অচেনা পথ

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-১২ ২৩:৩৬:৫৮

সরদার আব্বাস আলী:

কোলাহল পেরিয়ে উঁচু উঁচু টিলার মাঝে গাছে ঘেরা যে উঁচু ভবনটি দাড়িয়ে আছে ওটা রায়হানের হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী থাকে ওখানে থাকে, রায়হান তাদের একজন।

হল থেকে বেরিয়ে বা দিকে বাকিয়ে যে রাস্তাটি শহরের দিকে গেছে, সেটায় কিছু দূর এগোলেই একটা লেডিস টেইলার্সের দোকান। দোকানের সামনে দেয়ালে খেলা আছে “মডার্ন টেইলার্স”, মহিলা ও শিশুদের পোশাক তৈরি করা হয়।

দোকানটি রায়হানের খুব পরিচিত। গত তিন বছর ধরে এ রাস্তায় এ দোকানের সামনে দিয়ে সন্ধ্যার আযানের পরে অসংখ্য বার গিয়েছে সে। প্রতিদিনই যাওয়ার সময় সে দেখেছে দোকানের এক ষোড়শী মেয়ে কাজ ফেলে রাস্তার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে, রায়হানকেও দেখেছে অসংখ্য বার। রায়হানও দেখেছে, শ্যামলা বর্ণের গোল চেহারার মেয়েটিকে। চেহারার বাম দিকে চেখের নিচে একটা তিল আছে। টিউশনি শেষে একই রাস্তায় ফিরতো সে, তবে তখন দোকান বন্ধ থাকতো। অন্য সময়ও এ দোকানের সামনে দিয়ে গিয়েছে রায়হান, তখন মেয়েটিকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নি। দেখেছে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে, কোনো দিকে তাকানো সময় নেই।

বেশ কিছু দিন মেয়েটিকে দোকানে দেখা যায় নি। প্রথম দিকে রায়হান ভেবেছিলো হয়তো ছুটিতে বাড়ি গেছে। অনেক দিন পেরিয়ে গেলে ওর চিন্তার পরিবর্তন আসে। ভাবে দোকানদার হয়তো ঠিক মত টাকা দিতো না তাই চাকুরি ছেড়ে দিয়েছে অথবা হয়তো ভালো কোনো দোকানে চাকুরি পেয়েছে। আবার ভাবে না, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে তাই চাকুরি ছেড়ে স্বামীর সাথে চলে গেছে। আরও অনেক ভালো মন্দ চিন্তা আসে রায়হানের মাথায়।

প্রায় তিন মাস পরে মেয়েটি আবারও দোকানে এসেছে। সেই একই দৃশ্য। চলে অল্প দিন। আবার নেই। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় মেয়েটি আর দোকানে আসে না।

এক দিন সন্ধ্যায় দোকানের সামনে একটা বড় ধরনের জটলা দেখে এদিয়ে যায় রায়হান। দেখে, এক বৃদ্ধ বয়সী মহিলা দোকানের সামনে দাড়িয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে দোকানদারকে অনুরোধ করছে কিছু টাকা দেয়ার জন্য। দোকানদার তার কথা রাখে নি, তাড়িয়ে দিয়েছিলো। বলেছিলো টাকা নিলে তার দোকানের অমঙ্গল হবে। কোনো নষ্টা মেয়ের জন্য সে টাকা দেবে না।

টাকা না পেয়ে চলে যাচ্ছিলো মহিলাটি। রায়হান ভাবলো কথা বলবে। পরে ভাবলো কি বলে পরিচয় দেবে? কি জানতে চাইবে। এ মহিলা কি আসলেই ঐ মেয়ের কেউ? নাও তো হতে পারে। সাত পাঁচ ভেবে তার পিছু নিলো রায়হান।

দুটি রিক্সাই অনেক রাস্তা বাক খেয়ে হাসপাতালের সামনে এসে থামে। পিছন পিছন একটা রিক্সা আসতেছে তার দিকে নজর নাই মহিলাটির। রিক্সা থেকে নেমে হাসপাতালের পূর্ব দিকে সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠে দক্ষিণ দিকের মহিলা ওয়ার্ডে ডুকে যান তিনি। রায়হান ওয়ার্ডের সামনে এসে দাড়ায়, মহিলা ওয়ার্ডে রাতে প্রবেশ করা ঠিক হবে না। তাছাড়া পরিচিত কেউ না থাকলে কি বলবে সে। কিছু সময় দাড়িয়ে ওয়ার্ডের ভিতরে দেখার চেষ্টা করে সে। এখান থেকে কিছুই দেখা যায় না। পরে পশ্চিমের দেয়ালের সাথে রাখা চেয়ারে বসে থাকে রায়হান। কিছু সময় পরে এক লোক এসে এখান থেকে সবাইকে সরে যেতে বলে। রায়হান চলে যায়। আজ আর টিউশনিতে যাওয়া হলো না।

