নিবেন্দুবাবুর পেনশন

 প্রকাশিত: ২০২০-০৬-০৪ ২১:৩৮:০৯

শ্যামল কান্তি ধর:

লালপুর বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের হিন্দুধর্মশিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ের শিক্ষক নিবেন্দু শর্মার স্কুলের শেষ দিনটি অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতই শেষ হল। ছুটি শেষে বাইসাইকেলে করে মৌলানা স্যারের সাথে বের হয়ে গেলেন। হাতে তার পুরনো সেই বড় ছাতা। ইসলামধর্ম শিক্ষক শফিকুল ইসলাম "মৌলানা স্যার" হিসাবেই স্কুলে পরিচিত এবং জনপ্রিয়। গত কয়েক বছর তারা একই সাথে সাইকেল চড়ে স্কুলে যাতায়াত করেছেন। কাঁচা মাটির রাস্তা সলিং করা ইটের হয়েছে, পাকা হয়েছে। বড় বড় গাড়ির যাতায়াত বেড়েছে। সুনসান ছায়া সুনিবিড় রাস্তা ব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু তারা দুজন সাইকেল ছাড়েননি। নিবেন্দু বাবুর স্কুলের শেষ দিন হলেও মৌলানা স্যারের আরও চার বছর বাকী। আনুষ্ঠানিকভাবে নিবেন্দু বাবুর চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়েছিল দু বছর আগে। ম্যানেজিং কমিটির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তার চাকুরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল যা শেষ হল কোন বিদায়ের আয়োজন ছাড়াই।

নিবেন্দু বাবুর ছোট ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে আর বড় মেয়ে স্নাতক পাস করে এখন বাড়িতেই আছে। মেয়েটির বিয়ের কথাবার্তা চলছে কিন্ত নিবেন্দু বাবু সাহস করে উঠতে পারছেন না। মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য যে পরিমান অর্থের দরকার সেই পরিমান অর্থ তার হাতে নেই। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে বসত বাড়িটাই আছে। নিবেন্দু বাবু তার পেনশনের টাকার জন্য অপেক্ষা করছেন। টাকাটা তার হাতে আসলেই তিনি মেয়ের বিয়ের কথা পাকা করবেন। পেনশনের সব কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পেশ করা হয়েছে দু বছর আগেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোন সুরাহা হয়নি। তিনি নিজে কয়েকদিন ঢাকা গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছেন কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

শেষবার স্কুলের তরুণ শিক্ষক, তারই ছাত্র বিবেকানন্দকেও পাঠিয়েছিলেন। বিবেকানন্দ অবশ্য বলেছিল, স্যার একটু অন্যভাবে এগোতে হবে। কিন্তু নিবেন্দু বাবু মন থেকে ঠিক সায় পাননি। আর ঐ "অন্যভাবে" এগোনোর মত অবস্থাও তার নেই। প্রতি মাসে ছেলেকে টাকা পাঠাতে হয়। নিত্যপন্যের ঊর্ধ্বমুখী বাজারেও তিনি নিষ্পেষিত। তার মাঝে মাঝে মনে হয় ইয়াকুব সাহেবের মত যদি ইংরেজি কিংবা নিখিল বাবুর মত গণিতের শিক্ষক হতে পারতেন তাহলে ক্লাস শেষে স্কুলে অথবা অন্য কোন জায়গায় প্রাইভেট পড়াতে পারতেন। সাইকেল চালাতে চালাতে মৌলানা স্যার পেনশনের টাকার কথাটা তোললেন। নিবেন্দু বাবু তখন এক হাতে সাইকেলের মৃদু ব্রেক ধরে, আরেক হাতে ছাতা ধরে মুল রাস্তা ছেড়ে বাড়ির রাস্তা ধরলেন।

