মাসকাওয়াথ আহসান’র গল্প “দেজাভু : নাজমা’স বেবি”

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৭-৩০ ১৪:৫৬:৩৫

 আপডেট: ২০১৫-০৭-৩০ ১৫:০৬:০৬

প্রবীর বাবুর বাড়ীর দখল আমার চাই। বিনা ভাড়ায় একটা রুম দিয়ে দেবো যুবলীগের অফিসের জন্য, একটা জাতীয়তাবাদ:

একতলা একটা গাছপালা ঘেরা বাড়ী। লাল রঙের মেঝে; গোল গোল পিলার। পুরনো দিনের ধুপের গন্ধ মাখা শান্ত পাখি ডাকা এক বসত বাটি। উঠোনের একপাশে একটা তুলসীতলা; সান্ধ্য প্রদীপ রাখার বেদিটি ঠিক সেইরকম আছে; যেরকমটা ছিলো এখানে যখন ইংরেজীর শিক্ষক প্রবীর রায় বসবাস করতেন।

এ তল্লাটে এমন শিক্ষকের জুড়ি মেলা ভার। পথে ঘাটে দাঁড়িয়ে সক্রেটিসের মতো ইংরেজী গ্রামার শেখাতেন রায় বাবু। উনার স্ত্রীর ইচ্ছে করতো একদিন লোকটার গায়ে এক বালতি জল ঢেলে দিতে। স্কুলটাই যার সংসার; ছাত্ররাই যার সন্তান তার বিয়ে-সংসার এসবের কী দরকার ছিলো! কিন্তু লোকটা বাড়ী ফিরে চা খেতে খেতে যখন সাহিত্যের গল্প তুলতো; সেই গল্পের নায়িকা হয়ে উঠতো রায় বাবুর স্ত্রী সাবিত্রী। তুলসী তলায় ভগবানের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করতো সাবিত্রী, ভগবান এই লোকটাকে আমার কিছু আয়ু দিয়ে দিও যেন অনেকদিন ছাত্র পড়াতে পারে।

হঠাতই দেশের পরিস্থিতিটা খারাপ হতে থাকে। প্রবীর রায় রেডিও-তে বিবিসির খবর শোনেন। চারপাশে গোল হয়ে বসে তার ছাত্ররা। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার পরেও শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সেনা সমাবেশ করছে। মুক্তির যুদ্ধটাকে চাপিয়ে দিচ্ছে জোর করে।

রায় স্যার তার ছাত্রদের বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটাকে বুঝতে চেষ্টা করো। সমঝোতা চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় উনি সম্ভাব্য সেনা হামলা সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। ছাত্রেরা আশীর্বাদ নিয়ে যুদ্ধে চলে যায়।

হঠাত পাড়ার মোড়ে ছাত্র সংঘের দিদার টিটকারী দেয়, মালাউন সবই বিদেয় করে বাপের দেশে পাঠায়ে দেবো ভাবতেছি।
স্তম্ভিত হয়ে যান প্রবীর রায়। এই ছোট্ট শহরটিতে এই প্রথম কেউ তার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে।
উনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, এটা আমার বাপ-দাদার দেশ; এখান থেকে আমি কোথাও যাবোনা।

এরপর আত্মীয় স্বজন পরামর্শ দেয় রাতে বাড়ীতে না থাকতে। সাবিত্রীর ছোট ভাই রাতে বাড়ীতে থাকবে। এরকম একটা বন্দোবস্ত হয়। রায় বাবুর মন সায় দেয়না। নিজের বাড়ী ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। ঘোষণা দিয়ে দেন। গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রেরা আসে। সাবিত্রী তাদের জন্য রাতের খাবার তৈরী রাখে।

মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে সাবিত্রী বৌদিকে অন্নদাত্রী দেবী মনে হয়। কৃতজ্ঞতার অশ্রু লুকিয়ে তারা ফিরে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে।

একদিন ছাত্রসংঘের পান্ডা দিদার পাকিস্তানী সেনাদের প্রবীর রায়ের বাড়ীর পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। রায় বাবু তখন বাড়ীতে ছিলেন না। সাবিত্রী রান্নাঘরে চুলার পাশে বসে রান্না করছিলো। সমূহ বিপদ দেখে সে ভগবানের কাছে ক্ষমা চেয়ে আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে মারে। আগুনের লেলিহান শিখার মাঝ দিয়ে একটি স্নিগ্ধ দেবী যেন হেঁটে বেরিয়ে চলে যায় অন্তহীন দূরযাত্রায়।