এরপরে অনেক সন্ধ্যায় টিউশনিতে না গিয়ে এ চেয়ারে বসে ছিলো রায়হান সেই মহিলাটির আসায়। নাম জানলে হয়তো খুঁজে বের করা যেত। ভাবে, ঐদিন কেনো যে তার সাথে কথা বললো না, কথা বললে তার এতো কষ্ট করতে হতো। নানা চিন্তায় তার মাথাটাও ভার হয়ে থাকতো না। অন্যান্য কাজের সাথে হাসপাতালের এ চেয়ারটায় বসে থাকাও নিয়ম হয়েছে রায়হানের। অনেকে তাকে দেখেছে এখানে বসে থাকতে। এভাবে চলে যায় মাস।

সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ঘনিয়ে এসেছে রায়হানের। তাই এখন ক্লাস শেষ করেই হাসপাতালে যায় রায়হান। সন্ধ্যায় যায় টিউশনিতে।

একদিন হঠাৎ দেখে কয়েকটি কাগজ হাতে ওয়ার্ড থেকে বের হচ্ছে মহিলাটি। ওয়ার্ড থেকে বেরিয়েই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় সে। পিছু নেয় রায়হান। তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। হাসপাতাল থেকে বেড়িয়েই মহিলাটির সামনে দাড়ায় ও। বলে, একটু কথা বলা যাবে? আপনাকে মনে হয় ওই দোকানের সামনে দেখেছি?

মহিলা জানায় তার মেয়ে ওই ওয়ার্ডে ভর্তি। আজই বাড়ি থেকে এসেছে। এর আগে দুই বার ভর্তি হয়েছিলো। পরে টাকার অভাবে বাড়ি চলে গিয়েছিলো। এখন অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যাওয়ায় আবার নিয়ে আসতে হলো।

কি অসুখ হয়েছে জানেন না তিনি। শুধু বুঝেন অসুখটা ভালো না। কেউ কাছে আসতে চায় না। সবাই নষ্টা বলে। বাড়িতে কেউ আসতো না। দূর থেকে দেখে চলে যেত। তারতো মেয়ে তার করার কিছু নাই। কত লোকে কত কথা বলে সবই তার শুনতে হয়। সহ্য করতে হয় কারণ সে তো মা। তার মেয়ের প্রতি তার অনেক বিশ্বাস তার মেয়ে নষ্টা হতে পারে না। তারপরও লোকের কথায় উত্তর দেয় না সে।

রায়হান বলে আমি ওকে একটু দেখতে চাই। কথাটা শুনেই বড় বড় চোখ করে তাকায় মহিলাটি। রায়হানের কাছে মনে হয় সে কোনো অন্যায় করে ফেলেছে। মহিলাটি জানতে চায়, তুমি শিউলিকে চেনো?

মেয়েটির নাম শিউলি, নাকি পরীক্ষা করার জন্য এ নাম বলছে বুঝতে পারে না রায়হান। বলে, না, চিনি না।

আবার রায়হানকে কয়েকবার দেখে নিয়ে মহিলাটি বলে, চিনো না তারপরও দেখতে চাও? যারা ওরে চিনে তারাতো কেউ দেখতে চায় না?

এ প্রশ্নের জবাব রায়হানের কাছে নেই। সেও হয়তো রোগের নাম শুনলে পালিয়েও যেতে পারে আবার নাও পারে, ভাবে রায়হান।

অবশেষে মহিলাটি জানায়, এখনতো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তুমি দেখতে চাইলে কাল বিকেলে এসো।

রাতে এ নিয়ে অনেক চিন্তা করে রায়হান। কি হয়েছে মেয়েটির? এই মেয়েই কি সেই মেয়ে নাকি অন্য কেউ? এ মেয়ে হলে সে কি বলবে? অন্য কেউ হলে কি বলবে? কেনো মহিলাটি তাকে বারবার দেখছিলো। মহিলাটি তাকে নিয়ে কি ভাবছে। কাল যাওয়া ঠিক হবে কিনা। গেলে কোনো সমস্যা হবে কিনা। একাই যাবে নাকি কাউকে নিয়ে যাবে। মহিলাটি তার পরিচয়ও জানতে চায় নি। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরে সে।

