ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা-২

রেজা ঘটক

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৭-০৫ ২৩:৩৯:২৮

 আপডেট: ২০১৫-০৭-০৬ ১৫:২৭:৪০

প্রচ্ছদ: মোবাশ্বির আলম মজুমদার

বসনা উপন্যাস মূলত ইতিহাস প্রধান। বসনিয়া যুদ্ধ ও জীবন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। লেখার পরতে পরতে ফুটে:

জোয়ার্নিক, ২১ এপ্রিল ১৯৯২

গত কয়েকদিন জোয়ার্নিকে সার্ব জঙ্গি বিমানগুলো একযোগে বিক্ষিপ্তভাবে বোমা হামলা করেছে। দ্রিনা নদীর দক্ষিণ পারে বসনিয়াক গ্রামগুলোকে নিশানা করে সেই হামলা হয়েছে। অনেকে মারা গেছে। নিহতের সংখ্যা অজানা।

অনেকে বাড়িঘর,সহায়-সম্পদ সবকিছু ফেলে,কেবল জীবন নিয়ে পালিয়েছে। গোটা জোয়ার্নিক এখন সার্ব সেনাবাহিনী দখল করার পায়তারা করছে। এখান থেকে সড়ক পথে জীবন নিয়ে পালানোর কোনো সুযোগ নেই। পাহাড়ি জঙ্গল পথে যারা পালাতে পেরেছে,তারাই এখনো বেঁচে আছে।

পাহাড়ি জঙ্গল পথে পালানো বসনিয়াক রিফিউজিদের সঙ্গে আমরাও যোগ দিয়েছি। আমার সাথে আমার স্ত্রী হাইরিয়া,আমার মেজো মেয়ে রাফিয়া,রাফিয়ার ছেলে ডেভিড,আর হাইরিয়ার মেজো ভাই রুস্তুমের ছেলে রাহমান। আমরা পাঁচজন একসাথে আছি।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে আমার ছোট মেয়ে মার্সিয়া,ছোট জামাই হাকিয়া,মার্সিয়ার একমাত্র ছেলে আহমেদ আর রাফিয়ার মেয়ে মায়া জোয়ার্নিক থেকে ব্রাটুনাচ গিয়েছিল। ওরা কেউ বেঁচে আছে কিনা আমরা এখনো জানি না।

ব্রাটুনাচের অবস্থা জোয়ার্নিকের চেয়েও খারাপ। আমরা জোয়ার্নিক থেকে পাহাড়ি জঙ্গল পথে রওনা দেওয়ার আগে ব্রাটুনাচ ল্যান্ডফোনে অনেক চেষ্টা করেছি। টেলিফোন এখনো সচল। রিং হয়। কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোন রিসিভ করে না।

হাইরিয়া’র মেজো ভাই রুস্তুমের ছেলে রাহমান ৬ এপ্রিল যুদ্ধ শুরুর পর ব্রাটুনাচ থেকে পালিয়ে পরসু জোয়ার্নিকে আমাদের কাছে এসেছে। রাহমান যা দেখে এসেছে,এক কথায় তা ভয়াবহ।

সার্ববাহিনী গোটা ব্রাটুনাচ শহর প্রায় গুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক লোক মারা গেছে। যারা বেঁচে আছে তারা পাহাড়ি জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। জুটিচা বা অটাবে’র পাহাড়ি জঙ্গলে যদি মার্সিয়ারা পালাতে পারে, তাহলে হয়তো এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু ওদের খবর এখনো কেউ বলতে পারে না।

মুরব্বিরা বলতেন,গাছের কাছে মনের কথা বলতে পারলে নাকি মনের আশা পূর্ণ হয়। জোয়ার্নিকের একটা বিখ্যাত জনশ্রুতি হল,কেউ যদি ওক গাছের কাছে তার মনের কথা বলে,আর তখন যদি ওক গাছ তার মাথায় দশটি পাতা ছুড়ে মারে,তাহলে তার আশা পূর্ণ হয়।

জোয়ার্নিকের বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে আমিও ওক গাছের কাছে একটি মনের কথা বলেছিলাম। যদি আমরা সবাই বেঁচে থাকি,আমাদের যেনো এই জীবনে আবার দেখা হয়। আমার মার্সিয়ার সাথে। আমার মায়ার সাথে। আমার ছোট্ট আহমেদের সাথে।

আমার বড় মেয়ে সামিয়ার সাথে। সামিয়ার ছেলে তারিকের সাথে। সামিয়ার মেয়ে সৈয়াদার সাথে। আমার বড় জামাই সৈয়াদে’র সাথে। আমার মেজো জামাই হাকিয়া’র সাথে। হাইরিয়া’র ভাই রুস্তুমের সাথে। সবার সাথেই যেনো আবার দেখা হয়।

