নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও-এর গল্প : খরার শিকার

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-১৭ ১৫:৪৩:২৮

 আপডেট: ২০১৬-০৯-১৭ ১৬:১৫:০৭

মনোজিৎ কুমার দাস:

বুড়িটি পাগলী ছিল এক সময় আমি বিশ্বাস করতাম। আমার মা বলেছিলেন, সে পাগলী। গ্রামের প্রায় সবাই তার সম্বন্ধে একই রকমের ধারণা ছিল। পাগলদের মতো পাগলামি কিন্তু কখনোই করতো না। সে বেশি কথাও বলত না। কিন্তু মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই সে কেন যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত।

বুড়িটি লোকজনের দিকে এমন ভাবে তাকাত, যা দেখে তারা ভাবতো বুড়িটি পাগলী। তার অস্থিচর্মসার শরীরের কুঁচকে যাওয়া চামড়া সাথে তার উজ্জ্বল চোখদুটো বেমানান বলে মনে হতো। তার চোখ দুটোতে যেন এক ধরনের রহস্যময়তায় ঘেরা ছিল। এ থেকেই আমার মনের মধ্যে তার পাগলামি সম্বন্ধে আমার মনে সংশয় দেখা দিয়েছিল।

মহিলাটি আচার আচরণ সম্বন্ধে আমার চিন্তা ভাবনার কথা নিয়ে মাঝে মধ্যে আমি আমার বাবার সঙ্গে আলোচনা করতাম। বাবা শান্ত ভাবে বলতেন , ‘ হয়তো সে মনের দু:খে এমনটা করে থাকে। প্রচণ্ড সূর্যের তাপ ও একটানা খরা আমাদের মগজকে টালমাটাল , আর তাতেই আমাদের মধ্যে পাগলাটে ভাব দেখা দেয়।’ তখন আমি বাবার কথা বুঝতে না পারলেও তার কথা বুঝেছিলাম। পুরো দেশটার শস্যখেত ফসল শূন্য। এক সময় পাহাড়ের চূড়াগুলোর সবুজ আর সতেজ শস্যখেতগুলো দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত, এখন সেগুলো ফসল শূন্য জমিন। প্রচণ্ড খরায় আমাদের জেলার কৃষকদের মাথায় হাত ! অথচ এক সময় কৃষকরা নয়নাভিরাম পত্র-পল্লব কথা ভেবে গর্বিত ছিল। আর এখন সেইগুলো খরায় পুড়ে শুকিয়ে কাঠ । আমাদের গ্রামের নিচু জমিনের মুগুমো গাছগুলো সারা বছরই পত্রপুষ্পে পল্লবিত থাকতো । গাছগুলো যেন সামান্য খরাকে থোড়াই কেয়ার করতো। কিন্তু এবারের প্রচণ্ড খরায় গাছগুলো পত্রপল্লবহীন হয়ে পড়ল।

প্রচণ্ড খরার ফলে সামনে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসার ভবিষ্যতবাণী করল অনেকেই। গ্রামের অনেকেই আবহাওয়াবিদ , ওঝা ও কবিরাজদের পরামর্শ নিতে লাগল। তারা সবাইকে সাবধান করে দিল সামনে মহাবিপদ। এদিকে রেডিও তে আবহাওয়ার পূর্বাভাস’ দিয়ে চলল। কেবিএস-এর (কেনিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিস) ও আবহাওয়া-দপ্তরের লোকেরা আবহাওয়া-বার্তা জানানোর জন্য তাদের ম্যাজিক-যন্ত্র দিয়ে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করে চলেছিল।

গ্রামের সবাই কেবলমাত্র মেঘ দেখছিল আর অপেক্ষা করছিল কখন বৃষ্টি নামবে। আমার পিতার চার স্ত্রী ও গ্রামের অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা প্রতিদিনই একত্রিত হয়ে বসে গল্পগুজব করত। তারা া প্রকৃত পক্ষে এই আশাতে ছিল কখন না জানি ঈশ্বর বৃষ্টি দেবেন। সবাই জলের জন্য চাতকের মত আকাশের দিকে চেয়ে থাকতো। গ্রামের বহু মানুষ অনাহারে ছিল। অন্যান্য পরিবারের তুলনায় আমাদের পরিবার ভাগ্যবান ছিল, কারণ আমাদের ভাইদের মধ্যে একজন নাইরোবিতে এবং অন্যজন লিমুরুতে কাজ করে অর্থকড়ি উপার্জন করত ।

