জীবনানন্দের ধুতি

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-০৮ ১৩:৩৭:০৬

 আপডেট: ২০১৬-০৭-০৮ ১৩:৪৪:৫৭

ফরিদ আহমেদ:

তক্তপোষের উপর উবু হয়ে গভীর মনোযোগে রুল টানা খাতায় লিখছেন তিনি। হাতে পেন্সিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্বোধ্য শব্দে বোঝাই হয়ে যাচ্ছে খাতার সাদা পাতা। এমনিতেই তিনি খুব ছোট অক্ষরে লেখেন, দ্রুত লেখার সময় সেগুলো আরো ছোট হয়ে আসে। হয়ে উঠে তাঁর কবিতার মতোই রহস্যময় এবং ইঙ্গিতবাহী।

দরজার কাছে কখন লাবণ্য এসে দাঁড়িয়েছে, টের পান নি তিনি।‘এই শুনছো?’লাবণ্যর এই উচ্ছ্বাসভরা ডাক শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকান তিনি। লেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অতি দ্রুত খাতাটাকে বন্ধ করে তক্তপোষের নীচে চালান দিয়ে দেন তিনি। ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসেন।

তাঁর কাণ্ড দেখে মনে মনে হাসেন লাবণ্য। বিয়ে হয়েছে, সেই কতো বছর হলো। এখনো লোকটা তাঁর লেখা নিয়ে লজ্জা পায়। তাঁকে দেখলেই খাতা লুকিয়ে ফেলে তোষকের নীচে, কিংবা তক্তপোষের নীচে ছুড়ে দেয় দ্রুতগতিতে। আজও ঠিক সেই ছেলেমানুষী কাজটাই করলেন। তিনি কিছু দেখেন নি এমন ভান করে ঘরে ঢোকেন লাবণ্য।
কিছুটা লুকোনো বিরক্ত নিয়ে লাবণ্যর দিকে তাকান তিনি। খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে বাধা পড়েছে তাঁর। কিন্তু, সেটা বলতে পারছেন না স্ত্রী আহত হবে বলে।

তিনি বিরক্ত হয়েছেন কিনা, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র নজর নেই লাবণ্যর। প্রবল উচ্ছ্বাসে ঘরে ঢোকেন তিনি। হাতে ধরা একটা নতুন ধুতি।

‘এই ধুতিখানা তোমার জন্য কিনেছি। দেখো তো কেমন হলো?’আগ্রহ ভরে ধুতিখানা লাবণ্য এগিয়ে দেন তাঁর দিকে।

লাবণ্যর বাড়ানো হাত থেকে ধুতিখানা নেবার কোনো আগ্রহ দেখান না তিনি।“আমারতো ধুতি আছে। খামোখা এটা কিনতে গেছো কেন তুমি?”নিরাসক্ত গলায় বলেন তিনি।

“মোটা মোটা ধুতি হাঁটুর উপরে পরে রাস্তা দিয়ে হাঁটো তুমি। লোকে হাসে না বুঝি?সেজন্য এই পাতলা কাপড়ের ভালো ধুতিটা কিনে এনেছি আমি।”অভিমানাহত লাবণ্য বলেন।

তক্তপোষ থেকে ধীরে ধীরে নামলেন তিনি। হেঁটে জানালার কাছে গেলেন। বাইরে বিষণ্ণ আকাশ। কোলকাতায় আজ বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়েই ধীর কণ্ঠে তিনি বললেন, “দেখ, তুমি যেভাবে খুশি সাজ পোশাক কর, তোমার সে ইচ্ছেয় আমি কোনো দিন বাধা দেবো না। কিন্তু, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। তোমার ইচ্ছামত আমাকে চালানোর বৃথা চেষ্টা করো না।”

তীব্র অভিমান এবং অপমান নিয়ে ঘর থেকে অপসারিত হন লাবণ্য। তিনি ফিরেও তাকান না। তাঁর দৃষ্টি সেই আকাশের ওপারের আকাশেই নিবদ্ধ।


২.
জলখাবার জুয়েল হাউজের সামনে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন তিনি। পার হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু অন্যমনস্ক তিনি। অন্যমনস্ক বললেও ভুল হবে। কী এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন তিনি। চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম স্পটিং স্টেশন থেকে তখনো প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে। অবিরাম ঘণ্টা বাজানো ছাড়াও বারংবার চিৎকার করে সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিল ট্রাম ড্রাইভার। কিন্তু, তিনি যেন আজ পণ করেছেন কারো কথা না শোনার। নির্বিকার রাস্তা পার হয়ে চলেছেন তিনি। যা অনিবার্য তাই ঘটলো। ড্রাইভার ট্রাম থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা নিল। কিন্তু, সেটা থামতে না থামতে ধাক্কা দিল তাঁকে। প্রচণ্ড এক ধাক্কায় তাঁর দেহ ঢুকে গেলো ক্যাচারের ভিতরে। ক্যাচারের কঠিন কবল থেকে অতি কষ্টে টে-হিঁচড়ে তাঁকে বের করে আনলো পথচারীরা। তাঁর দেহ রক্তাপ্লুত, দেহ অচৈতন্য। কেটে, ছিঁড়ে, থেঁতলে গেছে এখানে-সেখানে। রক্তের ছোপ মাথায়, হাতে, বুকে, ডান চোখের কোণায়। চুরমার হয়ে গেছে বুকের পাঁজর, উরুর হাড়।