ওক গাছ আমার কথা শুনলো কিনা জানি না। আমার মাথায় অবশ্য কিছু পাতা ঝরে পড়েছিল। কয়টি পাতা ছিল? আমি গুনতে সাহস পাইনি। পাতা গোনার মত সেই সময়ও হাতে ছিল না। পালানোর ভারী তাড়া ছিল। আমরা পাঁচজন জীবন নিয়ে জোয়ার্নিক থেকে পালিয়েছি।

অথচ এমন যুদ্ধ তো আমরা কেউ চাই নি। ১৯৯১ সালের ১৫ অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক রিপাবলিক অব বসনিয়া-হারজেগোভিনা সারায়েভো’র পার্লামেন্টে স্বাধীন বসনিয়া-হারজেগোভিনা’র মেমোরেন্ডাম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হলো। তখন বসনিয়ান সার্ব সাংসদগণ পার্লামেন্ট বয়কট করলেন। বসনিয়ান সার্ব পার্লামেন্ট সদস্যদের অনুপস্থিতিতে ওই মেমোরেন্ডাম পার্লামেন্টে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হল।

তারপর স্বাধীন বসনিয়া-হারজেগোভিনা’র ওই মেমোরেন্ডাম কার্যকর করার জন্য পার্লামেন্টের পরবর্তী অধিবেশন ডাকা হল ১৯৯২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বসনিয়ার পার্লামেন্ট সেদিন স্বাধীন বসনিয়া-হারজেগোভিনা’র পক্ষে জনমত যাচাই করার জন্য ২৯ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিল।

২৯ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চের সেই গণভোটে প্রায় ৬৩.৭% ভোট পড়ল। যার মধ্যে ৯২.৭% ভোটার স্বাধীন বসনিয়ার পক্ষে রায় দিল। যদিও ওই গণভোট প্রায় ৩৪% বসনিয়ান সার্ব বয়কট করেছিল।

গণভোটের রায় অনুযায়ী,১৯৯২ সালের ৫ মার্চ বসনিয়ার পার্লামেন্ট বসনিয়া-হারজেগোভিনা’র স্বাধীনতা ঘোষণা করল। কিন্তু বসনিয়ার সার্ব ওই স্বাধীনতা মেনে নিতে অস্বীকার করল। পাশাপাশি তারা সার্বিয়ার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বসনিয়ার আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি বন্ধ করতে সচেষ্ট হল। তারা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে বিক্ষোভ জানাল। জবাবে ১৯৯২ সালের ৫ এপ্রিল রাজধানী সারায়েভোতে প্রায় ১ লাখ মানুষ বসনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে শান্তি মিছিল বের করল।

সার্বিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের নিয়ন্ত্রণাধীন সারায়েভো’র হোটেল হলিডে ইন থেকে ওই শান্তিপূর্ণ মিছিলে স্নাইপার রাইফেল দিয়ে একজন সার্ব গুলি চালালো। সারায়েভো’র সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলের তখন অন্তঃত ৬ জন মারা গেল।

মিছিলের একেবারে সামনের দিকে ছিল বসনিয়াক মুসলিম মেডিকেল স্টুডেন্ট সুয়াদা দিলবারোভিক ও ক্রোয়াট মুসলিম নারী ওলগা সুসিক। সুদিয়া ও ওলগা ঘটনাস্থলেই মারা গেল। পরে সারায়েভো’র বিভিন্ন হাসপাতালে আরো ৪ জন মারা গেল। সুদিয়া দিলবারোভিক আর ওলগা সুসিক হল বসনিয়া যুদ্ধে প্রথম নিহত দুই বসনিয়াক।

কিন্তু সার্বিয়ান ডেমোক্র্যাট দল পাল্টা দাবী করল,গণভোটের দ্বিতীয় দিনে অর্থ্যাৎ ১ মার্চ সারায়েভো’র একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে নিকোলা গারদোভিক নামে একজন সার্বকে প্রথম খুন করা হয়েছিল। যেখান থেকে বসনিয়া যুদ্ধের সূত্রপাত। সেটি ছিল আসলে সার্বদের একটি গুজব। আসলে ৫ এপ্রিলের হত্যাকাণ্ড দিয়েই বসনিয়া যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক শুরু।

৫ এপ্রিলের পর থেকেই ঘটনা কেমন দ্রুত বদলে গেল। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সার্ব মিলিটারি এভাবে হামলা শুরু করলো। এমনিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৬টি সমাজতান্ত্রিক রিপাবলিক নিয়ে গঠিত হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশান।

