অচেনা ছবিতে চেনা গল্প— আয়নাল হক উপাখ্যান

 প্রকাশিত: ২০২০-১০-০৩ ০১:৪২:১৫

সঙ্গীতা ইয়াসমিন:

সকাল নটার পরেই আয়নালের কাজ শুরু হয়ে যায়, আড়তদারেরা ডেলিভারি দেবার পরে দোকানীরা যখন তাঁদের নষ্ট হয়ে যাওয়া সবজি ফেলে দিয়ে নতুন বাজার সাজায় মহব্বত জান বস্তির কাঁচাবাজারে, আয়নাল তখন সেগুলো রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পলিথিনে ভরে ফেলে। প্রতিদিন সকালে আট বছর বয়সের পিতৃহীন এই বালকের এটিই রুটিন কাজ। পিতৃদেব প্রদত্ত নাম আয়নাল হক হলেও, তার প্রিয় নানীজান আর মা লাইলি বেগম তাকে আদর করে আনু নামেই ডাকে। এই বয়সে আনুর সবজি কুড়োনোর কাজ করতে হয় পেটের খিদেয়। এই সবজি সিদ্ধ করেই বস্তির ঝুপড়িতে নানী-নাতির দুপুরের খাবার জোটে।পাঁচ বছর বয়স থেকেই মা আর নানীর সাথে বসবাস তার মিরপুরের এই মহব্বতজান বস্তিতে। মা লাইলী বেগম আর আনুকে ফেলে আনুর বাবা আরেকটা বিয়ে করে সংসার পাতে, লাইলী বেগমকে তালাক দিয়ে সেই যে লাপাত্তা হল, এই জীবনে আয়নালেরও আর কোনো খোঁজ সে করেনি। সেই থেকেই মা আর নানীই আনুর পৃথিবী। লাইলী বেগমকেই এই তিন সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হয়, বস্তির ঘর ভাড়া, আর তাঁদের তিন পেটের খাবার যোগাড় করতে তাঁকে হিমশিম খেতে হয়। লাইলীর একার রোজগারে তিন তিনটি পেট চলা কঠিন বিধায়, লাইলীর মা মাঝে মাঝে মিরপুর মাজারের কাছে গিয়ে ভিক্ষেও করেন। তবে, লাইলী চান না তাঁর বৃদ্ধ মা পেটের দায়ে ভিক্ষা করুক। তাই দিনশেষে কাজের বাড়ি থেকে আনা সারাদিনের জমানো খাবার দিয়ে তিনজনেই রাতের আহার সেরে নেয়।

গল্পের শুরুই হয়েছে আয়নাল ও তার চারপাশের জীবনের কিছু চিত্রকল্পের বর্ণনা দিয়ে। এই গল্প যে আয়নাল, তার জীবন, বেড়ে ওঠা, জীবন দর্শন সবকিছুকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তার আঁচ শুরুতেই পাওয়া যায়। গল্পকার তার চমৎকার উপস্থাপন কৌশলে আয়নালের জীবনীর যে বয়ান করে গেলেন, সেই বয়ানে কেবল আয়নাল ও তার পরিবারের গল্প গাঁথাই উঠে আসেনি। এই গল্প আমাদের সমাজ চালচিত্রের এক নিগুঢ় তত্ত্বের সরল দর্পণ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। এখানে যেমন আয়নালের জীবনের নানা নাটকীয় ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন চরিত্রের সাথে আয়নালের সম্পর্কগুলোকে ঘিরে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, উত্থান-পতন, শ্রেণী সংগ্রাম-দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ক্ষমতা ও কালো টাকার দৌরাত্ম্যের যে চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে তাকে নিঃসন্দেহে সামাজিক গবেষণার এক পূর্ণ দলিল বলে অভিহিত করা যায়। আর এইসব উপাদানকে উপেক্ষা করে আয়নাল হক কেবলই এই গল্পের নায়ক কিংবা প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠেননি। গল্পকার তাঁর বাস্তব পর্যবেক্ষণ এবং সমাজ নিরীক্ষণ দক্ষতার আলোকে এই গল্পের চিত্রকল্প সুনিপুণভাবে সাজিয়েছেন। আয়নালকে ঘিরে যে সকল পার্শ্ব চরিত্র নির্মিত হয়েছে, তার কোনোটিকেই অচেনা কিংবা অতিরঞ্জন মনে হয়নি, বরং অতি গুরুত্বপূর্ণভাবে সব চরিত্রের উপস্থিতিকে সমুজ্জ্বল করায় লেখক তাঁর মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আর এখানেই এই গল্পের সার্থকতা।

