লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ চলছে

 প্রকাশিত: ২০১৮-০২-০২ ২১:৩৮:০৬

বিবিসি বাংলা:

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির বইমেলা বাংলাদেশে লেখক প্রকাশক ও পাঠকদের জন্য মাসব্যাপী এক বড় উৎসব। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বই প্রকাশ হয় ফেব্রুয়ারির বই মেলাতে। কিন্তু মেলায় প্রকাশিত বই নিয়ে গত কয়েকবছরে নানা বিতর্ক এবং অঘটনের প্রেক্ষিতে লেখকরা কতটা মুক্ত ও স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন এ প্রশ্নটি সামনে আসছে।

একসময়কার বাম রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও এখন লেখালেখি করেন মহিউদ্দিন আহমদ। তাঁর লেখার বিষয়বস্তু রাজনীতি, রাজনৈতিক দলের ইতিহাস ও গবেষণা।

বাংলাদেশে লেখালেখির পরিবেশ নিয়ে তিনি বলেন, "একধরনের সেলফ সেন্সরশিপের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। এটা আমি অস্বীকার করবো না। আমি অনেক কিছুই লিখতে চাই। কিন্তু আমি মনে করি যে এটা লেখা যাবে না কারণ, লিখলে হয়তো প্রকাশক ছাপবে না অথবা প্রকাশক বিপদে পড়বে।"

"এখানে রাজশক্তি ঢুকে পড়েছে। এই হলো সমস্যা। এখন আমাদের দেশে অনেকেই আছেন যারা সমালোচনা সহ্য করেন না। অসহিষ্ণু মনোভাব। তারা চান তাদের ডিকটেশন অনুযায়ী মানুষ লিখবে।"

বাংলাদেশে ধারাবাহিক ব্লগার হত্যা, হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে এখন দেশান্তরী মাহমুদুল হক মুন্সী। রাজনৈতিক আশ্রয়ে এখন আছেন ইউরোপের একটি দেশে। ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে যে আন্দোলন হয়েছিল সেখানকার নেতৃস্থানীয় একজন তিনি। মৌলবাদ এবং সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বই প্রকাশের ইচ্ছা থাকলেও বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ সে বই আটকে দেবে বলেই তার আশঙ্কা।

তিনি বলেন, "মামলা হামলা ও ধর্মের নামে অত্যাচারের যে সংস্কৃতি চলছে তাতে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে আদৌ কোনো মুক্তমতের পক্ষের বই প্রকাশ করতে পারবো কিনা সে ব্যাপারে সন্দিহান।"

অতীতে বাংলাদেশে বইমেলা চলাকালীন উগ্রবাদী হামলার শিকার হয়েছেন লেখক হুমায়ুন আজাদ। তিন বছর আগে লেখক অভিজিৎ রায় মেলা থেকে বেরিয়ে হামলায় নিহত হন। এছাড়া অভিজিৎ রায়ের বই যে প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে সেখানেও হামলা হয়েছে। এছাড়া জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক খুন হয়েছেন নিজ অফিসের মধ্যেই।

২০১৫ সালে বইমেলায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বই প্রকাশ করার অভিযোগে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করা হয়। ২০১৬ সালে বদ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করা হয় একই অভিযোগ এবং গ্রেপ্তার হন লেখক ও প্রকাশক।

বলাকা প্রকাশনীর মালিক শরিফা বুলবুল বলছিলেন এসব কারণেই লেখকদেরকে একধরনের নির্দেশনা তাদেরকে দিতে হচ্ছে।

"লেখককে আমি বলেছি এইভাবে লেখা যাবে না। এইভাবে লিখলে আপনার বইটা হয়তো বাংলা একাডেমিতে প্রকাশ হবে না। মোল্লাদেরকে খেপিয়ে লাভ নেই। হয়তো ঘুরিয়ে অন্যভাবে লেখেন। আমার প্রকাশ করতে সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি কি জেল, জুলুম হুলিয়া এগুলো সহ্য করতে পারবেন?," বলেন তিনি।

ইদানিং কর্তৃপক্ষ কিভাবে বইমেলায় নজরদারি করে সেটিও বলছিলেন তার অভিজ্ঞতা থেকে।

"আমাদের প্রকাশনীর 'আহ পাকিস্তান' নামে একটা বই গত বছর মোড়ক উন্মোচন হয়েছে। পুলিশ এসে এই বইটা কার, লেখক কে। কী ধরনের বই এরকম নানা প্রশ্নে জর্জরিত করে লেখককে। তারা একটা বই নিয়েও যায়। যদিও বইটি ছিল জঙ্গিবাদ বিরোধী একটা বই।"

এদিকে এবছর স্পর্শকাতর বই প্রকাশে আগে থেকেই সতর্ক থাকার বিষয়টি সামনে আনছে পুলিশ।

মেলার দুদিন আগে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে এসে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, "এমন কোনো বই এখানে আনা যাবে না যেটি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে আঘাত হানে। আমাদের গোয়েন্দারা রয়েছে, বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। এবং বাংলা একাডেমির অধীনে একটা ডেডিকেটেড কমিটি করা হয়েছে এগুলো খবরদারি রাখার জন্য। যখনই এ ধরনের খবর আসবে তখন ওই কমিটি ওইটা যাচাই করে দেখবে এ ধরনে কিছু আছে কিনা। যদি থাকে তার বিরুদ্ধে আমরা দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেব।"

অতীতে বিতর্ক ও হামলার অভিজ্ঞতা থেকেই নজরদারি ব্যবস্থার কথা পুলিশ জানালেও লেখকরা বই প্রকাশে তদারকি বা যাচাই বাছাইয়ের বিরোধী।

লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, "আমি মনে করি পুলিশের কোনো এখতিয়ারই নেই এ ব্যাপারে কথা বলার। সে বইটা তো আগে তাদের পড়তে হবে। মনে করেন একটি বই ছাপা হয়ে গেছে, বাংলা একাডেমি মনে করলো এর মধ্যে সমস্যার কিছু নেই। পুলিশও মনে করে সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে তো আমি মনে করতে পারি সমস্যা আছে।"

এদিকে পুলিশ বাংলা একাডেমির নেতৃত্বে কমিটি করে যাচাই বাছাইয়ের কথা বললেও একাডেমি জানাচ্ছে তাদের এমন কোনো উদ্যোগ নেই।

মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, "আমরা লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমরা লেখকের লেখা বইয়ে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করতে চাই না। এটা তো আমাদের কাজ না। যদি বই নিষিদ্ধ হয় সেটা সরকার কিভাবে করে সেটাও আমাদের জানা নাই। আমি এক কথায় বলবো আমরা লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তবে সেই লেখককে সৎ হতে হবে, চিন্তাশীল হতে হবে এবং তীক্ষ্ণভাবে বিষয়কে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা থাকতে হবে।"

যে কোনো অবস্থাতেই কোনো কর্তৃপক্ষ নয় লেখক প্রকাশকরা সবসময় বই পছন্দ অপছন্দ কিংবা গ্রহণ ও বর্জনের সিদ্ধান্ত পাঠকেরও ওপরই ছেড়ে দেয়ার পক্ষে।

এ প্রসঙ্গে কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, "লেখক হিসেবে আমি যে কোনো শর্তের বিরুদ্ধে। একটামাত্র শর্ত, কোনো শর্ত থাকবে না।"

আপনার মন্তব্য