নিবেন্দু বাবুর বাড়িটা খুব ছোট নয়। পুকুর পেরিয়ে দু পাশে খালি জায়গা রেখে এক চিলতে পথ, পরে উঠান। উঠান পেরিয়ে কাঠের ও টিনের তৈরী পুরনো ঘর। সাইকেলের ঘন্টাধ্বনি শোনে তার স্ত্রী রেনুকা বেরিয়ে এলেন। নিবেন্দুবাবুর হাত থেকে ছাতা নিতে নিতে বললেন "দীপিকা এসেছে"। দীপিকা নিবেন্দু বাবুর মেয়ের নাম। দীপিকা এসেছে শুনে তার বেশ ভালো লাগলো। বাড়িটা এতদিন খালি খালি লাগছিল। মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল দীপিকা। সাইকেল বারান্দায় হেলান দিয়ে রাখতে রাখতে তিনি বললেন, তা একাই এলো।

'না ওর মামার সাথে এসেছে, এখন ঘুমাচ্ছে, শরীরটা ভালো নয় বলছে'।

দীপিকার মামা অমলেশের সাথে নিবেন্দু বাবুর খুব ভাব। অমলেশ এসেছে শুনে উনার চিন্তাক্লিষ্ট মুখে কিছুটা আনন্দের আভা খেলা করে গেল। অনেক আনন্দ বেদনার কথা তিনি ভাগাভাগি করেন অমলেশের সাথে।

 "তা কোথায় অমলেশ?"

"একটু বাজারে গেছে"- রেনুকা বললেন।

২)

সন্ধ্যা নেমেছে। রেনুকা তুলসীর বেদীতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। ঠাকুর ঘরের বারান্দায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রার্থনা সংগীত গাইছে দীপিকা, "ভব সাগর তারণ কারণ হে'। এই গানের একটি লাইন খুব পছন্দ নিবেন্দু বাবুর। "মম মানস চঞ্চল রাত্রদিনে/গুরুদেব দয়া কর দীনজনে"। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। অমলেশ বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে ফিরেছে। অমলেশ জানে, নিবেন্দু বাবু সরষে বাটা ইলিশ খেতে খুব পছন্দ করেন। আজ পূর্নিমা। উঠানে  মাদুর পেতে বসেছেন নিবেন্দু এবং অমলেশ। মুড়ির সাথে সরিষা তেল ও থানকুনি পাতা মেখে দিয়েছেন রেনুকা। মুখে মুড়ি তুলে দিতে দিতে কথাটা তুলল অমলেশ, "জামাইবাবু, পাত্র পক্ষ ফাল্গুনেই বিয়ে সম্পন্ন করতে চাইছে।

"তা, তো ঠিক আছে অমলেশ, কিন্তু সমস্যাতো এক জায়গায়। কিভাবে সাহস করি বল।"

অমলেশ সম্পুর্ন ব্যাপারটা জানে তাই কোন রাখঢাখ না রেখেই বলল, কিছু মনে করবেননা জামাইবাবু, আমি কিছু টাকা দিচ্ছি, চলেন ঢাকা যাই। আবারো সেই "অন্যভাবে" এগোনোর ঈঙ্গিত।

চা দিতে এসে রেনুকা কথাটা শোনলেন। তিনিও তাতে সায় দিলেন। কিন্ত নিবেন্দু বাবুর মনের আকাশে কোথায় একটা কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে যায়। তিনি সারা জীবন ছাত্রদের ধর্মশিক্ষা পড়িয়ে এসেছেন। নীতির প্রশ্নে যতটুকু পারেন আপোষহীন থাকার চেষ্টা করেছেন। উনার প্রাপ্য টাকাটাও তিনি যখন পাচ্ছেন না তখন মন কিছুটা দুর্বল হচ্ছে।

অমলেশ বলল, আমার টাকাটা আপনি ধার হিসাবেই নেন। পরে আমার টাকা আমাকে দিয়ে দিবেন।

নিবেন্দু বাবু আকাশের দিকে তাকালেন। ভরা পূর্নিমায়ও এক টুকরো মেঘ এসে কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে দিল চাঁদকে। দীপিকা গাইছে, "লক্ষ্য শূন্য লক্ষ বাসনা, গিয়াছে ডুবে অকুল গরল পাথারে। "

