ঘরকুনো সরফুদ্দীন

 প্রকাশিত: ২০২১-০৮-২৫ ২২:১০:১৮

এখলাসুর রহমান:

জানালার ফাঁক গলিয়ে বাতাস আসছে। প্রচণ্ড বাতাসে নড়ছে আলনার রক্ষিত কাপড়। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে ঘরের মেঝে। বজ্রপাতের শব্দে আতঙ্কিত চারদিক। দোতলায় বসে থেকে সরফুদ্দীন দেখে রাস্তাঘাট ফাঁকা। মাঠ দিয়ে শুধু একজন দৌড়ে আসছে। সরফুদ্দীন অবাক হয়। লোকটার কি ভয়ডর নেই? এমন দিনে কেউ ঘরের বাইরে বেরোয়। তার পরনে ধূতি পাঞ্জাবি। আরে লোকটাতো ওদিকেই আসছে। হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকছে। কে ও? কার কাছে আসছে। এই হাসপাতালেতো সরফুদ্দীন-সায়মা ও খায়রুজ্জামান-শরীফা এই চারজনই থাকে। এখানে দুটি পরিবার দুদিকে থাকে। দুই পরিবারের দুই দরোজা মুখোমুখি। একটিতে কেউ নক করলে আরেকটিতে ভ্রম হয়।

বসনপুরের এই হাসপাতালটিতে কোন ডাক্তার থাকেনা। সরকারি অফিস সময়ে নিয়মিত কেউ বসেও না। নাইটগার্ড ও আয়ারা বদলি লোক দিয়ে নিজেরা নিজেদের পারিবারিক কাজ করে। তারা মাসে এক দুইবার মন চাইলে অফিসে আসেতো আসেনা। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় কোন চিকিৎসক নেই। অথচ সরকারি কোষাগার হতে এই হাসপাতালটি নির্মাণে কোটি টাকা খরচ হয়েছে। ওটি রুম, ডাক্তারের রুম, প্রশিক্ষণ রুম খাঁ খাঁ করছে। হাসপাতালটির পরিদর্শিকা শরীফা না থাকলে এটি একটি ভূতুড়ে বিল্ডিংয়ে পরিণত হতো। তিনি হাসপাতালের দোতলাতেই থাকেন। প্রতিদিন মানুষ ছুটে আসে ডাক্তারের খোঁজে ও ওষুধ নিতে। কিন্তু এখানে কোন ডাক্তার নেই। শরীফা খাতুন একাই হাসপাতালটির সব দায়িত্ব পালন করে। একজন দিয়ে কি একটি সরকারি হাসপাতাল চলতে পারে? সরফুদ্দীনকে ডাক্তার ভেবে অনেকেই দরোজায় নক করে। বলে, স্যার, আমি অসুস্থ। আমারে কিছু ওষুধ দেন।

সরফুদ্দীন বলে, আমি ডাক্তার না ও এই হাসপাতালের কেউ না। আপনি পশ্চিমের দরোজায় নক করেন। দেখেন, শরীফা আপা আছে কিনা। বারবার দরোজার খটখট শব্দে সরফুদ্দীন মাঝেমাঝে খুবই বিরক্ত হয়। অযথা প্রায় সময়ই তাকে দরোজা খুলে এসব রোগীদের সাথে কথা বলতে হয়। তবে কি ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে যে লোকটা হাসপাতালে এলো সে একজন রোগী? কিন্তু তার দৌড়েতো তাকে রোগী মনে হয় না। বসনপুর হাসপাতালে আরেকধরনের রোগী প্রায়ই আসে। তারা হলো প্রসূতি মাতা। সন্তান ডেলিভারি করানোর জন্য তারা শরীফাকে খুবই নির্ভর করে থাকে। আর শরীফার দায়িত্বও এটাই। ওষুধ দেয়া ও চিকিৎসা করা তার দায়িত্ব নয়। অথচ ডাক্তার খোঁজে প্রতিদিনই তার কাছে লোকের ভিড়। শরীফা গভীর রাতে ঘুমিয়ে গেলেও দরোজার খটখট শব্দে জেগে উঠতে হয়। তারা চেঁচিয়ে বলেন, আপা, দরোজা খুলেন। আমরা ডেলিভারির রোগী নিয়ে এসেছি। তাড়াতাড়ি দরোজাটা খুলেন। এমন ডাক প্রথমরাত, মধ্যরাত, শেষরাত ও ভোর রাতেও শোনা যায়।

