সিলেটের আদিকথা

২৬ ডিসেম্বর ২০১৪, শুক্রবার কলকাতার যোধপুর পার্ক হাইস্কুল মাঠে দক্ষিণ কলকাতা সিলেট অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকার জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ আয়োজনে ইন্দো-বাংলা সিলেট উৎসবে এই লেখাটি উপস্থাপন করেন উৎসবের প্রধান অতিথি হিসেবে।

 প্রকাশিত: ২০১৪-১২-৩০ ০৯:২৬:২৯

 আপডেট: ২০১৪-১২-৩০ ০৯:২৯:১৮

আবুল মাল আবদুল মুহিত:

মোগল সুবা বাংলায় বৃটিশ শাসনের সূচনা হয় ১৭৫৭ সালে যখন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হয়। ফার্সীই কিন্তু বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালের প্রথম আশি বছর ছিল এদেশের রাজভাষা। ১৮৩৭ সালে ইংরাজী হলো বৃটিশ-ভারতের রাষ্ট্রভাষা এবং ১৮৪৪ সালে নির্দেশ হলো যে, সরকারি কর্মকর্তাকে অবশ্যিই ইংরাজী জানতে হবে। সেই সময় মুসলমান এলিট গোষ্ঠি ফার্সী এবং ঊর্দুর প্রবক্তা হয়ে গেলেন। হিন্দু সম্প্রদায় কিন্তু সহজেই এই পরিবর্তন মেনে নিলেন এবং এতে সূচনা হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের পশ্চাৎপদতা এবং সম্ভবতঃ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ যার পূর্ণ সুযোগ নেয় বৃটিশ সামাজ্যবাদ। প্রথম পরিবর্তনের হাওয়া প্রবর্তন করলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৬১ সালের প্রথম মুসলমান স্নাতক হুগলীর খান বাহাদুর দেলোয়ার হোসেন আহমদ। বাংলার ভূখণ্ডে ক্রমে ক্রমে এই প্রগতিবাদী গোষ্ঠি ভারি হতে থাকলো। কুষ্টিয়ার মীর মোশাররফ হোসেন, ঢাকার কবি কায়কোবাদ, যশোরের মুন্সী মেহেরুল্লাহ, সিলেটের ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ আহমদ, চব্বিশ পরগনার শেখ আবদুর রহিম, বরিশালের মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন, রাজশাহীর মির্জা মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, টাঙ্গাইলের নওশের আলী খান ইউসুফজাই, সিরাজগঞ্জের ইসলাম হোসেন সিরাজী, ধানবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী, সিলেটের শিক্ষাবিদ স্কুল পরিদর্শক আবদুল করিম, ফেনীর খান বাহাদুর আবদুল আজিজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা, খুলনার খান বাহাদুর এমদাদুল হক, লাকসামের নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরী, রংপুরের বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ মুসলিম সমাজে পুনর্জাগরণের সূচনা করেন।



বাংলা ভাষা ভারত উপমহাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা এবং এই ভাষায় সাহিত্যকর্মের জন্য ১৯১৩ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মতান্তরে সপ্তম বা দশম শতাব্দীতে বাংলাভাষার উদ্ভব হয় এবং পাল রাজত্বকালে (৭৫০-১১৫৫ খৃষ্টাব্দ) বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধি লাভ করে। ১২০৩ সালে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা পেলে পরবর্তী প্রায় চারশ’ বছর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকশিত হয়। শাহ সগীর, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম, শেখ ফয়জুল্লাহ, মইনুদ্দিন, দৌলত উজির, সোনা গাজী, মোজাম্মেল হক একদিকে যেমন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন তেমনি মালাধর বসু, চণ্ডীদাস, শ্রীকর নন্দী, পরমেশ্বর, বিজয় গুপ্ত, বিদ্যাপতি, গুণধর খান, বৃন্দাবন দাস প্রমুখ সকলেই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সাহিত্য সেবা করেন। বাংলাভাষা কিন্তু কোনদিনই রাষ্ট্রভাষা ছিল না; সেখানে পালি, সংস্কৃত বা ফার্সী ছিল অধিষ্ঠিত। সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে পর্তুগীজ মিশনারিদের উদ্যোগে প্রথম ছাপার হরফে বাংলা গ্রন্থ প্রকাশিত হতে থাকে। অবশ্যি, প্রথম বাংলা ছাপাখানা স্থাপন করেন জেমস অগাস্ট হিকি ১৭৭৮ সালে শ্রীরামপুরে। লেখক নাথানিয়েল হালহেড ঐ সময়েই সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন যে, বাংলা প্রেসিডেন্সীর রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত। ১৯২১ সালে যখন খেলাফত আন্দোলন তুঙ্গে ছিল তখন অনেক মুসলমান নেতা প্রস্তাব করেন যে, ঊর্দুই হবে ভারতের জাতীয় ভাষা। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী এর বিকল্প হিসাবে দাবি করেন যে, ভারতের এক বৃহত্তর জনগোষ্ঠির ভাষা বাংলারই রাষ্ট্রভাষার সেই সম্মান পাওয়া দরকার।


বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতে সাংবিধানিক উপায়ে স্বশাসনের দাবি উত্থাপিত হয়। কংগ্রেস ১৯০৬ সালে এই দাবি গ্রহণ করে। মুসলিম লীগ ১৯১৩ সালে একই দাবি উত্থাপন করে। বৃটিশ সরকার প্রথম মহাযুদ্ধে ভারতের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে ও ভারতের ধন ও জনসম্পদ এই যুদ্ধে খুব কাজে লাগে। ভারতবাসীর আশা ছিল যে, স্বায়ত্তশাসনের দাবি বৃটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে মেনে নেবে। কিন্তু ১৯১৯ সালের মন্টেগু চেমসফোর্ড সংশোধিত ভারত কাউন্সিল আইন সেই আশার গুড়ে বালি দিল। এক হিসাবে তারই প্রতিফল ছিল অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন। এই আন্দোলনেই মহাত্মা গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধ হয়ে যায় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূলমন্ত্র এবং প্রধান কৌশল। মহাত্মা গান্ধী, শওকত আলী ও মওলানা মোহাম্মদ আলী ভ্রাতৃদ্বয় এই সময়ে ১৯২১ সালে ২৯ আগস্ট সিলেটে আগমন করেন। সিলেটে খেলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে খেলাফত নেতা জনাব আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে শাহী ঈদগাহে ঐ এক বিরাট জনসভায় মহাত্মা গান্ধী এবং অন্যান্য অতিথিরা বক্তব্য রাখেন। এই বছরেই ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন (মন্টেগু চেমসফোর্স) সংস্কার আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন অবশ্যি মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস বয়কট করে এবং সীমিত ভোটাধিকার থাকা সত্ত্বেও মাত্র এক-ষষ্ঠমাংশ ভোট প্রদান করা হয়। আসামে সে সময় জনসংখ্যা ছিল ৭০ লাখ এবং ভোটার সংখ্যা ছিল ২০২,৪৪০ এবং ভোট প্রদান হয় মাত্র ৩৩,৩৫২। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন ১৯২২ সালের শুরু পর্যন্ত চলতে থাকে। ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে চৌরিচৌরাতে পুলিশ এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে ২২ জন পুলিশ নিহত হয় এবং থানা পুড়িয়ে দেয়া হয়। মহাত্মা গান্ধী এই সহিংসতা কোনমতেই মেনে নিতে পারলেন না এবং তাৎক্ষণিকভাবে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন অবসানের ঘোষণা দিল।


খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্য অনেকটা কমে যায় এবং অনেক সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান যেমন শুদ্ধি ও সংগঠন এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯২১ সালে যদিও সব প্রদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সরকার নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় কিন্তু তাতে জনসমর্থন তেমন পাওয়া গেল না। ১৯২৩ সালে আবার নির্বাচন হলো। তাতেও রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব পরিবর্তন হলো না। সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য দেশবন্ধু হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ১৯২৩ সালের এপ্রিল মাসে বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পন্ন করেন। কিন্তু ১৯২৫ সালে ১৬ জুন দেশবন্ধুর অকাল মৃত্যুতে এই চুক্তিটি কার্যকরী রইল না। ১৯২৭ সালের ৮ নভেম্বর বৃটিশ সরকার সাংবিধানিক সংকট সমাধানের জন্য সাইমন কমিশন নামে একটি উচ্চ পর্যায়ের ভারত শাসন কমিশন নিযুক্ত করে। এই কমিশনে কোন ভারতীয় সদস্য ছিলেন না এবং এই কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কমিশনের কাছে কংগ্রেস নেতা মতিলাল নেহেরু সে সময় তখন দলের পক্ষে ভবিষ্যতের সংবিধান সম্বন্ধে প্রস্তাব রাখেন। সেখানে মুসলমান স্বার্থ যথার্থভাবে সংরক্ষিত না হওয়ায় ১৯২৯ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আগা খানের নেতৃত্বে তার বিখ্যাত ১৪ দফা পেশ করেন। একইসঙ্গে শুরু হয় বিশ্বব্যাপী মহামন্দা যার কুফল ভারতেও অনুভূত হয়। ১৯৩০ সালে ভারতীয় কংগ্রেস ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা করে কিছুদিনের মধ্যেই ১২ মার্চে মহাত্মা গান্ধী লবণ মার্চ এবং অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন। অন্যদিকে চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লব ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং কঠোরভাবে অবদমিত হয়। অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য ১২ নভেম্বর বৃটিশ সরকার লণ্ডনে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। এই বৈঠক কংগ্রেস বয়কট করে। গোলটেবিলের দ্বিতীয় বৈঠক হয় ১৯৩১ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং তাতে কংগ্রেস অংশগ্রহণ করে। শেষ গোলটেবিল বৈঠক হয় ১৭ নভেম্বরে এবং এতেও কংগ্রেস যোগ দেয় নি। ১৯৩২ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড কম্যুনেল এ্যাওয়ার্ড ঘোষণা করলেন কিন্তু গোলটেবিল বৈঠকের শেষ অধিবেশনে কংগ্রেস যোগ না দিয়ে আবার অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এই অসহযোগ আন্দোলন কিন্তু তেমন শক্তিশালী ছিল না। ১৯৩৫ সালে “ভারত সরকার আইন” বৃটিশ পার্লামেন্টে পাস হলো এবং তার অধীনে ১৯৩৭ সালে সারাদেশব্যাপী ১১টা প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।