হতাশ হয়ে দিদার সেনাদের নিয়ে ফিরে যায়। প্রবীর রায়কে হত্যা এবং সাবিত্রী ছিলো লোভের জায়গা। দিদার এই লোভ দেখিয়েছিলো। পাঞ্জাবের সেনারা চরম হতাশায় দিদারকেই জাপটে ধরে লোভের প্রশমন করে।
প্রবীর রায় বাড়ী ফিরে সারা বাড়ী খুঁজে তারপর রান্নাঘরে গিয়ে পুড়ে যাওয়া জুঁইফুল দেখে অজ্ঞান হয়ে যান।

তারপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন না রায় বাবু। আত্মীয় স্বজন অনেকে ভারতে গিয়ে থেকে গেছে। যারা আছে তারাও ঠিক আর সেই ভরসা পাচ্ছে না। রায় বাবুর ভাগ্নী বিনীতা মামার বাড়ীতে থাকে। তাকে ধীরে ধীরে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে যায়। প্রথম দুদিন ক্লাসে চুপ করে বসে থাকেন। তৃতীয় দিন আবার একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করেন। স্কুলের সংসারে সন্তান ছাত্রদের নিয়ে আবার রায় বাবু ফিরে যান তার স্বপ্নের ঘোরে। অনেক গুলো পাখীকে উড়তে শেখানোর শিহরণ এ কাজে।

দেশ নানান চড়াই উতরাইয়ের মাঝ দিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উনাকে নিয়ে কথা বলাই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবু রায় বাবু ছাত্রদের বলেন সেই সুপারম্যানের গল্প; যিনি এই মানচিত্র পতাকা দিয়ে গেছেন। ছাত্রদের মাঝে জনপ্রিয়তার কারণে জামাতের রোকন দিদার রায় বাবুকে বাগে আনতে পারে না। রায় বাবু সবকালেই বঙ্গবন্ধু নামের সুপারম্যানের গল্প শুনিয়ে যান। ছুটলে তাকে থামাবে কে!

হঠাত একদিন দিদার একগাল হাসি দিয়ে বলে, স্যার ক্ষমা ঘেন্না করে দেবেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে আপনাকে বিশেষ অতিথি করতে চাই।
প্রবীর রায় বলেন, আমি রিটায়ারমেন্টের পর বের টের হই কম। আপনি অন্য কাউকে বিশেষ অতিথি করেন।

এই প্রত্যাখ্যানটা নিতে পারে না দিদার। রাতেই প্রবীর রায়ের বাড়ীতে হামলা হয়। বিনীতার মেয়েটি গুলিবিদ্ধ হয়। প্রবীর রায়কে চাপাতি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। বিনীতা গুলিবিদ্ধ মেয়েটিকে কোলে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়।

প্রবীর রায়ের আত্মীয় স্বজন সন্তান হারানো বিনীতা আর স্বামীকে ভারতে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। নামমাত্র মূল্যে বাড়ীটা একটি মুসলমান পরিবারের কাছে বিক্রী করে দেয়া হয়। নাজমা নামের একটা মেয়ে বিনীতাকে বলে, দিদি আপনাদের বাড়ী আপনাদেরই থাকবে। যত্নের ত্রুটি হবে না। মাঝে মধ্যে বেড়াতে আসবেন।

তাইতো নাজমা তুলসী গাছটাতে নিয়মিত পানি দেয়। সন্ধ্যাবাতি দেবার বেদীটারও যত্ন নেয়। নামাজের সময় নাজমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে খবরের কাগজে দেখা প্রবীর রায়ের রক্তাক্ত মৃতদেহ। দুই হাত তুলে প্রার্থনা করে মানুষটির আত্মার শান্তির জন্য।

এরমধ্যে দিদার স্থানীয় রাজনৈতিক মাস্তানগুলোকে বলে, প্রবীর বাবুর বাড়ীর দখল আমার চাই। বিনা ভাড়ায় একটা রুম দিয়ে দেবো যুবলীগের অফিসের জন্য, একটা জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলকে আর একটা নামাজ কক্ষ। ঐখানে আমাদের ছেলেরা ইসলামের হেফাজত করবে। দাঁড়িয়ে যায় সর্বদলীয় ঐক্যজোট। হামলা হয় ঐ বাড়ীটিতে; যে বাড়ীর দিকে দিদার গত ৪৫ বছর ধরে লোলুপ চোখে তাকিয়ে আছে।

হামলায় গুলিবদ্ধ হয় নাজমা আর তার গর্ভের সন্তান। পৃথিবীতে আসার আগেই ঘাতকের গুলি শিশুটিকে জানিয়ে দেয় তুমি হিংস্র এক জনপদে এসে পড়েছো। ডাক্তাররা অনেক কষ্টে শিশুটিকে বাঁচিয়ে তোলেন। নাম দেয়, নাজমা’স বেবি।

আপনার মন্তব্য