মায়েদের প্রসূতি সেবার দিক থেকে বসনপুর হাসপাতালটির বেশ সুনাম রয়েছে। শ্রেষ্ঠ প্রসূতি মাতা সেবিকা হিসাবে শরীফাকে পুরস্কারও দেয়া হয়েছে। সরফুদ্দীন যে ইউনিটটিতে থাকে আগে সেটা প্যাঁচার আস্তানা ছিলো। ভাঙা জানালা গলিয়ে রাতের প্যাঁচারা ওখানে আশ্রয় নিতো। এই ভূতুড়ে বিল্ডিংটিতে কারো একা থাকা সম্ভব নয়। শরীফার স্বামী খায়রুজ্জামান প্রায়ই ব্যবসায়িক কাজে বাইরে থাকে। ছোট ভাই উল্লাসও থাকে দোকানে। সে ক্ষেত্রে শরীফা কি করে এই বিল্ডিংয়ে একা থাকে? এ ছাড়াও রয়েছে রাতের প্যাঁচাদের বীভৎস চিৎকার। এদের চিৎকারে রাতে ঘুমানোর সুযোগ নেই। এমন ভূতুড়ে বিল্ডিংয়ে কি একা থাকা যায়? শরীফা বিষয়টা অফিসকে জানালো। বলল, আরেকটি পরিবারকে উঠানোর সুযোগ দিলে আমি এখানে থাকতে পারি। একা একা থাকা কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তবে আমি কাউকে উঠালেও নিরিবিলি নির্ঝঞ্জাট কোন ০১৭ কোড পরিবারকেই উঠাবো।

হাসপাতালের কর্মকর্তা জুলমত আলী বলল, ০১৭ কোড পরিবার মানে?

শরীফা বলল, আমাদেরও সন্তান নেই এখানে উঠাবোও এমন একটি পরিবারকে যাদের সন্তান নেই। আমরাই ০১৭ কোড পরিবার।

জুলমত আলী হেসে বলল, যাদের সন্তান নেই তারা কি ০১৭ কোড? খুব মজার কথা বললেনতো শরীফা! ঠিক আছে হাসপাতালটি চালু করা দরকার। উঠিয়ে নিন এমন কোন ০১৭ কোড ফ্যামিলিকে।

সেই থেকে বসনপুর হাসপাতালে আস্তানা গাড়লো সরফুদ্দীন। স্ত্রীর চাকরির সুবাদে এখানে থাকা। সরফুদ্দীনের স্ত্রী চাকরির কাজে বাইরে যায় আর সে সারাদিন দরোজা লাগিয়ে ভাবনার ঘোরে বসে থাকে। লিখে কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ। এ যেন তার ঘরে বসে রাজা উজির মারা। নিরিবিলি একাকী থাকাটাই তার পছন্দের। ইন্টারনেট প্রযুক্তির প্রসারে এখন ঘরে বসেই বিশ্বের সবকিছু জানা যায়। আর একে সহজলভ্য করেছে ফেসবুক, টুইটার। এসব সোশ্যাল মিডিয়া এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইলে। ঘরে বসেই টিভির খবর ও সকল সংবাদপত্রের খবর পড়া যায়। কমে গেছে মানুষের টেলিভিশন ও মুদ্রিত পত্রিকার প্রতি আগ্রহ। কোন কিছু ঘটলে পত্রিকায় মুদ্রিত হওয়ার আগেই তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হয়ে যায়। এই মাধ্যমটিই এখন সংবাদকর্মীদেরও নির্ভরতার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠছে অন্যতম তথ্যঘর।

সরফুদ্দীনকে আশপাশের সকলেই ঘরকুনো ভেবে থাকে। এজন্য কেউ কেউ তাকে বাঁকা দৃষ্টিতেও দেখে থাকে। আসলে এই লোকটা কী? কাজকর্ম নেই সারাদিন ঘরে বসে থাকে! কিন্তু আসলে কি তাই? সে কি কোন কাজই করে না? সে কি কেবলই একটি অকর্মা ঘরকুনো ব্যাঙ? চাষি হালচাষ করে ক্ষেতে। শ্রমিক কারখানায়। এ ক্ষেত্রে কবির কর্মক্ষেত্র কোথায়। একজন গল্পকারের কর্মক্ষেত্র কোথায়। বসনপুরের মানুষ তাকে কুনোব্যাঙই ভেবে চলেছে। সারাদিন ঘরে বসে থাকলে এছাড়া আর কী বলা যায় তাকে? সে ঘরে মাঝেমধ্যে উল্লাস আসে। ও খায়রুজ্জামানের শ্যালক ও শরীফার ছোট ভাই। উল্লাস সরফুদ্দীনকে বলে, দুলাভাইতো ঘরেই থাকেন।

