এ কথা সামান্যই

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-২৭ ১৯:২৯:২৫

 আপডেট: ২০১৬-০৯-২৭ ২২:৫৭:৫৫

প্রশান্ত মৃধা:

পঞ্চাশের দশককে মনে রাখলে হিসেবে সুবিধে হয়। হিসেবটা বেশ চুঁইয়েই নামে, কখনও খাড়াখাড়ি কখনও আড়াআড়ি কখনও সোজা বা বাঁকা বা দীঘল হয়েও। তার কারণ সম্ভবত খুব সংক্ষেপে এই : পাকিস্তানের সৃষ্টি থেকে রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক বাতাবরণে উত্তাল ষাটের দশক পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের বায়ান্নর যুগান্তকারী ঘটনার বেশি খেয়ালে থাকে না। অথচ বছরের হিসাবে বায়ান্ন থেকে বিঘতখানেক দূরে দাঁড়ানো ওই ষাট কি একষট্টি সালে পৌঁছতে যে সাহিত্যিক নির্মিতি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে সেটুকু ষাটের উত্তরাধিকার। সব অর্থে।
সাহিত্যের যে কোনও মান্য ইতিহাস বইয়ের ফাঁক গলে গবেষকের চোখ যদি আরও একটু তলানিতে ঠেকে, তাহলে ওই পর্বে ‘পাকিস্তান, পাকিস্তান’ জিকিরের ভিতরে প্রচল বাংলা সাহিত্যকে অক্লান্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার সেই রক্তাক্ত প্রচেষ্টায় শরিক ছিলেন কয়েকজন।

সেই চেষ্টা স্বাভাবিক উচ্চারণে কোনও আন্দোলন ছিল না। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন বাদে আন্দোলিত হয়ে ওঠার মতন বাতারণও সে সময়ে অনুপস্থিত। হয়তো, সেই কারণে, সৈয়দ শামসুল হক হৃৎকলমের টানের শুরুতেই নিজেদের পঞ্চাশের এক ‘নীরব’ প্রজন্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এমনকি এই সময়ের লেখকের আরও কেউ কেউ আত্মজীবনীর কোনও কোনও পৃষ্ঠায় নিজেদের একই অভিধা দিয়েছেন।

নীরবতার তো কোনও সঙ্গী থাকে না। সঙ্গী সে চায়ও না। এই জন্যে হৃৎকলমের টানেতে এক নীরবপ্রজন্মকে আত্মবয়ানে হাজিরের ফাঁকে সৈয়দ শামসুল হক আসলে একপ্রকার আত্মজীবনীও নির্মাণ করেন। ওই রচনার সঙ্গে চলতে চলতে তাঁর হয়ে ওঠার ইতিহাসকেও বুঝে নেয়া যায়। আসল ধন্দটাও সেখানে তেলেজলে বেড়েও ওঠে। তাতে যে কোনও তরফের হিসেব মিলিয়ে নিতেও সংকটই তৈরি হয়--- কোনটি তার আসল অভিধা। এর কারণ মূলত, বাংলাদেশের সাহিত্যে আমাদের বেড়ে ওঠার ইতিহাসে সৈয়দ শামসুল হকই একমাত্র লেখক যাকে প্রায় সাহিত্যের প্রতিটি মাধ্যমে পাঠ নিতে নিতে পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। পাঠকের সেক্ষেত্রে সমস্যা হয় কম। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের লেখক সেই মধ্যপঞ্চাশ থেকে শুরু করে গত প্রায় ষাট বছরের সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হককে কোথায় রাখি কোথায় রাখি--- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন বারবার। সাহিত্যের ইতিহাস নির্মাণের এই এক সমস্যা। অন্তত যাঁদের আমরা সব্যসাচী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করি, তাঁদের ক্ষেত্রে।

