বাণিজ্যিক কাগজগুলো নীরব তবে পশ্চিমবঙ্গের লিটলম্যাগ বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহী : সাত্যকি হালদার

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-২৬ ১২:৩২:৫৩

 আপডেট: ২০১৬-০২-২৬ ১২:৪৯:০৮

অঞ্জন আচার্য:

পশ্চিমবঙ্গের একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক সাত্যকি হালদার।

অনেক দিন ধরেই নিয়োজিত আছেন কথাশিল্পে; লিখছেন গল্প-উপন্যাস। আনন্দবাজার, দেশ, কালি ও কলম পত্রিকার মতো প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকার নিয়মিত বা বিশেষ সংখ্যার পাশাপাশি সমানতালে লিখে চলেছেন তিনি বিভিন্ন ছোটকাগজেও।

যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ‘সাগ্নিক’ নামে একটি লিটলম্যাগ। পেশায় ডাক্তার এই মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষটির বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা অকৃত্রিম।

সাহিত্যে সত্যিকার অর্থেই নিবেদিত প্রাণ এ অনন্য-সাধারণ লেখকের সঙ্গে কথা বলেন কবি ও গল্পকার অঞ্জন আচার্য

অঞ্জন : আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে হল, বলবেন?
সাত্যকি : বেশিরভাগের যেমন হয় আমার লেখা শুরু খানিকটা সেরকম ভাবেই। মানে ওই স্কুল পত্রিকায় লেখা, পরে স্থানীয় ছোট পত্রিকা, হঠাৎই কখনও বাণিজ্যিক, আধা-বাণিজ্যিকে লিখে ফেলা। ক্রমশ লিটল ম্যাগাজিনের বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয়।

অঞ্জন : আপনার বেড়ে ওঠার গল্পটি শুনতে চাই।
সাত্যকি : কলকাতায় জন্মালেও আমার শৈশব কৈশোর কেটেছিল এক শান্ত মফস্বলে। সেখানে আমি যে প্রাথমিক স্কুলটায় গেছি সেটা একটি বুনিয়াদি বিদ্যালয়। এই স্কুলগুলো এখন অনেকটাই উঠে গেছে। কিন্তু বুনিয়াদি স্কুলের কেন্দ্রে ছিল খেলাধুলা, সাহিত্য, নিজের কাজ নিজে করতে শেখানো, এই সব। যেমন ওখানে একটা পিরিয়ড ছিল সাফাই। প্রতিদিনের প্রথম পিরিয়ড। যখন সবাইকে সেদিনের মতো স্কুল চত্বর পরিষ্কার করে ফেলতে হত। এছাড়া, আমি ক্লাস ফাইভে ওঠার পর আমার বাবা এমন একজনকে গৃহ শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন যিনি প্রায় কখনোই আমাকে স্কুলের বই পড়াতেন না। তিনি একটি স্কুলে ওপরের ক্লাসে বাংলা পড়াতেন অথচ তার প্রায় পুরো পড়াশুনোর জগতটা ছিল ইংরেজি সাহিত্যে। তার ছিল গানের প্রতি অনন্ত ভালোবাসা ও বিচিত্র রকম গান শোনার অভিজ্ঞতা। সপ্তাহে চার বা পাঁচ দিন সন্ধেবেলা এসে তিনি আমার সঙ্গে গল্প করতেন। শুধু গল্প করাই তার কাজ। এবং কদাচিৎ খানিকটা ইংরেজি শেখাতেন। এই ছিল তার গৃহ শিক্ষকতার চাকরি।

অঞ্জন : বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহটাই বা কোথা থেকে পেলেন?
সাত্যকি : বলতে গেলে এটা অনেকটা পারিবারিক। তবে বাংলা সাহিত্য কথাটি না বলে বরং বলা যায় সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ। এটার শুরু নিশ্চয়ই আমার পরিবারের ভেতর থেকে। আমাদের পরিবার মূলত সংস্কৃত ভাষা চর্চার পরিবার। ঠাকুরদা একটি স্কুলে পণ্ডিত মশাই ছিলেন। বাবা কাছাকাছির আর একটি মফস্বল কলেজে সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপনা করতেন। এছাড়া বাংলা বিভাগে ছন্দের ক্লাস নিতেন বাবা। বাবার বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও সংস্কৃতে এমএ ক্লাসের পাঠ্য বই সত্তর দশক ও আশির দশকের গোড়া পর্যন্ত বেশ প্রচলিত ছিল। মা-ও একটি স্কুলে বাংলাই পড়াতেন। এই সব মিলে এমন একটি আবহ ছিল বাড়িতে যেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতির কথা চলতই। এসব শুনে বা না-শুনেই আমার ছেলেবেলা।
পরে যখন পড়ার জন্য আমি কলকাতায় চলে আসি তখন বাংলা সংস্কৃতির অনেকটা কেন্দ্রের কাছে আসার সুযোগ পাই, যেহেতু আমার কলেজটি ছিল খোদ কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়, প্রেসিডেন্সি, সংস্কৃত কলেজ, পাতিরামের গা ঘেঁষে।