"চলেন কাল সকালের ট্রেনেই ঢাকা যাই''- অমলেশ বলল। মেঘে ঢাকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিবেন্দুবাবু রাজি হয়ে গেলেন। দীপিকার প্রার্থনা সংগীত শেষ হয়েছে।

৩)

সকাল সাতটায় ট্রেন ছেড়েছে। সারাটা পথ নিবেন্দু বাবু ঘুমিয়েই কাটালেন। দুপুর দুইটায় ট্রেন স্টেশনে থামলো। তারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট অফিসে চলে গেলেন। কয়েকবার আসা যাওয়ায় একজন কর্মকর্তার সাথে নিবেন্দু বাবুর পরিচয় হয়েছে। ভাগ্য ভালো উনাকে পাওয়া গেল। তবে তিনি লাঞ্চ ব্রেকে আছেন, তাই একঘণ্টা অপেক্ষা করতে বললেন। তার কক্ষের সামনেই একটা বেঞ্চিতে তারা বসে পড়লেন। এখন সামান্য দূরের ভ্রমনেও নিবেন্দুবাবু কাহিল হয়ে যান। বসে বসেই তিনি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলেন। লাঞ্চব্রেক শেষ হলে তাদের ডাক পড়ল। চেয়ারের পেছনের তোয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, আপনারা নিচতলায় একটু করিম সাহেবের কাছে চলে যান, আমি বলে দিচ্ছি। আমাকে এখন একটু বেরোতে হবে।

দুর্ভাগ্য, করিম সাহেবকে পাওয়া গেল না। তিনি কিছুক্ষণ আগে বাসায় চলে গেছেন। আজ নাও ফিরতে পারেন। তবু নিবেন্দু বাবু অফিস শেষ  হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলেন। কর্মব্যস্ত অফিস ধীরে ধীরে নীরব হল। সব বৈদ্যুতিক পাখা, বাতি বন্ধ হয়ে যাবার পর তারা অফিস থেকে বের হলেন। করিম সাহেব আর এলেন না। তারা কাছাকাছি একটা  মোটামুটি মানের হোটেলে উঠলেন। রাতে একেবারেই ঘুম হলো না নিবেন্দুবাবুর। হোটেলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক চিন্তা তার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে। পেনশনের টাকা, ছেলের লেখাপড়ার খরচ, দীপিকার বিয়ে। তার ছেলে রঞ্জনের লেখাপড়া, দীপিকার বিয়ে শেষ হয়ে গেলে তিনি রেনুকাকে নিয়ে তীর্থ ভ্রমনে বের হবেন। তাদের দীর্ঘ  বিবাহিত জীবনে স্ত্রী রেনুকার অনেক চাওয়াই তিনি পুরন করতে পারেননি! কিন্তু রেনুকার চোখে কখনো এর জন্য কোন হতাশা দেখেননি বরং রেনুকার ঐ গভীর দুটো চোখে পেয়েছেন ভরসা।

পরদিন সকালে করিম সাহেবকে পাওয়া গেল। চোখে চশমা, মুখ ভর্তি পান নিয়ে করিম সাহেব কাগজপত্রের ফটোকপি চেয়ে নিলেন। কাগজ নিয়ে কিছুক্ষন নাড়াচাড়া করে বললেন, "দু বছর আগের আবেদন, এর আগের বছরের অনেক ফাইলই এখনো নিস্পত্তি হয়নি। আপনারটা আরো দেরী হবে বলে মনে হচ্ছে। কাল সকালবেলা আসুন, দেখি ফাইল কতদুর পর্যন্ত গেছে।

অমলেশ বলল, দেখুন উনি বয়স্ক মানুষ, ঢাকায় থাকার মত কোন আত্বীয় স্বজনও নেই। যদি আজ একটু কষ্ট করে দেখেন তবে খুব ভালো হয়। কি মনে করে করিম সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। বললেন, আসুন আমার সাথে।