বিভিন্ন ভাবনায় সকালে আর ক্লাসে যাওয়া হয় নি তার। ভাবলো এক বন্ধুকে নিয়েই হাসপাতালে যাবে সে। একা যাওয়া ঠিক হবে না। বিকেলে হাসপাতালে গেলো রায়হান। সাথে তার বন্ধু নিয়াজ। ওয়ার্ডের সামনের দাড়িয়ে থাকলো কিছু সময়, পরে দেখতে পেলে সেই মহিলাটিকে। একাই সে। কোনো কথা জিজ্ঞাস না করেই তাদের দুজনকে সাথে নিয়ে ওয়ার্ডে প্রবেশ করলো সে। পশ্চিম সারির শেষের বেডটিতে গিয়ে থামলেন তিনি। পাশে বসে বললেন, দেখ তোকে দেখতে কারা এসেছে। মুখ থেকে কাপড় সরাতেই চিনতে পারলো রায়হান। গায়ের রং অনেকটা কালো হয়ে গেছে। অনেক শুকিয়ে গেছে, শরীরের হাড় গোনা যাবে। শুকিয়ে চেহারা এখন আর গোল নেই। চোখের নিচের তিলটা দেখেই চিনতে পেরেছিলো রায়হান। না হলে হয়তো নাও চিনতে পারতো সে।

রায়হানকে দেখে শিউলি বললো, আপনি?

শিউলির দিকে তাকিয়ে রায়হান বললো, আমি মানে? আমাকে আপনি চিনেন?

উত্তরে শিউলি বললো, চিনি, নাম জানি না।

নিয়াজ পাশে রাখা ডাক্তারের ফাইল দেখছিলো। কিছুক্ষণ পরে রায়হানের কানে কানে বললো, মেয়েটার এইডস হয়েছে। চল আমরা চলে যাই।

সেদিন আর বেশি সময় কথা হয় নি। নিয়াজের পিড়াপিড়িতে চলে এসেছিলো। চলে আসার সময় শিউলি জানতে চাইছিলো রায়হান আবার আসবে কিনা? তার ধারণা রায়হান আর আসবে না।

রায়হান বুঝতে পারে শিউলিকে সবাই কেনো নষ্টা বলে। সে ভাবে, মেয়েটিতো ভালোও হতে পারে। এইডস কি মানুষের শরীরে জন্ম নিতে পারে না? পারে কিনা জানে না রায়হান। তবে এইডস শরীরে আসার তো অনেক কারণ আছে। সে ভাবে, আমি যে নিষ্পাপ চেহারা দেখেছি তাতে সে কোনো ভাবেই খারাপ হতে পারে না। চেহারা দেখেই কি মানুষের ভালো মন্দ নির্ধারণ করা যায়? যায় না। চিন্তার সাগরে তলিয়ে যায় রায়হান। সে যাই হোক সে নিয়মিতই হাসপাতাল যাবে, খোঁজ খবর নিবে বলে চিন্তা করে।

রায়হান নিয়মিতই হাসপাতাল যায়। সে প্রায় শিউলি সম্পর্কে সব কিছুই জেনেছে। সে জেনেছে, শহরের উত্তর দিক দিয়ে যে বড় রাস্তাটি আছে। সেটা দিয়ে ত্রিশ কিলোমিটার গেলেই শিউলিদের গ্রাম। সেখানেই বড় হয়েছে সে। শিউলি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে তখন তার বাবা মারা গেছে। তার বাবা ছিলো কৃষক। তেমন জমা জমি ছিলো না। বাড়ির জমি ছাড়াও এক খণ্ড জমি তাদের আছে। আর ছিলো দুইটা গরু। বাবা মারা যাওয়ার পর এক বছর পড়া-শুনা হয়েছিলো তার। চাচা আর মামারা মিলে কিছু টাকা দিয়েছিলো আর গরু দুইটা বিক্রি করে চলেছিলো ওই বছর। পরে আর কেউ টাকা দিতে রাজি হয় নি। পরে কাজের সন্ধানে শহরে আসে শিউলি। তার চাচার সাথে এসেছিলো। একটা দর্জি দোকানে দিয়ে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিলো শিউলির চাচা। কাজ শিখতে সময় লেগেছিলো বছর দুয়ের মত। তারপর কাজ নিয়েছিলো মডার্ন টেইলার্স দোকানে। কাজের মেয়ে সে। সারাক্ষণ কাজ করতো। খুব বেশি কথা বলতো না। কারও সাথে ঝগড়া তার পছন্দ নয়। বছর তিনেক ভালোই চলেছিলো তার। তার আয়ের টাকা দিয়ে ভালোই চলছিলো তাদের সংসার। এরপরই মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

