জফির সেতুর উপন্যাস ‘হিজলের রং লাল’ ও আজকের বাংলাদেশ

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-১৫ ১৪:০৩:৩৫

অহী আলম রেজা :

বাংলাদেশের উত্তরপূর্বপ্রান্তে অবস্থিত এক শান্ত সুনিবিড় জনপদের নাম সিলেট। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পথ দেখিয়েছে এ জনপদ। ভারতজুড়ে ব্রিটিশের পতাকা যখন উড়ছে, তখনও অধিকার আদায়ে সবার আগে ছিল সিলেট। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ তৈরিতেও সিলেটবাসীর রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। পাকিস্তানের চাঁদতারা খচিত পতাকার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদের প্রথম সুর উঠেছিল সিলেট থেকে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশের ন্যায় সিলেটবাসীও বুঝে নেন আর বসে থাকার সময় নেই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় আক্রমণ চালায়। পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় বীর বাঙালি।

সিলেট অঞ্চলের এমনই এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কবি জফির সেতুর মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত উপন্যাস হিজলের রং লাল।

হিজলের রং লাল মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। একাত্তরের অভূতপূর্ব রক্তিম স্পন্দনমাখা সময়টি ধারণ করা হয়েছে উপন্যাস-জুড়ে। কিন্তু এর বিস্তার সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে হালের গণজাগরণ মঞ্চ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঔপন্যাসিক দেশভাগের শিকার উদ্বাস্তু চারপুরুষের একটি পরিবারের এমন এক মর্মস্তুদ আখ্যান নির্মাণ করেছেন যা মানবিক সংকটে পূর্ণ, সে-অর্থে অস্তিত্ব-সংগ্রামেরও কাহিনি। শুধু তাই নয়, এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে জেগে-ওঠা আরেক বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের পর আরও এক রক্তাক্ত যুদ্ধের সমান্তরাল কাহিনি। যে-যুদ্ধ দৃশ্যের ভেতরে ও দৃশ্যের বাইরে, আজকের বাংলাদেশে...’।

১৯৭১ সালের বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের কাহিনি উপন্যাস লেখা হয়েছে হাতেগোনা। শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ার পাশা, সেলিনা হোসেন, রশীদ হায়দার, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, শহীদুল জহীর, নাসরীন জাহান ও শাহীন আখতার প্রমুখ। কথাসাহিত্যিকের কলমে রচিত হয়েছে এসব উপন্যাস। রুশ বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতার সংগ্রাম, এমনকি বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন দেশে যে পরিমান অসাধারণ উপন্যাস রচিত হয়েছে সে তুলনায় বাঙালির সেই রক্তঝরা দিনগুলো নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য রচনা এখনো সৃষ্টি হয়ে ওঠেনি। বেহুলা বাংলা সে অভাববোধ থেকেই ৭১-এর ৭১ উপন্যাস সিরিজে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য লেখকদের দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত একগুচ্ছ উপন্যাস। প্রবীণদের পাশাপাশি এতে অংশগ্রহণ করেছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিশ্রতিশীল তরুণ লেখক। জফির সেতু বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের জন্য উল্লেখযোগ্য কবি। গল্পকার হিসেবেও তিনি পরিচিত। ৭১-এর ৭১ উপন্যাস সিরিজে তিনি লিখেছেন এই অসাধারণ উপন্যাসটি।

হিজলের রং লাল উপন্যাসের প্লট হিসেবে ঔপন্যাসিক বেছে নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টর অর্থাৎ সুনামগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলের কিছু বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে উপন্যাসটি রচিত। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ৫ নম্বর সেক্টরের কিছু উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ও অকুতোভয় সম্মুখ ও গেরিলাযোদ্ধাদের রক্তাক্ত ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী উপন্যাসটিতে ঠাঁই পেয়েছে।
‘অগ্নি' নামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীর বিভীষিকাপূর্ণ একটি রাতের কাহিনির ভেতরে উপন্যাসে উঠে এসেছে অগ্নির তিন পূর্বপুরুষের কাহিনি। অগ্নির বাবা শিহাব মাস্টার মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী একজন শিক্ষক। গ্রামের স্কুলে তিনি পড়ান। কাদের মোল্লার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে যে-গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠে তিনি তার একজন নিষ্ঠ সমর্থক। অগ্নিও জাগরণ মঞ্চের একজন কর্মী। হঠাৎ অগ্নির বাবা খুন হন। পুলিশ এটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চায়। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিতে টালবাহানা করে। শহরের হাসপাতালে রাতের বেলা ময়নাতদন্তের জন্য লাশের সঙ্গে শহরে আসেন অগ্নির দাদা ছিদেক আলি। তিনি মুক্তিযুদ্ধ একজন দুর্ধর্ষ গেরিলা ছিলেন। বর্তমানে বয়োবৃদ্ধ ও হাঁফানি রোগী। নিহত পুত্র শিহাবকে মর্গে রেখে নাতনি অগ্নির সঙ্গে রাতে হোটেল কক্ষে কাঁপুনি-জ্বরসহ ছিদেক আলি মন্থন করেন তার জীবনের অতীত কাহিনী। ৪৭-এর দেশভাগের শিকার ছিদেকালিরা সাম্প্রদায়িকতায় নিঃস্ব এপারে পালিয়ে এসে কীভাবে বয়ে বেড়াচ্ছে ওপারের আসামের ফেলে আসা শৈশবের মর্মন্তুদ স্মৃতি। তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে রূপবতী পিতামহী নূর-ই-জাহানের রূপ ও মায়ার বিভা। কীভাবে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ছিদেকালিদের পুরো পরিবার। শহীদ হয়েছিল ভাই আবদুল ওয়াহিদ। আরেক সম্মুখযোদ্ধা সহোদর সুরুজ আলির সঙ্গে কীভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে আবেগ বিনিময় হয়েছিল। কীভাবে পাকি কমান্ডার রাব্বির কর্তৃক অপমানিত হয়েছিল তাদের একমাত্র বোন মেহের বানু।