সরফুদ্দীন মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ আমি ঘরেই থাকি। বলতে পারো ঘরকুনো ব্যাঙ। তবে আমি কিন্তু একলাই কুনোব্যাঙ না। একজন ডাক্তারও সারাদিন তার চেম্বার ঘরেই বসে থাকে। একজন দোকানদারও তাই। দোকানের বাইরে যায় কেবল খাওয়া, বাথরুম আর গোসলের জন্য। কিংবা দোকানের মাল ফুরিয়ে গেলে চালান আনতে। ডাক্তার বসে বসেই রোগী দেখে। দোকানদার দোকানের মাল বেচে। দোকানদার মালের চালান আনতে বাইরে যায় ডাক্তার যায় নিজের ও রোগীর প্রয়োজনে। এক্ষেত্রে দোকানদারের চালান যদি অটো দোকানে এসে যেতো তারা কি বাইরে যেতো? ডাক্তারের বাথরুম, গোসল কিংবা রোগীর প্রয়োজন না হলে কি তারা বাইরে যেতো? আসলে ডাক্তার, জজ, বিজ্ঞানী ও গবেষক সকলেই ঘরেই চর্চা করে। আর তাদের এই ঘর চর্চা কর্মই বাইরে যায়।

সরফুদ্দীন লেখে। লেখাটাই তার কর্ম। আর এই কর্মটি ঘরে বসে সারতে পারলে তার বাইরে যাওয়ার কী যুক্তি? সে মনে করে একজন দোকানদার যেমন মালের প্রয়োজনে বাইরে যায়। একজন লেখকও বাইরে যাবে লেখার উপাদান সংগ্রহের জন্য। সরফুদ্দীন উল্লাসকে বলে, লেখার প্রয়োজন হলে আমি বাইরে যাই। নইলে যাই না। যেমন ডাক্তার, জজ ও দোকানদাররা তাদের প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যায় না। আমিও তাই। উল্লাস সরফুদ্দীনের কথা শুনে হাসে। হাসতে হাসতে কাশি উঠে যায় তার। সরফুদ্দীন বলে, এই যে তুমি কাশছো এখন নিশ্চয়ই তুমি ঠাণ্ডা লাগাবে না। বৃষ্টিতে ভিজবে না। কাশির ওষুধ কিনতে ডাক্তারের কাছে ছুটবে। কিন্তু ওই ডাক্তার ব্যাটাও কুনোব্যাঙের মতো ঘরেই বসে থাকে। পৃথিবীর যতো দার্শনিক গবেষক সকলেই কিন্তু চর্চা করে ঘরে বসেই। মানুষের আসল ঠিকানা ঘর। ঘরকে সাজানোর প্রয়োজনেই সব মানুষ বাইরে যায়। যদি বাইরে না গিয়েও ঘর সাজাতে পারতো তাহলে কেউ কি বাইরে যেতো?

উল্লাস অবাক হয়ে বলল, সেটা কীরকম দুলাভাই?

সরফুদ্দীন বলল, তোমার শরীফা আপা ঘর হতে বাইরে গিয়ে স্কুলে পড়েছে কেন? নিশ্চয়ই ঘর সাজাতে নাকি? আমার স্ত্রী সায়েমা এখানে চাকরি করে কেন? নিশ্চয়ই নিজের বাড়ির ঘর সাজাতে, নয় কি? খায়রুজ্জামান ঘর ছেড়ে দোকানে বসে থাকে কেন? দোকান ঘর হতে চালানে যায় কেন? নিশ্চয় দোকান ঘর সাজাতে। আর দোকান ঘর সাজায় নিজ বসতঘর সাজাতে। উদ্দেশ্য ঘরের সিন্ধুকে টাকা থাকবে। দামি আসবাব পত্র থাকবে। ঘরের আলনায় দামি কাপড়চোপড় থাকবে।

