কবি শামসুর রাহমানের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের দাবি

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-১৮ ০৩:৪৫:০৩

 আপডেট: ২০১৬-০৮-১৮ ০৪:১৭:৪১

রেজা ঘটক:

আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগ-এর উদ্যোগে ১৭ আগস্ট ২০১৬, বুধবার, কবি শামসুর রাহমান-এর দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শাহবাগস্থ কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে এক স্মরণ সংযোগ আয়োজিত হয়।

'কবি শামসুর রাহমান স্মরণ' শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী ও শিশু সাহিত্যিক জনাব ইয়াফেস ওসমান।

'কবি শামসুর রাহমান স্মরণ' অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশবরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কবি আসাদ মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও কলা অনুষদের ডিন ড. বেগম আখতার কামাল ও চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি দিলদার হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগের সাধারণ সম্পাদক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি মাসুদ পথিক।

'কবি শামসুর রাহমান স্মরণ' অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী ও শিশু সাহিত্যিক ইয়াফেস ওসমান বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ দেশের যে কোনো ক্রান্তিকালে কবি শামসুর রাহমান সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শোকার্ত আগস্ট মাসে কবি'র দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ আমি দু'জন কবি'র কথা স্মরণ করতে চাই। একজন বাংলাদেশের রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের পোয়েট অব পলিটিক্স। অন্যজন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের পর আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম রূপকার কবি শামসুর রাহমান। আইউব খানের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি কবিতায় ও মিছিলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলা সাহিত্য থাকবে, ততদিন বাংলাদেশের এই দুই মহান কবিকে বাংলাদেশ স্মরণ করবে।

অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানের উপর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেন, আমার বোন রূপালী'র বক্ষ সমস্যা ছিল। একই সমস্যা ছিল আমার বন্ধু কবি আবুল হাসানের। মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে তখন প্রায়ই আমি বোনের কাছে যেতাম। সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। কবি আবুল হাসানও বক্ষব্যাধি হাসপাতালে প্রায়ই যেতেন। তো একবার রাহমান ভাইও বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। তখন আমি রোজ একবার রাহমান ভাইকে দেখতে যেতাম। ডাক্তাররা বললেন, ওঁনার সঙ্গে বেশি কথা বলা যাবে না। আপনি আর বেশি আসবেন না। কিন্তু রাহমান ভাই বললেন, না না, নির্মল আসলে আমার খুব ভালো লাগে। ও খুব মজার মজার কথা বলে। যা শুনে আমি ওই সময়টুকু রোগের কথা ভুলে থাকি। সেই সুযোগে আমি রাহমান ভাইকে একটা প্রস্তাব দিলাম যে আপনি জীবিত থাকতেই আমি অ্যাডভান্স আপনার এলিজি লিখে ফেলি। মনে করেন এটা মৃত্যুকে মৃত্যু দিয়ে চ্যালেঞ্জ করার মত ব্যাপার আর কি! পরে রাহমান ভাই সাড়া দেওয়ায় আমি তাঁর এলিজি লিখেছিলাম। সেই এলিজি শুনে রাহমান ভাই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলেন। এই ঘটনার পর রাহমান ভাই অন্তত আরো প্রায় ৩০ বছর বেঁচেছিলেন। পরে একটা অনুষ্ঠানে রাহমান ভাই'র উপস্থিতিতে আমি আমার সেই কবিতা পাঠ করেছিলাম। আজকে রাহমান ভাই'র আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি সেই কবিতাটি আবার পাঠ করছি। পরে তিনি কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লেখা সেই এলিজি পাঠ করে শোনান।
 
অনুষ্ঠানে কবি আসাদ মান্নান বলেন, ব্যক্তি শামসুর রাহমান হয়তো আজ আমাদের সামনে নেই কিন্তু কবি শামসুর রাহমান চিরকাল আমাদের সামনে ও হৃদয়ের গহীনে থাকবেন। রাহমান ভাই'র সঙ্গে আমার অজস্র স্মৃতি। মনে পড়ে আমরা চট্টগ্রামে রাহমান ভাই'র পঞ্চাশতম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম। রাহমান ভাই সারাজীবন কবিতার প্রতি অত্যন্ত সৎ ছিলেন। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালো বাসতেন। বিশেষ করে তরুণ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের তিনি খুব প্রশ্রয় দিতেন। রাহমান ভাই'র সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় কারো বয়সের কথা মনে পড়তো না।

অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ড. বেগম আখতার কামাল বলেন, কবি শামসুর রাহমানের কবিতাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি তিনি ছিলেন পুরোপুরি একজন নাগরিক কবি। যে বিষয়ে তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা নেই, সেই বিষয়ে তিনি কখনো কাল্পনিক বা অলীক কোনো কবিতা লেখেননি। জীবনের অভিজ্ঞতা আর বাংলাদেশের আন্দোলন সংগ্রামের ন্যায্য অধিকারের প্রতি গণমানুষের ও সামাজিক দায়বোধ তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে। নাগরিক জীবনের বিশেষ করে বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নব্বই শতক পর্যন্ত নগর ঢাকার ক্রমবর্ধমান নাগরিক জীবনের যে মূল সুর, সেই নগর ঢাকার কাব্যিক স্বরটি ছিল কবি শামসুর রহমানের কবিতায় সবচেয়ে বড় ক্যানভাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে বর্তমানে কবি শামসুর রাহমান অনার্স ও মাস্টার্সে পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। আশা করি ভবিষ্যতে কবি'র উপর দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো অনেক কাজ হবে।

অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি দিলদার হোসেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগের পক্ষ থেকে কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে সরকারের কাছে ১৫ দফা দাবি উত্থাপন করেন। যার মধ্যে একটি ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে। দাবিগুলো হলো কবি শামসুর রাহমানের জন্মজয়ন্তী ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পালন করতে হবে। ঢাকার একটি সড়কের নাম কবি'র নামে করতে হবে। সড়কের মোড়ে কবি'র ভাস্কর্য নির্মাণ করে বসাতে হবে। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের যে কোনো একটি কবি'র নামে প্রবর্তন করতে হবে। কবি'র নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে ইত্যাদি।    

অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানের কর্মময় জীবনের উপর সূচনা বক্তব্য দেন কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা রেজা ঘটক। এছাড়া কবি শামসুর রাহমানের উপর স্মৃতিচারণ করেন ক্লাসিক্যাল সংগীত শিল্পী ওস্তাদ বাবু রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিক্ষক ড. সাঈম রানা, ইউ ল্যাব স্কুল ও কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও শিল্পী নাজমা আখতার, কবি ও অধ্যাপক কামরুল ইসলাম, ছোটকাগজ অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ, ছোটকাগজ লোক সম্পাদক কবি অনিকেত শামীম, কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান ও কবি শামসুর রাহমানের ছোট বোনের ছেলে মানজারে নাদিম। এছাড়া অনুষ্ঠানে কবি শামসুর রাহমানের প্রতি নিবেদিত কবিতা আবৃত্তি করেন কবি আয়শা জেবীন, কবি লিলি হক, কবি মিলন সব্যসাচী, কবি বদরুল হায়দার ও কবি সুজন হাজং।

