মর্যাদা কী ঝালমুড়ি!

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-১৩ ২২:৩৭:০৪

 আপডেট: ২০১৬-০১-১৩ ২২:৪৬:০৭

মাসকাওয়াথ আহসান:

মন্ত্রী মহোদয়ের সামনের চেয়ারে বসে তিনজন আমলা। জিল্লু একটি কমলা লেবু ছিলে মন্ত্রী মহোদয়কে দেয়।

--স্যার শীতের সময় ভিটামিন সি অতীব জরুরী।

মন্ত্রী মহোদয় বলেন, মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ করে পাঠাই।
জিল্লু লাজুক হাসি হাসে।

--সে সময় কাছিম স্যার মন্ত্রী না থাকায় মেডিক্যালে চান্স পাই নাই।
--দেশ একজন বিরাট ডাক্তার হারিয়েছে।

মন্ত্রী এবার হাসিমুখে সামনে বসা নাছেরকে জিজ্ঞেস করে,
--ইউনিভার্সিটি শিক্ষকেরা কী কোন কাজ করে; না কী বসে বসে বেতন নেয়!
--কাজ করে স্যার, ভোরের পত্রিকায় তাদের কলাম দেখি, দুপুরে ফেসবুকে মানববন্ধনে তাদের ছবি দেখি আর রাতে টকশো তো আছেই।
--তো আমরা তাদের বেতন দেবো কেন!

শাহালম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, চাকরীর এতোবছর হয়ে গেলো স্যার, এতো খাটাখাটুনী করলাম, সমাজে সম্মান নাই স্যার।
--তা কীভাবে তোমাদের সম্মান বাড়ানো যায় ভাবছো কিছু!
জিল্লু মন্ত্রী মহোদয়ের সারা ঘরে ঘুরে ঘুরে সম্মান খুঁজে। অবশেষে টেবিলে রাখা অনেকগুলো ফাইল আঁতিপাতি করে খুঁজে একটা ফাইল বের করে।
--পাইছি স্যার; এই যে সম্মান!

শাহালম বলে, স্যার এইটা মর্যাদার প্রশ্ন। আমগো সম্মান বাঁধাই কইরা দ্যান।

মন্ত্রী মহোদয় বলেন, একটা খুব করুণ কাহিনী শোনো। অত্যন্ত মেধাবী তরুণ সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় চান্স পেয়েছিলো সেইকালে। পুলিশ ভেরিফিকেশান করতে এসে পুলিশ তাকে বলে, সবই ঠিক আছে ভাই কিন্তু সিএসপির মেয়ে বিয়ে না করলে আপনারে মনে হয় নিযুক্তি দেবে না। কী অবিশ্বাস্য মর্যাদা ছিলো সিভিল সার্ভিসের। তোমরা তো বাঁইচা গেছো মিয়া!

নাছের বলে, স্যার এখন ঐরকম একটা ভাবগাম্ভীর্য্য ফিরিয়ে আনতে হবে। পাত্রীর বাপেদের বুঝিয়ে দিতে হবে আমলার মর্যাদা সবার উপরে। অর্থাৎ কোন ছেলে সুপিরিয়র সার্ভিসে চান্স পাইলে তাকে অবশ্যই বেয়াই সমাজের লতায় পাতায় জড়িয়ে দিতে হবে; তারপর নিয়োগপত্র। একদিন পুরা সিসটেমটাই সৌদী রাজবংশের মতো হয়ে পড়বে।
শাহালম উল্লসিত হয়, এরে বলে মাস্টারপ্ল্যান।

জিল্লু সম্মানের ফাইলটা খুলে দেয় মন্ত্রীর সামনে।
--স্যার আমলার মর্যাদা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের দুইধাপ উপরে দিয়া দিলেই সম্মানের ইউসিউরেন্স হইয়া যায়!