বৃদ্ধ মহিলাটি সম্বন্ধে আমার পিতা যে মন্তব্য করেছিল সে সম্বন্ধে আমি বিশেষ ভাবে চিন্তা করতে শুরু করলাম। দিনটি ছিল মাসের শেষ, আমার মা বাজার থেকে কিছু শাকসবজি আর আনাজপাতি কিনে আনল। আমি তা থেকে কিছু শাকসবজি মায়ের অজান্তেই থলেয় ভরে সন্ধ্যার দিকে বৃদ্ধা মহিলাটির মাটির ঘরের দিকে হাঁটা দিলাম।

গ্রামের মাঝামাঝি এলাকায় বৃদ্ধটির মাটির ঘর। আমি আগেও সেখানে গিয়েছি, কিন্তু এ দিন সন্ধ্যায় যাওয়াটা ছিল অন্য রকমের। ফায়ার প্লেসের আগুন নিভু নিভু জ্বলছিল। হঠাৎ আমি মাটির দেওয়ালে যেন একটা ভুতুড়ে ছায়া দেখতে পেলাম। এক সময় আমি দেখতে পেলাম ঘরের এক কোণায় বৃদ্ধাটি জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। জায়গাটা আধারে ঢাকা। ওখান থেকে কেটে পড়তে ইচ্ছে করলেও পালাতে পারলাম না। মহিলাটিকে বললাম,‘ দিদিমা তোমার জন্য এই আনাজপাতি এনেছি।’ আমার কথা শুনে মহিলাটির চোখদুটো যেন জ্বল জ্বল করে উঠল। এক সময় মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে বলল, ‘ খরা আমার সর্বনাশ করেছে। ’ আমি বৃদ্ধাটির মর্মস্পর্শী অবস্থা দেখে আমি সেখান থেকে বের হয়ে এসে ভাবলাম , আমার পিতা তার প্রকৃত অবস্থার কথা না জেনে তাকে পাগলী ঠাওরেছেন।

সপ্তাহ-খানেক পরে বৃদ্ধাটি নিজের সম্পর্কে বিস্তারিত বলল। সে খরাকে মোকাবিলা বলা তার করে এসেছে। সে আবোলতাবোল ভাবে কথা বলে চলায় অন্ধকার ঘেরা তার কুঁড়েঘরটায় বিষাদের ছায়া পড়ল। মাসের পর মাস বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকার পর গতরাতে প্রথম ক’ফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে।রাস্তাঘাটে নির্জন। বৃদ্ধাটি তার একমাত্র সন্তানের নি:চুপ বসে আছে। সে শুধুমাত্র তেপায়ার টুলের উপর বসে ফায়ারপ্লেসের ছোট্ট বিছানায় কালো চেহারার সন্তানের তীব্র যন্ত্রণা দেখছিল। ছেলেটি মাকে জিজ্ঞেস করল,‘ মা , তুমি কি মনে করো আমি মারা যাব।’ মা কী জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। সে শুধুমাত্র তার সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতে পারে। খিদেয় কাতর ছেলেটি বিনীত কণ্ঠে বলল,‘ মা আমি মরতে চাই না।’ মা কিছু না বলে অসহায় দৃষ্টিতে তার তাকিয়ে রইল। সে উপলব্ধি করল, ছেলের মনোবল এবং শারীরিক শক্তি তাকে ত্যাগ করে গিয়েছে। আবার অনুযোগভরা সেই আকুতি, ‘মা, আমাকে কিছু একটা খেতে দাও।’

নিশ্চয়ই সে জানত না, তার বৃদ্ধা মায়ের কিছুই ছিল না, তার শেষ দানা গমটুকুও শেষ করে ফেলেছিল। সে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, তার প্রতিবেশীদের আর বিরক্ত করবে না, কেননা তারা তাকে দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে টিকিয়ে রেখেছিল। সম্ভবত তারাও তাদের সহায়-সম্বল খরচ করে ফেলেছিল। তথাপিও ছেলেটি খাবারের আশায় মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। সে যেন তার মাকে দয়ামায়াহীন একজন মানুষ হিসাবে অভিযুক্ত করছে।