সমাপনী বক্তব্যে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগ-এর সম্মানীয় সভাপতি ও 'কবি শামসুর রাহমান স্মরণ' অনুষ্ঠানের সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, কবি শামসুর রাহমানের দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আজ আমি রাহমান ভাই'র সঙ্গে আমার শেষ দিকের একটি বিশেষ স্মৃতির কথা বলতে চাই। নোবেল বিজয়ী ও ভারতরত্ন বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও পদ্মশ্রী বিজয়ী বিশিষ্ট লেখিকা নবনীতা দেব সেন-এর কন্যা নন্দনা সেন একবার আমাকে একটি অনুরোধ করেন। ভারতের রাজধানী দিল্লী থেকে ছয়টি ভাষার ছয় জন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিককে পুরস্কার দেওয়া হবে। আমাকে সেই পুরস্কারের একজন বিচারক হবার অনুরোধ করলেন নন্দনা সেন। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ থেকে একজন কবি'র নাম ও তাঁর লেখা পাঠানোর অনুরোধ করেন। প্রথমেই আমার রাহমান ভাই'র কথা মাথায় আসে। রাহমান ভাই'র যত লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, সেখান থেকে আমি কিছু কবিতা নন্দনা সেনকে পাঠালাম। সেটা ২০০৬ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দুই পয়েন্টে হারিয়ে কবি শামসুর রাহমান তখন অন্য পাঁচ জন কবি'র সঙ্গে বাংলা ভাষার পুরস্কারটি জেতেন। রাহমান ভাই তখন খুব অসুস্থ। হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। ওরা দিল্লীতে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কবি'র উপস্থিতি চান। কিন্তু রাহমান ভাই কিছুতেই যেতে রাজি না। নন্দনা বললেন, আপনি রাহমান ভাইকে কোনোভাবে দিল্লী পর্যন্ত নিয়ে আসেন। তারপর ওঁনার যাবতীয় টেককেয়ার করার দায়িত্ব আমার। হুইল চেয়ারে বিমানে ওঠানো নামানো যে কত কষ্টের ব্যাপার। আমাদের ফ্লাইট ছিল ঢাকা-কোলকাতা, কোলকাতা দিল্লী। কোলকাতা এয়ারপোর্টে রাহমান ভাইকে বিমানের সিঁড়ির একেবারে গোড়া থেকে এত যত্ন করে ওরা নামালেন আবার দিল্লীর বিমানে তুলে দিলেন। ওরা যে কতটা যত্ন নিলেন সেবার তা আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম। এমন কি বিমানের পাইলট রাহমান ভাইকে না নামানোর আগ পর্যন্ত বিমানে বসেছিলেন। আমরা দিল্লীতে নামার পর থেকে ঢাকায় পুনরায় ফেরা পর্যন্ত নন্দনা রাহমান ভাই'র সবটুকু যত্ন অত্যন্ত মনোযোগের সাথে করলেন।

"রাহমান ভাই যে পুরস্কার পেলেন সেখানে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার ভারতীয় রূপীর একটা চেক ছিল। নন্দনা আমাকে বললেন, রাহমান ভাই'র ভুলো মন। কোথায় হারিয়ে ফেলবেন, চেকটা আপনার কাছে রাখেন। আমরা ঢাকায় ফেরার তিন দিন পর আমি রাহমান ভাইকে সেই চেকটি দিতে যাই। শ্যামলীতে রাহমান ভাই আর আমার বাসা খুব কাছাকাছি। অথচ কী আশ্চর্য ঢাকায় নেমে তিন দিন চলে গেলেও রাহমান ভাই একবারও আমাকে চেকটির কথা টেলিফোন করেও জিজ্ঞেস করেননি। এমন নির্লোভ এবং অত্যন্ত সৎ ছিলেন রাহমান ভাই। কবিতার প্রতিও রাহমান ভাই সারাজীবন এমন সৎ ছিলেন। বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একেবারে সামনের সারিতে থেকে তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কবি শামসুর রাহমান কোলকাতা কেন্দ্রিক কবিতার কেন্দ্রকে ঢাকা কেন্দ্রিক কেন্দ্রতে পরিণত করতে পেরেছিলেন তাঁর শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমেই। উভয় বাংলায় তিনি তাঁর সময়ের সমানভাবে উচ্চারিত কবি। রাহমান ভাইর অনেক কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো অন্যান্য ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদ করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে পারলেই তাঁকে যথাযথ সম্মান করা হবে বলে আমি মনে করি। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর কবিতার শক্তি যথাযথভাবে পৌঁছাতে পারলেই হয়তো আমাদের সেই স্বপ্ন একদিন সার্থক হবে।"

অনুষ্ঠানে আলোচনা পর্ব শেষে চাষার পাল ব্যান্ড দলের শিল্পী যাদু রিচিল ও টগর ড্রং সংগীত পরিবেশন করে। আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগের সাধারণ সম্পাদক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কবি মাসুদ পথিক অনুষ্ঠানে আগত সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আজ 'কবি শামসুর রাহমান স্মরণ' অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগ যে নবযাত্রার সূচনা করলো, ভবিষ্যতে আমরা সারাবিশ্বে বাংলাদেশের ও বাঙালি সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে আমাদের সংস্কৃতির শেকড় চেনাতে চাই। এখন থেকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সংস্কৃতি সংযোগ এরকম নিয়মিত আয়োজন করবে।

আপনার মন্তব্য