পুতুল নাচের সংখ্যাকথা

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-২৯ ২২:৩৩:০২

 আপডেট: ২০১৫-১২-২৯ ২৩:০৫:১১

মাসকাওয়াথ আহসান:

পুতুলের কাছে ফোন আসে, হ্যালো পুতুল আমি কমল বলছি। তুমি জলপাইগুড়ির মেয়ে তাই তোমাকে জলপাইগুড়িতে নিয়ে যেতে চাই। যাবে কী!

--কী বলেন এসব। আমি এখন অংক খাতা নিয়ে বসে। মাথাটা ঘুরছে। অংক সাবজেক্টটা কেন যে থাকে!

--আমি তোমার ম্যাথেম্যাটিক্যাল প্রবলেমস সলভ করে দেবো। কাল সকাল ১১ টায় স্কুলের সামনে থেকো।

ফোন রেখে পুতুল আবার অংক নিয়ে বসে। ৩কে ১০ দিয়ে গুন করলে যে ৩০ হয়; সেটা মুখস্ত করতে থাকে। তিন-দশে তিরিশ, তিন দশে তিরিশ আবৃত্তি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন অংক ক্লাসে টিচার জিজ্ঞেস করেন, পুতুল ৩ কে ১০ দিয়ে গুন করলে কত হয়!

পুতুল চোখে-মুখে অন্ধকার দেখে। কাল রাতে এতো করে মুখস্ত করেছে; কিন্তু মনে পড়ছে না।

টিচার বলেন, দেখি তোমার আব্বার সঙ্গে কথা বলি। তোমার একটা বে-থা দিয়ে দিক। অযথা শুধু স্কুলে এসে আর গিয়ে কী লাভ!

পুতুল কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী চলে যায়। আবার একটা ফোন আসে!

--সে কী পুতুল তোমার না সকাল ১১ টায় স্কুলের সামনে থাকার কথা ছিলো!

--টিচার আমাকে পড়াশুনা করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু আপনি ১১টার সময় দাঁড়ানোর কথা কখন বললেন!

--কাল সন্ধ্যাতেই না বললাম।

--মনে পড়ছে না। আমি তিন দশে তিরিশ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। ক্লাসে সেটাও মনে পড়েনি। টিচার আমার আব্বাকে বলেছেন আমার বিয়ে দিয়ে দিতে।

--দ্যাটস গ্রেট। টিচারতো আমাদের ১১টায় দেখা হবার চেয়ে বেশী জরুরী কাজ করেছেন। ভাগ্যিস তিন দশে তিরিশ মনে পড়েনি তোমার।

পরদিনই কমল বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। কমলের মা কমলকে জিজ্ঞেস করেন, এই পুতুল মেয়েটা কী গান-টান কিছু জানে!

কমল উত্তর দেয়, সেটাতো জিজ্ঞেস করিনি। তবে মেয়েটা অংকে দুর্বল।

--এই সেরেচে।

ভালোয় ভালোয় কমলের সঙ্গে পুতুলের বিয়েটা হয়ে যায়। রিসেপশানের পর কমল পুতুলকে বলে, যাদেরকে ইনভাইট করেছি সবাই এসেছে। বলোতো পুতুল আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে কতজন অতিথি এসেছিলেন! এনি গেস!

--কত আর তিন দশে তিরিশ জন হবে!

দপ করে নিভে যায় কমলের মুখের হাসি। ব্যালকনিতে গিয়ে ফস করে একটা সিগ্রেট ধরায়। ফিরে এসে জিজ্ঞেস করে, বিয়েতে কত ভরি গয়না পেলে দুইপক্ষের সবার কাছ থেকে।

--কত আর তিন দশে তিরিশ ভরিই হবে।

কমল এবার স্টিলের আলমিরা থেকে একটি বোতল বের করে একটু হোমিওপ্যাথি পরিষেবার জন্য পাশের ঘরে চলে যায়।

এমন সময় বড় ভাবী এসে বলেন, মেয়েটি ভাগ্যবতী। অনেক উপহার পেয়েছে। পঞ্চাশ ভরির গয়না পেয়েছে। কিন্তু আমি ওকে এটা জানাতেই সে বললো, আসলে নাকি এটা তিন দশে তিরিশ ভরি হবে। পঞ্চাশ আবার কী সংখ্যা!

