গ্রন্থমেলায় ফরিদ আহমেদের ‘কমল শোভার মল্লিকা বাহার ও অন্যান্য’

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৮ ১৩:১০:৪৬

 আপডেট: ২০১৬-০২-০৮ ১৩:১৮:৪০

রাজেশ পাল:

এবারের বইমেলার কিছু পূর্বে প্রকাশিত হল মুক্তমনা বাংলা ব্লগের সাবেক মডারেটর, জনপ্রিয় ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট ফরিদ আহমেদের “কমলশোভার মল্লিকা বাহার ও অন্যান্য” গল্পগ্রন্থটি।

বাংলা ব্লগে পুনরায় সাহিত্যের ধারাকে ফিরিয়ে আনার পথিকৃতের কাজ করে চলেছেন ফরিদ আহমেদ। মূলত: বিভিন্ন সময়ে ব্লগে প্রকাশিত সাহিত্য বিষয়ক লেখাগুলোর সংকলন এই বইটি।অত্যন্ত প্রাঞ্জল ,হৃদয়গ্রাহিক ভাষায় লেখক তুলে এনেছেন বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃতপ্রায় কিছু লেখনিকে। বইটিতে লেখকের ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা ১১ টি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। লেখাগুলো হলো:

  • চন্দ্রকান্তি এক কবি চন্দ্রাবতী
  • দাস আর দাশ নিয়ে চলে হাঁসফাঁস
  • কমল শোভার মল্লিকা বাহার
  • কপতক্ষ নদ
  • বুদ্ধদেব বসুর লেখা প্রকাশ
  • মেঘনাধবদ কাব্য এবং একজন মধুকবি
  • কবির মৃত্যু
  • জেলখানার কবি
  • নীল দর্পণ এবং একজন পাদ্রীর জন্য তর্পণ
  • বঙ্গের প্রথম মহিলা কবি
  • ছন্দের যাদুকর

প্রথম গল্পটি কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে, দ্বিতীয়টি কবি জীবনানন্দ, তৃতীয়টি কমল কুমার মজুমদার, চতুর্থটি কবি মাইকেলের সনেট, পঞ্চমটি বুদ্ধদেব বসু, ষষ্ঠটি মহিলা কবি, সপ্তমটি মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অষ্টমটিতে কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, নবমটিতে কবি নাজিম হিকমত, দশমটিতে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র এবং ষষ্ঠটিতে ছড়াকার সত্যন্দ্রনাথ রায়ের জীবনের বিভিন্ন দিক লেখক সযত্নে দৃষ্টি নন্দনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নিচে লেখকের দুটি লেখা থেকে কিছুটা উতকলিত হলো:

কমলশোভার মল্লিকা বাহারে কমলকুমার মজুমদার সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক বলেছেন, “কমলকুমার মজুমদারের ভক্তকুল তৈরি না হবার জন্য অবশ্য অন্য কাউকে দায়ি করা যায় না। সব দায়-দায়িত্ব আসলে তাঁরই। সবাই যেখানে পাঠক চান, তিনি সেখানে পাঠককে দূরে সরিয়ে রাখার কঠিন পণ করে নেমেছিলেন মাঠে। হাতে গোণা কয়েকজন মাত্র পাঠক পেলেই যে কোনো সাহিত্যিক খুশি হন, সেটা কমলকুমারকে না দেখলে বিশ্বাস করাটা কঠিন। এক দুরূহ কঠিন, অপ্রচলিত এবং ব্যাকরণ না মানা কিন্তু অসম্ভব কাব্যধর্মী গদ্যশৈলীর প্রাচীর তুলে পাঠকের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিদারুণভাবে বিপন্ন করে তুলেছিলেন তিনি। সান্ধ্যভাষার মতো এক দুস্তর গদ্যচর্চায় তিনি অকম্পিত, অবিচল, অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং অবশীভূত। তাঁর সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে গেলে পাঠককে পরিশ্রম করতে হয় তাঁরই মতো করে, ইচ্ছাশক্তিটাকে বলিয়ান করতে হয়ে প্রবল পরাকাষ্ঠায়।

পাঠকের প্রতি এমন দয়ামায়াহীন লেখক বিশ্বসাহিত্যে বিরল। অন্যেরা যেখানে সুধাপাত্র পাঠকের মুখে তুলে দিতে ব্যস্ত, তিনি সেখানে একে লুকিয়ে রেখেছেন গহীন অরণ্যের মাঝে লুকায়িত দুর্গম এক দুর্গের মধ্যে। পাঠককে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে, কঠিন পরিশ্রম করে, প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে, তারপরই পৌঁছাতে হয় সেই অমূল্য সুধাপাত্রের কাছে। এই দুর্গমতার জন্য শুধু যে পাঠক হারিয়েছেন তিনি তা নয়, সমঝদার সমালোচকরাও দূরে থেকেছে তাঁর কাছ থেকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘বাংলা ছোটগল্পের তিন দিকপাল’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে, ‘কমলকুমার মজুমদার জীবিতকালে পাঠক পাননি, সমালোচকদেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি তাঁর দিকে, তাঁর নামে বঙ্কিম পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর এগারো বছর পর, যা এক নির্মম রসিকতার মতন।‘”

