রাঙা’দি

 প্রকাশিত: ২০২১-১০-০৭ ১৮:৪৪:২৬

 আপডেট: ২০২১-১০-০৭ ১৮:৪৫:১৯

অজয় রায়:

সেবার যখন আশ্বিন মাসে পূজার আগে রাঙা’দি তার আলতা রাঙা পায়ে হেটে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল, তারপর থেকেই রায়বাবুদের বাড়ির ছোটবাবু কেমন যেন হয়ে গেল। গ্রামের লোক তাকে পাগল বলে। রাঙাদির বিয়ের সাথে ছোটবাবুর পাগল হওয়ার কী সম্পর্ক সে প্রশ্নের উত্তর আমার আজও ম্যালেনি।

আচ্ছা রাঙা’দি কি জানে সে প্রশ্নের উত্তর? অবশ্য তাকে সে প্রশ্ন করার সাহস আমার কোনদিনও হয়ে উঠেনি। কিন্তু লোকে বলে দিদির জন্য নাকি ছোটবাবু পাগল হয়েছে। সেই থেকে শিকলে বাঁধা ছোটবাবুর জীবন। কেবল বছরে একবার ছুটি মেলে শিকল থেকে, সেটা পূজার সময়। তখন তার উন্মাদনাও বেড়ে যায়। তবুও বছরের এই পাঁচটি দিন বড়বাবু মেজবাবু মিলে কোনরকমে ভাইকে সামলে নেয়।

পূজা আসলে রাঙা’দিও আসে বাপের বাড়ি। এই কটা দিন সারা বছরের মাঝে আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমাদের পূজা মানেই রায়বাবুদের বাড়ির পূজা। আর রায়বাবুদের বাড়ির পূজা মানে দিনে দিনে কমে আসা এক বনেদি বাড়ির পূজা। ঝাড়বাতির রোশনাই, ঠাকুর দালানে আলপনা, ধূপের গন্ধ, ধুনুচি নাচ, ঢাকের আওয়াজে পুরনো দেয়ালে ফিরে ফিরে আসা প্রতিধ্বনি আর সাথে যেন ফিরে আসে এক নস্টালজিক শৈশব-কৈশোর। আমি আর রাঙা’দি মিলে খুব সকালে সেজেগুজে চলে যাই রায়বাবুদের ঠাকুর দালানে।

রাঙা’দির পূজার সাজ বরাবরের মতই আমাকে বিস্মিত করে, যেন পটে আঁকা ছবির মত। স্নান শেষের কোঁকড়ানো ভেজা চুল, সিঁথিভরা রক্তরাঙা সিঁদুর, হাতে সদ্যতোলা ফুলের ডালা আর সারা শরীর জুড়ে কেমন যেন এক পবিত্রতার গন্ধ। ঠিক যেন দুর্গা প্রতিমারই আরেক রূপ। পূজার সাজে রাঙাদিকে দেখলেই ছোটবাবুর চোখমুখ কেমন যেন ঝলসে উঠে। যেন কিছু বলতে চায়, নষ্ট করে দিতে চায় পবিত্রতার সেই গন্ধটা। ছোটবাবুর এ আচরণে রাঙা’দি ভয় পায় না খুশি হয় আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

সপ্তমী, অষ্টমী পেরিয়ে নবমীর সন্ধ্যা, নবমীর আরতি রায়বাবুদের পূজার পুরনো রেওয়াজ। রাঙা’দির হাতে পঞ্চপ্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপের আলোর একদিকে মায়ের মুখ আর অন্যদিকে রাঙা’দির মুখ আমাকে মুহূর্তের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত করে দেয়। দুই প্রতিমার মাঝখানে পঞ্চপ্রদীপ যেন পৃথিবীর সমস্ত আলো নিয়ে বসে আছে। নবমীর নিশি শেষে বিজয়া দশমীর মেলা বসে গ্রামে। একদিকে মেলায় উঠে জীবনের সকল অনুষঙ্গ, অন্যদিকে বিষাদের বিন বাজিয়ে পর্দা নামে জীবনের অন্যতম উৎসবের। মেলা শেষে দশমীর সিঁদুর খেলায় যোগ দেয় সবাই। মায়ের পায়ের সিঁদুর মাথায় ঠেকিয়ে স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে রাঙাদি। ঠাকুর দালানের এক কোনে বসে অজানা এক অভিমান ও রাগে ফোঁস ফোঁস করে ছোটবাবু।

সারা গ্রামে প্রতিমা নিরঞ্জন শেষে সন্ধ্যায় গঙ্গার ঘাটে বিসর্জন হয় মায়ের মৃন্ময়ী রূপের আর মায়ের চিন্ময়ী রূপকে গ্রামের মানুষ হৃদমন্দিরে যতন করে রেখে দেয় সারা বছরের জন্য। বিসর্জনের বিষণ্ণ নীরবতা যেন ছড়িয়ে পড়ে জলনিমগ্ন প্রতিমার মুখ থেকে সবার অন্তরে। চিরাচরিত এ নীরবতা ভাঙে অন্য এক বিষাদের রবে। গ্রামময় ছড়িয়ে পড়ে ছোটবাবু নাকি বিসর্জনের সময় গঙ্গায় নেমে আর উঠে আসেনি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকি আমরা।

রাতশেষে ছোটবাবুর অন্তর্ধানের খবরই সত্যি হয়। এ গ্রামে এমন বিসর্জনের রাত বোধহয় আর আসেনি।

আচ্ছা ছোটবাবু কি মাকে যেতে দিতে চায়নি নাকি রাঙা’দিকে যেতে দিতে চায়নি? এ প্রশ্ন রাঙা’দিকে আমার জিজ্ঞেস করা হয়নি। এমনকি আবার পূজায় আসবে কি না তাও জিজ্ঞেস করা হয়নি।

রাঙাদি স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে। আচ্ছা রাঙা’দিকে কি জিজ্ঞেস করব কিছু ফেলে গেল কি না?

আপনার মন্তব্য