বৃত্তবন্দি

 প্রকাশিত: ২০২১-০৯-২৭ ০১:৫৪:৩২

এখলাসুর রহমান:

মিরাসের মা'র বয়স পঞ্চাশের কম হবে না। পাকিস্তানের জন্ম আর ওর জন্ম একই বছর একই মাসে। মিরাসের মা'র বাবা এজাজুদ্দীন ছিলেন জিন্নাহর ভক্ত। ইংরেজদের থেকে হিন্দুদের প্রতি তার ক্ষোভ ছিলো বেশি। ওরা মুসলমানদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে ফুলে ফেঁপে বড়লোক হচ্ছে। জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার কথা বলছেন। যাকে শাসন করবে মুসলমানেরা বিজাতীয় খ্রিষ্টান কিংবা হিন্দুরা নয়। এজাজুদ্দীন মুসলিম লীগের সমর্থক বনে যায়। ওর বিশ্বাস জিন্নাহর ক্ষমতায় যাওয়া মানে ওর নিজের ক্ষমতায় যাওয়া। এতদিন ইংরেজদের সাথে খাতির জমিয়ে কী অত্যাচারটাই না করেছে তাদের উপর। এর শোধ নিতে হবে। সে জমাত আলীর কথায় ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ। এজাজুদ্দীন লেখাপড়া না জানা মূর্খ মানুষ। ধনু নদীতে যাত্রী পারাপার করে। খেয়া মাঝি। জমাত আলী প্রতিদিনই নদী পার হয়ে গঞ্জে যেতো। সে মুসলিম লীগের থানা শাখার সভাপতি। নদী পার হতো আর জিন্নাহর গুণকীর্তন করতো। পুরান বাজারে মিটিং করতো।

এজাজুদ্দীন ছিল তার নিয়মিত শ্রোতা। মুসলমানদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে হলে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গড়তে হবে। মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই। আজাদ পাকিস্তান গড়তে চাই। মিরাসের মা মা'র মুখে শুনেছে ওর যখন জন্ম হয় তখন বাবা পাকিস্তান সৃষ্টির আনন্দ মিছিলে। ঘরে স্ত্রী প্রসব ব্যথায় ছটফট করছে। এই অবস্থা দেখেও সে জমাত আলীর ডাকে চলে গিয়েছিল। ক্ষমতায় এলো জিন্নাহ। জমাত আলী রাতারাতি বড়োলোক হতে শুরু করলো। মাত্র দু বছরের মধ্যেই তার ভাগ্যের বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেল। এজাজুদ্দীন মারা গেল যক্ষ্মারোগে। বিনাচিকিৎসায়, না খেতে পেয়ে। মিরাসের মাকে নিয়ে বিধবা হলো ত্রিশোর্ধ বৈলকতের নেছা। সহায় সম্বলহীন ও কীভাবে বাঁচাবে নিজেকে এবং দুধের শিশুটিকে। জমাত আলী এগিয়ে এলো। বৈলকতের নেছাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বাঁদি রাখলো। আগেকার সময়ে বাঁদি বিয়ে বলে একটা কথা ছিল। গৃহকর্তার পছন্দ হলে এইসব বাঁদিদের সাথে স্ত্রীর মতো ব্যবহার করতে পারতো তারা। আর সেটা শুধু দৈহিক সম্পর্কের দিক থেকে। তাকে সামাজিকভাবে স্ত্রীর মর্যাদা দিতো না।

বৈলকতের নেছার এই তরফের এক ছেলে সন্তান জন্মেছিল। ও বড় হয়ে জমাত আলীকে চায়াজী ডাকতো। আব্বা বা বাবা ডাকার অধিকার পায়নি। ছেলেটা জন্মরোগা। লিকলিকে শরীর। জমাত আলী ছোটবেলা হতেই ওকে ক্রীতদাসের মতো খাটাতো। বৈলকতের নেছা ছেলের নাম রেখেছিল পচন মিয়া। যেমন নাম তেমনই স্বাস্থ্য চেহারা। পচন মিয়া আর বৈলকতের নেছার থাকার জায়গা ছিল গোয়াল ঘর। বিবির তরফের ছেলেদের সাথে তার মেলামেশার কোন অধিকারই ছিল না। এভাবেই অনাদরে অবহেলায় বড় হতে থাকে সে। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে জমাত আলীর মৃত্যু হয়। তখন মিরাসের মা পূর্ণাঙ্গ যুবতি। এ বাড়ির বড় ছেলের স্ত্রী বৈলকতের নেছাকে ডেকে নিয়ে বলল, তোমার মেয়ে বড় হয়েছে এ অবস্থায় আর থাকতে দেয়াটা উচিত নয়। তুমি কালকের মধ্যে যেখানে পারো চলে যাও।