একজন পুরুষ ছাড়া একজন নারী কী বা করতে পারে? জরুরি অবস্থার সময় বৃদ্ধা তার স্বামীকে হারিয়েছিল, বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইরত কেনিয়ার জাতীয়তাবাদী শক্তি মাউ মাউদের দ্বারা অথবা ঔপনিবেশিক সেনাদের হাতে সে নিহত হয়নি, এক বিয়ার পানের আসরে তার উপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। এটা এতই আকস্মিক মৃত্যু ছিল যে, পারতপক্ষে লোকে কেবল এটুকুই বলত। ছেলেটাকে দেখবার কাজে বৃদ্ধাটিকে সাহায্য করবার জন্য লোকটা এখন আর নেই।

১৯৬১ সালের আজকের রাত ১৯৪০ সালের সেই এক রাতটা তার কাছে এতটুকুই ভিন্ন ছিল যে, তখন তার দুই ছেলে খরা এবং অনাহারে একের পর এক মারা গিয়েছিল। সে সময়টা ছিল ‘কাসাভা দুর্ভিক্ষ’র সময়। লোকে কাসাভা থেকে আটা তৈরি করে খেত বলে সেই সময়টাকে ওই নামে ডাকা হত। তখন তার স্বামী বেঁচে ছিল , তাই ছেলে দুটো মারা যাওয়া শোক তার স্বামীস্ত্রী ভাগ করে নিয়েছি।। এখন সে একাকী।

বৃদ্ধাটি ভাবল, এটা তাদের পরিবারের উপর কি একটা অভিশাপ নয় ? একবারের দুর্ভিক্ষ থেকে সৌভাগ্যক্রমে তার মাকে মিশনারিরা যদি রক্ষা না করত তবে তার নিজেরই জন্ম হত না! এটা ঘটেছিল শ্বেতাঙ্গদের প্রকৃত অর্থে কেনিয়া আগমনের ঠিক পূর্বমুহূর্তে। রুরায়া দুর্ভিক্ষ ছিল গিকুয়ু জনগোষ্ঠীর মোকাবেলা করা, তখন পর্যন্ত সব থেকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিল ওটা। তার দাদা-দাদি মারা গিয়েছিল, পরিবারের মধ্যে একাই তার মা প্রাণে বেঁচেছিল। বৃদ্ধাটি ছেলেটার অভিযোগের, অনুনয় ভরা মুখ দেখত, তখন সব দুর্ভিক্ষের ভয়াল চিত্র তার মধ্যে জেগে উঠত। কেন এটা শুধু তার জন্য? কেন অন্য নারীদের জন্য নয়? ছেলেটা তার শেষ বয়সের একমাত্র সন্তান ।

বৃদ্ধাটি কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে গ্রামের প্রধানের কাছে গিয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, তার কাছে কিছু নেই। তাছাড়া মনে হয়েছিল, সে তাকে বুঝতে পারছে না, অথবা বুঝতে পারছে না যে, খরা প্রকৃতই মানুষ মারতে পারে। সে ভেবেছিল, তার ছেলেটি সেই পুরনো রোগে ভুগছে, যা তাকে প্রায়ই আক্রমণ করে থাকে। অবশ্য মা-ও এরকমই কিছুটা চিন্তা করেছিল। ছেলেটা তার সবসময়ই রোগে-ভোগা এক সন্তান। কিন্তু সে কখনও তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। এমনকি এখনও সে নেবে না। না, না, এমনকি হাসপাতালও তাকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। তার সাধ্যমত এই পঙ্গুর জন্য যা কিছু করা সম্ভব সেটা করাকে সে প্রাধান্য দিয়েছিল। কিন্তু এবার সে বুঝল, তাকে খাবার না খাইয়েই খাবার সে তাকে মেরে ফেলছিল।

গ্রামপ্রধান জানিয়েছিল যে, জেলা-কর্মকর্তা খাদ্যদ্রব্যে রেশন-প্রথা চালু করেছেন, ‘দুর্ভিক্ষ ত্রাণ কার্যক্রম’-এর অংশবিশেষ খাদ্য খরা কবলিত এলাকার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এ খবরটা সম্বন্ধে সে আগে কেন শোনেনি? সে রাতে সে সামান্য ঘুমিয়েছিল, কেননা পঙ্গুটি জিজ্ঞেস করেই চলেছিল, ‘আমি কি সুস্থ হয়ে উঠব, মা?’