অঞ্জন : লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন কোন লেখক আপনার প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছেন, বা এখনো করে যাচ্ছেন?
সাত্যকি : সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’-এর কাছে আমি বারবার ফিরে যেতে চাই। ও রকম একটি পলিটিকাল ফিলসফির বই এমন একটি সাবলাইম টোনে আর কোথাও বলা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। ওয়ালিউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ যে কোনও দিন যে কোনও জায়গা থেকে পড়া শুরু করতে ভালোবাসি আমি। এই উপন্যাসটির জন্য আমার টান, আমার নিবেদন আমি বহু দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাই। ইংরেজি অনুবাদে চেকভ এবং তারই ঘরানায় বাংলার লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন আমার ছাত্রজীবন। এছাড়া দেরিতে হলেও সাম্প্রতিক পড়লাম বালজাক। বালজাকের জীবনী ও গল্প। প্যাশান ইন দ্য ডেজার্টের মতো গল্প পৃথিবীতে কটিই বা লেখা হয়েছে! এছাড়া আলেকজান্ডার পুশকিন, তার হাতে গোনা ছোটগল্পের সম্ভার, দ্য পোস্টমাস্টার কিংবা দ্য আন্ডারটেকার।

আধুনিক সময়ে অবশ্যই মার্কেজ। মার্কেজই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র সাহিত্যিক যিনি পৃথিবীর প্রায় সমস্ত লেখ্য ভাষায় তার উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারলেন। মার্কেজ তার সাহিত্য রচনা করে গেছেন স্প্যানিশ ভাষায়, অথচ ব্রিটেন এবং আমেরিকা জুড়ে ইংরেজিতে এই মুহূর্তে মার্কেজ ঘরানার কতজন ধারক। মার্কেজের দিকে তাকালে সত্যিই বিস্মিত হয়ে যেতে হয়।এছাড়া লালন রবীন্দ্রনাথের গান অনেকের মতো আমারও আশ্রয়।

অঞ্জন : আপনার লেখাগুলোর রসদ আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? এসব লেখায় ব্যক্তি আপনি কতখানি উপস্থিত আছেন?
সাত্যকি : এর আগে যাদের লেখা নিয়ে কথা বললাম তার অব্যবহিত পরে নিজের লেখা নিয়ে কথা শুরু করা বাতুলতা। তবু তোমার প্রশ্নমালার স্বার্থে বলি কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করে বেরিয়ে আমি পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম ও মফস্বলে সরকারি চাকরি নিয়ে চলে যাই। সেখানে গিয়ে যে জীবন ও মানুষ দেখতে পাই তার সঙ্গে আমার কোনও পূর্ব পরিচয় ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামও এই শতাব্দীর দোরগোড়া থেকে এক রকম গ্লোবাল বদলের শরিক হয়ে যায়। আমি গিয়ে যে গ্রাম দেখি সেই গ্রাম যেন হঠাৎই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাকে যেন পোশাক বদলে বাইরে কাজের খোঁজে যেতে হচ্ছে। চিরচেনা চণ্ডীমণ্ডপ আর বাঁশবনের নির্জন ছায়ায় সে আর খুশি নয়। পারিবারিক চাষের জমি ভাগবাটোয়ারা হয়ে যাওয়ায় তার ভাগে যেটুকু পড়েছে তাতে তার ছেলেপুলে নিয়ে সংসার চালানো মুশকিল। এর বাইরে তাকে গ্রাম ছাড়িয়ে যে কাজের পৃথিবী তা ডাকতে শুরু করেছে। তাকে সুরাট ডাকছে, গুরগাঁও ব্যাঙ্গালোর মুম্বাই ডাকছে আবার মালয়েশিয়া, আবু ধাবি পৌঁছে দেওয়ার দালালও ঘোরাফেরা করছে চারপাশে। গ্রামের এত কালের চরিত্ররা তাই আজ বিভ্রান্ত। দিশেহারা। এই সময়ের চালচিত্র বাংলাদেশের সাহিত্যেও নিশ্চয়ই এসেছে। দুই বাংলায় এই প্রেক্ষাপটটি তো প্রায় একরকম।  বদলে যাওয়া গ্রাম-মফস্বল তাই আমার প্রথম দিকের লেখালেখির একটা বড় বিষয়। যদিও এই যে হিউম্যান মাইগ্রেশন, আজকে যার প্রায় বিশ্ব-জোড়া ছবি এই বিষয়টি আমাকে বরাবরই টানে। হয়তো টানবেও।

