গাছের কথা, মনের কথা

 প্রকাশিত: ২০২১-০৪-১৪ ২০:৪৩:১০

ঋতশ্রী দে:

আজকাল বাগানের গাছগুলোর দিকে তাকাতে খুব ভালো লাগে। কেন জানি না। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি এই গাছগুলোকে। কিন্তু কোনোদিনও এত আগ্রহ নিয়ে তাকানো হয়নি গাছগুলোর দিকে। বাগানের প্রত্যেকটা গাছ আমার মায়ের হাতে লাগানো।

আমার মা গাছ লাগাতে খুব ভালোবাসেন। তাই নিজের ভালোলাগা থেকেই বাগানে আম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ধরণের ফলের গাছ লাগিয়েছেন। এছাড়াও আমাদের উঠানের সামনে গেটের দুদিকে আছে দুটি শিউলিফুলের গাছ। আর বুদ্ধিজীবী নিম গাছটি উঠোনের একপাশে বাগানের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নিম গাছের পাশেই হলো আতাফলের গাছ। যদিও আতা গাছে তোঁতা পাখি দেখার সৌভাগ্য হয়নি এখনো। হবেইবা কি করে? এতোদিন ভালো করে লক্ষ্যই করিনি গাছের দিকে। হয়তো এসেছিলো তোতা পাখি আমিই খেয়াল করিনি।

আতা গাছের পাশেই আছে কামরাঙা গাছ। আমাদের বাড়িতে বেলেম্বু গাছ দুইটি। একটি হলো বাগানে আরেকটি হলো বাড়ির পিছনের দিকে। বাড়ির পিছনের দিকের বেলেম্বু গাছটিতে একেবারে নিচ থেকে বেলেম্বু ধরে। মা মাঝে মাঝে বেলেম্বু দিয়ে টক রান্না করেন। এছাড়াও আমাদের বাড়িতে আছে তিনটি নারকেল গাছ। আর আম-কাঁঠাল গাছের কথা তো বললামই।

সারা বাড়িতে অনেক ছোটো ছোটো ফুলের গাছ আছে। যেহেতু আমাদের বাড়িটা চারকোণা তাই বাড়ির চারদিকে অনেক পাতাবাহার সহ কচু গাছ, রুঝনটো পাতার গাছ আছে। গাছপালা নিয়ে কোনদিনও এর আগে এরকম ভাবা হয়নি। কিন্তু আমার বাবা আমাকে সবসময় বলেন, “গাছকে দেখো, গাছের পাতা গিয়ে ধরো, গাছের পরিচর্যা করো, গাছের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো”।

তখনি আমার মনে একটু খটকা লাগে। গাছের সঙ্গে কথা! আমি জিজ্ঞেস করলাম, “গাছের সঙ্গে আবার কথা বলা যায় নাকি”? বাবা তখন বললেন, “গাছেরও প্রাণ আছে। কথা বলা যাবে না কেন, চাইলেই যায়। গাছ তো মানুষের মতো কথা বলবে না। গাছকে দেখেই তার মনের কথা অনুভব করে নিতে হয়”। বাবার এতো জোরাজোরিতে ভাবলাম ঠিক আছে সকালবেলা এখন থেকে উঠোনে গিয়ে দাঁড়াবো কিছুক্ষণ।

