মিডিয়ায় যৌন হেনস্থার কাহিনী নিয়ে প্রিয়তীর বই ‘ছোবল’

 প্রকাশিত: ২০২০-০২-১৫ ০১:০৫:৫১

মোনাজ হক:

মাকসুদা আখতার প্রিয়তীর হাত ব্যাগে নাকি অনেক প্রসাধনী দ্রব্যের সাথে একটা 'স্ক্রু ড্রাইভার' থাকে সবসময়, যা তাকে বিপদে আপদে সহায়তাও করে, দুষ্টু জনের নাটবল্টু ও নড়বড়ে (মানসিক) স্ক্রু'কে টাইট করতে। ডাবলিনে অনুষ্ঠিত সুন্দরী প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে ৭০০ প্রতিযোগিকে পেছনে ফেলে ২০১৫ সালে 'মিস আয়ারল্যান্ড' নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশি মেয়ে মাকসুদা আখতার প্রিয়তী।

মিস আয়ারল্যান্ড খেতাব অর্জন করে প্রিয়তী ২০১৫ সালে, তারপর বাংলাদেশের নারী নির্যাতনে প্রথম বিরোধিতা করে জনসম্মুখে #মিটু আন্দোলনে মুখ খোলেন ২০১৭ সালে। এর পর লিখেছেন তিনি পত্রপত্রিকায় ও সোশাল মিডিয়াতে।

"ছোট ছোট লেখা লিখে অনেক অনুপ্রেরণা পাই সবার মাঝ থেকে। এই অনুপ্রেরণা আমাকে নিয়ে পৌঁছায় আমার জীবনী ‘প্রিয়তীর আয়না’ লেখা পর্যন্ত, যা আমি আমার দায়িত্ব মনে করেছি, সমাজের মানুষগুলোর প্রয়োজনে। আমাদের সমাজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চোখ-কান বন্ধ রাখে, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সতর্ক বার্তা পৌঁছানো আমার দায়িত্ব ছিল। দায়িত্ব ছিল নারীদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়ার, যেখান থেকে হয়তো কেউ কেউ নতুন উদ্যমে আবার জীবন নতুন করে শুরু করার প্রত্যয়ী হবেন। নিজের ভিতর নিজেই হয়তো সাহস যোগাবেন। অনেকের কণ্ঠস্বর হয়ে কথা বলেছি, প্রিয়তীর আয়নায়" এটা ছিলো ২০১৯ সালের কথা।

এবার প্রিয়তী তার দ্বিতীয় ডকুফিকশন বই 'ছোবল' প্রকাশ করলেন এবছর ২০২০ সালে। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বইটি বইমেলায়, দেশ পাবলিকেশনের বিক্রয় স্টলে (স্টলনাম্বার- ২৫৩-২৫৫) পাওয়া যাচ্ছে।

'ছোবল' বইটি পাঠকদেরকে জানাবে আরেক সংগ্রামের গল্প। যে সংগ্রাম কেবল বিষাদ আর গ্লানিতে ঘেরা একটা অদ্ভুত এক টুকরো দুঃখের মতন। যেখানে অপমান রয়েছে, যেখানে নিষ্ঠুরতা রয়েছে, যেখানে হতাশা আর একটা দীর্ঘশ্বাস রয়েছে, আবার প্রেম ভালোবাসাও রয়েছে।

'ছোবল' সাপের মত লকলকে জিহ্বা বের করা একটা নষ্ট সমাজের অসংখ্য বাধা কাটিয়ে একজন নারীর গল্প, অসংখ্য পুরুষের অসুস্থ ভাবনার সীমান্তগুলো পাড়ি দিয়ে একজন নারী এগুতে চাইছেন, এটি এই বইয়ের অন্য একটি দিক উঠে এসেছে। একজন নারীর জন্য এই মিডিয়া জগত ঠিক কতটা কুৎসিত হয়ে উঠতে পারে এবং একজন নারীর তারকা হয়ে উঠবার পেছনটা এই পুরো মিডিয়া জগতে কতটা পিচ্ছিল আর ভয়াবহ, এই বই মূলত সেটিরই গল্প বলেছে।

শো'জগতে 'কাস্টিং কাউচ' নামের এই শব্দের বিচিত্র একক অর্থের সাথে আমরা হয়ত অনেকেই পরিচিত এবং হয়ত অনেকেই পরিচিত নই। মিডিয়া জগতে কাজ করতে গেলে পরিচালক, প্রযোজক, প্রভাবশালী অভিনেতা কিংবা সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাশালী কোনো ব্যক্তি কী করে সেই কাজ পেতে চাওয়া ব্যক্তিকে (বিশেষ করে নারী) যৌন হেনস্থা করেন কিংবা করবার চেষ্টা করেন, এই বইটির মূল উপজীব্য সেটি-ই।