এই নির্বাচনের ফলে ভারতের সাতটি প্রদেশে প্রথমবারের মত সুনির্দিষ্ট ও সীমিত দায়িত্বের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্যি, লাট এবং বড়লাট সাহেবের জন্য স্ববিবেচনার সুযোগ অব্যাহত থাকে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টের আন্তরিক এবং কঠোর চাপে বৃটিশ সরকারকে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য করে। তাছাড়া দেশে অব্যাহতভাবে স্বাধীনতার দাবি তখন তো বেশ বেগবান ছিল। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে বৃটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠিত হলো দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্র- ভারত এবং পাকিস্তান।


পাকিস্তান ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। ১ হাজার মাইলের ব্যবধানে একদিকে ছিল পশ্চিম পাকিস্তান, আয়তনে বড় কিন্তু জনসংখ্যায় সংখ্যালঘিষ্ঠ। আর অন্যদিকে ছিল পূর্ব পাকিস্তান, আয়তনে ছোট কিন্তু জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার একটি অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা বাংলা। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ছিল অনেক এবং সেখানে সেমিটিক ফার্সী, ঊর্দুর প্রভাব ছিল প্রধান। পাকিস্তানের নীতি-নির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে ঊর্দু, যদিও বাংলা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারাটি বাংলাদেশ রুখে দাঁড়ায়। ভাষা আন্দোলনের শুরু হয় ১৯৪৭ সালেই এবং প্রথমে ১৯৪৮ এবং পরে ১৯৫২ সালে এইটি ব্যাপক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য ঢাকায় ছাত্ররা জীবন দান করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশে বাংলা ভাষা আন্দোলন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে শুধু অজনপ্রিয় নয় গণশত্রুতে পরিণত করে। সিলেট এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এখানকার সুধীমহলে ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় এবং তাতে বিশিষ্ট গুণীজন ড. সৈয়দ মুজতবা আলী মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন।


ভাষা আন্দোলন এক হিসাবে ১৭ বছর পরে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনের সনদ ছিল ১৯৬৬ সালের ছয় দফা। পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন কোনমতেই গ্রহণ না করে বন্দুক দিয়ে তা নির্মূল করতে মনস্থ করে। এরই ফলে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। প্রাথমিকভাবে ঢাকায় বাঙালির প্রতিরোধ আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করা হয়। কিন্তু মফঃস্বলে এই কাজটি তত সহজ ছিল না।


ঢাকার হত্যাযজ্ঞ যখন সারাদেশে প্রচার লাভ করলো তখন দেশের সর্বত্র পাকিস্তান প্রতিরোধ আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয় ১লা এপ্রিল। অন্যান্য জেলাতেও একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ২৬ মার্চের পরে। সুসজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অস্ত্রের জোরে প্রতিটি জেলায় অন্তত জেলা শহরে পাকিস্তানি দখল প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ২ মাসের মধ্যেই মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হয় এবং দেশের সর্বত্র নানাভাবে তারা পাকিস্তানী দখলদারদের যুদ্ধে লিপ্ত করে। সাধারণভাবে বলা হয় যে, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে প্রায় এক লাখ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। এছাড়া অগণিত বাঙালি দেশের সর্বত্র গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধা এবং গেরিলাদের ভয়ে আগস্ট মাস থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সূর্যাস্তের পর টহল দেয়া অথবা কোন অপারেশন করা থেকে বিরত থাকে। অবশেষে নভেম্বরে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়। এরই প্রতিফলন হিসেবে পাকিস্তান বনাম ভারত-বাংলাদেশের অঘোষিত যুদ্ধ ৩রা ডিসেম্বরে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ হয় স্বাধীন এবং মুক্ত। সিলেটে এই স্বাধীনতা আসে ১৭ ডিসেম্বরে। সেদিন বাংলাদেশের পতাকা সিলেটে জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী উত্তোলন করেন এবং কুচকাওয়াজে নেতৃত্ব দেন জেড ব্রিগেডের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান।