রাস্তার পাশে এক চায়ের দোকানে করিম সাহেব নিবেন্দু বাবুদের নিয়ে গেলেন। তিন কাপ চায়ের কথা বলে কন্ঠ নিচু করে বললেন, তা কার সাথে কথা বলব? যাক বাছা গেল। কথাটা কিভাবে উত্থাপন করবে সেই চিন্তা করে অমলেশের একটু বাধো বাধো ঠেকছিল। করিম সাহেব বাধাটা ভেঙ্গে দিলেন।

অমলেশ করিম সাহেবের সাথে একটু আড়ালে গেল। করিম সাহেব বললেন, ফাইল নিচ থেকে টেনে উপরে নিতে হবে। আরো কিছু লাগবে।

অমলেশ অনেক অনুনয় বিনয় করে করিম সাহেবকে রাজি করাতে পারল। অমলেশের কাছে নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে করিম সাহেব বললেন, ঠিক আছে আগামী সপ্তাহে একবার যোগাযোগ করবেন। সেখান থেকে বের হয়ে তারা সরাসরি  বাস স্টেশনে  গেলেন।  বাড়ি পৌঁছুতে পৌঁছতে রাত দশটা বেজে গেল। টানা দুদিনের ভ্রমন শেষে নিবেন্দু বাবুর ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটা যখন বিছানায় এলিয়ে দিলেন তখন তার দুচোখ জুড়ে ঘুম। দীপিকা দুইবার ডাকতে গিয়ে বাবার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে তার বড় মায়া লাগলো। তাই আর ডাকেনি। পরদিন অনেক বেলা করেই  ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে ওঠে দেখলেন তার বন্ধু বিধুবাবু ও নিয়াজ খান এসেছেন। বিধুবাবু তাদেরই গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। গতবছর অবসরে গেছেন। বিধু বাবুর পেনশনের টাকা ছাড় হয়েছে দু মাস আগেই। নিয়াজ খানের স্থানীয় বাজারে একটা ফার্মেসি আছে। তারা তিন বন্ধু সন্ধ্যার পর সেই ফার্মেসিতে আড্ডা দেন। কয়েকদিন ধরে নিবেন্দুবাবু ফার্মেসিতে যাচ্ছেন না তাই দুই বন্ধু চলে এসেছেন তার বাড়িতেই। হাত মুখ ধুয়ে নিবেন্দুবাবু দুই বন্ধুর সাথে অনেকদিন পর আড্ডায় বসলেন। কিন্তু নিবেন্দুবাবুর অন্যমনস্কতা ঠের পেলেন দুই বন্ধু। তারা আশ্বাস দিলেন বন্ধুকে, মন খারাপ করনা নিবেন্দু, আমরাতো আছিই। এইসব হতাশার মাঝে বন্ধুদের আশ্বাসই নিবেন্দুবাবুর মনে কিছুটা সান্ত্বনা এনে দেয়।

৪)

ঠিক সাতদিন পর নিবেন্দুবাবু ফোন দিলেন করিম সাহেবের ফোনে। জানলেন এখনো কিছু হয়নি।আর বড় সাহেব আগামী পাঁচ দিনের জন্য দেশের বাইরে থাকবেন। এরই মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক করে বড় সাহেবের টেবিলে ফাইল পাঠিয়ে দিবেন। পাঁচদিন পরে আবার ফোন দিলেন। জানলেন বড় সাহেব এসেছেন, স্বাক্ষর হওয়া মাত্রই স্কুলের ঠিকানায় চেক পৌঁছে যাবে। এরপর প্রতিদিন নিবেন্দু একটি হলুদ খামের প্রতীক্ষায় থাকেন। তিনি মৌলানা স্যারকে চিঠির কথা বলে দিয়েছেন। মৌলানা স্যারের সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ এখন নিবেন্দু বাবুর আরো প্রিয়। এই শব্দ শুনলেই মনে হয় তার পেনশনের টাকার চেকের খবর বুঝি এলো। এরপর আরো কয়েকদিন কেটে গেল।এরই মধ্যে অমলেশ ফোন করে পাত্র পক্ষের তাগাদার কথা জানিয়েছে। তারা এই ফাল্গুনেই বিয়েটা শেষ করতে চায়। নিবেন্দু বাবু  আবার একদিন ফোন দিলেন করিম সাহেবকে। করিম সাহেব জানালেন স্বাক্ষর হয়ে গেছে। কয়েকদিনের ভেতরেই তিনি ডাকে চেক পেয়ে যাবেন। একদিন দুপুরবেলা নিবেন্দু বাবু দুপুরে খাবার খেয়ে দিবানিদ্রা দিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় মৌলানা স্যারের সাইকেল তাদের বাড়ির উঠানে এসে থামল। মৌলানা স্যারের হাঁকডাকে নিবেন্দু বাবুর ঘুম ভাঙল।

অবশেষে তিনি তার কাঙ্খিত হলুদ খামের চিঠি পেলেন। কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে খাম খুললেন। হ্যাঁ, তার পেনশনের টাকার চেকই এসেছে।তিনি কয়েকবার পেনশন ভাতার সংখ্যাটির উপর হাত বুলিয়ে নিলেন। নিবেন্দু বাবুর চোখের কোনের জল আড়াল করতে পারলেননা তার প্রিয়তমা স্ত্রী রেনুকার কাছে, তার বড় আদরের মেয়ে দীপিকার কাছে।

৫)

নিবেন্দুবাবু বসে আছেন স্কুলের পাশের একমাত্র সরকারী ব্যাংকের ম্যানেজারের সামনে। চেকটি দেখে ম্যানেজার জানালেন, তার হিসাব নম্বরে চেকটি নগদায়ন হয়ে আসতে সাত দিনের মত লাগবে। এখনকার মত ডিজিটালাইজেশন তখনো হয়নি। তবু ম্যানেজার আগামী বৃহস্পতিবার একবার খোঁজ নেয়ার জন্য বললেন। নিবেন্দুবাবু ম্যানেজারকে যত দ্রুত সম্ভব চেক নগদায়নের অনুরোধ করে বাজারে গেলেন। কিছু মিষ্টি ও দই নিয়ে স্কুলে যাবার পথে অমলেশকে ফোন দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়িতে আসার কথা বললেন। নিবেন্দুবাবুর পেনশনের চেক প্রাপ্তির কথা শুনে শিক্ষকরা খুব আনন্দিত। প্রধান শিক্ষক নিবেন্দুবাবুকে বৃহস্পতিবার স্কুলে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, স্কুলের ছাত্ররা ওইদিন তার সম্মানে একটা বিদায় সম্বর্ধনার আয়োজন করেছে।

সন্ধ্যায় অমলেশ এলো। নিবেন্দুবাবু গ্রামের তার জ্ঞাতি কয়েকজনকেও আসতে বলেছেন। দীপিকার প্রার্থনা সংগীত শেষ হয়েছে কিছুক্ষন আগে। যাদেরকে আসার কথা বলা হয়েছিল তারা প্রায় সবাই এলেন। সবার সাথে রেনুকাও বসেলেন। পাত্রপক্ষ যেদিন দীপিকাকে দেখতে আসে তখন তারাও ছিলেন। এখন সবাইকে নিয়ে পাত্রকে আশীর্বাদের দিতে যাবার দিন ঠিক করতে হবে এবং সেদিনই  বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করা হবে। দীপিকা একবার এসে সবাইকে চা বিস্কিট দিয়ে গেল। অনেক কথাবার্তা হল, বিয়ের কথাবার্তা যেমন হয়। অবশেষে ঠিক করা হল আগামী রোববার পাত্রের বাড়ি যাওয়া হবে।

৬)

বৃহস্পতিবার সকাল বেলায় নিবেন্দুবাবু ব্যাংক খোলার আগেই উপস্থিত হলেন। ম্যানেজার এসে তার চেম্বারে নিয়ে বসালেন। দপ্তরীকে এক কাপ কফি দিতে বলে নিবেন্দুবাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে বলললেন,

"স্যার একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। আপনার চেকটা নগদায়ন না হয়েই ফেরত এসেছে কারন চেকে শুধু একজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর আছে। দু জনের স্বাক্ষর ছাড়া চেকটি অকার্যকর। তাই দুজনের স্বাক্ষরকৃত চেক নিয়ে আসতে হবে। "

