প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৫ ১৫:০১:০৯
সঙ্গীতা ইয়াসমিন:
পড়া শেষ হল "শরণার্থী শিবির থেকে সম্মুখযুদ্ধে" মোজাম্মেল হক নিয়োগীর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি কিশোর উপন্যাস। এটি তাঁর লেখা অষ্টম কিশোর-উপন্যাস। তাঁর বর্তমান প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা নব্বই ছাড়িয়েছে। তিনি শিশু-কিশোর সাহিত্য, ছড়া, কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস ছাড়াও উন্নয়ন গবেষণামূলক সাতটি একাডেমিক গ্রন্থও রচনা করেছেন।
তাঁর লেখনী প্রেম-ভালোবাসা-বিরহ, সমাজের নিবিড় অন্বেষণ, মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট-টানাপোড়ন, বাস্তব-পরাবাস্তবসহ জীবন অভিজ্ঞতার তিক্ত নির্যাস; সেখানে আছে সমকামিতা, রাজনীতি, স্বৈরশাসন এসবের বৈত্রিম্যময় এক বিপুল সমাহার।
ব্যক্তিগত জীবনে অন্তর্মুখী এবং প্রচারবিমুখ এই সাদাসিধে লেখক তাঁর কলমের সাথেই কথা বলেছেন জীবনের দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ। তিনি লেখেন নীরবে-নিভৃতে আমাদের জন্য, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। মনের তাগিদে, ভেতরের তাড়নায় তিনি লেখেন, কেবল জনপ্রিয়তা পাবার আশায় নয়।
খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের যে গৌরব, যে অর্জন, তা দীর্ঘদিন ধরে অনেক বেশি আড়ালের বিষয় ছিল। ইদানীং অনেকেই লিখছেন এই বিষয়ে, হচ্ছে অনেক গবেষণাও; তথাপিও, আমাদের এই সোনালি অর্জনে শিশু-কিশোরদের কী ভূমিকা ছিল, কিংবা আদৌ ছিল কিনা সে বিষয়ে খুব বেশি তথ্য ও গবেষণা চোখে পড়ে না। তাছাড়া আমাদের এই গৌরবকে ম্লান করে দিতে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করতে এখনও দিবানিশি চলছে নানারকম ষড়যন্ত্র। এখনও শহীদের সংখ্যা নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন, প্রশ্ন আসে বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা আর নির্যাতনের মাত্রা নিয়েও। আর এহেন এক সঙ্কটময় সময়ের মধ্য দিয়ে যারা বেড়ে উঠছে সেই কিশোর-কিশোরীরা বিভ্রান্তিতে পড়ছে খুব স্বাভাবিকভাবেই; সেই বিভ্রান্তি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে সাহায্য তো আমাদেরই করতে হবে। যারা অগ্রগামী, যারা জানেন সেই অতীতের রক্তঝরা দিনের কথা তারাই নেবেন সেই দায়িত্ব; সেক্ষেত্রে মোজাম্মেল হক নিয়োগী একধাপ এগিয়ে।
ইতিপূর্বেও তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস।“শরণার্থী শিবির থেকে সম্মুখযুদ্ধে” এই উপন্যাসে একটি সত্যাশ্রয়ী গল্প লেখকের সাবলীল উপস্থাপন দক্ষতায় আরও বেশি বাস্তব ও মূর্ত হয়ে উঠেছে। কাহিনী নির্মাণ, বিন্যাস ও চরিত্র চিত্রণে লেখকের মুনশিয়ানার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়, যা কোনক্রমেই বিমূর্তের আবরণে আসল সত্যকে আড়াল করতে পারেনি।
এই গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় বাংলাদেশী একটি শরণার্থী শিবিরের প্রতিদিনের জীবনের কিছু খণ্ডিত চিত্র বর্ণিত হয়েছে। সে ছবি কেবল ছবি নয়, জীবনেরও কথা কয়। জীবনের মায়া দেশত্যাগের থেকেও যে বড় নয়, মানুষের বোধের ভেতরে মা-মাটি-দেশ আর দেশের মুক্তির যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা তা কেবল সময় আর পরিস্থিতিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, এর ব্যাপ্তি অনেক দূর বিস্তৃত সে কথাই বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে। এই গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনায় কিশোর-সাহিত্যে একটি মাইল ফলক; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বীজ সম্প্রসারণে, যুদ্ধের ছবি হৃদয়ে গেঁথে দিতে এই প্রজন্মের কাছে এ গ্রন্থ অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