বিজ্ঞাপন

লাইলী স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে বস্তিতে যখন আশ্রয় নিয়েছিল বৃদ্ধা মাসহ, তখন শয়তানের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে না নিজের যৌবতী শরীরের সম্ভ্রম বাঁচাবে সেই যন্ত্রণায় দিন কাটাতে হয়েছিল, তেমনি আফজাল চরিত্রটিও বন্ধু হয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল প্রাচীন-প্রবীণ এক বটবৃক্ষ হয়ে। এই দুটি অবস্থাই আমাদের সমাজে পাশাপাশি বিরাজমান।

আনুর শৈশবে যখন হাতে থাকার কথা ছিল রঙ পেন্সিল, স্কুলের ব্যাগ, টিফিনের বক্স, যখন সে প্রজাপতি দিন কাটাবে নিত্য রঙিন পাখনায়, যখন সে ফড়িংয়ের ডানায় উড়িয়ে দেবে কয়েকশ বিকেল, স্বপ্ন দেখে রাত কাটাবে পঙ্ক্ষীরাজের ঘোড়ায় চড়ে, তখনই তাকে চিনতে হয়েছিল জীবনের নির্মম সত্য। জঠরের জ্বালা বড় জ্বালা। বস্তি জীবনে ভালোবাসার মানুষ বলতে মা আর নানী বিনে স্নেহ, সোহাগ দেবার মতো কেউই ছিল না তার আশেপাশে। কখনও সখনও অন্যসব শিশুদের বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুল যাওয়া দেখে তারও মন খারাপ হত বৈকি, তবুও জীবন যেখানে নিত্য ভাঙে অস্তিত্বের লড়াইয়ে, সেখানে টিকে থাকাই বড় যুদ্ধ।

জীবন নামের যে যুদ্ধটা আয়নাল জিতে নিতে চেয়েছিল, নিজের বুদ্ধি, পরিবেশ থেকে লব্ধ জ্ঞান আর সেই জ্ঞানকে কাজে লাগানোর যে অসীম দক্ষতা তাঁর ছিল, তা নির্বিবাদে উল্লেখযোগ্য। সুস্থ,সুন্দর পরিবেশ পেলে আয়নাল যে এক অন্য মানুষ হতে পারতো সে অনুমান করতে আমাদের ভুল হয় না যখন দেখি আয়নাল একই হাতে স্বার্থের প্রয়োজনে মানুষ খুন করলেও উদার হস্তে তার চারপাশের অসহায় মানুষকে দান করছেন, ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছেন, চাকরি দিয়ে, কিংবা চিকিৎসা করেও পাশে থেকেছেন, এমন এক মানবীয় মন তার ভেতরে শেষবধি অবশিষ্ট ছিল।

খুব সাদা চোখে দেখলে আয়নালকে অপরাধী মনে হবে, অসৎ সংসর্গেই যে তার জীবন শুরু করেছিল। চুরি করা, পকেট মারা, তার কাছে আদতেই কোনো অন্যায় মনে হয়নি। ছোটো ছোটো অপরাধ করে যখন সে বড় আনন্দ কিনতে শিখে গেলো নির্ঝঞ্ঝাটে, তখন থেকে ধীরে ধীরে সে হয়ে উঠলো অতি সাহসী। যা তাঁকে তার ক্যারিয়ার গড়তে, সুখী জীবন গড়ার পথের পাথেয় হিসেবে অনুপ্রাণিত করেছিল এ কথা নিশ্চিত করে বলাই যায়। জীবন যাপনের এই স্টাইল ভিন্ন অন্যকিছুও সে ভাবতে পারতো, ভিন্নখাতেও তার ভাবনারা প্রবাহিত হতে পারতো, কিন্তু তার জীবন এবং পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় সেটিই হত অস্বাভাবিক। আট বছর বয়সে যখন চায়ের দোকানে কাজ করতে গিয়ে একটামাত্র পুরি না বলে খাবার অপরাধে বেদম মার খেল, এবং সেই ঘটনার জের হিসেবে তাদের একমাত্র আশ্রয় বস্তির ভাড়া বাড়িটিও রাতের অন্ধকারে ছেড়ে পালাতে হল, তখন সমাজ ও জীবনের এই কদর্য রূপের ভেতরে সে কোন আত্মায় সৎ-অসৎ, মন্দ-ভালোর পার্থক্য নিরূপণ করতে শিখবে? ক্ষুধার হাত বাড়ালেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, বুয়ার পোলা, ফকিন্নির পুত বলেই যাকে তাড়িয়ে দিয়েছে সকলে, তার তো একমাত্র লক্ষ্যই হবে বেঁচে থাকা, ভালোভাবে গায়ে তাকত নিয়ে পেশির জোর নিয়ে এই পৃথিবীটাকে দেখিয়ে দেওয়া যে সে ও পারে।