নিবেন্দুবাবু চোখে অন্ধকার দেখলেন। কুয়াশাঘেরা সুন্দর সকাল তার কাছে হঠাৎ বিশ্রী লাগছে। তিনি অল্প অল্প ঘামছেন। ব্যাংকের কোলাহলমুখর পরিবেশ তার কাছে শান্ত মনে হচ্ছে, অনেক দূরের মনে হচ্ছে। তিনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। কথা বলতে পারছেন না। চেকটি হাতে নিয়ে উঠতে গিয়ে তার কাছে মনে হল মাথাটা কিছু ঘুরছে।

ম্যানেজার বললেন, স্যার শরীর খারাপ লাগছে? স্যার আপনি কিছু সময় বসেন। এক কাপ কফি খান। দেখবেন ভালো লাগবে।

নিবেন্দুবাবু বললেন, থাক বাবা, আপনি অনেক করেছেন। আমাকে একটু স্কুলে যেতে হবে।

নিবেন্দুবাবু প্রায় টলতে টলতে স্কুলে গেলেন। মৌলানা স্যার সহ সবাই এগিয়ে এলেন। ধরাধরি করে তাকে চেয়ারে বসালেন। আজ তার বিদায় সম্বর্ধনার দিন। তাই মনকে একটু শান্ত করে নিজেকে ঠিক করার চেষ্টা করলেন। ছাত্ররা এত উৎসাহ নিয়ে আয়োজন করেছে। কিন্ত তিনি শেষ পর্যন্ত পারলেন না। মাথা ঘুরে ডায়াস থেকে পড়ে গেলেন। যখন তার জ্ঞান হল তিনি জেলা হাসপাতালের বিছানায় শোয়া। পায়ের কাছে বসে রেনুকা কাঁদছেন। নিথর হয়ে বসে আছে দীপিকা। রঞ্জন মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রঞ্জনকে মৌলানা স্যার খবর দিয়ে আনিয়েছেন। তিনি হাত নেড়ে রেনুকাকে কাছে ডাকলেন। মৃদু স্বরে চেকের ঘটিনাটি রেনুকাকে বললেন এবং অমলেশকে খবর দিতে বললেন। রেনুকা কান্না বুকে চেপে রেখে শান্ত স্বরে বললেন, চিন্তা করোনা। অমলেশকে খবর দেয়া হয়েছে। রেনুকা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন নিবেন্দু বাবুর মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।

৭)

পাঁচদিন পর নিবেন্দুবাবু বাড়ি ফিরে এলেন। তবে পুরোপুরি সুস্থ নয়। অনেক দুর্বল হয়ে গেছেন। এরই মধ্য অমলেশ রঞ্জনকে সাথে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিল। করিম সাহেবকে নিয়ে আবার ঐ চায়ের দোকানেও যেতে হয়েছিল। করিম সাহেব একটু আফসোস করে বললেন, "তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এরকম হয়েছে তবে চিন্তা করবেন না আমি ব্যবস্থা করছি।"

এবার নিবেন্দুবাবু নিজে দীপিকার পাত্রপক্ষকে ফোন করে ক্ষমা চেয়ে বৈশাখ মাস পর্যন্ত সময় চেয়ে নিলেন। ছেলের বাবা রাজি হলেন। এখন দুর্বল শরীর নিয়ে নিবেন্দুবাবু পুকুরপারে বড়শী হাতে নিয়ে বসে থাকেন। প্রতিদিন অপেক্ষা করেন মৌলানা স্যারের। কিন্তু কোন চিঠির খবর আসে না। মাঝে মাঝে করিম সাহেবকে ফোন দেন। খোঁজ খবর নেন। প্রতিবারই করিম সাহেব তাকে আশার কথা শোনান। নিবেন্দুবাবু সান্ত্বনা খুঁজে নেন। এরপর একদিন চৈত্র মাসের বিকেলবেলা চিঠি এলো। খাম খুলে তিনি চেক পরীক্ষা করে নিলেন। এবার ঠিক আছে। পরদিন তিনি ব্যাংকে গিয়ে চেক জমা দিয়ে এলেন।সেদিন রাতেই তিনি তার বুকে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলেন। সকাল বেলায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। হাসপাতালে সিটের স্বল্পতার জন্য নিচে বিছানার ব্যবস্থা করে তাকে রাখা হল। এভাবে কয়েকদিন থাকার পর একটা ভালো সিট পাওয়া গেল। হাসপাতালের বারান্দায় অপেক্ষায় থাকেন রেনুকা, দীপিকা, রঞ্জন। মাঝে মাঝে আসে অমলেশ। রাতে তারা হাসপাতালের বারান্দায়ই শুয়ে থাকেন। নিদ্রাহীন রাতে বারান্দায় শুয়ে, বসে তারা অপেক্ষা করেন নিবেন্দুবাবুর সুস্থতার। একমনে মালা জপ করে যান রেনুকা।

