বইমেলায় ভিড় বেশি হলে পুলিশের চেকিংয়ে এ কোন সিস্টেম?

বইমেলার ডায়েরি-১৩

 প্রকাশিত: ২০২০-০২-১৫ ১৩:৪৮:২৩

রেজা ঘটক:

শুক্রবার ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলার ত্রয়োদশতম দিন। একে তো ছুটির দিন, তার ওপর পহেলা ফাল্গুন, তারও ওপরে ভ্যালেনটাইনস ডে। অথচ এই দিনটি ছিল স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস। ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার এরশাদের প্রণীত মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে সেদিন শিক্ষাভবন অভিমুখে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়লে প্রাণ হারিয়েছিলেন জয়নাল, মোজাম্মেল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ ছয় জন।

নতুন প্রজন্ম সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের ধার ধারে না। তাদেরকে নতুন ট্যাবলেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রজন্ম তাই নিয়ে মেতে আছে। বাংলা ক্যালেন্ডার এমনভাবে সংস্কার করা হয়েছে যে, সব গুলিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম এখন আর স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কথা স্মরণ করে না। বলা যায় তারা এসব জানারও আগ্রহবোধ করে না।

তাই এক গ্রুপ পালন করেছে পহেলা ফাল্গুন। আরেক গ্রুপ পালন করেছে ভ্যালেনটাইনস ডে। মাঝখান থেকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হাওয়া। যুগে যুগে স্বৈরাচারের ধরন বদল হবার কারণে এভাবে ইতিহাসকে নানান কৌশলে আড়াল করা হয়েছে। এতে শাসকের যতটা সুবিধা হয়, সেভাবেই সবকিছু ঢেলে সাজানো হয়। এ বড় আজব ইতিহাস। এদেশে আন্দোলন করতে গিয়ে প্রাণ দিলে গোটা জাতির কী আসলেই কিছু যায় আসে?

বইমেলায় শুক্রবার তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। কোনো স্টলে বই দেখার মত সুযোগ ছিল না। মানুষ আর মানুষ। মানুষ ছুটি কাটাতে ভুল করে বইমেলার প্রাঙ্গণকে বেছে নিয়েছে। সাবের ভাই (কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবের) বলছিলেন, এত ভিড় দিয়ে আমাদের কী হবে? বইমেলায় প্রবেশের জন্য টিকিট সিস্টেম করা দরকার। যারা বই কিনবে বা বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কেবল তারাই তখন আসবে। অনাকাঙ্ক্ষিত লোকজন তখন আর এমুখো হবে না।

সত্যিই যারা বই পড়ে না, বই কেনে না, তারা বইমেলায় খামাখা যে ভিড় করে, তাদের কাছে এটা একটা সার্কাস। তারা আসলে আমোদ দেখতে আসে। এমনিতে ভিড় দেখলেই বাঙালির সেখানে অকারণে উকি মারার অভ্যাস। সে বাজারে হোক, ফুটপাতে হোক। কোথাও একটু ভিড় দেখলে সেখানে বাঙালি কৌতূহলী উকি দেয়। বইমেলাও এসব ছুটির দিনে সেরকম একটা সার্কাসে পরিণত হয়।

অথচ এদিনে সবাই যদি একটা করে বই কিনত তাহলে পুরো বইমেলায় আর একটি বইও অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো। বইমেলায় লোকজন ভিড় করতে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমি'র উচিত আগামীতে বইমেলায় টিকিট চালু করা। প্রকাশক ও লেখকদের জন্য কার্ড করে দেওয়া। এর বাইরে যারা বইমেলায় ঢুকবে তাদের মিনিমাম টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। বিনেপয়সায় ভিড় জমানো ঠেকাতে হবে।

বইমেলায় বাংলা একাডেমি বাথরুম করে দিয়েছে কিন্তু সেই বাথরুম যে প্রতিদিন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার নিয়ম, সেটা তারা একদম ভুলে গেছে। ফলে বাথরুমগুলো ইতোমধ্যে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেছে। বইমেলায় প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে ছিল প্রচুর ধুলো। স্বাভাবিকভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া ছিল কঠিন যুদ্ধের মত!

আমাদের পুলিশ বাহিনী যে কাজটি করেছে সেটি নতুন করে চিন্তার বিষয়। বইমেলায় যেদিন খুব ভিড় হয়, সেদিন পুলিশ আর চেক করে না। তাহলে অন্যদিনগুলোতে গায়ে হাত দিয়ে চেক করানোর মানে কী? যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে পুলিশ কী জবাব দেবে? এমন কী এসব দিনে যেখানে শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ রাখা উচিত, সেখানে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়নি। ফলে মানুষের চলাফেরায় এত বিড়ম্বনা হয়েছে যে, এসব বিড়ম্বনাকে হজম করার জন্য সবাইকে বাধ্য করা হচ্ছে। এ কোন সিস্টেম রে মাইরি!

আমরা এমন একটা দেশে বসবাস করি, যেখানে আইন যে কখন কোথায় খাঁড়ায়ে যায়, সেটা বুঝতে পারাটাই একটা ঝামেলা। এর মধ্যে আবার একই দিনে মহামান্য প্রেসিডেন্ট সাহেব প্রধান সড়ক ধরে কোথায়ও গিয়েছিলেন, ফলে রাস্তা দীর্ঘসময় ভিআইপি চলাচলের জন্য ছিল বন্ধ। এই যে কালচার করা হয়েছে, এটা দেশের অন্য মানুষকে আর মানুষ মনে করা হয় না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসুস্থ রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স সেই যানজটের মধ্যে খাঁড়ায়ে ছিল। এ কোন সিস্টেম রে মাইরি!

৩০ লাখ শহীদ আর ৫ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে আমরা যে দেশটি পেয়েছি, সেটি যে কীভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, কীভাবে সেই দেশটি পরিচালনা করতে হবে, সেটি আমরা ৫০ বছরেও শিখলাম না। তাহলে এত উন্নয়ন দিয়ে কী হবে? এর মধ্যে আবার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি তো আছেই। ঢাকায় থাকা মানে ধূলা খাওয়া বাধ্যতামূলক একটা অবস্থায় ঠেকেছে। এসব দিনে এই দেশটাকে স্রেফ একটা ছাগলের খামার মনে হয়। যেখানে কোনো সিস্টেম ন্যূনতম ভাবে দাঁড়ায়নি।

এসব দিনে বইমেলায় গেলে অসুস্থ হয়ে বাসায় ফিরতে হয়। তাই কিছু আর লিখতে ভালো লাগে না। যাও বাছা গো রহো।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বইমেলা থেকে ফিরে।

  • রেজা ঘটক: নির্মাতা ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য