‘ইছাই নদীর পালা’ লিখেছিলাম ইছামতির পাড় ছেড়ে চিরাচরিত জেলে পরিবারের মানুষদের কাছে বা দূরের শহরে নানা রকম কাজে মজুর বৃত্তি করতে চলে যাওয়া নিয়ে। ‘বন পরব’ উপন্যাসে রয়েছে বাঁকুড়া পুরুলিয়ার খরা এলাকা থেকে কৃষি শ্রমিকদের বছর বছর বর্ধমান হুগলির অপেক্ষাকৃত উর্বর এলাকায় কাজ খুঁজতে চলে যাওয়ার কাহিনী। শেষ উপন্যাস ‘অনাগরিক’-এর বিষয় বাংলাদেশ থেকে ঠিকা শ্রমিক হয়ে ভিসা পাসপোর্ট ছাড়া কলকাতায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে আসা। তিনটি উপন্যাসেই মানুষ তার চেনা সমাজ ছেড়ে আর কোথাও যাচ্ছে। সে চেনা পরিধিতে আর খুশি নয়। উপন্যাস তিনটি প্রকাশের সময়কাল যথাক্রমে ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৫ সাল। যদিও বিষয় হিসেবে তিনটিই আজও একই রকম জীবন্ত ও সচল।এছাড়া আমার ছোটগল্গগুলিতেও ঘুরেফিরে চেনা জায়গার বাইরে চলে যাওয়া আর বদলানো সময়ের কথা আসে। সচেতনভাবে আমি না চাইলেও আসে।

অঞ্জন : পত্রিকায় কবে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে? শুরুটা জানতে চাই।
সাত্যকি : মোটামুটি ১৯৮৭ সাল থেকে লিখতে শুরু করেছি। সেটা আমার ছাত্রজীবন। প্রথম দিকে বছরে একটি বা দুটি গল্প লিখতে পারতাম। তুলনায় এখন লেখার পরিমাণ একটু বেশি।

অঞ্জন : বর্তমান সময়ে পশ্চিমবঙ্গে নতুনদের মধ্যে কাদের লেখা আপনার পছন্দ?
সাত্যকি : এ ব্যাপারে আমার ধারণা খুবই কম। তবে এখনও যারা লিখছেন তাদের মধ্যে রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের নঙ্গরচন্দ্র সিরিজের বেশ কিছু লেখা, অমর মিত্রের ধনপতির চর উপন্যাস, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর উপন্যাস চতুষ্পাঠী এবং কিন্নর রায়ের সাম্প্রতিক সময়ে লেখা বেশ ক-টি ছোটগল্প আমার পছন্দের। এরা প্রত্যেকেই এখনও সচল। এরা এখনও বিষয়ের দিক থেকে নতুন ভাবনা ভাবতে পারেন। আবুল বাশার এখনও নতুন রকমের লিখছেন।

অঞ্জন : বাংলাদেশের কবিতা গল্প উপন্যাস সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? কার কার লেখা ভালো লাগে।
সাত্যকি : সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর উপন্যাস নিয়ে আমার মুগ্ধতার কথা আগেই বলেছি। এছাড়া বলব শওকত ওসমানের কথা, ইলিয়াসের ঘরানার কথা, আবু ইসহাকের কথাশিল্প নির্মাণের দৃশ্যময়তার কথা। এবং অবশ্যই শহীদুল জহির। সৈয়দ শামসুল হকের আত্মজীবনী যেটি বছর কয়েক আগে কোনও একটি ঈদ সংখ্যায় পড়েছিলাম সেটির কথাও ভুলে থাকা যাবে না। আমি পছন্দ করি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে এবং তার লেখা পড়ার সময় আশা করি কখনও তার সঙ্গে আমার একবার দেখা হবে। এছাড়া হরিশংকর জলদাস, প্রশান্ত মৃধা, সাদ কামালী, মঞ্জু সরকার, মশিউল আলম, শাহীন আখতারের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। কখনো ভালো লেগেছে অথচ এই মুহূর্তে মনে করতে পারলাম না এমন কিছু নাম নিশ্চয়ই রয়ে গেল আড়ালে। কিন্তু খণ্ডকালীন সাক্ষাৎকারের এটিই তো সীমাবদ্ধতা।