আয়নালের শৈশবের নির্মমতা, স্নেহহীন, দরিদ্রতা, দারিদ্রের নিষ্ঠুর কষাঘাতই যে আয়নালকে রুক্ষ-কঠিন এক সিংহ পুরুষে তৈরি করেছিল তার সাক্ষাৎ প্রমাণ মেলে অনেক প্রেমময় স্ত্রী শাহানার সাথে তাঁর আচরণে। সাহানাকে ভালোবেসেই সে জীবনসাথী করার পরিকল্পনা করেছিল, শাহানার পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করা, বিয়ের যাবতীয় খরচাপাতি নিজেই করা, শাহানার জন্য দামী অলঙ্কার, সাজপোশাক কেনা, এ সবই তার সাহানার প্রতি প্রেমের নিদর্শন। কিন্তু সেই প্রত্যাশিত, স্বপ্নের রাজকুমারী তার জীবনে যখন এলো, তখন কীভাবে তার সাথে আচরণ করবে, কীভাবে তাঁকে আগলে রাখবে, যত্ন করবে তাও জেনো সে ঠিক ভেবে উঠতে পারলো না, সে কতটুকু উন্মুক্ত হবে, কতটুকু ঢেকে রাখবে এই অন্তর্দ্বন্ধই জেনো সাহানার কাছ থেকে তাঁকে দূরে ঠেলে নিয়ে গেল। আয়নালের রাজনৈতিক জীবনের অন্ধকার কর্মকাণ্ডকে দূরে রেখে কেবলই প্রেমময় স্বামী হয়ে ওঠা আয়নালের পক্ষে আদতেই সম্ভব ছিল না। এদিকে সাহানার একাকীত্ব, ভালোবাসাহীন শোকেসের ভেতরে বন্দী পুতুলের মতো জীবন, দাম্পত্যের উষ্ণতাবিহীন নিঃসঙ্গতার ভেতরে পুরানো সম্পর্কের সূত্র ধরেই তাঁর খালাতো ভাইয়ের সাথে জড়িয়ে পড়া, তাও সমাজ বিধির নিয়মের একেবারের বাইরের গল্প নয়। এমনই হওয়ার কথা এই সম্পর্কের নিয়তি। দাম্পত্য সম্পর্কের এই জটিল ও গরল সমীকরণ তৈরিতেও লেখক সিদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন।

আফজাল মিয়ার সাথে লাইলীর দ্বিতীয় পর্যায়ের সাংসারিক জীবনটা অতি চমৎকার এবং মধুময়ভাবে তুলে ধরেছেন। আফজাল মিয়া লাইলীর যাবতীয় দুঃখ কষ্টকে নিজের দায় বলেই মেনে নিয়েছিলেন। তিনি আয়নালকেও পরম স্নেহ করতেন, এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আয়নালের পাশেই ছিলেন। এমন ভালো মানুষ আমাদের আশেপাশে কম হলেও লেখক এই চরিত্রের মাধ্যমে আশার আলো সঞ্চার করেছেন। এমনও যে হয়, তা আমরা শিখে নিতে পারি এই গল্প পাঠে। অপরদিকে লাইলীর কাজের বাড়ির আপার ভূমিকাও লাইলীর জীবন নাটকের এক বিশাল মোড় ঘুরিয়ে নিতে সাহায্য করেছে। যখন আমরা পত্রিকার পাতায় নিত্য দেখি গৃহ পরিচারিকার ওপরে মালকিনের নির্মম নির্যাতনের ছবি, তখন এই গল্পের কাজের আপার এই ভিন্নরূপে অবতীর্ণ হওয়াও সামাজিক সম্পর্কের দায় মোচনের ইতিবাচক রূপ হয়ে ধরা দেয়।

