অনাবাসী: দেশহীন মানুষের গল্প

 প্রকাশিত: ২০২১-০৩-২২ ২২:২৭:২৭

সঙ্গীতা ইয়াসমিন:

‘দেশহীন মানুষ’ শব্দটা শুনলেই বুকের ভেতরে একটা মোচড় দিয়ে ওঠে; সাতশো বিলিয়ন মানুষের এই পৃথিবীতে জাতভেদে-অঞ্চলভেদে কত ভাগ, সীমারেখা, তার কাঁটার বেড়া, স্বাধীনতা, পরাধীনতা । যুদ্ধবাজ রাজ-রাজাদের দখলদারিত্ব আর আগ্রাসনের ফলে সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই এই পৃথিবীতে রয়েছে হানাহানি, মারামারি, রক্তারক্তি। রোহিঙ্গা নির্যাতনের ইতিহাসও মানব ইতিহাসে নির্যাতনের এক দীর্ঘ আখ্যান।

‘অনাবাসী’ ঔপন্যাসিক মো. রেজাউল করিম রচিত একটি ইতিহাসভিত্তিক রচনা। যার প্রেক্ষাপট রোহিঙ্গাদের বাস্তুহারা জীবন এবং সময়কাল ১৯৭৮ থেকে ২০১৩। দীর্ঘ সময়ে রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকবার দেশ ছাড়া হতে হয়েছে, এমনকি নিজদেশ বার্মায় প্রতিদিন নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের জীবন দিতে হয়েছে বিনাদোষে, আবার প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়েও গিয়েছেন লক্ষ লক্ষ পরিবার। এই চিত্রে উঠে এসেছে বার্মার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপট, সামরিক জান্তার কর্মকাণ্ড, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তায় বাংলাদেশের ভূমিকার কথা। ‘অনাবাসী’কে গল্প বলা সমীচীন নয়, কেননা এর অনেককিছুই ইতিহাসের সত্যাংশ বলে আমরা অনেকেই জানি। আবার এটি গল্পের ঢঙেই এগিয়েছে একথা বললেও মিথ্যে বলা হয় না। তবে, এটি মূলত জাতিগত দাঙ্গার একটি দুর্বিষহ স্থিরচিত্র, কিছু ক্ষমতাহীন মানুষের মার খাওয়ার নির্মম জীবনালেখ্য।

কেবল ধর্মের দোহাই দিয়ে বৌদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বার্মার সামরিক সরকার ১৯৬২ সাল থেকেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়, কেড়ে নেয় ভোটাধিকারও।স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হতে হয় রোহিঙ্গাদের, সাথে যুক্ত হয় সরকারী তত্ত্বাবধানে নির্যাতন-অত্যাচার, চলাচলে বিধিনিষেধ, তাঁরা স্বভূমে হয়ে থাকেন পরবাসী। খানা তল্লাশি চালিয়ে যুবকদের গ্রেপ্তার, এবং যুবতীদের তুলে নিয়ে যাওয়া, বৃদ্ধদের গুলি করে হত্যা, এসবই ছিল শত শত বছরের বাপ-দাদার দেশে রোহিঙ্গাদের নিত্য উপহার।তাঁদের অপরাধ, তাঁরা আরব ও বাঙালি বংশোদ্ভূত আরাকানি মুসলমান।

রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের এই গল্প পড়তে গিয়ে বার বার অন্তরের তলে একটা চেনা সুর বেজে উঠেছিল যার সাথে নাসাকা বাহিনীর নির্মম নির্যাতনও হুবহু মিলে যায়। একাত্তরে এমন নির্মমতার শিকার হয়েছিলাম আমরাও। পৃথিবীর সকল নিষ্ঠুরতার ধরন বোধ করি একইরকম হয়। আর সকল অসহায়ত্বের রঙও একই হয়। লেখক তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তথ্যের ভিত্তিতে এই গল্প রচনা করলেও একজন বাঙালি হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য তাঁর অন্তর কেঁদেছিল সেই একই নির্যাতনের ছবি হয়তো তিনিও লালন করেছিলেন তাঁর অন্তরে, আর সে কারণেই ওদের বেদনার ভার বইতেই তিনি এমন রচনা করেন।

