‘একটি মুমূর্ষু বাংলা একাডেমির জন্য মেরুদণ্ড প্রয়োজন’

ফেসবুক প্রতিক্রিয়া

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৬ ০২:৫৭:৩৫

 আপডেট: ২০১৬-০২-১৭ ১৩:০০:৪২

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবী তুহিন মালিক, জামায়াত-শিবিরের ফেসবুক পেজ 'বাঁশেরকেল্লা', ফেসবুকে নয়ন চ্যাটার্জি নামক ইসলামধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী আইডি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের দাবি ও হুমকির মুখে একুশে গ্রন্থমেলার 'ব-দ্বীপ প্রকাশন'-এর স্টল বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।

তাদের দাবি ব-দ্বীপ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘ইসলাম ও বিতর্ক’ নামক বইয়ে ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটাক্ষ করা হয়েছে।

সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) শাহবাগ থানা পুলিশ ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ব-দ্বীপ প্রকাশনের স্টলটি বন্ধ করে দেওয়ার পাশাপাশি ওই প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বইও জব্দ করে। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই তাদের নিজস্ব টাইমলাইন ও কমেন্টে ঘটনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান।

ফেসবুক ব্যবহারীদের অনেকেই এ ঘটনার জন্যে বাংলা একাডেমির বাড়াবাড়িকে দায়ি করে তাদের 'মেরুদণ্ড' আছে কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী আবার বইমেলা কারা নিয়ন্ত্রণ করছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

সাংবাদিক সুপ্রীতি ধর ব-দ্বীপ প্রকাশন বন্ধের পেছনে আরও অনেকেই থাকতে পারে সে ইঙ্গিত দিয়ে লিখেন,

......বইমেলা, ব্লগার-মুক্তমনাদের জীবন কী নির্ভর করছে 'নয়ন চ্যাটার্জি' নামক পেইজের ওপর? তাইতো মনে হচ্ছে। গতবছর থেকেই দেখছি, দেশে কিছু ঘটনা ঘটার আগেই সেখানে সাম্প্রদায়িক, উস্কানিমূলক লেখা ছাপা হয়, তারপর সেই অনুযায়ী প্রকাশনী সংস্থা বন্ধসহ, মানুষ হত্যা পর্যন্ত হচ্ছে। আসলে এটি চালাচ্ছে কে, বা কারা? শুধুই কি ইসলামপন্থী গোষ্ঠী? ফারাবির শিষ্যরা? আমার তো মনে হয় না। যেহেতু এই পেইজের লেখার ওপর ভিত্তি করে এবছর বইমেলায় বদ্বীপ প্রকাশনী সংস্থার স্টল বাতিল করা হলো, তার মানে বুঝতে হবে এর পিছনে আরও বড় বড় হাত আছে, যা প্রশাসনের কাছেরই। এমনকি বদ্বীপ প্রকাশনা সংস্থার কয়েকটি বইয়ের উল্লেখ করে সেই বইয়ের লেখকের ছবিও ছাপিয়েছে এই পেইজে। আমার আশংকা তো আরও বহুদূর ছড়িয়ে গেল এতে করে....

ফেসবুকে সাগর লোহানী একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজক কে এমন প্রশ্ন এবং একই সঙ্গে বাংলা একাডেমির পদধারীদের উদ্দেশ করে লিখেছেন,

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে আজ সোমবার বিকেলে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলটি বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে ওই প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বই জব্দ করা হয়েছে।

--- আমার প্রশ্ন: অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজক কে? পুলিশ নাকি বাংলা একাডেমী? কোন স্টল বন্ধ করবার এখতিয়ার কি পুলিশের আছে?
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলে, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারি, ব-দ্বীপ প্রকাশনীতে এমন বই প্রদর্শিত হচ্ছে যাতে ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। পরে অনুসন্ধানে বিতর্কিত লেখার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামের বইটিতে মহানবী মুহাম্মদ সম্পর্কে আপত্তিকর শব্দ পাওয়া গেছে।