বাড়িতে দু-দুটো যুবক ছেলে আছে। তোমার মাইয়ার ভাবভঙ্গিও ভালো না। আজিজ মজিদকে দেখলেই খালি হাসে। এতো হাসি কিসের! যেমন মা তেমন মেয়ে হবেনা হুঁ...

বড় বউয়ের ওমন বিদ্রূপে বৈলকতের নেছা রেগে ওঠে, বাজে কথা কইয়েন না। আমার মাইয়ার নামে বদনাম দিলে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কাঁইপা উঠবো। আমনের দুই দেওরের দিকে আমার মেয়ে কোনদিন চোখ তুইল্যাই চায় না। মুখ সামলাইয়া কথা কইয়েন!

কী, কী কইলি বান্দির ছেরি। যতো বড়ো মুখ না ততো বড়ো কথা। আমারে খবরদারি! বাইর অও, বাইর অও হারামজাদি। বড় বউ বৈলকতের নেছার চুলের মুঠি ধরতে উদ্যত হয়।

তখন ছুটে আসে মিরাসের মা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে বড় বউকে বাধা দ্যায়, মারতে অইবো না ভাবী। আমরা আউজগাই চইলা যাইয়াম।

এরপর বৈলকতের নেছা, পচন মিয়া ও মিরাসের মা অজানার উদ্দেশ্যে বের হয়।

সময়টা ১৯৭১ সাল। মিরাসের মার বিয়ে হয়েছিল ফুটপাথের এক পাউরুটি বিক্রেতার সাথে। ওর বাড়ি ঘর ছিলো না। থাকতো রেলস্টেশনের কাছে এক ঝুপড়ি ঘরে। নোংরা, পচা, বিশ্রি পরিবেশ। পাশেই মলমূত্র ত্যাগের নালা। মশা মাছি ভনভন করতো তাতে। খেতে বসলে নাকের ফুটো দিয়ে মলের গন্ধ ঢুকতো। এখানে থেকে পচন মিয়া স্টেশনে কুলিগিরি করে কিছু রোজগারের চেষ্টা করতো। ও রাতে স্টেশনেই পড়ে থাকতো। এই বিশ্রি ঝুপড়ি ঘরে ঘুমানোর চেয়ে স্টেশনের প্লাটফরমে ঘুমানো ভাল। পচন মিয়া বেশির ভাগ সময় ঘুমাতো টিকেট কাউন্টারের সামনের ফাঁকা জায়গাটায়। পাউরুটি বিক্রেতা ভগ্নীপতিটিও অনেক সময় তার নিদ্রাসহচর হতো। ঝুপড়ি ঘরে সারাক্ষণ থাকতে থাকতে বৈলকতের নেছা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। কিছুদিন ধরে তার কাশিতে রক্ত বমি হচ্ছে। অথচ হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কোন নাম নেই। অমৃত নগর থানার পেছনেই হাসপাতাল। বাজারে গুজব পাকিস্তানি মিলিটারি এসেছে। লোকজন ভয়ে বাইরে বেরোচ্ছে না। অনেকেই তল্পিতল্পাসহ ধনু নদীর পাড়ে পুরান বাজারের দিকে চলে যাচ্ছে।

শহরে থাকা আর নিরাপদ নয়। পাউরুটি বিক্রেতা মেয়ের জামাই বলল- আম্মাজান, দেশে অহন বিরাট গণ্ডগোল। আজিম ভাইয়ের মুহে হুনছি পাকিস্তানিরা বাঙালিরারে শোষণ কইরা বড়লোক অইতাছে। এইডা আর বাঙালি মুখ বুঁইজা সহ্য করবো না। মেলা করছে। এইবার ভাগ্য বদল করতে অইলে আমাগো স্বাধীন অইতে অইবো। পাকিস্তানিগো খেদাইতে অইবো। বৈলকতের নেছা কাশতে কাশতে বলল, এই রকম কথা তোমার শ্বশুরের মুহেও শুনছি। ভাগ্য পরিবর্তন করতে অইলে মুসলমানদের লাগিন আলাদা রাষ্ট্র গড়তে অইবো। পাকিস্তান গড়তে অইবো। জমাত আলী এইসব কথা কইয়া তোমার শ্বশুররে মিছিলে লইয়া যাইতো, কিন্তু...