সেই ৬টি সমাজতান্ত্রিক রিপাবলিক হল- সোশালিস্ট রিপাবলিক অব বসনিয়া-হারজেগোভিনা, সোশালিস্ট রিপাবলিক অব ক্রোয়েশিয়া,সোশালিস্ট রিপাবলিক অব মেসিডোনিয়া,সোশালিস্ট রিপাবলিক অব মন্টিনেগ্রো,সোশালিস্ট রিপাবলিক অব সার্বিয়া এবং সোশালিস্ট রিপাবলিক অব স্লোভেনিয়া। এছাড়া সার্বিয়ার অধীনে দুইটি সায়ত্তশাসিত সমাজতান্ত্রিক প্রদেশ ছিল। সমাজতান্ত্রিক কসোভো ও সমাজতান্ত্রিক যুভোডিনা।

আজ যদি মার্শাল টিটো বেঁচে থাকতেন,তিনি কি এসব সহ্য করতে পারতেন? বসনিয়ার ৯২.৭ ভাগ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে। অথচ সার্ব বসনিয়ার স্বাধীনতা মানতে চায় না। এটা স্রেফ মিলোসেভিচের একটা চাল। আর রাশিয়া মিলোসেভিসকে গোপনে তাল দিচ্ছে।

আমরা বসনিয়াক-সার্ব-ক্রোয়াট এতোদিন পাশাপাশি বসবাস করলাম। মুসলিম-খ্রিষ্টান পাশাপাশি বসবাস করলাম। কখনো তো এমন যুদ্ধের বিষয় আমাদের মাথায় আসেনি। কাদের স্বার্থে কার ইসারায় মিলোসেভিচ এই যুদ্ধ লাগিয়ে দিল?

বসতবাড়ি ছেড়ে জীবন হাতে নিয়ে এই যে পাহাড়ি জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি,এভাবে আমরা কতদিন বাঁচতে পারব? আমরা পাঁচ জন না হয় এখনো বেঁচে আছি! কিন্তু আমার ছোটমেয়ে মার্সিয়া? রাফিয়ার মেয়ে আমার আদরের মায়া? মার্সিয়ার ছোট্ট ছেলে আহমেদ? ছোট জামাই হাকিয়া? ওরা কেউ কী বেঁচে আছে? আমরা এখনো কিচ্ছু জানি না। ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করারও কোনো সুযোগ নাই।

রাহমান বললো,বসনিয়াক যুবকদের যেখানেই সামনে পাচ্ছে,সেখানেই ওরা কুকুরের মত গুলি করে মারছে। ওদের হাতের মেশিনগান কেবল বসনিয়ান পুরুষদের হত্যা করছে। যুবতী মেয়েদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

আমার মার্সিয়া আর মায়াকে কী ওরা ধরে নিয়ে গেছে? হাকিয়া আর ছোট্ট আহমেদকে কী ওরা গুলি করে মেরে ফেলেছে? হায় খোদা,যদি ওরা বেঁচে থাকে,একবার আমাদের সঙ্গে মিলন করে দিও। এই বুড়ো সোলেমানকে একবার ওদের সঙ্গে দেখা করাও। নইলে এত দুঃখ নিয়ে আমি মরেও শান্তি পাব না।

দ্রিনা নদীর পাশে জোয়ার্নিকে আমার বসতবাড়ি এখন কী অবস্থায় আছে? সেখানে এখন কারা থাকে? নাকি সার্ব মিলিটারি আমার বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছে? নাকি বোমা মেরে আমার এত কষ্টের বাড়ি গুড়িয়ে দিয়েছে?

এই পাহাড়ি জঙ্গলে এভাবে আমরা কতদিন বাঁচতে পারব? এভাবে না খেয়ে না ঘুমিয়ে আমরা কী বাঁচতে পারব? আমার ডেভিডকে ওরা পেলে তো সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলবে। রাহমানকে পেলে ওরা মেশিনগানের গুলিতে ঝাঝরা করে দেবে। ওরা কী এই বুড়ো সোলেমানকেও বসনিয়াক পুরুষ হবার অপরাধে গুলি করে উড়িয়ে দেবে?

ওরা কী আমার রাফিয়াকে ধরে নিয়ে যাবে? হাইরিয়োকে পাগল বানিয়ে না খাইয়ে মারবে? এই পাহাড়ি জঙ্গলে আমরা কতদিন নিরাপদ? এখানে আজ রাতে সার্ব জঙ্গি বিমান বোমা মারলে কী আমরা বাঁচতে পারব? আমরা কিভাবে বাঁচব? একমাত্র আকাশের ওই চাঁদ আর তারা সাক্ষি। আমাদের কারো কোনো অপরাধ নাই। এই যুদ্ধ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিয়েছে মিলোসেভিস।

ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা প্রথম পর্ব

আপনার মন্তব্য