--- আমার প্রশ্ন: একটি থানার ওসি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানতে পারলো (কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি) যে কোন একটি বিশেষ বইয়ে “আপত্তিকর শব্দ” পাওয়া গেছে এবং তার ভিত্তিতে বই খুলে এর সত্যতা আবিস্কার করে সিদ্ধান্ত নিল বই জব্দ ও স্টল বন্ধ করবার!!!! তাহলে কি আগামী বই মেলায় বই প্রকাশের পূর্বে পুলিশের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হবে?
এ প্রসঙ্গে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব জালাল আহমেদ বলেছে, "পুলিশ আমাদের বলেছে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন বই প্রদর্শিত হচ্ছে। স্টলটি নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ কারণে প্রকাশনীটির স্টল বন্ধ করা হয়েছে।"

--- আমার প্রশ্ন: পুলিশের একজন ওসির নির্দেশেই যদি বই মেলার গতি প্রকৃতি নির্ধারণ হয় তাহলে জালাল আহমেদ বা শামসুজ্জামান খান সাহেবদের আর বাংলা একাডেমির চেয়ার আঁকড়ে পড়ে থাকার কি কোন দরকার আছে?

তীর্থের কাক আতঙ্কের ইঙ্গিত করে লিখেছেন,

বাংলাদেশ নামক ব- দ্বীপটি যেখানে বাংলাস্তানের ক্রমাগত দখলদারিত্বের মুখে বিলুপ্তির পথে, সেখানে ব- দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয়া বড়ো কিছু তো নয়!
খুব বেশীদিন হয়তো নেই, যেদিন বাংলাদেশ বলতে গিয়ে আশেপাশে চাপাতির ভয় আছে কিনা দেখতে হবে।
লজ্জা লজ্জা.........!!!

কবি সরদার ফারুক নিজের অস্বস্তির কথা জানিয়ে লিখেন,

মনটা ভার হয়ে আছে । একজন তরুণ মেধাবী ছড়াকারের আত্মহত্যার খবর, বইমেলায় ‘ব-দ্বীপ’ প্রকাশনের স্টল বন্ধ করার খবর-- কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না । গত বছর অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পরে বইমেলা বর্জন করেছিলাম । তাতে কারোর কিছু যায় আসেনি। সবাই তারপরেও হেসে হেসে অটোগ্রাফ দিয়ে গেছে।''

শামস রাশীদ জয় ব-দ্বীপ প্রকাশনে পুলিশের অভিযানের ছবি শেয়ার করে লিখেছেন,

এই বাহিনীর পূর্বসূরিরা এক বিস্ময়কর গৌরবগাঁথা রচনা করেছিলেন - ৪৫ বছর আগে ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে বিপুল অস্ত্রধারী ধর্মান্ধ পাকিস্তানী হায়েনাদের বিরুদ্ধে অনেক অপ্রতুল শক্তি নিয়েও তাঁরা করেছিলেন এক ভীষণ রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধযুদ্ধ। হাজারো সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার উত্তরসূরিরা আজ কয়েক দশক পর পাকিস্তানপন্থী জামাতশিবিরের পলাতক সদস্যদের বাঁশেরকেল্লা গ্রুপের দুর্বল শক্তির বিরুদ্ধেই প্রতিরোধযুদ্ধ করতে অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছেন।

পরাজিত অন্ধকারের কাছে ঐতিহ্য, গৌরব, আদর্শ, ও স্বপ্নের এই ক্রমাগত অপমান আর সহ্য হয় না। অগ্নিযুগের সেই শহীদদের কাছে ক্ষমা চাই।

জহিরুল হক বাপি লিখেন,

রোদেলার স্টল বন্ধ করা হয়েছিল মৌলবাদীদের দাবীর কারণে। কোন বই যাচাই বাছাই পূর্বক যদি সামাজিক, রাজণৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, ক্ষতির কারণ হয় তবে তা নিয়ে ব্যাবস্থা নেওয়া যেতে পারে। রোদেলার ঐ বইটি বাংলা একাডেমীর কেউই পড়ে নি। কিন্তু একটি বই এর কারণে শাস্তি পেল কত জন লেখক? অনেকে হয়ত জমি বিক্রি করে বা মা-বৌ এর গয়না বিক্রি করে বই বের করে ছিল সেই বই মেলায় প্রদর্শিন, বিক্রি হলো না অণ্য একটি মাত্র বইয়ের কারণে। এবারও বাশের কেল্লার দাবীর প্রেক্ষিতে “ব-দ্বীপ” প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধরলাম কোন একটি বই নিয়ে সমস্যা আছে সেই জন্য ঐ প্রকাশনীর সব লেখক শাস্তি পাবে? কেউ কেউ দেউলিয়াও হবে। সভ্য সমাজে এমন বর্বরতা ?!!!!