প্রথমবার যখন অসুস্থ হয় তখন গ্রামের অনেকেই দেখতে এসেছিলো। কেই বাদ নেই, চাচা, মামা, এলাকার কত লোক যে এসেছিলো তার হিসেব নেই। যখন বাড়ি নেয়া হয়েছিলো তখন গ্রামের প্রায় সবাই দেখতে এসেছিলো। সবাই তার জন্য দোয়া করেছিলো। সময়ের সাথে সাথে সব পাল্টে গেছে। শেষবার যখন বাড়িতে নেয়া হয়েছিলো তখন কেউ দেখতে আসে নি। বাড়ি নেয়ার দুদিন পর ওর মামা এসেছিলো বাড়িতে। বাহির ঘর থেকে চলে গিয়েছিলো। একবারের জন্যও ঘরে যায় নি সে। ছোট বেলা এই মামা ওকে কত আদর করতো। বলতে বলতে কেঁদে ফেলে শিউলির মা। সবাই ওকে নানা প্রশ্ন করেছে। কেউ বাদ নাই, সবাই।

বলে, শোনো বাবা, তোমরা শিক্ষিত পোলা। কত কিছু বুঝ, বলতো আমার মাইয়াডা কি সত্যিই খারাপ? ও কত ভালো ছিলো। কারও সাথে বেশি কথা বলতো না। চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে তার। এমন অনেক দেখেছে রায়হান। দেখেছে শিউলির পাশে বসে কাঁদতে। রায়হান অনেকবার বুঝিয়েছে, ওর পাশে বসে কাঁদলে, ও কষ্ট পাবে। হয়তো তার মনে থাকে না অথবা বুঝতে পারে না।

রায়হান বেশ কয়েকবার ঋণ করে টাকা দিয়েছে শিউলির মাকে। কত খরচ, ঔষধ, খাওয়া। এতো টাকা যোগাবে কোথা থেকে?

রায়হানের ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে তাই এখন আর নিয়মিত হাসপাতাল যাওয়া হয় না। দুইটা পরীক্ষা হয়েছে তার মধ্যে মাত্র একবার হাসপাতাল যেতে পেরেছে সে। তৃতীয় পরীক্ষা শেষে হাসপাতাল গিয়ে জানতে পারলো শিউলির অবস্থা ভালো না। গত তিন দিনে অনেকবার বমি করেছে। কিছু খেতে পারে না। মাঝে মাঝে বেশ কান্নাকাটি করে। রায়হানকেও দেখতে চেয়েছে দুইবার। রায়হানের কথা শুনে একবার চোখ মেলে তাকিয়েছে শিউলি। সাথে ঠোটের কোনো একটু মুচকি হাসি। তারপর আবার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে।

রাতে রায়হান হলে ফিরে নি। পশ্চিমের দেয়ালের সাথের চেয়ারে বসে ছিলো সারারাত। সকালে শিউলির মা বাড়ি যাবে জমি বিক্রি করতে। যদি ঔষধপত্র কিনে কিছু দিন মেয়েটাকে বাঁচানো যায়। কেউ তো আর সত্য কথা বলে না। সব আশ্বাসই মিথ্যে মনে হয় শিউলির মার কাছে। সবচেয়ে বেশি মিথ্যে মনে হয় ডাক্তারের কথা। একা একাই বিড়বিড় করেন তিনি। মনে হয় পাগল হয়ে যাবেন। গ্রাম থেকে ফেরার সময় শিউলির মামীকে নিয়ে এসেছে সাথে করে। একা সব সামলাতে পারেন না তাই। তিনিও আসতে চাননি, পরে অনেক বুঝিয়ে সাথে করে নিয়ে আসতে হয়েছে।

গত চার দিন ধরে হাসপাতালেই আছে রায়হান। মাঝে মাঝে দুই তিন ঘণ্টার জন্য হলে যায়। আবার ফিরে আসে। রাতেও চেয়ারে বসে বসে ঘুমায়। কয়েকটা পরীক্ষাও দিতে পারে নি সে। ওই দিন ডাক্তার বলে গেছে, সময় বেশি নাই। যা চায় খেতে দিন। কি আর চাইবে? কিছুই চাইবে না, চাইলেও পাবে না। সাধ্য থাকলে না সাধ পূরণ করবে।

