প্রকাশিত: ২০২০-১১-২১ ১২:৫০:৪৭
রাহাত রাস্তি:
এক দেশে একবার ‘ধরনা’ নামক এক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হলো। ‘বিশ্ব ধরনা নির্মূল সংস্থা’ ঘোষণা দিল সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। হাত ধুতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
সেই দেশে সবই ঠিকঠাক চলছিল। বেশ কিছু মানুষ ধরনায় আক্রান্ত হলেও বিধিনিষেধ মেনে চলায় অনেকেই এই নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই মাস্ক পরা নিয়ে একটা ভয়াবহ বিপত্তি দেখা দিল। একদল লোক মাস্ক পরে ঠিকই কিন্তু তারা তাদের নাক বের করে রাখে। কিছুতেই তারা তাদের নাক ঢাকে না। ঘটনার শুরু এখান থেকেই।
যারা মাস্ক পরেও নাক বের করে রাখে স্বাভাবিকভাবেই তারা তিরস্কৃত হতে লাগল। কারণ নিশ্বাসের সাথে ধরনা ভাইরাস আক্রমণ করতে না পারার জন্যই মাস্ক। তাই নাক খোলা রেখে মাস্ক পরলে আসলে মুখ ঢাকছে ঠিকই কিন্তু নাক থাকছে অরক্ষিত। সঠিকভাবে মাস্ক পরাদের সাথে নাক খোলা মাস্কওয়ালাদের সংঘাত দেখা দিল। ক্রমেই তা ভয়াবহ রূপ নিল। এই মাস্ক পরা নিয়ে দুই ভাগ হয়ে গেল শহর। একভাগে ঠিকভাবে পরা মাস্ক। আরেকভাগে নাক খোলা মাস্কের লোকেরা। তাদের মধ্যে মিছিল মিটিং শুরু হলো।
নাক খোলা মাস্কের লোকেরা মিছিল দিতে লাগল এভাবে— দলনেতা সুর করে বলছে, 'মাস্ক পরব ঠিকঠাক'; তখন বাকি সবাই সেই সুরে সমস্বরে বলছে, 'তবে খোলা/ রাখব নাক!'
সঠিকভাবে মাস্ক পরা লোকেরা মিটিং করতে লাগল, কী করা যায়। কিছুতেই অ্যান্টি পার্টিকে বোঝানো যাচ্ছে না যে নাক খোলা রেখে মাস্ক পরলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তারা এ ব্যাপারে কিছু লিফলেট বিলি করার সিদ্ধান্ত নিল। তাতে লেখা—'নাক ঢেকে মাস্ক পরি/ ধরনা ভাইরাস দূর করি।'
কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এর মধ্যেই 'সঠিকভাবে মাস্ক পরা' দলের এক ছেলের সাথে 'নাক খোলা মাস্ক' দলের এক মেয়ের প্রেম হয়ে গেল। ঘটনা এরকম— ধরনা পরিস্থিতিতে অনেকদিন কেটে গেছে। শহর থেকে একটু দূরের এক রিসোর্টে বেড়াতে গেছে বেশ কিছু লোক। রিসোর্টের সবুজে হারিয়ে যেতে যেতে যেন নতুন করে প্রাণভরে শ্বাস নিচ্ছে সবাই। তবে এখানেও সবাই যথারীতি মাস্ক পরে আছে।
রিসোর্টের বড় পুকুরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল সঠিকভাবে মাস্ক পরা একটি ছেলে। সে মোবাইলে চোখ রেখে গান গাইতে গাইতে হাঁটছে। হঠাৎ করেই পথের পাশের একটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল সে। ছেলেটি হতভম্ব হয়ে সেখানেই বসে থেকে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে, হাত থেকে পড়ে যাওয়া মোবাইলটি খুঁজছে।
ছেলেটি যেদিকে মুখ করে আছে তার বিপরীত দিক থেকে হঠাৎ একটা সুন্দর ঘ্রাণ এসে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল তার নাসারন্ধ্রে। সেই সুবাসে বুঁদ হয়ে থাকল সে বেশ কয়েক সেকেন্ড। তারপর পেছনে ঘুরতেই দেখতে পেল, একটি মেয়ে তার মোবাইলটি বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, আপনার মোবাইল!