অনুরূপভাবে “জেলখানার কবি” লেখাটিতে কবি নাজিম হিকমত সম্পর্কে লেখকের উক্তি, “বাম আদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বাংলাদেশে এমন কোন লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কবিতা পড়েননি বা শোনেননি। বিপ্লবী কবিতা লিখে দেশে দেশে যারা গণমানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন, নাজিম হিকমত তাদের মধ্যে অন্যতম। জেলখানার কবি তিনি। সারাটা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য লড়েছেন, জ্বালাময়ী সব কবিতা লিখেছেন, আন্দোলন করেছেন। মানুষের অধিকার আদায় আর শ্রেণী-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে।

এই জেলখানার কবির  নাম নাজিম হিকমত। তাঁর জন্ম তুরস্কে। কিন্তু তিনি শুধু তুরস্কের কবি নন। তিনি পৃথিবীর কবি, সমস্ত শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কবি। তাঁর কবিতা অনুদিত হয়েছে পৃথিবীর নানান দেশে, নানান ভাষায়। বাংলা ভাষাও ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে নাজিম হিকমতের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। কবিতা ভক্তদের অসম্ভব প্রিয় তিনি। তাঁর ‘জেলখানার চিঠি’কবিতাটিতো মনে হয় অনেক কবিতাপ্রেমীরই মুখস্থ। প্রায় সব আবৃত্তিকারই তাঁর কবিতা আবৃত্তি করার জন্য রীতিমত মুখিয়ে থাকেন।”

একইভাবে “মেঘনাধবদ কাব্য এবং একজন মধুকবি “ লেখায় কবি মাইকেল সম্পর্কে বলেছেন, “বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের যুগ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী সময়কে তিনি মুড়িয়ে দিয়েছেন মুঠো মুঠো মণিমুক্তা দিয়ে। মধুসূদনের আগে বাংলা কবিতা পড়ে ছিল মধ্যযুগে। তখন রাজত্ব চালাচ্ছিল সব প্রতিভাহীন এবং কল্পনারহিত পদ্যকারেরা। তিনিই একক প্রচেষ্টায় বিশাল এক ধাক্কা দিয়ে বাংলা কবিতাকে মধ্যযুগীয় পদ্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে এনে ফেলে দেন আধুনিকতার আঙ্গিনায়। এরকম দ্রোহী পুরুষ,উদ্ধত এবং আত্মম্ভরি মানব, এরকম অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান কবি বাংলা সাহিত্যে আর জন্মায়নি। হয়তো আর জন্মাবেও না কোনদিন। প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথও তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না। এই বিপুল পরাক্রম দেখানোর জন্য অবশ্য বাইরে থেকে তাকে ঋণ করতে হয়েছে প্রচুর। সারা বিশ্বের রত্নভাণ্ডার খুলে খুলে দেখেছেন তিনি, লুট করেছেন লাজ-লজ্জাহীন লুটেরার মত। যা কিছুকেই মনে হয়েছে মূল্যবান সেটাকেই তিনি নিয়ে এসে জমা করেছেন বাংলার ভাঁড়ার ঘরে। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলাকে অবিশ্বাস্য পরিমাণে, আবদ্ধ করেছেন অপরিমেয় ঋণে।

বাকি বিশ্বই শুধু নয়, বাংলার নিজস্ব ভাণ্ডারের দীর্ঘ দিনের অব্যবহৃত রত্নভাণ্ডারকেও আবিষ্কার করেছেন তিনি। চুপিসারে এগুলো পড়ে ছিল অনাদর এবং অবহেলায় ঘরের কোণে। গায়ে মেখে ছিল অযত্নের কাদামাটি। কারো চোখেই সেগুলো পড়েনি কখনো আগে। পরম যত্নে তিনি সেগুলোকে তুলে নিয়েছেন একটি একটি করে। পরিস্রুত করেছেন আপন প্রতিভার দাবানলে পুড়িয়ে পুড়িয়ে।”

লেখকের বলিষ্ঠ লেখনী বাংলা সাহিত্যের এই দিকপালদের সগৌরবে উপস্থাপন করে চোখের সামনে।বাংলা সাহিত্যে মিষ্টি প্রেমের যৌনগন্ধী লেখনীর ভিড়ে ফরিদ আহমেদের এই বইটি স্বকীয়তায় অনন্য বলে বিশ্বাস করি।বইটি প্রকাশ করেছে পাললিক সৌরভ,প্রচ্ছদ করেছেন কাব্য করিম। মূল্য ২০০ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায় পাললিক সৌরভের স্টলে।লেখকের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।

আপনার মন্তব্য