একটি নেট পত্রিকায় রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার কবিতা পড়লাম অতি সম্প্রতি, এবং মুগ্ধ হলাম।

অঞ্জন : পশ্চিমবঙ্গের যে পরিমাণ বই বাংলাদেশে পাওয়া যায় সে তুলনায় বাংলাদেশের বই পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায় না। এতে করে বাংলাদেশের অনেক শক্তিশালী লেখকের লেখাও পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের কাছে পৌঁছয় না। অনেক পাঠক বাংলাদেশি অনেক বড় লেখকের নাম পর্যন্ত শোনেনি। এই ব্যর্থতার হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় কী হতে পারে বলে আপনার অভিমত।
সাত্যকি : এই ব্যাপারে যেটা বলার তা হল তুমি বা তোমরা এটাকে ব্যর্থতা বলতে চাইছ ঠিকই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের গড়পড়তা পাঠক প্রকাশক বা লেখক এটাকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে চায় কিনা সে ব্যাপারে ঘোরতর সন্দেহ। এর মূল কারণ আমি চারপাশে যেমন দেখি, তাতে সমগ্র বাংলাদেশ বিষয়েই পশ্চিমবঙ্গে আগ্রহের অভাব। আমরা শুধুমাত্র বর্ষাকাল এলে বাংলাদেশ সম্পর্কে খানিকটা উৎসুক হই এবং বারবার জানতে চাই এ বছর ইলিশ মাছ আসছে কিনা। আর ভাসা-ভাসা শুনে ভাবি বাংলাদেশ যেন আমাদের তিস্তার জল কোনও ভাবে নিয়ে না চলে যায়। তুমি জেনে অবাক হবে অঞ্জন, বড় রাজনৈতিক ব্যাপার ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের প্রায় কোনো দৈনিক কাগজেই বস্ত্রশিল্প কারখানায় আগুন আর বড়সড় কোনও ফেরি দুর্ঘটনা ছাড়া বাংলাদেশের কোনও খবর ছাপা হয় না। ব্যাস। যে ভূখণ্ড নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই, তার সমাজ-জীবন নিয়ে তার ইতিহাস নিয়ে তার সংস্কৃতি নিয়ে তার সাহিত্য-চর্চা নিয়ে আগ্রহ হবে কেন! যেমন তুমি যদি মুক্তিযুদ্ধের কথা ধরো তো এটা নিশ্চিত যে পশ্চিমবঙ্গের খুব মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা আবেগ নিয়ে এপার বাংলার এখনের বাঙালির সে-অর্থে কোনও আগ্রহ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সনটাকেও বলতে পারবে না শতকরা নব্বই ভাগ লোক। ফলে ওই আর কী। এসবের কোনো পরিত্রাণ হয় না। যে মনে করছে আমার আর কিছু জানার দরকার নেই, নিজে যা লিখছি তাই একমাত্র মহাকাব্য, তাকে তুমি কীভাবে কী বোঝাবে! এবং তুমি আশ্চর্য হবে শুনে, পশ্চিমবঙ্গের সংলগ্ন প্রতিবেশী আসাম বা ওড়িশার সাহিত্য নিয়েও এ-রাজ্যে কেউ ভাবে না। ত্রিপুরা আরেকটি রাজ্য যার মাতৃভাষা বাংলা, যেখানে সমস্ত কাজকর্ম বাংলায় হয়। সেখানেও বাংলা ভাষায় সংস্কৃতি চর্চার একটি বলিষ্ঠ ধারা বহমান। পশ্চিমবঙ্গের হাতে গোনা তিরিশ জন মানুষও কি ত্রিপুরায় বসে লেখালেখি করা কোনও কবি বা গল্পকারের নাম জানেন? শতকরা নয়, হাতে গোনা তিরিশ জন! জানেন না।