প্রিয়তী আজকের প্রিয়তী হয়ে উঠবার ধাপগুলোতে এমন অসংখ্যবার যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন। সেটি চলচ্চিত্র তৈরির প্রস্তাবে, অথবা বিজ্ঞাপনের মডেল হতে গিয়ে, এমনকি সেটি মিডিয়া জগতের অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাজ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত যেটি হয়ে এসেছে, সেটি হচ্ছে “তুমি তোমার শরীর দেবে আমাকে আর আমি তোমাকে উপরে উঠবার সিঁড়ি বানিয়ে দেব”।

প্রিয়তী নিজেই সমাজের 'ছোবলের' কাহিনী তুলে ধরে বলেছে, “আমার এই বই পড়ে যদি একটি নারীও এই ঝলমলে জগতের কুৎসিত বিষয়গুলো জানেন এবং সতর্ক হয়ে পথ চলেন তাহলে সেটিই হবে তার পরম পাওয়া”

এই বইটির এক একটি গল্প এক একটি নামে প্রিয়তীর নিজের কথাই লিখেছেন। এই ঘটনাগুলো পাঠক হিসেবে পড়েছি আর বেদনায় সিক্ত হয়ে গিয়েছি। একজন নারী যে শুধু এইসব মিডিয়া মোঘল আর মাফিয়াদের চাপে পড়ে এমন যৌন হয়রানির শিকার হন সব সময় তাও নয়, তাই জেনেছি এই বই’ পড়েই। অনেক নারী শুধু লোভের বসে এবং অনেক উচ্চতায় উঠতে চাইবার তীব্র ইচ্ছে থেকে নিজেই আবার ফাঁদে পড়ে মাফিয়াদের বাহুবন্ধনে ঝুঁকে পড়েন ফলে যে নারীরা নিজেদের সম্মান আর ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে এই মিডিয়াতে চলবার সকল রকমের সংগ্রাম করে ফেরেন, সাধারণ মানুষের চোখে তারাও ক্রমশ হয়ে ওঠেন অপাংক্তেয়। দূর থেকে তখন এই অদ্ভুত সমাজ বলে ওঠে, “আরে ওই মেয়ে মিডিয়াতে কাজ করে? নিশ্চয়ই পরিচালকের সাথে শুয়ে বেড়ায়। ভালো মেয়ে কি আর এই লাইনে আসে?”

মিডিয়া মাফিয়াদের এই যে এমন সুযোগ বা আপত্তিজনক চাওয়া সেটিতে অনেক নারী-ই অবদান রাখেন শুধু তার নিজস্ব লোভের কারণে। দেখা গেছে একজন নারী যার আসলে যৌন সম্পর্কের চুক্তি করে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের, আসার কোনো দরকার-ই নেই কেননা তার অর্থ রয়েছে, মেধা রয়েছে, সম্ভাবনা রয়েছে অথচ দেখা গেলো এদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় এমন অনৈতিক প্রস্তাবটিতে রাজি হয়ে কাজ শুরু করেছে আর ফাঁদে ফেলে গেছে অসংখ্য নারীকে যারা এমন চুক্তিকে পায়ের নীচে ফেলে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন।

"আমি পারিনি, আমি দায়িত্ব নিয়েছি আমার নতুন প্রজন্মকে জানানো গ্ল্যামার জগতের অলিগলি এবং রূপালি চাদরে ঢেকে থাকা তার আরেক রূপ। আমার যদি আগে থেকে জানা থাকত, কেউ আমাকে অবগত করত, উপদেশ দিত বা সঠিক পথ দেখালে হয়তো এত কালো অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হতোনা", লিখেছে প্রিয়তীর তার বইতে।

খোলামেলা লেখার ধরনে অনেকেই বিশেষত নারী পাঠকরা হয়তো আঁতকে উঠবেন প্রিয়তীর 'ছোবল' পড়তে গিয়ে, যখন লেখক লিখছে- "আমার একমাত্র সাদা চামড়ার প্রেমিক আমাকে অনেক আগে সম্পর্কের শুরুতেই বলেছিল বার, নাইট ক্লাব, ক্যাসিনো এ ধরনের ইভেন্টে কিভাবে ড্রাগসের ছড়াছড়ি থাকে। যে সময়টা আমি মোটেই এই কালচারের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। কিভাবে দুষ্ট লোকরা কোন ধরনের পানীয় সঙ্গে ড্রাগ যোগ করে তাও জেনে গেছি"

'ছোবল' কোনো কল্পকাহিনী নয় প্রিয়তীর নিজের জীবনের মডেলিং ও ছবির জগতের বাস্তব ঘটনা আবার বৈমানিকের প্রফেশনে বাস্তববাদী নারী একই সাথে দুই সন্তানের মা কিভাবে জীবনযুদ্ধে একটা নিজস্ব যায়গা করে নিয়েছে তার গল্প। পাঠকদেরকে ছোবল অনেক দংশন করলেও এক নারীর পাশ্চাত্য ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির এক দ্বান্দ্বিক চরিত্রকে তুলে ধরেছে।

ছোবল
মাকসুদা আখতার প্রিয়তী
প্রকাশক: দেশ পাবলিকেশন
বিক্রয় স্টল: ২৫৩, ২৫৪, ২৫৫

আপনার মন্তব্য