একুশে বইমেলার রঙঢঙ!

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৭ ০১:৩৮:৩৯

 আপডেট: ২০১৬-০২-০৭ ০২:২৬:৪২

রেজা ঘটক:

বাংলা একাডেমি চত্বরে বর্ধমান হাউজের সামনে ভাষা শহীদদের একটি ভাস্কর্য আছে। একুশে বইমেলায় আগত বইপ্রেমীদের অনেকেই আসেন এই ভাষা শহীদদের ভাস্কর্যটি দেখার জন্য। কিন্তু মুশকিল হলো কর্পোরেট বেনিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া বাংলা একাডেমির বেলাল্লাপনায় সেই ভাষা শহীদদের ভাস্কর্যটি ঠিক মত দেখার কোনো উপায় নেই। ভাস্কর্যটির একপাশে বসেছে ফিট ক্রেকারের বিজ্ঞাপনের নামে বিশাল নিরাপত্তা টাওয়ার। এই টাওয়ার লেখক-প্রকাশকদের নিরাপত্তা দেবার নামে কর্পোরেট মাফিয়াদের বিজ্ঞাপনের জন্য খাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত সীমান্তে বা জেলখানায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এমন নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের কথা আমরা জানি। কিন্তু একাডেমি চত্বরের ভেতরে এই টাওয়ার তাহলে কীসের প্রতীক? জেলখানার? নাকি বহিঃশত্রু পর্যবেক্ষণের?

শুধু টাওয়ার নয়, ভাষা শহীদদের ভাস্কর্যটির সামনে চ্যানেল-আই বইমেলা নিয়ে লাইভ প্রোগ্রাম করছে। সেই প্রোগ্রাম করার সময় একপাশে তাদের বিশাল সাইনবোর্ড, আরেকপাশে আইএফআইসি ব্যাংকের বিশাল সাইনবোর্ড। এই লাইফ প্রোগ্রামের যন্ত্রণায় ভাষা শহীদদের ভাস্কর্যটি পড়ে যাচ্ছে আড়ালে। এটি কীসের লক্ষণ? আমাদের ঐতিহ্যকে আড়াল করে কাদের বিজ্ঞাপন দেখাতে বাংলা একাডেমি এই অপকর্মটি করছে বা করার সুযোগ দিচ্ছে? এটি নিয়ে দেশের কোনো লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিক কারো মাথা ব্যথা দেখলাম না। সবাই যেনো ঐতিহ্য আড়াল করে ব্যবসা করার রমরমা খবরেই ভারী খুশি।

বাংলা একাডেমি'র পুকুর পাড়ে একাডেমির কর্মচারী কল্যাণ সমিতির ব্যানারে খাবারের দোকানটি কী করছে? লোহার সিকে বারবিকিউ তাপাচ্ছে। বারবিকিউ'র সেই ধোয়ায় বইমেলায় আগতদের চোখ-জ্বালাপোড়া করছে। মূলত বারবিকিউর ধোয়ায় লেখকদের অন্ধ করার জন্যই বাংলা একাডেমি পুকুর পাড়ে এই বারবিকিউ তাপাচ্ছে। বারবিকিউ'র এই ধোয়ায় যাতে বাংলার কবি-লেখককুল অন্ধ হয়ে যায়, এ যেন তারই সুপরিকল্পিত আয়োজন। সঙ্গে রয়েছে পকেট কাটার নানান কিসিমের কাসুন্দি। বইমেলায় যারা এসে বারবিকিউ খায়, তারা কেউ বই কেনে না। বই কেনার টাকা বারবিকিউতে খরচ হয়ে যায়। তারপর কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে বাড়ি যায়। পাঠক যাতে বই না কিনে বারবিকিউ খেয়ে বাড়ি যায়, এই কৌশলটি তাহলে কীসের লক্ষণ? একটা জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তিলে তিলে শেষ করার এই সুপরিকল্পিত কৌশলের বিরুদ্ধে এত হাজার হাজার লেখক, কবি, সাহিত্যিক, কারো যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই।     
 