একদিন সকালবেলা ভেতর থেকে ডাক এলো তাদের। নিবেন্দু বাবুর অবস্থা বেশী ভালো নয়। নাকেমুখে অক্সিজেনের মাস্ক লাগানো নিবেন্দুবাবু  রেনুকাদের ইশারায় কাছে ডাকলেন। দু হাত তোলে দীপিকা, রঞ্জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রেনুকা কাছে এসে নিবেন্দুবাবুর কপালে হাত রাখলেন। সেই হাতে নিবেন্দুবাবুও তার হাত রাখলেন। গভীর মমতায়। নিবেন্দুবাবু মারা গেলেন সকাল নয়টা ত্রিশ মিনিটে। রঞ্জন, দীপিকা, রেনুকা আছড়ে পড়লেন নিবেন্দুবাবুর নিথর দেহে। হাসপাতাল, তাই কান্নাটাও বুকে চাপা দিয়ে রাখতে হয়।

নিবেন্দুবাবুর মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে গেল। খবর শুনে গ্রামের প্রায় সবাই এসেছেন। শুরু হল শবদাহের ব্যস্ততা। চিতার কাঠের গাছ দেখিয়ে দিয়েছেন বিধুবাবু। গ্রামের নারীদের কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছেন রেনুকা ও দীপিকাকে। বুকে চেপে রাখা কান্না এবার বাধ ভেঙ্গেছে। মরদেহের পাশে বসে আছে রঞ্জন। তার সাথে আছেন বিধু বাবু ও অমলেশ। আয়োজন চলছে নিবেন্দুবাবুর শেষ স্নানের। বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছে রঞ্জন। যে বুকে সে একদিন জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে উস্নতা নিত, সেই বুক আজ কত শীতল হয়ে আছে। স্কুলের পক্ষ থেকে নিবেন্দুবাবুর মৃত্যুর খবর মাইকিং করে ঘোষণা করা হল। খবর শুনে তার বর্তমান ও পুরনো ছাত্ররাও এলো। এলেন স্কুলের সব শিক্ষক। ব্যাংকের ম্যানেজারকেও বাড়ির এক কোনায় দেখা গেল। উনাকে আরেকটি দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। সকালেই নিবেন্দুবাবুর হিসাবে টাকা এসে জমা হয়েছে এবং মৃত্যর খবর পাবার সাথে সাথেই তিনি হিসাবটি "ফ্রিজ" করে দিয়েছেন। এটাই নিয়ম। তার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছুই করার নেই।

নিবেন্দুবাবুর দেহ চিতায় তোলে যখন মুখাগ্নি করা হচ্ছে তখন ম্যানেজার মৌলানা স্যারের কানে কানে কথাটি জানিয়ে দিলেন। নিবেন্দুবাবুর চিতার আগুনের দিকে তাকিয়ে মৌলানা স্যারের মনে হল সেই আগুন তার বুকের ভেতর ছড়িয়ে গেছে। চিতার আগুনের  রঙের সাথে যেন মিশে যাচ্ছে একটি হলুদ খামের রঙ।

আপনার মন্তব্য