সাহিত্যের একটি মাধ্যমে যে লেখক তাঁর সমকালে সৃষ্টির তুঙ্গ স্পর্শ করেন, তাঁকে নিয়ে এই সমস্যা সাধারণত ঘটেই না। কবিদের ক্ষেত্রে মোটেও না। কথাসাহিত্যিক, গল্প উপন্যাস যা ই লিখুন, কথাসাহিত্যিক--- কেউ কেউ গল্পে কৃতী; প্রায়শ যাঁরা স্বীকৃত ঔপন্যাসিক, তাদের অনেকেই ছোটোগল্প রচনায়ও ক্ষমতাবান, ছোটোগল্পকাররা সব সময় তা নয়। কিন্তু যিনি কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক কাব্যনাট্য চিত্রনাট্য সাহিত্যপ্রবন্ধ অনুবাদ কি সাহিত্যকলাম সর্বত্র প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন এবং একই সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অবশ্যপাঠ্য লেখকে পরিণত হন--- তাঁর ক্ষেত্রে সব সময় হিসাব খুব সোজা হয়ে মেলে না। অন্তত সে কারণে বুদ্ধদেব বসু কবিদের আলোচনায় কবি, সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্য সমালোচক, রবীন্দ্রসাহিত্য আলোচক হিসেবে রাবীন্দ্রিক, ঔপন্যাসিক হিসেবে ‘আধুনিক’ উপন্যাসকার, ছোটোগল্পলেখক হিসেবে গল্পকার আবার অনুবাদক বা মহাভারতের ভাষ্যকার হিসেবেও মান্যতা পান । এই বহুধাবিভক্ত প্রতিভার ওজন যখন খ-খ- আলোচনায় ধরা হয়, তখন তার জায়গা নিরূপণ নিয়ে এ-প্রস্থ ও-প্রস্থ কাহনের আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে ঠিকই কিন্তু তাতে আসলে ওই প্রতিভার সম্পূর্ণ ব্যক্তিমা ঠিক ধরা পড়ে না। যেমন, সৈয়দ শামসুল হক সাধারণ্যে লেখক অথবা সাহিত্যিক, কবিদের সভায় সব্যসাচী লেখক, গল্পকার ভাবলে সঙ্গে ঔপন্যাসিকও, উপন্যাসকার মাথায় রেখে নাট্যকার, নাটকপাড়ার সে হিসেবের পরেও কলামপ্রাবন্ধিক থেকে চিত্রনাট্যকার পর্যন্ত আমাদের মাথায় রাখতে হয়।

সম্প্রতি, তাঁকে নিয়ে এই ধন্দে আবার পড়া গেছে। দিন কয়েক আগে এক কবি ও সাহিত্যসম্পাদক বন্ধু হঠাৎ মন্তব্য করেন, ‘সৈয়দ হককে নিয়ে আমাদের সাহিত্য-আলোচনা একটা সমস্যায় পড়ে, দেখিস।’
‘কেন?’
‘কেন? এক. তার সাহিত্যের সকল মাধ্যমে সফলতার জন্যে। দুই. তাঁর বইয়ের বিপুল সংখ্যা।’

তা সত্যি। এই হিসাব যে নিজের জানা ছিল না, তা নয়। কথাটা উঠেছিল একজন তরুণতর লেখকের বইমেলায় একাধিক বই প্রকাশের সূত্রে।

‘দুটোই ভালো বই হলে দেখা গেল কোনওটারই কোথাও আলোচনা হল না। দেখবি তখন দুটো বই ই আলোচনার বাইরে থেকে যায়। সাহিত্য সম্পাদকরা ভাবেন, কোন্ বইটা রাখবেন, কোন্টা রাখবেন না--- সেই হিসাব করতে করতে দুটোই বাদ। তা ছাড়া-
‘তাছাড়া?’ কথার পিঠে তার কথা শোনার উৎসাহ ছাড়ি না।
‘এদেশে বেশি বই নিয়েও এক সমস্যা--- ভাববে, বেশি বই বেরিয়েছে, তার মানে খারাপ লেখে--- এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি সৈয়দ হককে নিয়ে।’
‘তা সত্যি।’
‘হিসাব কর--- এই দেশের মঞ্চের দুই একখানা নাটকের নাম করলে তাঁর নাটককে অবশ্যই হিসাবে রাখতে হয়।’
‘হ্যাঁ।’
‘গল্পেও তাই। তার প্রথমদিককার গল্পগুলো মনে কর। তারপর উপন্যাসÑ এদেশে ভালো উপন্যাস লেখা হয়েছে কয়খানা? এর ভিতরে তার দুই তিনটি উপন্যাসকে যে কোনও বিচারে উল্লেখ করতে হবে। আর বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা কিংবা পরানের গহীন ভিতর?’
নিজের জানা হিসেব মিলে যেতে লাগলে সেখানে তর্ক চলে না। সে কথায় হয় জয় (সমর্থন) দিতেও সুবিধা হয়। ফলে, ওই সাহিত্যসম্পাদক যখন নিজের সমকালীন একজন লেখকের অতিপ্রজতাকে সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন এবং এর সঙ্গে দেশের সাহিত্যসমালোচনা-রুচিকে মেলালেন তখন নিজের হিসেবটাকেও এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে।