কিছুই বুঝতে পারছে না ছেলেটি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। মেয়েটির গা থেকে ভেসে আসা পাগলকরা ঘ্রাণে এখনও বুঁদ হয়ে আছে সে।
মেয়েটি আবারও বলল, কী হলো, নিন আপনার মোবাইল।
ওহ, হ্যাঁ। বলে ছেলেটি এবার হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিল।
আপনি পড়ে যাওয়ার পর এটি ছিটকে আমার পায়ের কাছে এসে পড়েছে, আমি ওই গাছটির পাশে বসে ছিলাম।
একা?
হুম একা। বন্ধুরা মিলে ঘুরতে এসেছি। এখন একটু নিরিবিলিতে একা সময় কাটাচ্ছি।
হুম।
আপনি? এবার মেয়েটি প্রশ্ন করল।
আমিও আপনার মতই বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসে একটু দলছুট হয়েছি।
মেয়েটি এবার হাসল। এই প্রথম ছেলেটি ভালোভাবে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। খুব হতাশ হল ছেলেটি। কারণ, মেয়েটি মাস্ক পরেছে ঠিকই কিন্তু নাক বের করা। তখন সে মেয়েটিকে বলল, আপনি তো আমাদের অ্যান্টি পার্টি।
হুম তাই তো দেখছি।
নাক খোলা রেখে মাস্ক পরা আর না পরা তো একই, ছেলেটি বলল।
সারাক্ষণ নাক বন্ধ করে রাখেন আপনাদের নিশ্বাসের কষ্ট হয় না? মেয়েটি বলল।
হয়। তারপরও ধরনার জন্য সতর্ক থাকতেই ভালোভাবে মাস্ক পরি।
তারপর কয়েক মিনিটের নীরবতা। সঠিকভাবে মাস্ক পরা ছেলেটিকে অবাক করে দিয়ে এবার মেয়েটি বলল, আপনার মোবাইলটি একটু দেখতে পারি?
নিশ্চয়ই! ছেলেটি বলল।
মেয়েটি মোবাইল হাতে নিয়ে কিছু একটা টাইপ করল তাতে। এমন সময় পুকুরের অন্যপাশ থেকে ডাক এল, তানজিনা!
মেয়েটি মোবাইল ফেরত দিয়ে আর কিছু না বলেই যেদিক থেকে ডাক এসেছে সেদিকে ছুটল।
ছেলেটি মেয়েটির চলে যাওয়া দেখতে লাগল। জানল মেয়েটির নাম। তানজিনা!
ছেলেটি তারপর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে গেল, মেয়েটি একটি মোবাইল নাম্বার টাইপ করে গেছে!
এর দুই ঘণ্টা পরে। বিকেল হয়ে গেছে। ছেলেটি লাঞ্চ করে আবারও পুকুরের একপাশের ঘাটের সিঁড়িতে এসে বসল। ঠিক উলটো দিকেও আরেকটি সিঁড়ি দেওয়া ঘাট আছে এই পুকুরের। তানজিনাকে দেখা গেল সেখানে। বসে আছে সে। তানজিনা ছেলেটিকে দেখেই হাত নাড়াল। কানে হাত দিয়ে ইশারায় ফোন করতে বলল।
ছেলেটি সেই নাম্বারে ডায়াল করল সাথে সাথে। হ্যালো! বলল ছেলেটি।
হ্যালো! বলল তানজিনা।
কী অবস্থা?
এই তো! আচ্ছা আপনার নামটা তো জানা হলো না!
রায়হান।
রায়হান, ভারি সুন্দর নাম। আমি...
আপনি তানজিনা!
কীভাবে জানলেন!
ইচ্ছে থাকলে জানা যায়।
তাই বুঝি!
একটু থেমে রায়হান বলল, আচ্ছা আমরা এত কাছে থেকেও ফোনে কথা বলছি কেন? আমরা কি পাশাপাশি বসতে পারি না?