সেদিন সকালবেলা উঠে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করার পর ভাবলাম যাই একটু উঠোনে, গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাগানের গাছগুলোকে দেখে আসি। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার কারণে আর বেশি কিছু না ভেবে চট করে উঠোনে চলে গেলাম। তারপর বেশ কিছুক্ষণ উঠোনে দাঁড়ানোর পর হুট করে আমার চোখ পড়লো কাঁঠাল গাছের পাতার উপর। দেখলাম রোদের সোনালী আলো কাঁঠাল পাতার ওপর কি সুন্দর ঝিকমিক করছে। তখন আমি কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছিলাম তাই গানের সঙ্গে এ দৃশ্যটি আমার কাছে ভালোই লাগলো। সে সঙ্গে আমার ক্লান্তি ভাবটাও কেটে গেলো। তারপর আস্তে আস্তে আমি বাগানের বাকি গাছগুলোর দিকেও ভালো করে লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম। দেখলাম আমাদের আম গাছের ডালে একটা সুন্দর নীল পাখি এসে বসেছে। পাখিটা কি সুন্দর করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলো। রোদের কড়া আলোর নিচে দাঁড়িয়ে, আমার চারপাশে সকালের শীতল বাতাসের স্নিগ্ধ ছুটাছুটির মাঝখানে এই সুন্দর দৃশ্যগুলো দেখতে আমার বেশ ভালোই লাগছিল। যাহ! গান বন্ধ হয়ে গেলো কেন? এইতো দিব্যি বাগানে হেঁটে হেঁটে মায়ের ফোন দিয়ে গান শুনছিলাম। ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বিদ্যুৎ চলে গেছে তাই ওয়াইফাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে গানও বন্ধ হয়ে গেছে। মনটা কিছুক্ষণের জন্য একটু খারাপ হয়ে গেলো। কারণ, হেঁটে হেঁটে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনা আমার অনেকদিনের অভ্যাস। আর গান ছাড়া উঠোনে খালি খালি দাঁড়িয়ে কিইবা করবো।

এমন সময় বাবা এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন। তখন বাবাকে বললাম তোমার ফোনটা এনে দাও তো বাবা। কারণ বাবার ফোনে কিছু গান ডাউনলোড দেয়া আছে তাই ইন্টারনেট ছাড়া শোনা যাবে। তখন বাবা বললেন, “এখন গান দিয়ে কি করবে, এখন উঠোনে এসেছো যখন গাছ দেখো, পাখির গান শোনার চেষ্টা করো, সবসময় ফোনে গান শুনলে শরীরও খারাপ করবে।’ তখন বাবাকে বললাম এই নিরিবিলির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে নাকি বাবা। বাবা বললেন, ‘নিরিবিলি কোথায় এই নিঃশব্দের মধ্যেও একটা শব্দ আছে, প্রকৃতির শব্দ, সেটা অনুভব করার চেষ্টা করো। তাহলেই ভালো লাগবে।’ বাবার এই কথাটা কেন জানি আমার মনে দাগ কাটলো। নিঃশব্দের মধ্যেও শব্দ আছে কথাটা তো চমৎকার।

তারপর সেদিন আমি ঘরে চলে এসেছিলাম। কিন্তু মনে আমার একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছিল। মনে হচ্ছিলো প্রকৃতি থেকে অনেক শক্তি নিয়ে ফিরেছি আমি। এরপর থেকে প্রায়ই আমি সুযোগ পেলেই উঠোনে গিয়ে বসি, গাছগুলোর দিকে তাকাই এবং এখনো আমি উঠোনের সিঁড়িতে বসে বসে লিখছি। আজকাল কেন জানি গাছের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার অনেক ভালোলাগে। কিন্তু বাগানের সবকিছুর মধ্যে কেমন জানি একটা পরিবর্তন এসেছে। শিউলি গাছের মধ্যে একটু নিচের দিকে একটা গর্ত হয়ে গেছে। গর্তটা বেশ বড়ই। আর এই সুযোগে দুষ্টু পোকামাকড়গুলোও বৃদ্ধ শিউলি গাছের গর্তে বাসা বেঁধেছে। ছোটবেলা যখন খেলতাম তখন গর্তটা ছিলো না। তারপর নিমগাছের মধ্যে দেখলাম ফাটল ধরেছে একেবারে বৃদ্ধ মানুষের চামড়া শুঁকিয়ে গেলে যেমন ফাটল ধরে ঠিক তেমনি। আসলে গাছটারও তো বয়স হয়েছে। কিন্তু আমার ভুল হলো- গাছটা আমার বাড়ির উঠোনে কড়া রোদ্দুরের মধ্যে সুন্দর ছায়া দিলেও, তার পুষ্টিগুণে ভর্তি নিমের স্নিগ্ধ বাতাস দিলেও আমি এই গাছটিকে কিছুই দিতে পারিনি। কিন্তু গাছগুলো আমার ওপর একটুও অভিমান করেনি। এতটাই উদার তাদের মন।