জেলা-কর্মকর্তার কার্যালয়ে লম্বা লাইন। সে তার রেশন নিয়েছিল এবং দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিল। সে ঘরে প্রবেশ না করে বাইরেই বসে পড়েছিল, তার হাঁটার যেন শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল।

বিষণ্ণ চেহারার নারী-পুরুষেরা তাকে কিছু না বলেই তার ঘর থেকে দল বেঁধে বেরিয়ে আসছিল। বলার প্রয়োজনও ছিল না। সে জানতে পেরেছিল, তার ছেলে চলে গিয়েছে, এবং আর কখনও সে ফিরে আসবে না।

বৃদ্ধা একবারও আমার দিকে তাকায়নি যখন এসব বলছিল। এবার সে চোখ তুলে তাকিয়ে বলে চলল, ‘আমি এখন একজন বুড়ি। সূর্য অস্তমিত হয়েছে আমার একমাত্র সন্তানের উপর; খরা তাকে নিয়ে গিয়েছে। এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা।‘

সে ভাঙাভাঙা গলায় আমাকে কাহিনীটি বলেছিল যার মধ্যে এমন কোন অসংলগ্ন কথা ছিল যাতে তাকে পাগলী বলা যায়। আমি অসহনীয় দু:খ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।ভাবলাম, কেন কিছু লোক যন্ত্রণা ও দুর্দশা ভোগের জন্য জন্ম নেয় ।

দুই বা তিন সপ্তাহ আগে আমি বৃদ্ধার সঙ্গে শেষবারের মত কথা বলি। স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার জন্য আমি ভালোভাবে মনে করতে পারছি না। এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বলা চলে প্রায় সপ্তাহ-খানেক ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, যদিও হালকা গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। স্ত্রীলোকেরা শস্য রোপণের কাজে ব্যস্ত। সবার মনে আশা জেগে উঠেছে।

গতকাল থেকে মুষলধারায় মৌসুমি বৃষ্টির শুরু হয়েছে। এবার মৌসুমি বৃষ্টির একটু আগেভাগেই শুরু! এমন বৃষ্টির দেখা বহুবছর মেলেনি। আমি বৃদ্ধ নারীটির কুঁড়েঘরে এবার মিষ্টি আলু নিয়ে গেলাম।

দরজা খুলে তাকে ঘরের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকতে দেখতে পেলাম। আগুন নিভে গিয়েছিল। শুধুমাত্র লন্ঠনের কাঁপা কাঁপা হলুদ আলো তখনও জ্বলে চলেছিল। আমি তার সঙ্গে কথা বললাম। সে সামান্য মাথা তুলল। নিষ্প্রভ আলোতে তাকে সাদা দেখাচ্ছিল। সে তার চোখ সামান্য খুলল। সেগুলোর অস্বাভাবিক অলৌকিক উজ্জ্বলতা সহস্রগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কেবল বাড়তি কিছু তাতে ছিল। দুঃখ নয়। আনন্দ বা উল্লাসের আভাস যেন পাওয়া যাচ্ছিল। সে যেন অনেকদিন আগে হারিয়ে-যাওয়া কিছু একটা সে ফিরে পেয়েছে। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত। সে হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাসিতে এমন কিছু ছিল, যা অপার্থিব, প্রায় দানবীয় ও কুৎসিত। সে কথা বলতে লাগল, দুর্বল সুরে, আমার দিকে সরাসরি না তাকিয়ে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার সন্তুষ্টি বা স্বস্তি যেন উচ্চস্বরে ঘোষিত হচ্ছিল। বৃদ্ধাটি বলল,‘আমি তাদের সবাইকে এখন দেখছি। সবাই সদর-দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।এবং আমি যাচ্ছি...’