একটু অসুবিধা আছে। আমার বান্ধবীরা যদি দেখে হাসাহাসি করবে।
ঠিক আছে তাহলে।
একটা কাজ করবেন?
কী?
আপনি ঘাটের নিচের সিঁড়িতে নেমে পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে বসবেন?
হুম, বসব।
আমিও বসছি। বলল তানজিনা।
দুজনেই পুকুরের দুই প্রান্তে জলে পা ডুবিয়ে বসেছে। রায়হান পা দিয়ে যে ঢেউ তুলছে সেই ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়ছে তানজিনার ফর্সা ও নগ্ন পায়ে।
আবার তানজিনা তার কোমল পা পুকুরের জলে ধাক্কা দিয়ে যে ঢেউ তুলছে তা ক্রমশ সারাপুকুরে সুখের বুদ্বুদ তুলে একসময় আছড়ে পড়ছে রায়হানের খালি পায়ে।
এভাবে চুমুর মত ছোট ছোট ঢেউ বিনিময় করতে করতে তারা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এল। দুজনে দুজনার পা-ছোঁয়া পানি গায়ে মেখে পরস্পরের প্রেমে না পড়ে পারল না।
মরে আসছে বিকেলের রঙ। সূর্যের তির্যক আলো লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে কাকচক্ষু পুকুরের জলে। রোদে পোড়া বিকেল ক্রমশ জুড়িয়ে আসার গন্ধের সাথে সদ্য প্রেমে পড়া এই দুই যুবক যুবতীর গন্ধে বাতাস হয়েছে আকুল।
তানজিনা বলল, এই বলো না আমার কী তোমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে?
তোমার ফিগার! রায়হান বলল।
অসভ্য! ঠিক করে বলো?
তোমার নাক।
মানে?
সত্যি, মাস্ক পরেও তুমি যে নাকটা বের করে রাখো, এত সুন্দর নাক আমি আমার জীবনে দেখিনি!
দুষ্ট! বলে তানজিনা আবার বলল, এখন উঠতে হবে। আমাকে ডাকছে, আমরা এখন শহরে ফিরে যাব।
হুম, আমরাও ব্যাক করব।
বাই তাহলে?
বাই। ফোন দিও।
দুই
রাত দশটা। তানজিনা আর রায়হান কথা বলছে ফোনে। তানজিনা বলল, জানো রায়হান সেদিনের পর থেকে আমি না তোমার মত মাঝে মাঝে নাক ঢেকে মাস্ক পরার অভ্যাস করছি। কিন্তু আমার বড় ভাই দেখলে খুব রাগ করে। বলে, মাস্ক পরবি ঠিক আছে, নাকও মাস্কে ঢুকিয়ে রাখছিস, কী ব্যাপার, এই বদ অভ্যাস কবে থেকে ধরেছিস? খবরদার নাক ঢাকা মাস্কে যেন তোকে আর না দেখি!