মন্ত্রী বিস্ফারিত চোখে তাকান। শিক্ষকরা যদি মেনে না নেয়। আর অন্য সার্ভিসের লোকদেরও ব্যাপক অবনমন হয়ে যায় এই ছকে!

নাছের গম্ভীর হয়, এই যে স্যার এতো স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন হয়; সেইখানে রিটার্ণিং অফিসার হিসাবে কত কষ্ট করে আমাদের ছেলেরা; তারা কী কোনই রিটার্ণ পাবে না!
--শিক্ষকরা যদি বিক্ষোভ করে; অন্য সার্ভিসের লোকেরা তো স্টাফ হিসেবে চুপচাপ থাকবে।

জিল্লু কঁকিয়ে ওঠে, শিক্ষকরাও তো স্টাফই।
হঠাত এসময় মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিত। মন্ত্রী উঠে জড়িয়ে ধরেন।
--কী সৌভাগ্য আমার!
--আপনাকে আমার লেখা তৈলপরাবাস্তবতা বিষয়ক প্রবন্ধের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনের প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত দিতে এলাম।
--তৈলপরাবাস্তবতা নিয়ে ভালো কাজের বড্ড অভাব। কবিতা রয়েছে বিস্তর। রয়েছে কলাম। শুধু ছিলো না প্রবন্ধ।

হঠাত এই বুড়ো এসে পড়ায় ভীষণ বিরক্ত জিল্লু। মনে মনে বলে, কী এক মোরগ উন্মোচনের দাওয়াত নিয়া ঢুইকা পড়লো জরুরী বৈঠকের মধ্যে। ওয়ারেন অফ প্রিসিডেন্সে দুই ধাপ নামাইয়া দিলে বইয়া থাকতে হইতো মন্ত্রীর পিএ’র সামনে সাজানো দাঁত বের করা চেয়ারে।

মন্ত্রী পন্ডিত মশাইকে জিজ্ঞেস করেন, জুনিয়র শিক্ষকেরা কী ক্লাস নেয়; নাকি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে যায় টাকা কামাতে।
--স্পিড মানির সুযোগ নেই; তবু বাঁচতে তো হবে; তাই হয়তো কেউ কেউ যায়।
স্পিড মানি শব্দবন্ধটি শুনেই তিনজন আমলা বিদায় নেয়।

মন্ত্রী বলেন, শিক্ষকদের নয়টা পাঁচটা অফিস বাধ্যতামূলক করতে চাই।
--তাহলে যারা পাঁচটার পরে গবেষণাগারে থাকে; চেম্বারে বসে পরীক্ষার খাতা দেখে তাদের কী হবে!
--যা করার পাঁচটার মধ্যেই করে ফেললেই হয়।
--সব সাবজেক্টই তো ইংরেজী সাহিত্য নয়।