ভারত বিভাগের সময় ১৯৪৭ সালে সিলেট জেলার আয়তন কিছুটা কমে যায়। কারণ রেডক্লিফ সীমানা কমিশনের রোয়েদাদ অনুযায়ী সিলেটের আড়াইটি থানা ভারতের আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্তমানের সিলেট জেলা সেই ১৯৪৭ সালের নতুন চৌহদ্দির জেলাটি। পূর্ব পাকিস্তানে সিলেট জেলা অন্যান্য জেলা থেকে কিছুটা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এটা শুধু কথ্য ভাষা ব্যবহারের বিষয় ছিল না। এটার সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল সিলেটের ভূমি ব্যবস্থাপনা, যেখানে বড় বড় কতিপয় জমিদারের পরিবর্তে ছিল কয়েক হাজার ছোট ছোট মিরাসদার। সেই স্বাতন্ত্র্য এখনও অনেকটা বজায় আছে বলে আমার মনে হয়। এই সিলেট পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেও সবসময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যেমন- ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশে শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। সিলেটে তার সূচনা অনেক আগেই হয়। সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত ভাষা বিষয়ক ভাষণ ৪৭ সালের নভেম্বর মাসেই বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। সিলেটে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারেও স্থানীয় স্বার্থ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা অনেক আগেই সূচিত হয়। তারা স্বেচ্ছায় তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সারাদেশে ব্যবহারে সম্মতি দেন কিন্তু সেখানে নিজেদের জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা রাখার দাবি আদায় করেন। তবে সিলেট শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়ে। আসামে প্রাথমিক শিক্ষার যে ব্যবস্থাটি ছিল সেটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। কিন্তু তাতে গুণগত পরিবর্তন প্রায় ৪৫ বছরে কিছুই হয় নি। এজন্য আজও সিলেটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সবটিতে ৫ জন করে শিক্ষক নিযুক্তি দেয়া সম্ভব হয় নি। এছাড়াও সিলেটে প্রাকৃতিক সম্পদের স্থানীয়ভাবে ব্যবহারও তেমন প্রসার লাভ করে নি। অধুনা যানবাহনের উন্নয়ন এবং বিশেষভাবে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার বিভিন্ন পদক্ষেপ সিলেটে নেয়ার ফলে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হোটেল ও আপ্যায়ন ব্যবসা এবং পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় কার্যক্রম সিলেটে এখন বেশ জোরেসোরে চলছে। সিরামিক শিল্পেও সিলেটে আগ্রহ বেড়েছে। সিলেটে সামান্য প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার ফলে সেখানে অধুনা বিদ্যুৎ সরবরাহও যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। তাই বলা যেতে পারে যে, সিলেট জোর কদমে এগিয়ে চলছে এবং বিনিয়োগ ও ভ্রমণের জন্য একটি সম্ভাবনাময় অবস্থায় আছে।

১০

এই সিলেট এখানে সমবেত আমাদের সকলের পূর্বপুরুষদের দেশ এবং আমাদের অনেকের বর্তমান বাসভূমি। শ্রীভূমি সিলেটের আকর্ষণ শুধু যেমন আগে ছিল তেমন নয় এখন বরং আরো বেড়েছে। সর্বোপরি সিলেটবাসীরা এখনো তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে, তাদের সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শে অটুট থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। নতুনের মধ্যে সিলেটে একটি সুদৃশ্য শহীদ মিনার স্থাপিত হয়েছে। সুরমা নদী অতিক্রমের জন্য অনেক পুল হয়েছে। নদীবক্ষে ভ্রমণ বিনোদন ও আহারের জন্য নৌবিহারের ব্যবস্থা হয়েছে। সুদৃশ্য একটি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে জাতীয় খেলাধূলা অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়াও আর একটি স্টেডিয়াম ও ক্রীড়া কমপ্লেক্স স্থাপিত হয়েছে। রাস্তাঘাট অবশ্যি অনেক বেশি ঘিঞ্জি এবং বেশুমার ঘরবাড়ী, দালান কোঠা, এবং বিশেষ করে শপিং কেন্দ্র মহানগরটিকে ছেয়ে ফেলেছে। ছোট বড় পুকুর দীঘি অনেক কমে গেছে।
চলুন সিলেটে বেড়িয়ে আসা যাক।

আপনার মন্তব্য