস্ফালন। মনভাসির টান মনের টানে বয়ে চলে বহমান নদীর মতো--

‘‘নদী সকল দেশের মাতা; সবখানেতে তাঁরই আঁচল পাতা। দেশে দেশে নদীরই গান; নদীই জীবনগাঁথা।
নদী কোনো দেশ চেনে না ধর্ম জাতি বাঁধ মানে না। নদী জানে শুধু যাওয়া পথে একটুখানি চাওয়া।
মানুষ কোনো শেষ জানে না; নদী এবং স্রোত বোঝে না। মানুষ জানে শুধুই পাওয়া এবং দখল করে খাওয়া।’’ (নদী-- পৃষ্ঠা ৫৪)

এই নদী শুধুমাত্রই নদী নয়, নদীর অন্তরালে নিরবধি অন্য এক যদি, স্রোতের মতো বয়ে চলে মননশীল পাঠকের মনে। নদীর সাথে মানুষের মৌলিক সংযোগ আবিস্কার হবার পরেই, লোকভাষার হাত ধরে মনভাসির মনোকথায় আমরা ফিরে যাই মাটির কাছে—

‘‘মাটি খাঁটি, মাটিই আমার মা। তবু আঁতুড়ঘরের মাটি আমায় চিনতে পারল না।
ছুঁইতে গেলাম। ঠেলে দিলে, থেঁতলে দিলে তুমি। ক্ষত হলেও ক্ষতি হয় নাই কিছু। কঠিন ঢেলা, সালাম জানাই তুমি জন্মভূমি।’’ (মাটি-- পৃষ্ঠা ৫৬)

মনভাসির টান অম্লান ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে লোকভাষায় এক শাব্দিক স্নান। প্রতিটি অনুভূতিশীল মানুষের হৃদয়ের অতল নাড়িয়ে দেওয়ার সকল উপাদান মনভাসির টানে হাজির হয়েছে পরম মমত্বে। মানুষের জন্যই হোক মানুষের গান, মন জাগানিয়া অনুভবে ঋদ্ধ হোক মনভাসির টান।

আপনার মন্তব্য