মন্ত্রী মহোদয় হো হো হেসে বলেন, দেখুন পৃথিবীর মহৎ সাহিত্যগুলো রাতেই লেখা হয়েছে।
--শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশী কাজ করতে হয়। কাজটা তারা নীরবে করেন। অন্যদের মত দেখিয়ে করেন না! আপনার নিজেরও তো অভিজ্ঞতা আছে।
--খুব মিস করি। শিক্ষকতায় থাকলে আজ ধরুন আমার অনেক প্রকাশনা থাকতো; কতো ছাত্র থাকতো। তা না কী সব রাবিশ নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলাম।
--হিংসা হচ্ছে মশাই।
--তা একটু হচ্ছে বৈকি! একটু সমস্যায় পড়েছি ভাই। আমলারা পাকিস্তান-ভারতের আমলাদের মত মর্যাদা চায়।
--যাদের মানুষ ভয় পায়; তাদেরকে তো কখনোই সম্মান করতে পারে না। মর্যাদা কী ঝালমুড়ি যে এক ঠোঙ্গা কিনে দেবেন!
--তাহলে কী করি! ওরা গণতন্ত্রের স্তম্ভ ধরে দাঁড়িয়ে আছে; কত সুন্দর নির্বাচন পরিচালনা করে।
--প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ন্যায়পালের মর্যাদা দিয়ে দিন। তাঁকে ন্যায়রত্ন উপাধিতে ভূষিত করুন।
--কিন্তু আসল কাজটা যে আমলাদেরই করতে হয়!
--পাকিস্তান-ভারতের জিন্নাহ-নেহেরু নির্বাচিত জননেতা ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন আমলা নির্ভর। বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় আমলা নির্ভর ছিলো। অথচ বৃটেনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা আমলা নির্ভর নয়। জনপ্রতিনিধি নির্ভর। পাকিস্তান-ভারত বৃটিশ কলোনিয়াল হ্যাং-ওভারে ভুগলেই আমাদের ভুগতে হবে এমন কথা নেই।এ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু তো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। তিনি জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। নানা পেশার মানুষ দিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা সাজাতে চেয়েছেন।আজকের এই স্পেশালাইজেশানের যুগে কী জেনারেলাইজেশান চলে! শিক্ষা সচিব শিক্ষা সার্ভিস থেকে আসবে, স্বরাষ্ট্র সচিব পুলিশ সার্ভিস থেকে আসবে, তথ্য সচিব তথ্য সার্ভিস থেকে আসবে, স্বাস্থ্যসচিব স্বাস্থ্য সার্ভিস থেকে আসবে। এমন কী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় চলবে সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের লোকদের দিয়ে। এমনটাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ অন্য জাতীয় নেতাদের ভাবনা। বঙ্গবন্ধু পরে সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিতে চেয়েছেন। বাই দ্য ওয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য করা হয়েছিলো আমাদের মতো অধম শিক্ষকদের নিয়ে।

মন্ত্রী কলিং বেল টিপে এম এল এস এস মহোদয়কে খুঁজে পাননা। উনি নামাজের বিরতিতে হাওয়া হয়ে গেছেন। জিল্লু দৌড়াতে দৌড়াতে আসে এক গ্লাস হরলিকস নিয়ে।
মন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান না হয় ব্যর্থ রাষ্ট্র; ভারত তো বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। ইন্দিরা গান্ধী নিজেই যখন আমলাতন্ত্রকে সবার ওপরে মর্যাদা দিয়েছেন; আমরা কী ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে গণতন্ত্র বেশী বুঝি!

পন্ডিত হেসে বলেন, প্রথমতঃ উনি নেহেরুর মেয়ে, বাবার নীতিটিই গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া সেখানে নানা রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী দমনে আমলাদের প্রয়োজন হয়। ঐসব রাজ্যে এই আমলারা বৃটিশ আমলাদের মতো আচরণ করে। নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে ইন্দিরা গান্ধী আমলাদের অনুগত রাজকর্মচারী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। জননেত্রী অতিরিক্ত আমলা নির্ভর হয়ে পড়লে যা হয়; তাঁর দলটি আজ জনবিচ্ছিন্ন প্রায়। ভারতে কংগ্রেসের কোন ভবিষ্যত দেখিনা। কিন্তু আমাদের দেশটি শান্তিপূর্ণ। ভারতের মতো অতো ঝামেলা নেই। আমরা কেন আমলা নির্ভর দেশ গড়বো; যে আমলা নির্ভরতা আজ খোদ বৃটেনেই নেই।

জিল্লু আড়ি পেতে পন্ডিতের কথা শুনতে নানা অছিলায় মন্ত্রীর ঘরে আসে। শোকেসে সাজানো সম্মাননা স্মারকগুলোর মাঝে মর্যাদা খোঁজে। হঠাত দেখে তাদের আমলাদের উপহার দেয়া ক্রেস্টটি পেছনের দিকে। একেবারে সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেয়া সম্মাননা স্মারক।

আপনার মন্তব্য