উল্লাস অবাক চোখে সরফুদ্দীনের দিকে তাকায় আর কথা শুনে। ভাবে, কী অবাক ঘরকুনো লোক এই সরফুদ্দীন। সরফুদ্দীন একটু থেমে বলল, মানুষের জীবনেও ঘর, মরণেও ঘর। শীতের রাত্রিতে কম্বলের ওম ছেড়ে মুসল্লিরা ঘর ছেড়ে মসজিদে যেতে বাইরে বেরোয় কেন? সেটাও ঘরের জন্যই নয় কি? মরার পরেও তাকে মাটির ঘর বানিয়ে কবর দেয়া হবে। সেই কবরে সুখে শান্তিতে থাকার জন্যই তাদের বাইরে বেরোনো নয় কি? সরফুদ্দীন কথা বলে তাই ঘরের জানালার সাথে। দরোজার সাথে। জানালা খুলে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। চাঁদ দেখে। তারা দেখে। সূর্য দেখে। বাইরের প্রকৃতিকে চোষণ করে সেই ঘরের ভিতর নিয়ে আসে। এই হাসপাতালে সরফুদ্দীনের সাথে উল্লাস ছাড়া কারও সাথে তেমন কোন কথা হয় না। খায়রুজ্জামান কেবল বাসায় খেতে আসে আবার চলে যায়। এখানে যেই আসে সেই সরফুদ্দীনের ঘরে থাকা নিয়ে সমালোচনা করে।

কী আশ্চর্য ঘরকুনো লোকরে বাবা!

সরফুদ্দীন মাঝেমধ্যে বিকেলে ঘর হতে বাইরে বেরোয়। হেঁটে হেঁটে মতিয়া খালীবাজার যায়। দেওয়ানবাড়ির মোড় কিংবা ছত্রকোনা মোড় পর্যন্ত যায়। মাঝেমাঝে ময়মনসিংহ ব্রিজ পাড় হয়ে বিয়াশীর মোড় পর্যন্তও যায়। সরফুদ্দীনের কেন এই বাইরে হাঁটা। ঘরে সুস্থ থাকার উদ্দেশ্যে নয় কি? ঘরকুনো সরফুদ্দীন ঘরে অসুস্থ থাকতে চায় না। কারণ অসুস্থ হলে আর ঘরে থাকতে পারবে না যেতে হবে হাসপাতালে। কিন্তু সরফুদ্দীন শুধু ঘরেই থাকতে চায়। ঘরে থেকেই মরতে চায়। পৃথিবীর ঘর ছেড়ে কবরের ঘরে যেতে চায়। ঘরই তার ধ্যানজ্ঞান। ঝড় বৃষ্টিতে একাকী বসে বসে সরফুদ্দীন তার একাকীত্ব নিয়ে ভাবছিলো। বসনপুরের মাঠ বেয়ে বেয়ে জল গড়াচ্ছিলো। দৌড়ে আসা লোকটা হাসপাতালের গেটে বসে ভিজে জবুথবু হয়ে গিয়েছিল। ঝড় বৃষ্টি থামছে তবু লোকটা বসেই আছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে না। বসনপুরের একটি ছোট্ট শিশু লোকটাকে দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক লোক জমে গেল হাসপাতালে। একজন চেঁচিয়ে উঠলো, এই লোকটা, গলা কাটা! গলা কাটা!

কই গলা কাটা, কই ধর ধর...সব মানুষ তেড়ে এলো। লোকটা অসহায়ের মতো কী জানি বলতে চাচ্ছিলো। কেউ তার কথা শুনলো না। সকলই একযোগে তাকে কিল ঘুষি ও লাথি মারতে থাকে। মানুষের ধর ধর চিৎকার ও লোকটার আর্তনাদে হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। লোকটা মার খেতে খেতে কান্নার শক্তিও হারিয়ে ফেললো। পুরো শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলো। সরফুদ্দীন বাইরে গিয়ে দেখলো। কিন্তু কিছু বলতে পারলো না। বলতে পারলো না, থামুন, লোকটাকে মারবেন না। গণপিটুনির নেশা ভারী কড়া নেশা। মার খেতে খেতে লোকটা মরে গেল। সরফুদ্দীন ভাবে, কে এই লোকটা? কেন বসনপুরে এসেছিল? সত্যিই কি সে গলাকাটা? কিন্তু যদি সত্যি না হয়? ঘরকুনো সরফুদ্দীন ঘরে এসে কেবল এটা ভাবল, কে সে? লোকটার ঘর কোথায়। কেন বাইরে এসেছিল? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর এই লোকটা ছাড়াতো আর কেউ দিতে পারে না।

ঘরকুনো সরফুদ্দীন ঘরে গিয়ে প্রশ্ন নামের একটি গল্প লিখতে বসে গেল।

আপনার মন্তব্য