এই গল্পে মূলত কোনো প্রধান চরিত্র নেই, মোটা দাগে তিনটি পরিবারের জীবন সংগ্রাম ও তাঁদের বাঁচার লড়াইকে ঘিরেই এই গল্পের কাহিনী।এদের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার সাথে যেসব চরিত্র জড়িয়ে আছে তাঁদের মধ্যে ভিন্ন সম্প্রদায় হয়েও, কেউ কেউ আপন আলোয় হয়ে উঠেছেন উদ্ভাসিত, যা গল্পের সারবত্তা তৈরিতে গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উচি মং, নিজে বৌদ্ধ এবং সরকারি চাকরী করেও নিজের তত্ত্বাবধানে আবদেল করিম এবং হাশিমের (মুসলিম) পরিবারকে রাতের আঁধারে বাংলাদেশ পালিয়ে যেতে বার্মার সীমান্তে নিরাপত্তা সহায়তা করেছেন, অথচ, শহরজুড়ে তখন ছিল কারফিউ এবং খানা তল্লাশি। উচি মং অতিরিক্ত ফোর্স দিয়ে আবদেল করিমের বাড়িতে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছিলেন।

আরেকজন থুরামন, আব্দেল করিমের কন্যা রুখসানার স্বামী, যে একসময় রুখসানার গৃহশিক্ষক ছিলেন। এই যুবক নিজে বৌদ্ধ-বামার সম্প্রদায়ের হয়েও রুখসানাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। নিজ ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে নিজের শহর ছেড়ে, চাকরি ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ ত্রিশ বছর ছিলেন অনেকটা গৃহবন্দি জীবনে সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে। তবুও স্ত্রী-সংসার নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুখেই কাটিয়েছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মুসলিম হয়েও রেহাই পেলেন না তিনি। তাঁকে মরতে হয়েছিল সেই রোহিঙ্গাদের হাতেই।

ধর্মের বিষ এবং সাম্প্রদায়িক হিংসার চেয়ে কোনো বিষধর সাপের বিষও বিষাক্ত হতে পারে না, মানুষের ওপর ছোবল হানতে। যেকোনো যুদ্ধেই নীরিহ জনতারাই দুর্দশার শিকার হন। রাজ-রাজারা কেউ জেতেন, কেউ হারেন। নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ সাধারণ জনগণই চিরকাল রাজনীতির-দাঙ্গার-হিংসার নিষ্ঠুর বলি হয়েছে এই গল্পও তারই সাক্ষ্য বহন করে। আবার সাধারণ মানুষই ভালোবেসে জাত-ধর্ম ভুলে মানুষের পাশেই দাঁড়িয়েছে চিরকাল, এই সাধারণেরাই অসাধারণ গুণাবলী দিয়ে জগতকে আলোকিত করেছেন চিরকাল এও সত্য। এই দুটি চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে লেখক প্রকারান্তরে সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন।

ইতিহাস নির্ভর এই গল্প কেবল পাঠককে পাঠমুগ্ধই করবে না এর গবেষণামূল্যও রয়েছে বলে বিশ্বাস করি। লেখকের বহুমুখী পাঠ ও গবেষণার ফসল এই অনাবাসী, তিনি এমন চমৎকার উপস্থাপন কৌশলে নিপুণ হাতে চিত্রায়ন করেছেন যাতে এই গল্পের বাস্তব ভিত্তি রয়েছে এবং সেটা সত্যের অনেক কাছাকাছি একথা বুঝতে পাঠকের অসুবিধে হয় না। এই গ্রন্থের এটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক।

শুরু থেকে গল্প খানিকটা ধীর গতিতে এগোলেও শেষের দিকে আরএসওর তত্ত্বাবধানে বার্মার পুলিশ বাহিনীর যুদ্ধের যেসব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তা নিতান্তই লোমহর্ষক এবং পাঠককে সন্দেহাতীতভাবে সম্মুখ সমরে নিয়ে যাবে। যুদ্ধ বর্ণনার এই অংশেও ঢাকা শহরের গেরিলা বাহিনীর যুদ্ধের সাথে মিল পাওয়া যায়। যা পাঠককে আবেগমথিত করবে এবং সহ সম্পর্ক তৈরিতে সহায়তা করবে।

গতিধারার ব্যানারে ১৩৬ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি মনোরম প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে। চমৎকার প্রচ্ছদটি এঁকে এর বাহ্যিক সৌন্দর্যের উৎকর্ষতা বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রচ্ছদ শিল্পী সিকদার আবুল বাশার। ‘অনাবাসী’ ইতিহাসপ্রিয়, বোদ্ধা পাঠকের মনের খোরাক যোগাবে নিঃসন্দেহে। অনাবাসী পাঠক প্রিয়তা পাক এবং লেখক রেজাউল করিমের সাহিত্য সাধনা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করুক সেই শুভ প্রত্যাশা করছি।

আপনার মন্তব্য