অঞ্জন : অভিযোগ আছে বাংলাদেশের অনেক নবীন-প্রবীণ লেখকের ভালো লেখা পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা তো দূরে থাক, সাধারণ সাহিত্য পাতায় প্রকাশের জন্যও মনোনীত হয় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় তো বটেই, ঈদ উপলক্ষে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের সবিশেষ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ বৈষম্য কেন বলে মনে হয়। এটা কি বাণিজ্যিক নাকি রাজনৈতিক?
সাত্যকি : এই প্রশ্নটি আগের প্রশ্নের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এবং এর খানিকটা উত্তরও আগের উত্তরের মতো। অনাগ্রহী তাই উদাসীন। তবে এর বাইরেও কিছু কথা থাকে, কারো কারো কথা থাকে যাদের কথাও না বললে নয়। বাণিজ্যিক খবরের কাগজ তাদের সংস্কৃতির পাতায় বাংলাদেশ নিয়ে নীরব থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের লিটল ম্যাগ বা ছোট কাগজেরা অনেকেই কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে যথেষ্ট কৌতূহলী। এবং সরব। তারা অনেকেই অনিয়মিতভাবে হলেও বাংলাদেশ সংখ্যা করে, তোমাদের ওখানের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, লেখা আদানপ্রদানও হয়। তাদের উপস্থিতিটা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য মানচিত্রে সামগ্রিকভাবে এত জোরালো যে তারাও শেষ পর্যন্ত বেশ কিছুটা মনোযোগ অধিকার করে বসে। যেমন মনে করতে পারি তপস্যা ঘোষ সম্পাদিত ‘সাগ্নিক’ পত্রিকার কথা যারা গত সাত-আট বছরের মধ্যে অন্তত দুটি সংখ্যায় সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ছোটগল্প নিয়ে আলাদা ক্রোড়পত্র করেছে। এমন কাজ আরও অনেকে করছেন। এই মুহূর্তে সুশীল সাহা বলে এক ভদ্রলোকের কথা বলতে পারি যার স্বার্থহীন কাজটিই হল দুই বাংলার মধ্যে সাহিত্য-চর্চার আদান-প্রদান ঘটানো। তিনি বহুকাল ধরে এই কাজটিই করছেন। আসলে এমন মানুষ কম হলেও দুই পাশেই আছেন যারা কোনো না কোনোভাবে বাংলাভাষা সংস্কৃতির অখণ্ডতায় বিশ্বাস করেন। তাদের জন্যই শেষ পর্যন্ত আমরা অনেকটা আলো দেখতে পাই। আমরা তোমাদের ওদিকের নানা রকম লেখা পড়ার সুযোগ পাই তাদের মাধ্যমেই।

অঞ্জন : দুই বাংলার সাহিত্য সম্মিলন কীভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? এক্ষেত্রে যদিও লিটল ম্যাগগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। আপনি নিজেও লিটল ম্যাগে লেখেন।
সাত্যকি : বাংলাদেশকে বা আমার নিকট বাংলাভাষী পড়শিকে জানার আগ্রহ যত দিন না বাড়ছে তত দিন সামগ্রিকভাবে সাহিত্য জানার আগ্রহ তৈরি হবে না। ফলে বাংলাদেশ-চর্চা বাড়াতে হবে। সে কাজটা করতে হবে আমাদেরই। ব্যক্তি উদ্যোগে হলেও আমাদেরই সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এবং সে কাজটা হচ্ছেও।

অঞ্জন  : সাহিত্য প্রসারে ব্লগ অনলাইন পত্রিকা ও ওয়েব ম্যাগাজিনগুলো কতখানি ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
সাত্যকি : ইংরেজি ভাষা পড়ার মতো বাংলাভাষাতেও অনলাইন পড়াশুনো করার সুযোগ প্রতিদিন বাড়ছে। এবং এর ফলে হার্ড কপি আদান-প্রদানের যে ভৌগলিক জটিলতা তা দূর হয়ে যাচ্ছে। ওয়েব পত্রিকার মাধ্যমে সারা পৃথিবীর বাংলাভাষা চর্চার স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে এখন। এটা নিশ্চয়ই খুব ভালো ব্যাপার। সম্প্রতি ‘সেই বই’ নামে একটি সংস্থার সঙ্গে আলাপিত হওয়ার সুযোগ পেলাম যারা প্রায় ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত কিন্ডল্ নামক ই-স্লেটের আদলে বাংলা সাহিত্য পড়ানোর কথা বাণিজ্যিকভাবেই ভাবছেন। সারা পৃথিবী জুড়ে এই সংস্থাটির কাজের ভুবন।

অঞ্জন  : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সাত্যকি : তোমাকেও ধন্যবাদ অঞ্জন।

আপনার মন্তব্য

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন