ছোটবেলার ঈদ

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৯-২৫ ০০:২৬:২৪

 আপডেট: ২০১৫-১০-০২ ১৯:৫৭:২০

আহমেদ নূর:

বছরে দুটো ঈদ। আর ঈদ মানেই অনাবিল আনন্দ, উচ্ছ্বাস। উৎসবের আমেজে মোড়ানো একটি দিন। আমার স্মৃতির প্রখরতা বড়ই দুর্বল। তবুও উজ্জ্বল সেই দিনগুলো খুব মনে পড়ে। শৈশব- কৈশোরের ঈদ মানেই যেন, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’। সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি দিন।

কেমন ছিল আমাদের ছোটোবেলার ঈদ? দশ কিংবা বারো বছর পর্যন্ত বয়সকে ছোটোবেলা ধরে নিয়েই লিখছি। পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ এই দুয়ে মিলে কেটেছে আমার ছোটবেলা। এ সময়কার ঈদের স্মৃতি কিছুটা উজ্জ্বল, কিছুটা ধোয়াচ্ছন্ন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ঈদটা কেমন হয়েছিল তা এখন আর মনে করতে পারি না। তবে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় আত্মীয় স্বজনের সাথে পালিয়ে বেড়ানোর স্মৃতি বেশ মনে পড়ে। মনে আছে ঝুম বৃষ্টিতে পুরো রাত ভিজে একাকার হয়ে কাটিয়ে দেওয়ার ঘটনা; অগুণতি গুলির শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার স্মৃতি। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে পিচ্ছিল পথ পাড়ি দেওয়া আর আকাশ থেকে গোলাবর্ষণের দৃশ্য আজও চোখে ভেসে উঠে। পাকিস্তান আমলের শেষ ঈদটার স্মৃতি তাই শুধুই বারুদের গন্ধ মাখা আর পাকিস্তানিদের নৃশংস বর্বরতায় ভরা।

আমার জন্ম গ্রামে। এই সিলেটেই, নগরের পশ্চিম পাঠানটুলায়। গত শতাব্দীর ষাট এবং সত্তর দশকে এটা গ্রামই ছিল। বিজলি বাতির ব্যবস্থা তখনও ছিল না। চারদিকে গাছগাছালি আর জঙ্গল। মাঝেমধ্যে একেকটি বাড়ি। মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত। কাঁচা রাস্তা। বর্ষায় কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল। হাঁটতে হতো সাবধানে। নইলে চিৎপটাং হয়ে ধবধবে কাপড় কাদা-জলে একাকার। এমন গ্রামীণ পরিবেশেই আমার বেড়ে উঠা। ছোটোবেলা রমজানের ঈদের আনন্দটাই বেশি উপভোগ করতাম। সাদা-কালো যুগের ঈদ হলেও আমাদের ছোটোবেলার ঈদ ছিল উৎসবের রঙে রঙিন। এখনকার মত আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব ছিল না ঈদ।

ওই সময়ের ঈদ ছিল বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের ঈদ। ঈদ আনন্দে কোন ধর্মীয় গন্ডি ছিল না। হিন্দু মুসলমান সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ করতাম। যেমনটি হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের পুজোর সময়ও ঘটতো। উভয় ধর্মের বৃহৎ উৎসবগুলো ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির। রোজা শুরু হলেই আমাদের ঈদের দিনের প্রতীক্ষা শুরু হতো। ঈদে কি কি কিনতে হবে কিংবা কি কি দরকার তা আগেভাগেই জানিয়ে দিতাম বাবাকে। কোনো ঈদে তৈরি পোষাক আবার কোনো ঈদে কাপড় কিনে সেলাই করা। এখনকার মতো অত্যাধুনিক সেলাই প্রতিষ্ঠানও ছিল না তখন। সেলাই মানেই দর্জির দোকানে যাওয়া। দর্জিকে খলিফা নামেই ডাকা হতো। আর পুরোনো কাপড়গুলোকে ধুঁয়ে ইস্ত্রি করে রাখতাম। আশেপাশে কোন লন্ড্রি ছিল না। কাপড় ধোয়ার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল ‘রূপজ’। সেটা শহরে। এখনকার মত ড্রাই ক্লিনিং কিংবা আধুনিক ব্যবস্থা তখন অনুপস্থিত। ঘরে ঘরে ইস্ত্রি যন্ত্রও ছিলনা। দর্জির দোকানে সাধারণত ইস্ত্রি থাকতো। তবে বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি নয়। ইস্ত্রিতে কয়লা ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে গরম করতে হতো। আবার ইস্ত্রির ব্যবস্থা না হলে কাপড় ভাঁজ করে বিছানা কিংবা বালিশের নিচে রেখে ইস্ত্রির কাজ চালিয়ে নেওয়া হতো। মজার বিষয় হচ্ছে ঈদে কি পোষাক কিনেছি তা আমরা কাউকে দেখতে দিতাম না। তখন মনে হতো কাউকে দেখালেই পোষাক আর নতুন থাকবে না। ঈদের দিনই সবাই দেখবেন। এজন্য ঈদের কাপড় লুকিয়ে রাখতাম।

ঈদের দু-তিনদিন আগ থেকেই ঈদের পুরো প্রস্তুতি শুরু হতো। ঈদের দিন ভাল খাবার দাবারের আয়োজন ছিল দেখার মত। গরুর মাংস বাজার থেকে কিনে না এনে আগেরদিন এলাকার লোকজন মিলে বড় গরু জবাই করতেন। তারপর মাংস ভাগাভাগি করে নিতেন। ঈদের আরেকটি অনুষঙ্গ ছিল হাতে মেহেদী লাগানো। মেহেদী পাতা সংগ্রহ করে তা বেটে হাতে লাগাতাম। এখনকার মত টিউবে মেহেদী পাওয়া যেতনা। আর ঈদের আগেরদিন ইফতারের পরই ছুটে যেতাম পাশের মাঠে। চারদিকে খোলা মাঠ। পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। শুধু এক চিলতে বাঁকা চাঁদ দেখার আশায়। চাঁদের দেখা পেলেই দে ছুট। আজকের দিনের মত টেলিভিশনে ‘রমজানের ওই রোজা শেষে এল খুশির ঈদ’ গান শুনতে পেতাম না। সাদাকালো টেলিভিশনও ছিল না কারো ঘরে। সম্ভবত সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে একটি সাদাকালো টেলিভিশন আসে পাশের বিডিআর ক্যাম্পে। সে কি যে বিস্ময়! ছোট বাক্সে মানুষের চলাফেরা গান বাজনা। তবে চাঁদ দেখা গেলে ইফতারের পরপরই সাইরেন বেজে উঠতো। তাতেই সবাই বুঝে নিত আর রোজা রাখতে হবে না।

ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠা ছিল প্রথম কাজ। তারপর ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া আর শেষে কোলাকুলি করা। নামাজ থেকে ফিরে মা-বাবা এবং বড়দের সালাম করা একটা রেওয়াজ ছিল। এর একটা অন্য কারণও ছিল। সালাম করলেই টাকা পাওয়া যেত। যাকে আমরা সালামী বলতাম। যত বেশি সালাম ততবেশি টাকা। সাথে সেমাই, পিঠা এগুলো তো আছেই। ঈদকে সামনে রেখে আগেররাতে প্রত্যেক ঘরেই নানা ধরণের পিঠে তৈরি হত। হরেক রকম স্বাদ ও নকশার দেশি পিঠা। সময়ের ব্যবধানে পিঠা তৈরি হারিয়ে গেছে। এখন সবই বাজারে পাওয়া যায়। এসব এখন কেবলই স্মৃতি।

ঈদের সারাদিন পুরো এলাকা ঘুরে বেড়ানোই ছিল একমাত্র বিনোদন। বিনোদনের আলাদা কোন সুযোগ ছিলনা। আরও অনেক পরে টেলিভিশনে ঈদের ছায়াছবি দেখতে যেতাম বিডিআর ক্যাম্পে। কৈশোর পেরুনোর পর হয়তবা লুকিয়ে ঈদের দিন সিনেমা হলে যেতাম বন্ধুদের সাথে। ওই পর্যন্তই। কিন্তু এখন প্রতিটি ঘরই যেন ‘হোম থিয়েটার’। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে টিভি অন করলেই পুরো বিশ্বের বিনোদন হাতের মুঠোয়। সপ্তাহ কিংবা তারও বেশি দিনব্যাপী ঈদের আয়োজন এখন চ্যানেলগুলোতে। তারপরও বলব আমাদের ছোটবেলার ঈদই ছিল শ্রেষ্ঠ। আনন্দে শ্রেষ্ঠ, উপভোগেও শ্রেষ্ঠ।

আহমেদ নূর : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য