আয়নালের লেগুনার হেল্পারি থেকে শুরু করে সিরিয়াল ম্যান, পরবর্তীতে শ্রমিক নেতা হবার ধাপে ধাপে যে প্রক্রিয়া এই গল্পে চিত্রিত হয়েছে তা বর্তমান সময়ের আমাদের দেশের অপরাজনীতির অসাংস্কৃতিক চর্চার প্রতিচ্ছবিকেই মনে করিয়ে দেয়। রাজনীতির ময়দানে কীভাবে বড় ভাইয়েরা বড় ভাই বনে যান, তাঁদের ছায়াতলে ধীরে ধীরে আয়নালেরা জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে, এভাবেই ক্ষমতার শাখাপ্রশাখা বিস্তৃতি লাভ করে, যা আমাদের চারপাশ প্রত্যক্ষ করেই আমরা বুঝতে পারি।রাজধানীর বস্তিকেন্দ্রিক যে রাজনীতির কথা আমরা জানি, তার জ্বলন্ত উদাহরণ উঠে এসেছে এই গল্পে। তবে এই অপরাজনীতির যে ভয়াবহ চলমান দুষ্টচক্রের মধ্যে আমরা আছি তার পরিণামও যে অতি ভয়াবহ সেকথাও লেখক গল্পের ছলে বলতে চেয়েছেন আমাদের।

আয়নাল হক উপাখ্যান, লেখক মোঃ রেজাউল করিম রচিত সমাজ বাস্তবতার এক নিষ্ঠুর চিত্রকল্প। যা আয়নালের জীবনকে দিয়েছে বোধহীন, অন্ধকার, অসৎ, পঙ্কিলে বেড়ে ওঠা এক জীবন দর্শন। যে পঙ্কে থেকেই সে মাণিক তুলে আনতে চেয়েছিল, শেষ রক্ষা হয়নি তার, নিজেরই শৃঙ্খলে নিজেই বন্দী হয়েছে অবশেষে। শব্দমালা প্রকাশনীর ব্যানারে প্রকাশিত এই গ্রন্থটি মাত্র ১৩৫ পৃষ্ঠার উপন্যাস, যা একটানেই পড়ে ফেলার মতো এক নির্মেদ রচনা। যা আপনাকে প্রতি ছত্রে ছত্রে ঘটনার নাটকীয়তায় মুগ্ধ করবে, শঙ্কিত করবে, চরিত্রগুলোর সাথে আত্মীয়তায় গেঁথে দেবে। উপন্যাসের প্রচ্ছদটিও যথার্থ অর্থবহ, রঙ ও থিমের সমন্বয়ে। যা এক ঝলকেই আয়নালের জীবনের বৃত্তাবদ্ধ দুষ্টচক্রের শৃঙ্খলকেই নির্দেশ করে। প্রচ্ছদ শিল্পী ওয়ালীউল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ চমৎকার এই প্রচ্ছদের জন্য।

করোনাকালের দীর্ঘ আলসেমি ভরা জীবনে এই উপন্যাসটি ছিল অত্যন্ত সুখপাঠ্য। গ্রন্থ পর্যালোচনায় পেশাদার নই বলে যথার্থ মূল্যায়ন করায় ঘাটতি রয়ে গেল অনেকাংশেই। তবে পাঠক এর যথাযথ মর্যাদা দেবেন বলেই আশা রাখি। গল্পের প্রয়োজনেই লেখক বেশ কিছু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন যা রচনাশৈলীকে অধিক উৎকর্ষতায় উন্নীত করেছে নিঃসন্দেহে। তবে ‘গ- এ গল্প’ ‘ত-য় তরকারী’ জাতীয় বেশ কিছু শব্দ ব্যবহারের সাথে একেবারেই নতুনভাবে পরিচিত হয়েছি যার ব্যাকরণসিদ্ধ জ্ঞান আমার অজানা।

পরিশেষে লেখকের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা এমন সুখপাঠ্য এক রচনার সাথে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবার জন্য। ‘আয়নাল হক উপাখ্যান’ বহুল পাঠকপ্রিয়তা পাক সেই শুভ প্রত্যাশা রইল।

আপনার মন্তব্য