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবছর লটারিতে প্রকাশকরা যেখানে যিনি স্টল বরাদ্দ পেয়েছেন, বাহুবলের সুবিধা নিয়ে শক্তিশালী প্রকাশকরা সেখানে স্টল না করে নিজেদের পছন্দমত জায়গায় ইচ্ছেমত স্টল করেছেন, একাডেমির নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই। বইমেলার আয়োজকরা এটা নিয়ে এখন পর্যন্ত টু শব্দটি করছে না। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোন প্রকাশনার স্টল ঠিক কোনদিকে, এটি খুঁজে বের করাটা বইপ্রেমীদের জন্য এবছরের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অথচ মেলার ছয়দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো আয়োজকরা মেলার প্রবেশ গেটে একটি মানচিত্রের ব্যবস্থা করতে পারেনি।

প্রতি বছর অমর একুশে বইমেলাটি বাংলা একাডেমি আয়োজন করে কোনো ধরনের ডিজাইন ছাড়াই! অথচ একুশে বইমেলার সবচেয়ে আগে দরকার মেলায় আগত সকল প্রকাশনার স্টলগুলো যাতে খুব সহজেই বইপ্রেমীদের চোখে পড়ে তেমন একটি সুপরিকল্পিত ডিজাইন। ইউ আকৃতির ডিজাইন হলে বইপ্রেমীদের জন্য সকল প্রকাশনার স্টলে ঢু মারার যে সুবিধা হবার কথা, সেটি আয়োজক বা প্রকাশকদের কারোর কাছ থেকেই আসেনি। অথচ এবছর আমাদের প্রকাশক নেতারা জার্মানে অনুষ্ঠিত ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় স্বয়ং সংস্কৃতি মন্ত্রীসহ ঘুরে এসেছেন। বইমেলার মাঠটি যে একটি সুনির্দিষ্ট ডিজাইনের আওতায় করলে সেটি বেশি কার্যকর হয়, এটি নিয়ে কেউ কথা বলেন না। যে কারণে মার খায় কানাগলি, খুপচিতে পড়া প্রকাশনার স্টলগুলি। এনিয়ে কারো মুখে কোনো কথা নেই। আয়োজকদেরও কোনো আগ্রহ নেই। অথচ একুশে বইমেলায় সকল প্রকাশনাই কিন্তু নির্দিষ্ট ফি দিয়ে স্টল নিয়েছেন। সুবিধা পেতে কেন তাহলে এই শ্রেণীবিভাগ? বইমেলার মাঠে এলোমেলো স্টল বিন্যাসের কারণে একজন বইপ্রেমী তার কাঙ্ক্ষিত স্টলটি খুঁজতে খামাখা বেকুব হচ্ছেন। আবার ধূলা মারার জন্য পানি ছিটানোর গাড়ি সব জায়গায় যেতে পারছে না। কারণ কোনো কোনো গলি এত ঘিঞ্জি যে সেখানে পানির গাড়ি ঢুকতে পারে না। অতএব স্বেচ্ছায় ধূলা খাও। নইলে বাড়ি যাও।
 
বইমেলার প্রবেশ গেটে পুরুষ-মহিলা আলাদা গেট করে আমাদের নিরাপত্তাবাহিনী বিশাল এক ছওয়াবের কাজ করেছেন! বইমেলায় ঢোকার জন্য প্রবেশ পথে চারটি কলাম রাখলেও দুটি তারা বন্ধ করে রাখছেন। আর পুরুষ-মহিলা আলাদা প্রবেশ গেট করে খামাখা এক জটলা বাধাচ্ছেন গেটে। এটা কেন? সারা পথ এবং বইমেলায় মহিলা সঙ্গীটি পুরুষের সঙ্গে থাকলেও মেলার প্রবেশগেটে পুলিশ তাদের আলাদা করার এই খায়েস দেখাল কোন অজুহাতে? জটলা সৃষ্টির অজুহাতে নাকি বুদ্ধির ঘাটতি থেকে? পুলিশের এই বুদ্ধিটি কার মাথা থেকে এল? যে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা গেট লাগবে?