শুনে রায়হান বলল, আমার অবস্থা তো আরও খারাপ। সেদিনের পর থেকে আমিও তোমাকে মনে করে মাঝে মাঝে মাস্ক পরে নাক বের করে রাখি। আজ সকালে বাবা আমাকে এভাবে নাক খোলা রেখে মাস্ক পরতে দেখে খুব রাগ করেছেন। বলেছেন, আর কোনোদিন এভাবে মাস্ক পরতে দেখলে ঘর থেকে বের করে দেবেন।
সে রাতে তাদের কথা আর তেমন জমল না। দুজনেই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ঘুমাতে গেল।
তারও অনেকদিন পর রায়হানের বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা শুরু হলো। রায়হানের বাবা রায়হানকে ডেকে বললেন, তোর কি কোনও পছন্দ আছে? রায়হান কিছু না বলে মাথা নিচু করে রাখল। ঘটনা বুঝতে পেরে তিনি বললেন, ঠিক আছে তোর মায়ের সাথে কথা বল। রায়হানের মা সব শুনে তানজিনাদের খবরাখবর নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
অন্যদিকে তানজিনাও বড় ভাইকে তার পছন্দের কথা জানিয়ে দিল। শুনে তানজিনার ভাই বললেন, ঠিক আছে রায়হানের ঠিকানা দে। খোঁজখবর করি। তানজিনা ঠিকানা বলল।
কয়েকদিন পরে। রাতের খাবার খেয়ে রায়হানকে ডেকে পাঠালেন তার বাবা। বললেন, তোমাকে আমি খুব বিবেচক ছেলে বলেই ভাবতাম।
রায়হান ভয়ে ভয়ে তাকাল বাবার দিকে। তিনি বলছেন, তুমি কী করে 'নাক খোলা মাস্ক' পরিবারে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে? আমি বেঁচে থাকতে এই বিয়ে কিছুতেই হবে না।
কাছাকাছি সময়ে তানজিনাদের বাসার চিত্রও মোটামুটি একই। তানজিনার বড় ভাই জানিয়ে দিলেন, এরকম নাক মুখ ঢেকে যারা মাস্ক পরে সেরকম পরিবারের সাথে সম্পর্ক তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না।
তারপর কিছু দিন সব চুপচাপ। একদিন ভোরে ভোরে পালিয়ে গেল রায়হান ও তানজিনা। একটা বড় ব্রিজের উপর থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়ার সিদ্ধান্ত তাদের। সেখানেও বাঁধল বিপত্তি। তারা নদীতে লাফিয়ে পড়ল ঠিকই। কিন্তু সাঁতার জানার কারণে কেউই ডুবে গেল না। দুজনেই স্রোতের অনুকূলে সাঁতরাতে লাগল। সাঁতরাতে সাঁতরাতে তারা একসময় অচেতন হয়ে গেল।
তিন
সেদিন শহর থেকে অনেক দূরের একটি গ্রামের নদীর ঘাটে অচেতন দুটি যুবক যুবতিকে পড়ে থাকতে দেখা গেল। খবর পেয়ে গ্রামের লোকেরা এসে তাদের সুস্থ করে তুলল। যুবক যুবতি ঘটনা খুলে বলল। গ্রামবাসী বিয়ের ব্যবস্থা করল সে রাতেই।
তানজিনা ও রায়হানের বিয়ে হয়েছে একটু আগে। তাদের জন্য ছোট্ট একটা কুঁড়েঘরে বাসর সাজানো হয়েছে। টকটকে লালশাড়ি পরে গাঁদাফুল ছড়ানো বিছানায় বসে আছে নতুন বউ তানজিনা। একটু পরে টিনের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল রায়হান। গায়ে জামাইদের পাঞ্জাবি।
রায়হান পাশে এসে বসতেই ঘোমটা আরেকটু টেনে নিল তানজিনা।
কী ভাবছ? রায়হান বলল।
জানি না।
না জানা ভালো। ভালো হলো এখানে মাস্কের কোনো কারবার নেই। সবাই বলল এখানে কোনও ধরনা-ফরনাও নেই!
হুম।
মাস্কও নেই। নাক ঢাকা-খোলার ব্যাপারও নেই!
হুম।
চলো কিছুদিনের জন্য সব ভুলে যাই!
চলো। বলল তানজিনা। রায়হান লক্ষ করল, তানজিনার মিষ্টি কণ্ঠস্বর ঘন হয়ে এসেছে।
সদ্য বিবাহিত বউয়ের ঘোমটা সরিয়ে দিল রায়হান। এই প্রথম ভারি মিষ্টি একটা চাঁদ দেখল সে। আকাশের চাঁদের সাথে এই চাঁদের একটা পার্থক্য আছে। এই চাঁদ ধরা যাবে। নিজে এসে লুটিয়ে পড়বে বুকে।
রায়হান বিছানার কাছে রাখা হারিকেনের আলো নিভিয়ে দিল। তারপর নতুন কাপড়ের খসখস শব্দের সাথে মিশে গেল তানজিনার মিষ্টি কণ্ঠে উচ্চারণ করা 'অসভ্য' শব্দটি। সেইসব শব্দ সুখের অন্যান্য নাম হয়ে ভেসে গেল এই নিঝুম রাতে।
আপনার মন্তব্য