কোমল কংক্রিটে দাঁড়ানো ‘এক দ্য হিরো’

 প্রকাশিত: ২০২০-১০-০৯ ২১:৫৯:০৯

 আপডেট: ২০২০-১০-১০ ২৩:০৮:৩৯

উজ্জ্বল মেহেদী:

'কার সাক্ষীতে ভর করে দোষী সাব্যস্ত করলেন আমার ছেলেদের? সাক্ষী কে, নাম বলেন, তাড়াতাড়ি। দেখি কয়টা... ?'

‘ডট ডট ডট’। সঙ্গত কারণেই। মুখের ওপর কথা। কর্ণপাত করতেই উৎকট এক গন্ধ নাকে লাগল। চেনা গন্ধ, তবে ঘৃণার। কথায় প্রশ্নও উদ্ভট। যেন রক্তচক্ষুর এক জবাবদিহিতা। রেগে মেগে আগুন হওয়ার কথা, কিন্তু তিনি মাটির মতো শীতল অনুভব করলেন। এমন পরিস্থিতি তাঁর পেশাজীবনে নতুন নয়, আগে অনেকবার পড়েছেন। পেশার ছদ্মাবরণে থাকা প্রশ্নকারী রাজকূট-কৌঁসুলি, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করেন। বছর কয়েক আগের ঘটনা, কথাগুলো এখনও মনে থাকলেও লোকটার নামটা এই মূহুর্তে মনে হচ্ছিল না। 'র' আদ্যাক্ষরে কি যেন একটা নাম। যাক গে, নাম দিয়ে আর কী কাজ।    

সেদিন 'র'-এর রক্তচক্ষুর জবাবদিহিতার মধ্যে পড়ে তিনি মন ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন মন্দনিলার মতো করে। কত-সহস্র ঘটনাই তো আছে পেশাজীবনের ঝুলিতে। মনে পড়ল আরেক ঘটনা, এই কর্মস্থলের আগের কর্মস্থলের ঘটনা। তখন হাওয়া-হাওয়া করে একটি ভবন শাসন করতে চাইছিল দেশটাকে। ক্ষমতার দাপটে হাওয়া তো বটেই, মানুষও কাঁপত। 'ভয়ে তড়পাচ্ছি...' আওয়াজ যাপিত জীবনের হাওয়াকে করত আরও বেপরোয়া। কিন্তু তিনি কাঁপা বা তড়পানো কোনোটিই করেননি। হাওয়া-প্রতাপের এক ব্যক্তিকে দণ্ড দিয়ে বসলেন। তিন ঘন্টার দণ্ড। যেখানে দাঁড়ানো, সেখানেই দণ্ড কার্যকর। কথায় আছে হাকিম নড়ে, হুকুম নড়ে না। হাওয়া তখন উল্টো কেঁপেছিল সেদিন।

সেই থেকে তিনি 'হিরো'। রিয়েল হিরো। কোমল কংক্রিটে দাঁড়ানো 'এক দ্য হিরো'। বিচারিক বিবেক প্রখর এই হিরো সিলেটে বদলি হয়ে এলেন। সঙ্গে এল হাওয়া কাঁপানো তাঁর সাহসটাও। ঠিক ওই সময়ে একটি ঘটনা ঘিরে বিচারহীনতা আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলছিল। ছাত্রাবাসে অগ্নিকাণ্ড। ক্ষোভের আগুনে পুড়ছিলেন সবাই। পোড়া ছাত্রাবাস দেখে শিক্ষামন্ত্রীর অশ্রুবিসর্জন পর্যন্ত হয়েছে। কান্না সংবরণ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, 'আমি তো বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) ঘোষণার প্রস্তাব করতে চেয়েছিলাম এই ছাত্রাবাস-স্থাপত্যকে। আগুনে পুড়ে সব শেষ!'
শেষ থেকে একটা নতুন শুরু করতে চান হিরো। যে শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে দেশের একটি আইডল। সহবস্থান থাকবে, সারা দেশ তাকিয়ে থাকবে। রোজ সকালে হাঁটার অভ্যাসে একদিন, এক সবুজ সকালে হাঁটতে হাঁটতে হিরো যান পোড়া ছাত্রাবাস এলাকায়। সঙ্গে থাকা গানম্যানকে দূরে রাখলেন। একা সবুজ ঘাস আর পোড়া মাটির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। সেখানে কোনো কোমল কংক্রিট ছিল না। তবু মনে পড়ল কবিতা। 'জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল, কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।' কবি হেলাল হাফিজের কবিতায় হিরোর বিবেক আরও জাগ্রত। এই ছিল শপথ, মাটির সঙ্গে খাঁটি এক মানুষের অকৃত্রিম এক বোঝাপড়া।