দেশ মাতৃকাকে বাঁচানোর জন্যে একজন ১২ বছরের দরিদ্র পরিবারের কিশোর সেদিন কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছিল, কীভাবে ভূমিকা রেখেছিল, তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় আর অব্যক্ত বেদনার বানীসমূহ বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে। কিশোর চরিত্র ‘বাবু’ শৈশবেই মাকে হারায়, ছেলে বেলা কেটেছে নানীর কাছে, নানীর মৃত্যুর পরে বড় বোনের আশ্রয়ে ঢাকাতে চলে আসে। আর তখনই শুরু হয় যুদ্ধের ডামাডোল। যে বোনকে সে মা বলেই জেনেছে সেই বোনকেও একদিন হারাতে হয় অত্যন্ত নিদারুণ যন্ত্রণা আর ঘৃণার মধ্য দিয়ে। তার স্নেহের শেষ ছায়াতল সরে যায় মাথার ওপর থেকে; তার চোখের সামনেই পাকি-কুত্তারা বোনকে ছিঁড়ে কামড়ে খেয়েছিল, সেদিন সে ছিল কেবল অসহায় নীরব এক দর্শক! তবে তার হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল এই ঘটনা। তাই সে শোকে বিহ্বল হয়ে নয়, আরো বেশি শক্তি নিয়ে নিজেকে তৈরি করেছিল মুক্তিযোদ্ধা হবে বলে। কারণ, তার বিশ্বাস ছিল হোসেনপুর আর্মি ক্যাম্পে শত নির্যাতন সয়েও তার বোন তার জন্য অপেক্ষায় থাকবে, তাই সে স্বপ্ন দেখত আর্মি ক্যাম্প থেকে বোনকে উদ্ধার করার। সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে, অনেকগুলি সফল অপারেশনের পরে অবশেষে সে হোসেনপুর ক্যাম্পে যায়, কিন্তু ততদিনে বাংলার সবুজ জমিন হয়ে গেছে তার বোনের সবুজ শাড়ির আঁচল! তার ধর্ষিতা বোনের রক্তাক্ত শরীর হয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য!
বইটি পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন সাক্ষাৎ সেই সময়ের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। অনেকবারই নিজের অজান্তে চোখের কোণে জল গড়িয়েছে। হোসেনপুর ক্যাম্পের প্রতিদিনের জীবন, জীবন-মৃত্যুর খেলা, মুক্তির লড়াই, স্বদেশের মাটির প্রেম, আর গেরিলা অপারেশনের ঘটনাবলি এক নিমেষেই আমায় নিয়ে গেছে ৪৫ বছর পেছনের সময়ে। শরণার্থী জীবনে পরগাছার মত বেঁচে থাকার লড়াইয়েও মরে না তাদের স্বপ্ন; তাদের প্রতিদিনের প্রার্থনায় থাকে দেশ আর দেশের মুক্তি! তারা ভুলে যায় জাত-পাত-ধর্ম! সকলেরই একটি চাওয়া, একটি স্বপ্ন, দেশ একদিন স্বাধীন হবে! তারা আবার ফিরবে স্বপ্নের স্বাধীন দেশে। সবার আর ফেরা হয়ে ওঠে না হয়তো। শত স্বপ্নের সলিল সমাধি হয়ে যায় এই যুদ্ধের ময়দানেই।
তবু তো এই যুদ্ধই তৈরি করে নারায়ণদের মত বীরদের! ‘নারায়ণ’ যাকে সবাই জোকার আর আড্ডাবাজ বলেই চেনে, সেও দেশ মাতৃকার প্রেমে উজ্জীবিত হয় পরিস্থিতি আর সময়ের চাপে। একদিন সেও তার বৃদ্ধ মায়ের একমাত্র সবেধননীলমণি হয়েও তাকে কাঁদিয়ে চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। এক মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয় অন্য মাকে বাঁচাবে বলে; তার মাও তাকে ছেড়ে দেন মাথায় আশীর্বাদের স্পর্শ দিয়ে- নারায়ণের মা তাকে বলেন, “যা, মায়ের সম্ভ্রম বাঁচিয়ে শত্রুমুক্ত করে তবেই ঘরে ফিরে আয়, আর তা যদি না পারিস তবে মরে যাবি। মনে রাখিস, সে মরণ লজ্জার নয়, গৌরবের।"
রজতের আঁকা অতি চমৎকার প্রচ্ছদের ১২০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে শব্দশৈলী, পাওয়া যাচ্ছে বইমেলা ২০১৬ এ।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি উপন্যাসের এই গল্প আজকের কিশোরদের দ্বিধাবিভক্তির হাত থেকে বাঁচাবে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, এখন আরেকটা যুদ্ধ দরকার, বিভক্তি দূর করার; সব বৈরিতা দূর করে দেশকে এগিয়ে নিতে দরকার দেশপ্রেম আর চরিত্রের দৃঢ়তা, যা আজকের সময়ের দাবি।
মোজাম্মেল হক নিয়োগীর লেখায় সেই বার্তাই আছে, আছে সেই আশার বাণী। আগামী প্রজন্মের কাছে এই বার্তা পৌঁছানো আমাদের সকলের দায়। লেখক সকলের হয়ে সেই দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন সানন্দে। মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতে হবে হৃদয়ে, দেশের কাছে যে ঋণ আমাদের তার থেকে একটু একটু করে দায় মুক্তি করতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার। শুভকামনা আর অভিনন্দন রইল লেখকের জন্য। বইটির ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করি।
আপনার মন্তব্য