সেদিন রাতে কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো শিউলি। তখন মধ্যরাত। হঠাৎ রায়হানকে দেখতে চায় শিউলি। রাতে ওয়ার্ডে পুরুষ প্রবেশ নিষেধ। অনেক অনুনয় বিনয় করে ওয়ার্ডে প্রবেশ করেছিলো সে। রায়হানকে দেখে কিছু বলতে চাইছিলো শিউলি। মুখ নড়ছিলে ঠিকই, কোনো শব্দ বের হয়নি। দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়ছিলো অনবরত। হয়তো রায়হানের কাছে এ নিষ্ঠুর সমাজের বিচার দিতে চাইছিলো শিউলি। হয়তো বলতে চাইছিলো, কত আপনজন কাছে আসে নাই, আপনাকে চিনি না জানি না, আপনি কেনো এখানে পড়ে আছেন? সেদিন রায়হানের চোখেও পানি দেখেছিলো শিউলি। দেখেছে, নিথর এক করুন চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে আর বলছে, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কিছু সময় পরে সেই পরিচিত চেয়ারে এসে বসে রায়হান। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। শরীরটা একেবারে জড়ো হয়ে গেছে।

রাত তখন প্রায় শেষের দিকে, বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসও বইছে সামান্য। এক নার্স এসে রায়হান বলে ডেকেছিলো। বলছিলো রোগীর অবস্থা ভালো না। রায়হান আর ভিতরে যায় নি। কিছু সময় পরে উচ্চ স্বরে কান্নার আওয়াজ শুনে ভিতরে গেলো রায়হান।

হাসপাতালের সাথে সকল হিসেব শেষ করে ছাড়পত্র নিতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। লাশবহণকারী একটা গাড়ি আনা হয়েছে। ওয়ার্ডে গিয়ে দেখলো শিউলির মা এখন বারবার মূর্ছা খাচ্ছে। কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আসতেছে। লাশ নিয়ে গাড়িতে তুললো রায়হান। উপরে একটা সাদা কাপড় বিছিয়ে দিলো। শিউলির মামী শিউলির মাকে নিয়ে গাড়ির পেছনে উঠলো। রায়হান গাড়ির সামনের সিটে উঠে বসতেই গাড়ি চলা শুরু করলো। চারদিকের গাড়ি, ইটপাথরের বাড়ি পেরিয়ে তাদের গাড়ি শহর থেকে বের হলে প্রধান সড়ক ধরলো। চারদিকের গ্রাম, ধানক্ষেত পিছনে ফেলে বিপদের আওয়াজ বাজিয়ে হনহন করে ছুটছে লাশবাহি গাড়িটি। পেছনে কান্নার শব্দ।

পুরো পথে একটা কথাও বললো না রায়হান। প্রধান সড়ক ফেলে পার্শ্ব রাস্তা তারপর একটা কাঁচা রাস্তার পাশে এসে থামলো গাড়ি। সেখানে অনেক লোকের জমায়েত ছিলো। এই কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে কিছু দূর গেলেই শিউলিদের বাড়ি। আর গাড়ি নেওয়া যাবে না। লাশ নিতে হবে খাটিয়ায় করে। লাশ খাটিয়ায় তুলে এক কোনা কাঁধে নিলো রায়হান। বাকিগুলো বিভিন্ন জনে নিয়েছিলো। কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে শিউলিদের বাড়ির উঠানে খাটিয়া রাখলো রায়হানরা। খাটিয়ার সাথে সাথেই আসছিলো শিউলির মা। অনেকে তাকে ধরে রাখতে ছিলো। উঠানে এসে লাশের উপর পড়ে মূর্ছা খাচ্ছিল বারবার। কেঁদে কেঁদে বলছিল আমার সব শেষ।

চারদিক একবার দেখলো রায়হান। দেখলো একটা মাটির ঘর, উপরে পুরানো টিন। অনেক লোকের সমাগম। সবাই তাকে দেখছে। কারও সাথে কোনো কথা না বলে আবার রাস্তার দিকে হাটতে শুরু করলো সে। পাকা রাস্তার কাছে এসে একবার পিছনটা ভালো করে দেখে নিলো। এখান থেকেও কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। সন্ধ্যার আযান শোনা যাচ্ছে। গাড়িতে উঠে বসলো সে। গাড়ি চলতে শুরু করলো শহরের উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে গ্রামটি দূরে সরে যেতে লাগলো। সেদিকে আর একবারের জন্যও তাকাতে সাহস পেলো না রায়হান!

আপনার মন্তব্য