ও মাটি! হাওর- জল-ক্ষেত, ও আমার পূর্বপুরুষ-জননী!

 প্রকাশিত: ২০২০-০৭-১৩ ১৭:৪৫:২৪

আফরোজ রায়হান:

পানিতে খড় গেল, ঘর গেল, গোলায় কিছু ধান ছিল তাও গেল। তবু অকাল পানি যায়না। বেঘোরে মেঘ সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। শুধু ভাসায় আর নিয়ে যায়। আমি তো ভালোবেসেই ভুল করেছিলাম।

তোমার বাড়ি কোথায় গো! এত প্রেম করো কেন? ধুলোয় মলিন এই দেহ! তার ওপর ক্ষুধা,তৃষা ভার। জরা-ব্যাধি আছে-- এই বুকে সুখ-দুখ একাকার। এত সুধা কেমন করে চাও! এত ফিরে ফিরে আসো বার বার।

আমার বুঝি বসতে দিতে ইচ্ছে করেনা তোমাকে! আমিও তো ভালোবাসি। মাথা গুজার ঘর খানা তো রাখো! আতপ চালের ভাত নাইবা খেলে, সামান্য জলও তো দিতে পারি-- গরমে তৃষ্ণা পেলে! টিউবওয়েলের গলা পর্যন্ত ডুবে আছে। অথৈ পানি এখন। বলোতো, বিশুদ্ধ খাবার জল কোথা মেলে!

তোমার না আক্কেল নাই, যখন তখন মন চাইলো আর চলে এলে! আমিই তো ডাকি প্রয়োজন হলে। ডাকি না, বলো!

কার্তিক মাসে জোর করেই বেধে রাখি তোমায় --ক্ষেতের উঁচু আলে। বীজ বপন হলে আরেক দফা চাই-- জমিতে চারা রোপণের কালে। তুমি তো আসতেই চাও না --ধানের পাতা একটু সবুজ হলে। কত কষ্টে আমি সেচ দিয়ে পানি তুলি।

জানো, ঘণ্টা হিসেব করে কত খোয়া যায় ডিজেল আর মেশিন ভাড়া নিলে! এখন আর গতর খাটে না গো! জোশ পাইনা, দেখি জামানা চলছে ডিজিটালে। ডিজিটাল মানে শ্রম একটু কম কিন্তু অনেক খরচাপাতি। এত খরচা করে শেষমেশ কি পোষায় বলো! ধানের দাম এত কম হলে!

মাঘে মেঘে দেখা হলে তবু একটু স্বস্তি মিলে। ফাল্গুনে তোমার খবরই থাকে না। কোথায় থাকো! যৌবন আমার বিরহে যায় জ্বলে। চৈত্রমাসে তোমার এত বাড়াবাড়ি আমার ভাল লাগে না। ভয় পাই-- আচমকা বেড়ে ওঠো যদি! নিষ্ঠুর! মাঝে মাঝে তুমি তাই করো-- সব গিলে খাও ইচ্ছে হলে!

বলি, আমারও তো ব্যথা হয়, যখন শিলা আমার কাচা-ফাকা ধানে আচমকা ভাংচুর খেলে। অকালে ডুবাও যদি গলা অবধি কেমন করে শ্বাস নিই বলো! তুমি না কিচ্ছু বোঝনা। যখন যা ইচ্ছে তাই চাও- করো, কি হয় একটু সদয় হলে!

গেলো বোশেখেও কপাল পুড়েছে আমার। সেই যে চুপি চুপি রাতের আধারে চলে এসেছিলে! হাওর, নদী, ধান, দুদিনেই সব একাকার-- সোনা ছলছল শেষ জমিটুকুও গেলো তোমার অতলে।

--মজুর নাই, মেশিন চলেনা, নাওয়ের বাড়তি খাটুনি দিতে দিতে অবশিষ্ট আর কিছু থাকেনি গো! কেমন করে বছর পার হই! আমার তো খাবার, ঔষধ-খরচ, সাধ আহ্লাদ, সামাজিক সংসারাদি সব এখান থেকেই চলে।

তুমি না সত্যি নির্দয়, পাষাণ তুমি! তা না হলে মাস পেরুতেই আজ আবার কেমন করে এলে! ঘাট ভাসাও, কিচ্ছু বলিনি। মাঠের অর্ধেক দিয়ে দিলাম, তাও সাধ মিটেনি তোমার!