একুশে বইমেলার জায়গা বৃদ্ধি পেয়েছে এটা বেশ উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করেছিল আয়োজকরা। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে যে বিশাল একটা ঝামেলা ও জটলা পাকিয়ে সেটিকে গুবলেট করে ফেলেছে, সেদিকে কারো নজর নেই। বইমেলার জায়গা বাড়িয়ে বেশি প্রকাশকদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলা হচ্ছে। সেই সুযোগে ছাপা হচ্ছে অখাদ্য-কুখাদ্য। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পের প্রফেশনালিজম গড়ে না ওঠার পেছনে এই অখাদ্য-কুখাদ্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এখানে এখন ব্যবসায়ী, আমলা, মন্ত্রী, চানাচুর বিক্রেতা, হকার, দালাল, কালোবাজারি, চোরচোট্টা, ঋণখেলাপী, খুনি, দস্যু, দখলবাজ সবাই লেখক। সবার গণহারে বই প্রকাশ পাচ্ছে একুশে বইমেলাকে ঘিরে।

ব্যাঙের ছাতার মত রাতারাতি গজিয়ে উঠছে প্রকাশনা। কারো কোনো মনিটরিং নেই। ভুলভাল অখাদ্য-কুখাদ্য ছাপিয়ে বইমেলার মাঠ ভরিয়ে ফেলছে। চটপটি-ফুচকার মত ফেব্রুয়ারি মাসকে ঘিরে এখন প্রকাশনা ব্যবসাটি বেশ রমরমা। অথচ হবার কথা ছিল ঠিক তার উল্টো। একটি সুনির্দিষ্ট মান উত্তীর্ণ না হলে সেটিকে বই আকারে প্রকাশ করার এই দায় আসলে কার? রাষ্ট্র এভাবে এই জাতির কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের ধ্বংস করার এক গোপন খপ্পরের কবলে এখন। এই গা ভাসিয়ে দেবার স্রোতের কারণে আসল লেখকের ভালো বইটি রয়ে যাচ্ছে আড়ালে বা একটি ভালো লেখা হয়তো প্রকাশেরই সুযোগ পাচ্ছে না। ষোল কোটি জনসংখ্যার দেশে এখন কয় কোটি কবি-লেখকরে ভাই? পঙ্গপালের মত কবি-লেখক বৃদ্ধি করার এই অভ্যাসটি মোটেও দেশের কোনো উপকারে লাগবে না। বরং ধীরে ধীরে প্রকৃত লেখকরা বইপ্রকাশের আগ্রহ হারবেন বলেই আমার ধারণা।

বাংলা একাডেমি তরুণ প্রজন্মের কবিতা, গল্প, উপন্যাস প্রকাশ করে না। কিন্তু কেউ যদি রাজার বাড়ির কার্পেট নিয়ে একটা কিছু লিখে একাডেমিতে জমা দেয়, ওটা বই আকারে প্রকাশ করে একাডেমি। এই একাডেমি এবছর ৬০ বছর পূর্তি হীরকজয়ন্তী পালন করছে। কিন্তু একাডেমি কী এবার ৬০ জন তরুণ কবি-লেখকের বই প্রকাশ করতে পারত না? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেমন জামা পড়তেন, কেমন কমোটে হাগু করতেন, এমন আইডিয়া দিয়ে কিছু লিখে দিলে সেটি বই আকারে প্রকাশ করতে এই একাডেমির ভারী আগ্রহ। তাহলে নতুন লেখকদের কী হবে? তা নিয়ে খোদ একাডেমির কোনো আগ্রহ নেই কেন? তাহলে হীরকজয়ন্তী দিয়ে কী হবে?

প্রতিদিন বইমেলার উন্মুক্ত মঞ্চে একদল জ্ঞানপাপী বড় বড় গবেষণা পাঠ করেন। বিশিষ্টজনেরা তার উপর আলোচনা করেন। সেই আলোচনা প্রতিবছর কারা শোনে? একাডেমির কী এই দৃশ্যটি একবারও কারো নজরে আসে না যে, এটা একটা বস্তাপচা কারবারি। এটা কেউ খায় না। একাডেমি একটা তালিকা করে, সেই তালিকার গবেষক, লেখক, কবি এসে মঞ্চে ফাঁকা চেয়ার-টেবিলের উদ্দেশ্যে কিছু বাকোয়াজ করে একাডেমি থেকে নগদ কিছু নারায়ণ নিয়ে খুশিতে বাড়ি যান। তাতে বাংলা সাহিত্যের কী লাভ হচ্ছে?