কমল রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলে, ভাবী এই মেয়ে সব কিছুতেই তিন দশে তিরিশ বলে।

ভাবী বলেন, ও ঠিক হয়ে যাবে। আরেকটু বড় হলে নিশ্চয়ই পাঁচ দশে পঞ্চাশ হয় এটা শিখে যাবে।

নতুন বৌ নিয়ে কমল চলে যায় করাচীর পোস্টিং-এ। পুতুল শুধু জলপাইগুড়ির ভাষা ছাড়া কিছু বলতে পারেনা। তাই তাকে কমল ইংলিশ-ভিংলিশ শেখাতে থাকে। আর পিটিভির নাটক দেখার পরামর্শ দেয়। তবে কথা বলতে না পারার বেশ কিছু সুবিধাও থাকে। শুধু হাসলে তো আর কেউ বুঝতে পারবে না পুতুলের তিন দশে তিরিশের কান্ডখানা।

৫০ জন মত অতিথিকে বাসায় দাওয়াত দেয়া হয়। কমল বাসায় ব্ল্যাকবোর্ড এনে লিখে শেখায়, পাঁচ দশে পঞ্চাশ।অর্থাৎ পঞ্চাশ জন অতিথির জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু অতিথিরা আসার পর কমল লক্ষ্য করে খাবার যথেষ্ট নয়। পুতুলকে একপাশে ডেকে জিজ্ঞেস করে, কতজনের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করেছো।

--কেন তিন দশে তিরিশ জনের জন্য।

কমল-পুতুলের ঘর আলো করে একটি সন্তান আসে। ছেলেটি প্রথম যে শব্দটি উচ্চারণ করে তা হচ্ছে দশ।

কমল হাফ ছেড়ে বাঁচে। যে ছেলে আম্মা-আব্বা বলার আগেই দশ বলে, সে নিশ্চয়ই অংকে মায়ের মতো তিন দশে তিরিশ হবে না।ছেলের বয়স দেখতে দেখতে পাঁচবছর হয়ে যায়। কিন্তু কিছুতেই সে দশের বেশী গুনতে শেখে না। কমল সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই।

ঢাকায় ফিরে কমল অনুরোধ করে, পুতুল একটু চেষ্টা করবে তিন দশে তিরিশ মার্কা মামা-খালারা যেন বাসায় কম আসে।

পুতুলের মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। সারাদিন অংকের খোটা কার ভাল লাগে!

এরমধ্যে দেশে যুদ্ধ বেধে যায়। কমল যুদ্ধে যোগ দেয়। ফোন করে পুতুল বলে,

তুমি এই গন্ডগোলের মধ্যে কেন গেলা। গন্ডগোলে যে তিন দশে তিরিশজন মারা যাবে; তুমিও যদি তিন দশে তিরিশ জনের মধ্যে পড়ে যাও। আমি বাবা এই তিন দশে তিরিশ জনের মধ্যে পড়তে চাইনে।

কমল ধপ করে ফোন রেখে দেয়। রামগড়ে বসে হোমিওপ্যাথি পরিষেবা শুরু করে। সিদ্ধান্ত নেয়, আর এই তিন দশে তিরিশ নিয়ে জীবনটা অতিষ্ট করে লাভ নেই। এর চেয়ে একা থাকাও ভালো।

কিন্তু যুদ্ধের পর একজন মুরুব্বী স্থানীয় নেতার কাছে গিয়ে পুতুল নালিশ দেয় কমলের বিরুদ্ধে। মুরুব্বী ফোন করে কমলকে ধমক দেন, ফোর টুয়েন্টি করার জায়গা পাওনা।

কমল কাকুতি মিনতি করে বলে, স্যার আপনি পুতুলকে জিজ্ঞেস করুন যুদ্ধে কত মানুষ শহীদ হয়েছেন!

মুরুব্বী জিজ্ঞেস করেন, ও পুতুল বলোতো যুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কত!

পুতুল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দেয়, এই উত্তরটা কমন পড়েছে। তিন দশে তিরিশ জন।

মুরুব্বী বলেন, তিরিশ ঠিকই আছে কিন্তু তিরিশ লক্ষ হবে!

পুতুল জিজ্ঞেস করে, লক্ষ কী!

মুরুব্বী হো হো করে হেসে বলেন, কমল শুধু অংকের দুর্বলতার জন্য একটা সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবে তা কী হয়!

কমল আর পুতুল আবার সংসার করতে শুরু করে। কমল সংখ্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলো ব্যাটম্যানকে বলে দেয়। পুতুলের সঙ্গে সে সংখ্যা এড়িয়ে কথা বলে। তবু জীবনতো সংখ্যার নদী। পাসপোর্ট করার জন্য পুতুলের ডেট অফ বার্থ জরুরী হয়ে পড়ে।

পুতুল স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, এ ব্যাপারে তার আব্বাকে জিজ্ঞেস করতে। সংখ্যা সংক্রান্ত কোন বিষয়ে অন্ততঃ কমলের সঙ্গে কথা বলবে না সে।