সদা জাগ্রত হিরোর বিবেক মাটির সঙ্গে বোঝাপড়ায় আরও শাণিত। ২০১২ সালের ৮ জুলাই সেই অগ্নি-সন্ত্রাসের পর কেটে যায় পাঁচ বছর। সেখানে অবিকল স্থাপনা তৈরি করা হয়। কিন্তু পোড়ানোর বিচার নিয়ে চলে দোলাচল। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। হিরো স্বপ্রণোদিত ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। তলব করলেন, সর্বশেষ তদন্তকারী সংস্থাকে। মামলা 'ফাইনাল' দিয়ে শেষ চিহ্ন নিঃশেষ করার কোশেশ চলছিল। হিরো কোমল কংক্রিটে দাঁড়িয়ে ক্লেদ ঝাড়লেন। ছাত্রাবাসে আগুন দিল ভূতে! এবার 'ভূত' খুঁজতে গঠন করলেন তদন্ত কমিটি। রক্ষকদের পাঁচ বছর নিস্ফল তদন্তের ফল, হিরোর চেষ্টায় বিফল হয়নি। ছয় মাসে সম্পন্ন হলো তদন্ত। ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগকারী ৩২ জন অভিযুক্ত। এরমধ্যে তিনজন ঘটনার উসকানির জন্য দায়ী, ২৯জন অগ্নিসংযোগকারী।  
ছাত্রাবাস পোড়ানোর পর 'র'-রা দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বিভাজনটা ছিল স্বার্থসিদ্ধির। পোড়া ছাত্রাবাস পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজের কমিশন নিয়ে। আইনের চোখে তাদের কমিশনটা আসলে চাঁদাবাজি। এই চাঁদার ভাগবাটোয়ারায় 'র' থেকে 'আ' সদলবলে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু হিরোর স্বপ্রণোদিত বিচার প্রক্রিয়া দেখে 'র-আ' এক জোট। তাদের সংঘবদ্ধ মিছিল, সামনে দাঁড়ানোর লোভ সংবরণ করতে পারলেন না নেতারাও। তারাও একাত্ম, 'র-আ-এর সঙ্গে রাজকূটের অ-আ-ক-খ সবাই এক কাতারে। তাদের তর্জন-গর্জন-ভাষণে পুনঃতদন্তের দাবি। এই দাবি জানানোয় আশকারা পেল অভিযুক্তরা। এক রাতে এক বিবেকের বাসস্থানে হানা দেয়। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ভেদ করে হুমকি-ধমকি দিয়ে পরদিন জামিন প্রার্থনা। জামিন পেয়ে উপরতলার জমিনে যাতায়াত, স্থগিতাদেশ আসল উপর থেকে নিচে।

হিরো তো দমবার পাত্র নন, একটা স্থগিতাদেশ তো কী হয়েছে? খুনোখুনি, অস্ত্রবাজি কত কিছুই তো আছে। তরুণ বা তারুণ্য-শক্তিকে কবি নজরুল বলেছিলেন, 'মিলিত প্রাণের যৌবনফুল'। হিরো এদের 'রসুন' বানালেন। টান দিলেই রসুনের প্রতিপালকেরা এসে ধর্ণা দেয়। এক-এক করে হত্যা-অস্ত্রবাজি, দা উঁচিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া, সবকিছুতেই স্বপ্রণোদিত  ক্ষমতা দেখালেন হিরো। সাহসের তরি চলছে তো চলছেই। একদিন সেই হাওয়া শাসনকালের মতোই তাঁর বদলির আদেশ এল। তাতে এক চুলও বিচলিত নন হিরো। তবে ওপাশে ছিল 'র-আ'-দের মুখে তৃপ্তির ঢেঁকুর।

পোড়া ছাত্রাবাসের মতো হিরোর মন পুড়ছিল মন্দনিলার জন্যও। সাহসী মনে খানিকটা কষ্টের উদ্রেক এখন শুধু মন্দনিলার জন্য। হিরো ভাবেন, যদি সেই অগ্নিকাণ্ডের বিচার করা যেত, তাহলে তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পবিত্র মাটিতে সকল অপকর্মের যবনিকাপাত ঘটত। দেখতে বা শুনতে হতো না বর্বর ধর্ষণকাণ্ড। ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে 'আমি কূলহারা...' বলতে হতো না এক মন্দনিলাকে। ছাত্রাবাস পোড়ানোর বিচার হলে তো 'র-আ' রাই ধর্ষণযজ্ঞ থেকে এখনকার পরিস্থিতি থেকে বেঁচে যেত। নিজেদের তল্লাটে সন্ত্রস্ত-তটস্থ আর পলায়ন-তৎপর অবস্থার মুখে পড়তে হতো না।

করোনাকালে রাজনীতির 'র-আ'দের জন্য অদ্ভুত রকমের এক করুনা হয় হিরোর। বিবেক তাড়নায় মায়ের মমত্বে মন্দনিলার জন্যও মায়া হয়। 'যদি আগের কর্মস্থলে থাকতাম, কী করতাম?' হিরো চোখ বন্ধ করে ভাবেন। প্রথমত; ছাত্রাবাস পোড়ানোর বিচার দ্রুতলয়ে সম্পন্ন হতো, অভিযুক্তদের দণ্ডকারণ্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তিরোহিত হতো। দ্বিতীয়ত; গড়ের টিলায় একের পর এক খুনের যতটা সম্ভব বিচার তরান্বিত করার চেষ্টা থাকত, কলেজ ক্যাম্পাসে দা-উঁচিয়ে ধাওয়াকারীদের কারাভোগ তো হয়েছিল, এতদিনে ছোটখাটো একটা দণ্ডও দেওয়া সম্ভব হতো।

হিরো ভাবনার উপসংহারে আসেন। এসব হলেই তো মন্দনিলাকে পুড়তে হতো না, দলিত হওয়ার সুযোগ থাকত না, ছাত্রাবাসেও থাকত না দখলযজ্ঞের কোনো আস্তানা। হিরো মনে মনে কথা বলেন আর ভাবেন। বলেন, এরপরও যদি দলিত হতো মন্দনিলা, স্বপ্রণোদিত ক্ষমতার বলে সবার আগে তাকে সুরক্ষিত করে সাহসিকার আসনে স্থান করে দেওয়া, তাকে নিয়ে ঘটনার দুটো ভাগ তৈরি করে দংশনের মুখে ফেলার চেষ্টা কঠিনভাবে রোখা হতো। মন্দনিলার 'না' মানে 'না-ই'। অন্তরালে কোনো কিছুই খোঁজার অবকাশ নেই।

তারপর 'আমি কত অসহায়' বলে দায় এড়ানো কলেজ কর্তৃপক্ষকে ডাকা হতো। এই কর্তৃৃপক্ষের সঙ্গে তো হরিহর আত্মা হয়ে আছে রাজকূটের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা। রসুন বানাতেন সকলকে। অসহায়দের সহায় হতে আরেক টানে আসত তারাও। অনুষঙ্গে অবশ্যই থাকত, 'এসএমপি' থেকে ধর্ষণকারীদের নির্বিঘ্নে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া রক্ষক নামের সাক্ষী গোপালরা।

এক-দুই-তিন করে এদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ওপাশে প্রচলিত আ্ইনেই দ্রুত চলত বিচার। তদন্তের তারিখ নির্ধারণ করে দিয়ে স্বপ্রণোদিত আদেশ জারি থাকত পুলিশের প্রতি। যেমনটা ছিল, খাদিজা হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্র দাখিলে দিনক্ষণ ধার্য করে দেওয়া।   

রাজা গৌড়গোবিন্দের ‘গৌড়’ থেকে ’গড়’। গড়ের টিলায় একচেটিয়া আধিপত্য, একের পর ঘটনাক্রম থেকে ছাত্রাবাসে দখলযজ্ঞ, এরপর ধর্ষণকাণ্ডে ধর্ষণযজ্ঞ। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহটা হিরোর চোখে ভয়ংকর রূপে দেখাল। গা শিউরে ওঠে, ভাবতে ভাবতে আর মনে মনে কথা বলতে গিয়ে হিরোর গলা শুকিয়ে যায়। পেছন ফিরে তাকালেন। ফেলে আসা কর্মস্থল থেকে নতুন কর্মস্থলে তখন। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে কাঁপছিল রাজধানীর রাজপথ। 'যদি তুমি ভয় পাও... তুমিই বাংলাদেশ' স্লোগানে কিশোর বিপ্লবীরা অনেক কিছু করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল অনিয়মগুলো। উল্টো পথে চলা মন্ত্রীদের গাড়ি পর্যন্ত থামিয়ে দিয়েছিল, জলপাই রং তাদের চেনা ছিল না, তালাশ করছিল ড্রাইভিং লাইসেন্স। সব যানবাহন এক, চলবে একই নিয়মে। এমন কিশোর-বৈপ্লবিক অবস্থায় বাংলাদেশের সব পথ এক পথে চলতে শুরু করে। সুযোগ সন্ধানীরা হেলমেট পরে মিশে যায় কিশোর-দলে। নাশকতার আশঙ্কার মধ্যেও চলে কিশোর-বিপ্লব। শুরু হয় দমনপীড়ন। মুখ দেখে দেখে আঠারোর তারুণ্যকে কারাবন্দী করা হচ্ছিল।

এসব দেখে হিরোর মন পুড়ে। বিচারিক বিবেক-তাড়া করে। একাই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন সেদিন। প্রথম দফায় ১২২টি নিষ্পাপ মুখকে জেলে পুড়ে রাত পার করতে দেননি। নিরাপরাধীকে অপরাধী বানালে ক্রোধ থেকে জন্ম নেয় বড় কোনো অপরাধ। সেই ক্রোধ জন্মবার আগে বরবাদ করতে চাইলেন হিরো একাই। করলেনও। সড়ক নিরাপত্তা চাইতে গিয়ে ‘অপরাধী’ বানানো নিরপরাধদের মুক্তি দিলেন। ‘হচ্ছেটা কী?’ তথ্য-তালাশে টিকটিকিরাও শেষমেশ 'ঠিক ঠিক' করল। জানাল, কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, বরং পরিবারও ‘বিরোধী’ নয়।   

কোমল কংক্রিটে দাঁড়ানো 'এক দ্য হিরো' তখন দারুনভাবে সম্মোহিত হলেন। আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। বিবেকের মুখোমুখি তিনি। গান গাইতে পারেন না, তবু গাইতে ইচ্ছে করছিল। হিরো গাইছিলেন সুমনের গান; ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু/ বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে/ তোমার-আমার দেখা হবে/ অন্য গানের ভোরে...’।
...
পুনশ্চ : ‘মন্দ সময়ে এক মন্দনিলা’র মতো এই গল্পও সত্য ঘটনা অবলম্বনে।  'হিরো' কল্পিত কেউ নন, বাস্তবের একজন। কাজে হিরো, নামেও হিরো। অসীম সাহস, প্রখর বিচারিক বিবেকবোধ সম্পন্ন একজন। এ রকম মানুষ সমাজে খুবই প্রয়োজন। সিলেটে এই দুষ্কালে হিরোর শূন্যতায় পূর্ণতা দেবেন কি কেউ? কোন্ বনেগা হিরো?
প্রশ্নের উত্তর চাই না। উত্তর মিলবে কাজে। যদি উত্তর পাওয়া যেত, দেয়ালের গ্রাফিতির চরিত্র ‘সুবোধ’ হয়তো তাঁর খাঁচাবন্দি সূর্যটা চিরতরে মুক্ত করে দিতেন। কোনো এক খারাপ পরিস্থিতিতে 'সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না...' বললেও ফেরার পিপাসা ঠিকই থাকত।


সিলেট# ৮ অক্টোবর, ২০২০

আপনার মন্তব্য