-- পথ, উঠোন, বারান্দা দিলাম। তুমি ঘরেরও দখল নিলে। খাট, চুলো ভাসিয়ে দিলে! আমি থাকবো কোথায়? খাবো কেমন করে? না খেলে মানুষ বাঁচে বুঝি! ধানসুদ্ধ গোলা ভিজে গেলে কাল থেকেই যে আমাকে পথে নামতে হবে।

আমি তো ভিখারি নই গো! কাজ করে খাই। বাপ দাদার জমি-জমা ছিল, তাই মাটিতে গতর খাটাই। ভিক্ষা আমার আদতে যায় না। বাবা বলতো- "কৃষক নাকি সোনার মানুষ! মাটির লগে আমার চৌদ্দ পুরুষের এই মাখামাখি কারবার।"

কেমন করে হাত পাতি বলো! আমি তো গৃহস্থ। দু'বেলা উপোষ হলেও চুপ থাকি, কাউকে বলি না, এটা আমার চৌদ্দ পুরুষের ইজ্জতের ব্যাপার।

দুই বিঘা আমন জমিও আছে। ডিলারের বীজ কিনে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। গ্যারা গজিয়েছে। বপনের জমিটা তৈরি ছিল। মোস্তফার বেটা বিঘা প্রতি তিনশো করে নিয়েছে ট্রাক্টরের বিল। দু'বার চাষ দিতে হয়েছে। শেষমেশ আরও এক চাষ লাগতো। তার আগেই তুমি ভাসিয়ে দিলে সব। পরপর দু'বার। আরও হয়ত কয়েকদফা বাকি আছে! সবে তো আষাঢ় শুরু হলো।

কেমন করে পারো তুমি! ও পানি, কোথায় তোমার ঘর! ভালোবেসে কাঙ্গাল হয়েছি বলে মন বুঝনা, থাক। শরীর তো বুঝো! তোমার যৌবনে জ্বালা আছে। আমারও প্রয়োজন কিছুটা। তাই বলে শরীরের সাথে আমার পরিচয়টাকেও এভাবে ভাসিয়ে দেবে অথৈ বন্যার জলে।

আজ আমি আর গৃহস্থ নই। আমার পরিচয় এখন বানভাসি মানুষ। এখান থেকে অইখানে যাই, ফিরি এ ঘাট ছেড়ে অই ঘাটে। তবু ভিক্ষে করিনা। ক্ষিদের জ্বালায় শুধু হাঁক ডাকি--

"সাহায্য কিছু দেবেন গো মাই. বোন! ঘরে চিড়া-মুড়ি-গুড়, স্যালাইন যাই থাকে। দুই বেলা না খেয়ে পেট পুড়ে গো!-- লগে আমার দুধের শিশুটাও আছে।"

সরকার বাধ্য হলে কিছু হয়ত দেয়। তার সিকিভাগ কখনো পাতে ওঠে কখনো কানাকড়ি ও জুটে না।

ও পানি! হাওর-মাঠ-ক্ষেত, ও আমার পূর্বপুরুষ, জননী! তোমরা সবাই জেনে রাখো-- আমি আর কৃষক নই। এদেশে মাটি ও জলে গতরে খেটে এখন আর কেউ ভাত পায় না।

বড় হতে হতে আমার সন্তান একদিন হয়তো ভিক্ষা শিখে নেবে! ভিখারি ! হাহাহাহাহা!

আমি তো এদেশের মাটি ও জলকেই ভালোবেসেছিলাম!

আপনার মন্তব্য