আমরা গাছের যত্ন না নিলেও গাছ কিন্তু ঠিকই আমাদের কতো উপকার করে। আমরা প্রতি নিঃশ্বাসে যে অক্সজিনে নেই এর প্রধান উৎস গাছরে সবুজ পাতা। গাছ বাতাস থেকে কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস শুষে নেয়। গাছে এত সুন্দর সুন্দর ফুল হয় ফল হয় কিন্তু তাতে গাছের কোনো অহংকারই নেই। সে নিঃস্বার্থভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের জন্য কাজ করে যায়। এমনকি গাছ মারা গেলেও আমরা তাকে রেহাই দেই না কাঠ দিয়ে কতকিছু তৈরি করি। এতকিছুর বিনিময়ে একটু ভালোবাসা, একটু যত্ন তো গাছের প্রাপ্যই।

আমার বাগানের গাছগুলো আমার সঙ্গেই বেড়ে উঠেছে। তারা আমার জীবনের এমন এক বন্ধু যে আমি চাই আর না চাই তারা ঠিকই যত্ন করে যায়। আর আমি তাদের এমন এক বন্ধু যে তাদের কাছ থেকে এত কিছু পেয়েও এর বিনিময়ে হয়তো দিতে পারিনি কিছুই। আজ এত বড় হয়ে তাদের গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। বাবা ঠিকই বলেন গাছেরও প্রাণ আছে। আমি যখন গিয়ে আমাদের নিমগাছটিকে ধরি, মনে হয় গাছ আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। সত্যিই গাছের সঙ্গে কথা বলা যায়। তবে সেই যোগাযোগটা হয় একটু ভিন্নভাবে মনে মনে। আমিও হয়তো এই কয়েকদিনে গাছের মনের সঙ্গে নিজের মনকে একটু জুড়তে পেরেছি। তাইতো আজ এই বন্ধুকে নিয়ে গল্প লিখতে বসেছি আমি। শহরের এই আধুনিকতার ছোঁয়া, ইন্টারনেট ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ভিড়ে হয়তো আমিও আটকে আছি। তাইতো প্রকৃতির এই স্নিগ্ধ, নির্মল ভালোবাসাকে বুঝতে পারিনি আমি। এখন মনে হয় ঘরে বসে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শোনার থেকেও হয়তো গাছের মনের গান শোনা অনেক আনন্দের। কিন্তু বাবা যদি আমাকে জোর করে উঠোনে যেতে না বলতেন আর আমার মা যদি বাড়ির মধ্যে এই সুন্দর বাগানটি না করতেন তাহলে হয়তো আমি এসব বুঝতাম না।

আমি আমাদের এই শিউলি ফুলের গাছটির মতো উদার হতে চাই, নিজের প্রজ্ঞায় স্থান দিতে চাই অনেককে। নিমগাছের মতো অনেক বড় হতে চাই। সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই নিজের আলো। নারকেল গাছটির মতো শক্ত হতে চাই, যেন পৃথিবীর কোনো কালো অন্ধকার আমার সাদা মনে প্রভাব ফেলতে না পারে। আবার আমি তুলসীগাছের মতো নমনীয় হতে চাই। নির্মল বাতাসের সঙ্গে নিজেও আনন্দে দুলতে চাই।
 
আমি সুযোগ পেলেই এখন গাছের সঙ্গে কথা বলি। গাছের কথা আর আমার মনের কথা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গাছকে স্পর্শকরে তার উষ্ণতা নেই। তারও যে প্রাণ আছে, নির্মল প্রাণ।
লেখক : ঋতশ্রী দে, শিক্ষার্থী।

আপনার মন্তব্য