কথাটা শেষ করতে পারলোনা। রক্ত মেশানো এক দলা কাশ ফেলে বলল, কিন্তু কী ভাগ্য বদলডা অইলো আমরার। তেইশ বছর ধইরা দেখতাছি...

এভাবে খাদ্যের অভাবে অষুধের অভাবে একসময় বৈলকতের নেছা মারা গেলো।

পাউরুটি বিক্রেতা ইউনুস আজিম ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেল যুদ্ধে। মিরাসের মাকে বলে গেল, কুনু চিন্তা কইরো না। দেশের জন্য লড়তে যাইতেছি। দেশ স্বাধীন অইলে আমাগো মুক্তি অইবো। আর দুঃখ থাকবো না। তুমি অহন অমৃত নগরে থাইকো না। গ্রামে চইলা যাও। নয়মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানিরা পিছু হটে। জন্মলাভ করে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির। মিরাসের মা অপেক্ষায় থাকে এই বুঝি তার স্বামী এলো। পুরান বাজারের একটি ভাঙা স্কুলে সে আশ্রয় নিয়েছিলো। যুদ্ধ শেষে সকলে ফেরত এলেও ইউনুস আসেনি। বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। দাসী বাঁদীর কাজ করতে করতে বড় একঘেয়ে লেগে যায় মিরাসের মা'র। পরে শুরু করে মাছ ব্যবসা। ধনু নদীর মাছ নিয়ে বিক্রি করে নকলা বাজারে। এজন্য প্রতিদিনই তাকে ট্রলারে আনাগোনা করতে হয়। আসা যাওয়ায় পরিচয় হয় নকলার এক বুড়ির সঙ্গে। ফোকলা দাঁতের এই বুড়ি যেমন রসিক তেমন চালাক। তড়বড় করে কথা বলে। চোখের চাউনি গোয়েন্দার মতো। মিরাসের মাকে ডেকে নিয়ে একটা পান খাওয়ালো। বলল, কি লো! মাইয়া মানুষ। বুড়িও হস নাই। অহনও তরতাজা জোয়ানও আছিস। মাছের ব্যবসা কইরা ভাত খাইতে অয় কে রে। তোর জামাই কিতা করে?

মিরাসের মা বলল, যুদ্ধে গেছিলো। পরে আর ফিরে নাই।

বুড়ি খিঁচিয়ে ওঠে, যুদ্ধে। কিয়ের যুদ্ধে। কোন দরকার? উদ্দেশ্যটা কী?

উদ্দেশ্য দেশটা স্বাধীন অইবো। স্বাধীন অইলে আমাগো শান্তি অইবে।

দেশতো স্বাধীন অইছেই। অহন কোন শান্তিডা অইছে তোর, ক তো দেহি...

মিরাসের মা কথা না বলে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বুড়ি ধমকের সুরে বলে, এই চাইর আনার মাছের ব্যবসা কইরা কয় পয়সা পাস। না খাইয়া দো মইরা যাইতাছস গা!

বুড়ি একটু থেমে ফিসফিস করে বলল, তার চায়া এক কাম কর। আমি একখান বুদ্ধি দিই, হুন কাছে আয়...

বুড়ি মিরাসের মা'র কানের কাছে মুখ রাখলো। শুনেতো ও ভীষণ ভয় পেয়ে গেলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, কি! কিতা কইছইন আমি গাঞ্জার ব্যবসা করতাম!