কমল প্রতিদিন মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় সেই গুরুজনের ওপর যিনি জোর করে তাকে পুতুলায়তনে ফিরিয়ে এনেছেন। প্রতিদিন অচলায়তনে মাথা খুঁটতে খুঁটতে গুরুজনের বিরুদ্ধে ভিলেজ পলিটিক্সে গো এহেড করে দেয়।

এরপর ক্রমান্বয়ে গ্রামের মাতবর হয়ে ওঠে কমল। তারপর পুতুলের সূত্র অনুসারে সে গ্রামবাসীকে বোঝাতে থাকে সে আর ২৯ জন মিলিয়ে মোট ৩ দশে ৩০ জন যুদ্ধ করেছে। বাকীরা গড়ের মাঠে হাওয়া খেয়েছে।

কমল মোল্লাদের ওয়াজ-নসিহতে লাগিয়ে দিয়ে নিজে নিয়মিত রামগড়ের হোমিওপ্যাথি পরিষেবা চালিয়ে যায়। খেয়াল করে শোনে মোল্লারা তাদের বক্তব্য শুরু করে বিসমিল্লাহ হির রাহমানের রাহিম বলে। তার দুঃশ্চিন্তা হয়। এরা আবার মুরুব্বীর নাম নিচ্ছে নাতো! ওরা রহমান বলছে কেন!

পুতুলকে জিজ্ঞেস করে, বিসমিল্লাহ হির রাহমানির রাহিম ব্যাপারটা কী!

পুতুল বলে, তা জানি না। তবে জলপাইগুড়িতে বেসমিল্লাহ বলে। এনশাল্লাহ বলে। এরা ভুল বলচে।

এরমধ্যে গ্রামের কোন্দলে কমল নিহত হলে, রান্নাঘরে মাটন কড়হাই রান্না করার সময় মোল্লারা এসে তাকে বলে, ভাবী সাহাব এইবার ইনশাল্লাহ আপনি মাতবর হবেন।

পুতুল সংশোধন করে দেয়, ইনশাল্লাহ নাহ ওটা এনশাল্লাহ হবে। আর এখন আবার গন্ডগোল হবে। আপনারা প্রস্তুত থাকেন। তিন দশে তিরিশ জন মারা যাবে।

অবশেষে পুতুল গ্রামের মাতবর হয়ে গেলে কিছু গ্রাম্য কুচুটে লোক এসে জিজ্ঞেস করে, আপনার পাসপোর্ট বানাইতে হবে। ডেট অফ বার্থ কী হবে!

--সংখ্যার কথা আমাকে নয় আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করো।

কুচুটে সমাজ নিজেরাই ঝামেলাটা পোক্ত করতে সেই যে গুরুজন পুতুলের সংসার বাঁচিয়েছিলেন তাঁর হত্যাদিবসের তারিখটি পুতুলের পাসপোর্টে বসিয়ে দেয়।

এরপর কুচুটে সমাজ বুদ্ধি দেয়, ভিলেজ পলিটিক্সে আপনার বেশী কথা বলার দরকার নাই, নীরবে প্রতিপক্ষরে ঝাড়ু দেখাইয়া দিবেন; অরা চিল্লাইবো; গ্রামের লোক ভাববো অরাই বেশী খারাপ।

তবু শেষ রক্ষা হয়না। পুতুল ক্ষমতাচ্যুত হয়। ছেলেটি সেই যে দশ পর্যন্ত গুনতে শিখেছিলো; ওই দশ সংখ্যাটা নিয়ে খেলে গ্রামটার সর্বনাশ করে ছেড়ে দেয়।

ছেলে গ্রামছাড়া। তার সঙ্গে দেখা করতে লন্ডনে যায় পুতুল। সেখানে দেখা করতে আসে বিশিষ্ট সংখ্যা বিশারদ শর্মিলা। সে পুতুলকে জিজ্ঞেস করে, যুদ্ধে আপনাদের গ্রামে কতজন মারা গিয়েছিলো।

পুতুল পট করে উত্তর দেয়, তিন দশে তিরিশ!

--সর্বনাশ! আপনি তো আপনার প্রতিপক্ষের ন্যারেটিভকে সত্যি প্রমাণ করে ছেড়ে দেবেন দেখছি।

--তা হলে কী করবো!

পুতুলের ছেলে শর্মিলাকে খুলে বলে তার মায়ের তিন দশে তিরিশ আর তার দশের রহস্য।

শর্মিলা সিদ্ধান্ত দেয়, আপনি গ্রামে ফিরেই বলবেন যুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে কনফিউশান আছে।

--নিশ্চয়ই বলবো। জন্ম থেকে সংখ্যা নিয়ে জ্বলছি ওগো; আর কতকাল বলো জ্বলবো!

আপনার মন্তব্য