ধরাধরি করে সবাই মিলে তাঁর অচেতন দেহটাকে নিয়ে গেলো রাস্তার ওপারে। তারপরে তাঁর আহত স্থানে দেওয়া হলো বরফ, মুখে ছিটানো হলো জল। কেউ কেউ বাতাসও করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর সংজ্ঞা ফিরে পেলেন তিনি।“কী হয়েছে? আমি এখানে কেন?”মাটিতে নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখে দারুণ অবাক হয়ে গিয়েছে তিনি।
“হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন।”কে একজন বুদ্ধি করে বললো।

“ও”। নিজের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে অস্ফুট কণ্ঠে বলেন তিনি।

“আপনার নাম কী?ঠিকানা কোথায়?”আরেকজন জিজ্ঞেস করে।

“জীবনানন্দ দাশ। ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোড।”খানিকক্ষণ এধার ওধার তাকালেন তিনি। তারপর বললেন, “আমি কি এখন বাড়ি যেতে পারি?”

“তা, যেতে…হ্যাঁ যেতে পারেন বৈকি।”কেউ একজন দ্বিধাভরে অনুমতি দেয়।

উঠতে গিয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলেন তিনি। ছাতু হয়ে গেছে ডান পা। এবার আর সেবা না। ট্যাক্সি ডাকা হলো। দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে। এ যে মরণাপন্ন রোগী।

৩.
শবযাত্রার জন্য সাজানো হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবিকে। রবীন্দ্রনাথের পরেই তাঁর স্থান।বুদ্ধদেব বসু এই শ্রাদ্ধবাসরেই দ্বিধাহীন, স্পষ্ট কণ্ঠে ঘোষণা বুদ্ধদেব বসু ঘোষণা করেছেন, “রবীন্দ্রনাথের পর বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাশের মতো এতো বড়ো প্রতিভাবান, প্রতিপত্তিশালী কবির আর মৃত্যু ঘটেনি।”

গভীর ভালবাসায় কবিকে শেষ বারের মতো সাজিয়ে দিচ্ছেন লাবণ্য দাশ। বহু বছর আগে শখ করে স্বামীর জন্য যে ধুতিখানা কিনেছিলেন, সেটাকে বের করেন তিনি। একদিন কবির তীব্র অনাগ্রহ দেখে এই ধুতি নিয়ে তাঁর কক্ষ থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মানুষটা সামান্যতম বিলাসিতা করতে চাইতো না পোশাক আশাক নিয়ে। কিন্তু, আজ, এই শেষ বিদায়ের বেলায় তিনি তাঁর স্বামীকে মোটা ধুতি পরে বিদায় দেবেন বলে পণ করেছেন। উনি যদি রাগ হয়, হোক। আজকের দিনে তিনি তাঁর কোনো রাগ, ক্ষোভের কাছে পরাভূত হবেন না। ওমন মলিন বেশে আজকের এই শেষ যাত্রায় তিনি তাঁকে যেতে দিতে পারেন না।

বছরের পর বছর সেই ধুতি খানাকে বাক্সবন্দি করে রেখেছিলেন তিনি। সেটাকে আজ বের করে যত্নের সাথে তিনি পরিয়ে দিলেন কবির গায়ে। পাতলা ধুতি পরে শেষ যাত্রায় রওনা দিলেন জীবনানন্দ দাশ।

রাতে আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে স্বপ্ন দেখলেন লাবণ্য। স্নানের ঘরে ঢুকে তাঁর ধুতির খানিকটা জায়গা ধুচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ। শব্দ শুনে লাবণ্য গিয়ে হাজির হয়েছেন স্নানঘরে। কবির কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গিয়েছেন তিনি। লাবণ্যর পায়ের শব্দ শুনে জীবনানন্দ দাশ সলজ্জ মুখে বলছেন, “দেখ তো, কি মুস্কিল। আমার মাত্র একখানাই ধুতি। তাও আবার কাদায় ভরে গেল।”

ধুতিটার দিকে তাকিয়ে গলা শুকিয়ে যায় লাবণ্যর। অতি পরিচিত এই ধুতি তাঁর। শেষ যাত্রায় পরানো সেই পাতলা কাপড়ের বাহারি ধুতিটাকেই সযত্নে ধুচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ।

ঘুম ভেঙে যায় লাবণ্য-র। মুখে নোনা জল এসে পড়ছে কোথা থেকে। হাত দিয়ে জলের ধারাটার কোথা থেকে এসেছে টের পেলেন তিনি। তাঁর নিজের দুচোখ থেকেই নোনা জলের ঝরনাধারা বইছে।

গভীর কষ্টের মাঝেও মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠে তাঁর। তিনি জেনে গেছেন, শবযাত্রায় স্বামীকে নতুন ধুতি পরিয়ে দিয়ে কোনো ভুল তিনি করেন নি।

আপনার মন্তব্য