তাহলে কিতা করবি ছেমরি না খাইয়া মর! সপ্তাহে একদিন একটা খেপ দিবি ১৫ দিনের খাওনের টেহার ব্যবস্থা অইয়া যাইবো। আমি করতাছি না? এই দেখ আউজগাও যাইতাছি।

মিরাসের মা বুড়ির এই পরামর্শ নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করে। আসলে এই মাছ লইয়া প্রতিদিন আনাগোনা করলে আর বেশি দিন চলতে পারবে না। নির্ঘাত অসুস্থ হয়ে পড়বে। ইউনুস আসেনি আর আসবে বলেও মনে হয় না। পচন মিয়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর এখানে ওখানে থাকে। কখনো কুলিগিরি করে। কখনো রিকশা চালায়। হঠাৎ কোনদিন মিরাসের মা'র সাথে দেখা করতে আসে। আবার চলে যায়।

এতদিনে ধনু নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। প্রবল প্রচণ্ড স্রোতে। কালের স্রোততো তার চেয়েও দ্রুততর। এর কোন ক্ষয় নেই। বাধা নেই। কোন শক্তিই পারে না তার চলার গতি থামাতে। সময়ের স্রোতে অনেকবার ভোটের বাজার গরম হয়েছে। অমুক ভাইকে দিলে ভোট শান্তি পাবে দেশের লোক। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়েছে ধনু পাড়ের গ্রাম্য এলাকা। মিরাসের মা গত নির্বাচনে আজিম চৌধুরীকে ভোট দিয়েছিলো। সামনে ইউপি নির্বাচনের হাওয়া। মিরাসের মা'র বয়স এখন পঞ্চাশ। চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে। চুপসে যাওয়া মুখ। বত্রিশটি দাঁতের মাঝে ষোলটিই পোকায় খেয়ে ফেলেছে। সে এখন আর ট্রলারে প্রতিদিন আনাগোনা করে না। সপ্তাহে একদিন যায়। জীবন জীবিকার স্বার্থে বেঁচে থাকার জন্য এটিই সহায়। এই বুড়ি বয়সেও তাকে বাধ্য হয়ে বাঁকা পথে যেতে হচ্ছে। এই যাত্রা ও গিয়েছিল নকলা। দুর্ঘটনাটি ঘটে পাড়ের কাছাকাছি এসে। ট্রলারটি ঘাটে ভিড়ানোর সময়। এই জায়গাটা নিয়ে অজস্র অতিপ্রাকৃত কথা ছড়িয়ে আছে লোকের মুখে মুখে। প্রতি বছরই নাকি ওখানটায় জলের নিচে বসবাসকারী 'আজর' নামের অদৃশ্য জন্তু একটি মানুষ কিংবা গরু গ্রহণ করে। এই জায়গাটার প্রতি ধনু পাড়ের লোকদের প্রচণ্ড ভীতি। ট্রলারটি এখানে এসেই আকস্মিক ভাবে ডুবে যায়।

তখন শেষ রাতের নিঝুম প্রহর। যাত্রীদের মাঝে অনেকেই ছিলো ঘুমে। এলাকায় হইচই পড়ে যায়। ছুটে আসে থানা পুলিশ। নেতৃবৃন্দ। এমপি আজিম চৌধুরী ঢাকায়। উনি আসেননি। আসে তার সহচরেরা। সাংবাদিকেরা। ধনু পাড়ের লোকজন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখে এদের চকচকে চেহারা। আসে নৌবাহিনীর ডুবুরিরা। কী আশ্চর্য সুন্দর পোশাক! অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। শোনা যাচ্ছে আজিম চৌধুরীও আসবেন। ধনু পাড়ের এই অবহেলিত জনপদ সত্যিই ধন্য হবে এবার। হঠাৎ এই বিশাল জনস্রোতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে পচন মিয়া। কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মত জলে ঝাঁপ দেয়। অন্যরা চেঁচিয়ে ওঠে, এই করে কী! করে কী!

পচন মিয়া উঠে আসে একটি পোঁটলা হাতে। দেখে পুলিশ এগুচ্ছে ওর দিকে। পচন মিয়ার বুক কেঁপে ওঠে। পোঁটলাটা ছুঁড়ে ফেলে দে ছুট!

আজিম চৌধুরীর সহচরদের একজন বলল, শালার পুত পাগল নাকি?

মিরাসের মা'র পোঁটলাটা তখন স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে ভেসে ভেসে যাচ্ছে। নদীর স্রোত তখন অনেকটা হালকা। পুলিশ অফিসার চেঁচিয়ে ওঠে, এই আপনাদের মাঝে একজন একটু সাঁতার দিয়ে পোঁটলাটা নিয়ে আসুনতো। দেখি কী আছে এর মাঝে।

আপনার মন্তব্য