লেখক ও পাঠকের সঙ্গে সরাসরি যাতে কোনো যোগাযোগ না হয়, কবি-লেখকরা যাতে নিজেদের মধ্যে কোনো আইডিয়া নিয়ে, নতুন কিছু সাহিত্যকর্ম নিয়ে আড্ডায় মাততে না পারে, সেজন্য লেখকদের বসার জন্য বইমেলার মাঠে কোনো আয়োজন নাই। এই আয়োজনটি না থাকার বা না রাখার পেছনে একটি সুনির্দিষ্ট কৌশল রয়েছে। সেই কৌশলটি এই জাতিকে অনগ্রসর করে রাখার সঙ্গে জড়িত। প্রগতিশীলরা যাতে একত্র হতে না পারে, সেই প্রচেষ্টার পেছনে রাষ্ট্র কোটি টাকা খরচ করতে প্রস্তুত, কিন্তু তাদের একত্রিত হতে দেবে না কিছুতেই। এই রাষ্ট্রীয় কৌশল যে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে, সেটি যেনো কারো নজরদারিতে নেই। আহা মরি মরি!!

সোজা কথা, একেবারে বাণিজ্য মেলার মত আমরা অমর একুশে বইমেলা চাই না। বইমেলা হোক কেবল প্রকৃত পাঠক, লেখক, প্রকাশক ও বইপ্রেমীদের মিলন মেলা। গত বছর টেলিটক বইমেলায় সিম বিক্রি করে এক আকাম করেছিল। এবার দেখলাম কিছু কিছু প্রকাশনার স্টলে চানাচুর, চিপসের প্যাকেট। বই কিনলে তারা চানাচুর আর চিপসের প্যাকেট দিচ্ছে ফাউ। এই লক্ষণটি মোটেও শুভকর নয়। এই জাতি যাতে বই না পড়ে, সেজন্য তার হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই জাতি যাতে বইয়ের পাতায় চোখ না বুলায়, সেজন্য তাদের প্রাইভেট চ্যানেল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা ঘরে বসে টিভি দেখতে থাকো, আর মোবাইলে কথা বলতে থাকো। মোবাইলে কথা বলার সময় শতকরা ৯০ ভাগ মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস রপ্ত কর। ব্যাস, এতেই এই রাষ্ট্র যেন ভারী খুশি। তাহলেই নষ্টরা এই জাতির সবকিছু আরামে নিজেদের দখলে নিতে পারে। তোমাদের চোখ কান বন্ধ করার জন্য এই সুব্যবস্থা রাষ্ট্রই করেছে। তোমাদের বিবেককে ধ্বংস করার জন্য খোদ রাষ্ট্রই এদেশে কোটি টাকার প্রজেক্ট নিয়েছে। সেই সুযোগে এখানে ভরাট হচ্ছে নদী। দখল হচ্ছে মন্দির, প্রাচীন স্থাপনা। আর এসব করার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে পুলিশি ব্যবস্থা। আহা মরি মরি!!

একুশে বইমেলাকে শুধু বাংলা একাডেমি কেন্দ্রিক না করে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হোক। জেলায় জেলায়, উপজেলা উপজেলায়, এমন কী গ্রামে-গ্রামে একুশে বইমেলাকে ছড়িয়ে দিতে না পারলে প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচানো যেমন কষ্টকর হবে, তেমনি একাডেমি কেন্দ্রিক এই বইমেলা একসময় প্রকাশক-লেখকদের কাছেই একটা মহা ঝামেলার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এখন আর দেশে সারা বছর বই প্রকাশ পায় না। এই লক্ষণটি একটা জাতির জন্য, সেই দেশের কবি-লেখকদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত একুশে বইমেলাটি হোক কেন্দ্রীয়ভাবে। আর সারা দেশে এটিকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হোক। নইলে এই একুশে বইমেলাই এই জাতির জন্য ভবিষ্যতে একটা চরম বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন পার্বণে বিভিন্ন ঐতিহ্যকে ঘিরে সারাদেশে সারাবছর বইমেলার আয়োজন করা হোক। সারাবছর বই প্রকাশ করার নতুন নতুন আয়োজন করা হোক। নইলে কেবল এই একুশে বইমেলাকে ঘিরে বইপ্রকাশ এই জাতিকে একটি গর্তে ঢুকিয়ে ফেলার কৌশল। অতএব সাধু সাবধান।

৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রেজা ঘটক : কথাসাহিত্যিক।

আপনার মন্তব্য