আমরা জানতাম “একুশ মানে মাথা নত না করা” কিন্তু বর্তমান ডি.জি গত চার বছরে আমাদের শিখাচ্ছেন “একুশ মানে জামাত, জঙ্গী, আই.এস, জেএমবি, জঙ্গীদের নাপছন এমন কিছু না লিখা এবং না ছাপানো”।

আগামীবার বা তার পরের বার জামাতিরা সরাসরি দাবী তুলবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই না ছাপাতে, তাদের বেশি অপছন্দের কোন বই তুলে নিতে বা স্টল বন্ধ করে দিতে। বাংলা একাডেমী তাই করবে। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের এক ধরনের অনাগ্রহ দৃশ্যমান। স্বাভাবিক ভাবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী প্রকাশ হওয়া উচিত ছিল বাংলা একাডেমী থেকে। হয় নি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের উল্লেখ্য যোগ্য কোন কার্যক্রম নাই।

এফডিসি মৃত। বহু চেষ্টা করেও এটিকে আর বাচানো যাচ্ছেনা। বাংলা একাডেমীকে কি কৌশলে সেই দিকেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?

ব্লগার নুর নবী দুলাল প্রতিবাদের আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন,

একুশের বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ ও প্রকাশক-লেখক শামসুজ্জোহা মানিক ভাইকে তড়িগড়ি গ্রেফতারের পর আমরা বুঝতে পারলাম জামাতের ফেসবুক পেইজ 'বাঁশেরকেল্লা' এবং 'নয়ন চ্যাটার্জী' পেইজ সরকারই চালায়। এসব পেইজ থেকে যা নির্দেশনা দেওয়া হয় সেটার বাস্তবায়ন করছে সরকার। আওয়ামীলীগের একুশ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কতটা ভাওতাবাজিতে ভরপুর তা দেখার ইচ্ছে কি এখনো কারো আছে?

অধিকার কেউ কাউকে এসে দিয়ে যায় না, আদায় করে নিতে হয়। বায়ান্ন'র একুশ-এ ভাষার অধিকার বা ৭১ এ অর্জিত স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়েছিল। নামমাত্র ভাষার অধিকার বা স্বাধীনতা পাকিদের থেকে ছিনিয়ে আনতে পারলেও আমরা কখনই বাক-স্বাধীনতা আওয়ামীলীগ থেকে মুক্ত করতে পারিনি। আবার বায়ান্ন বা একাত্তুরের মত জ্বলে উঠতে না পারলে আমরা সব হারাবো। মেরুদন্ডহীন বাংলা একাডেমীতে ধিক্কার জানাই। চেতনার সরকারের সামান্যতম লজ্জ্বা আছে বলে এখন আর মনেই হয় না।

তোমরা জাগো হে প্রজন্ম, প্রতিবাদে ফেঁটে পড়.....
স্বাধীন মত প্রকাশ করার অধিকার হনন করার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াও....
জাগো বাহে..... কুনঠে সবাই......

ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট ইব্রাহিম খলিল সবাক লিখেছেন,

একটি মুমূর্ষু বাংলা একাডেমীর জন্য মেরুদন্ড প্রয়োজন।
কারো কাছে বাড়তি মেরুদন্ড থাকলে দান করতে পারেন।

পাপলু বাঙ্গালী লিখেছেন,

গত বইমেলায় 'রোদেলা' প্রকাশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এবারের বইমেলায় 'ব-দ্বীপ' প্রকাশনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আবারও সেই ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত হানার তথাকথিত অভিযোগে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টলটি বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। একই সাথে তারা ওই প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বই জব্দ করেছে। ধর্মান্ধদের সঙ্গে আবারও নির্লজ্জ আপোষ। অবিলম্বে একুশে বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানাই।

 

আপনার মন্তব্য