ঔপন্যাসিক এক জাদুকরী কৌশলে পাঠককে নিয়ে যান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে। পাঠকের কাছে একের পর এক উন্মোচিত হয় সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলীর নেতৃত্বে ৫ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধ ক্ষেত্রের বিভিন্ন যুদ্ধ-তান্ডব ও হার-জেতার কাহিনি। সঙ্গে পাকি-সহযোগী আল বদর, রাজাকার ও আস শামসএর নানা ভয়ানক ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। সেক্টর হেডকোয়াটার বাঁশতলা থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সাবসেক্টরের যুদ্ধ ক্ষেত্রগুলো বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, ছাতক, ডাউকি, ভোলাগঞ্জ, সালুটিকর, শেলা, বালাট, মুক্তাপুর, বেতুরা, রাধানগর, তেলিখাল, খাইরাই, গৌরিনগর, টেংরা, বিলাজুর, পাগলা, এয়ারপোর্ট, হেমু প্রভৃতি অঞ্চল ছাড়াও বিভিন্ন প্রত্যন্ত, পাহাড়ি ও চা-বাগান অঞ্চলের যুদ্ধকাহিনি, পাকিদের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট জীবন্তভাবে উপন্যাসে উঠে এসেছে। উপন্যাসে একাত্তরের কাহিনি শেষ হয়েছে টেংরা অপারেশন ও সালুটিকর হানাদার মুক্ত করার মাধ্যমে। উপন্যাসে জীবন্ত  হয়ে উঠেছে সেক্টর কমান্ডার মীর শওকতের যুদ্ধকৌশল, ব্যক্তিত্ব, দেশপ্রেম; সি আর দত্তের সাহসিকতা; জেনারেল ওসমানীর তেজস্বিতা। এছাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহসিন, ক্যাপ্টেন আকবর, লেফট্যানেন্ট মাহবুব, ক্যাপ্টন হেলাল, মেজর এস এম খালেদ প্রমুখের অসাধারণ যুদ্ধনৈপুণ্যসহ ছিদেক আলি, সুরুজ আলি, আবদুল ওয়াহিদ, আত্তর আলিদের মতো গেরিলাদের মরণপণ যুদ্ধকথা। শুধু তাই নয়, জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়া ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার মেজর শাফায়াত জামিল সহ অন্যান্য অকুতোভয় সেনানয়ক কর্তৃক সিলেটকে হানাদারমুক্ত করার বিষয়টিও ঔপন্যাসিক যুক্ত করেছেন কাহিনির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই।

তারপর আবার উপন্যাসে অগ্নির মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ উঠে আসে। বিশেষ করে রাজাকারদের ফাঁসি ও গণজাগরণ মঞ্চকে কেন্দ্র করে ব্লগারবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল প্রচারণা এমনকি ব্লগার হত্যার মতো জাতীয় ঘটনাগুলোও। আর অগ্নি হয়ে উঠেছে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চেতনার যথার্থ প্রতিনিধি। এসব মিলে হিজলের রং লাল উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ দলিল। ইতিহাসের ঘটনা নিয়ে রচিত হলেও এতে সমকাল গভীরভাবে বর্তমান। উপন্যাসটির সার্থকতা এখানেই।

হিজলের রং লাল-এর সম্পর্কে জফির সেতু সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি চেয়েছি তথ্য ও সত্যে অবিচল থাকতে। কিন্তু রচনাকালে আমি সচেতন ছিলাম যে আমি ইতিহাস লেখক নই, ঔপন্যাসিক। আর আমার রচনা হচ্ছে সাহিত্য। তাহলেও মূল ঘটনা ও চেতনা থেকে আমি বিচ্যুত হইনি। তবে শেষ পর্যন্ত হিজলের রং লাল একটি উপন্যাসই।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি সেসব মুদ্ধিযোদ্ধার প্রতি কৃতজ্ঞ যারা দিনের পর দিন সাক্ষাৎকার দিয়ে আমাকে তথ্য প্রদান করেছেন। কৃতজ্ঞ মুক্তিযুদ্ধের লিখিত অনেক ইতিহাস লেখকের প্রতিও।...উপন্যাস-রচনায় আমার প্রেরণা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আমাদের তরুণ প্রজন্মের দেশাত্মবোধ ও ইতিহাসস্পৃহা। সুতরাং লেখক হিসেবে আমি চাই তরুণ প্রজন্ম উপন্যাসটি পড়–ক ও এর ব্যাপ্তি ঘটুক।’

প্রকাশনা সংস্থা বেহুলা বাংলা, ঢাকা থেকে রক্তমাখা আগস্টেই প্রকাশিত হলো জফির সেতুর মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত উপন্যাস হিজলের রং লাল।

জফির সেতুর জন্ম ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১, সিলেটে। পেশা-শিক্ষকতা। কর্মক্ষেত্র শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কুড়ি। সাহিত্যপত্রে একাধিক উপন্যাস প্রকাশিত হলেও গ্রন্থ হিসেবে হিজলের রং লাল প্রথম।

আপনার মন্তব্য