বৃদ্ধাটি নেতিয়ে পড়ল। তক্ষুনি মিটমিট করে জ্বলতে-থাকা লন্ঠনটা দপ করে নিভে গেল, আমার চোখে পড়ল, আমার দেওয়া সব মিষ্টি আলুগুলো ঘরের কোণায় জমা করা, যাতে সে হাত দেয়নি।

বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। রাস্তার পাশের খোলা দরজাগুলোয় আমি দেখতে পেলাম জ্বালানো আগুনের দপদপানি, শুনলাম লোকজনের চেঁচামেচি ও অট্টহাসি।

বাড়িতে আমরা সবাই উপস্থিত ছিলাম। বাবাও ছিলেন। মা এরই মধ্যে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করেছেন। বৃষ্টি এবং খরা যা এখন আর নেই সেগুলো নিয়ে আমার ভাইবোনেরা বকবক করে চলেছে। বাবা ছিলেন যথারীতি নীরব এবং চিন্তামগ্ন। আমিও ছিলাম চুপচাপ। আমি কথাবার্তায় যোগ দিলাম না, কেননা ‘পাগলী’ স্ত্রীলোক এবং তাকে উপহার হিসাবে আমার দেওয়া মিষ্টি আলু স্পর্শ না করায় পড়ে ছিল সেই কথাই আমার মন তখনও মনে পড়ছিল।

আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছিল, সেও কী হারিয়ে গেছে খরায় এবং অনাহারে! ঠিক তখনই আমার ভাইদের মাঝ থেকে একজন বৃদ্ধাটি সম্বন্ধে ঠাট্টা করে এমন কিছু মন্তব্য করল, যা শুনে আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম।

‘সত্যি পাগলী!’ আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। কেবল বাবা বাদে আর সবাই তখন সচকিত ভীতি নিয়ে আমার দিকে তাকাল। বাবা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে।

লেখক পরিচিতি:
নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও কেনিয়ার বিখ্যাত লেখক। জন্ম কেনিয়ার কিয়াম্বু জেলার লিমুরু শহরের কাছে কামিরিথুতে ৫ জানুয়ারি, ১৯৩৮ সালে। ঔপনিবেশিক আমলে ব্যাপটাইজ করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল জেমস নগুগি। তিনি উগান্ডার ম্যাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩ সালে ইংরেজিতে বিএ পাশ করেন।

ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২-তে তাঁর লেখা The Black Hermit নামের নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস Weep Not, Child প্রকাশিত হয়। এটি লেখেন ইংল্যান্ডের লিডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে। এটা কোনও পূর্ব আফ্রিকান লেখকের ইংরেজিতে লেখা প্রথম উপন্যাস।

তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস The River Between, রচিত হয় ১৯৬৫-তে। ১৯৬৭ সালে রচিত হয় তাঁর সাড়া জাগানো উপন্যাস A Grain of Wheat এই উপন্যাসে ফ্যানোনিস্ট মার্কসিজমের প্রতি তাঁর ঝোঁক লক্ষ করা যায়।

তিনি ইংরেজি, খ্রিস্টধর্ম এবং তাঁর নাম জেমস নগুগিকে ঔপনিবেশিক ক্ষতচিহ্ন আখ্যা দিয়ে তা ত্যাগ করেন এবং ফিরে যান নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও নামে; লেখালেখির কাজও করতে থাকেন তাঁর মাতৃভাষা গিকুয়ু এবং সোয়াহিলিতে।

তাঁর লেখা অন্যান্য Will Marry When I Want , Caitaani mũtharaba-Inĩvil on the Cross ।তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প সংকলন উপন্যাস, নিবন্ধ সংকলনগুলো হল: A Meeting in the Dark , Secret Lives, and Other Stories Detained ,Decolonising the Mind: The Politics of Language in African Literature Matigari, Wizard of the Crow Something Torn and New: An African Renaissance ও আত্মজীবনীমূলক দুটি গ্রন্থ, Dreams in a Time of War: a Childhood Memoir, Ges In the House of the Interpreter: A Memoir ইত্যাদি।

নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও তার প্রতিটি রচনায় ফুটিয়ে তুলেছেন পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার সমাজ-জীবনের বিভিন্ন দিক, চোখে আঙুল দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিক শক্তির দানবীয় রূপ। তাঁর লেখা গল্প `GONE WITH THE DROUGHT কে ‘খরার শিকার নামে বঙ্গানুবাদ করা হল।
- অনুবাদক

আপনার মন্তব্য