তিনি শেষ করলেন, ‘আর এক্সপেরিমেন্ট--- যত বিষয় নিয়ে সৈয়দ হক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন, তার হিসাব কী দিয়ে মেলাবি? কিন্তু খেয়াল কর--- আমাদের এখানে সামগ্রিক সাহিত্যের আলোচনা তো প্রায় হয়ই না, তারপর যখন কোনও একটা বিষয়ে আলোচনা হয়, সেখানে সৈয়দ হককে কখনও কখনও যেন মনে হয় তাঁর যোগ্য জায়গা পাননি!’
আমাদের সাহিত্য সমালোচনায় সেই সংকট আছে, তীব্র ভাবেই। সব্যসাচী রবীন্দ্রনাথ বাদে বুদ্ধদেব বসুকে মনে রেখে যে সমালোচনার হিসাব--- সেই হিসাবে নিজের বেড়ে ওঠায় সৈয়দ শামসুল হককে মেলাতে গিয়ে দেখা যায়, কবিতায় যে স্বদেশ তাঁর কাছে ব্যাখ্যাত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের খুব কম কবির কবিতায় এভাবে বাংলাদেশ উপস্থিত। অন্তত লোকভাষার ব্যবহার ‘আধুনিক’ কবিতার বিচারে ‘অনাধুনিক’ হয়ে ওঠার যে সম্ভবনা থাকে, সেখান থেকে অন্তত বাংলা কবিতাকে তিনি মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও বাংলা কবিতার আলোচনায় পূর্ববাংলার কবিতার এই নিজস্ব ভাষ্যকে পশ্চিমবাংলা বা বাংলা কবিতার সামগ্রিকতা দিয়ে ঠিক বুঝে ওঠা যায় না।

আর, পঞ্চাশের দশকে তাঁর এক মহিলার ছবি, অনুপম দিন কি সীমানা ছাড়িয়ে থেকে বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ পর্যন্ত যদি একটি পর্বের যাত্রা ধরি তাহালে ব্যক্তি, ব্যক্তির সংকট থেকে যে সামগ্রিকতায় পৌঁছায়--- এই যাত্রাপথ একই সঙ্গে গদ্যের ও আখ্যানবিন্যাসের ভিন্নমাত্রা উপস্থাপন করে। অন্যদিকে খেলারাম খেলে যা, মৃগয়ায় কালক্ষেপ, বনবালা কিছু টাকা ধার নিয়েছিল, বারোদিনের শিশু, মেঘ ও মেশিন পর্যন্ত অন্যতর মনস্তাত্ত্বিক যাত্রা। তা কখনও কখনও শারীরিক, শারীরিক থেকে সামাজিক। এর সঙ্গে কোনওভাবেই মেলানো যায় না ‘ইহা মানুষ’কে; অথচ শুধু আখ্যানের জোর শেষ পর্যন্ত কাহিনিকে যে তীব্রতা দেয় তাতে গল্প প্রায় অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে। আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব সহজ অথচ অস্তিত্ব সংহারী দুই কাহিনি : নীল দংশন ও নিষিদ্ধ লোবান--- কাজী নজরুল ইসলাম বা বিলকিসের মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট, শারীরিক অসহায়ত্ব পুরোটাই একটানে যুদ্ধদিনকে তুলে আনে।

এর বাইরে, এই পাঠকে সামনে পিছনে, পিছনে সামনে এনে একাট্টা পাঠকের হিসাব মেলাতে তেমন সমস্যা হয় না। কেননা, পাঠক হিসাবে আমাদের ওই সাহিত্যেই নজর থাকে যে টুকু আমরা পড়ে নিচ্ছি। কিন্তু সেটি যদি সামগ্রিক লেখককে সকল মাধ্যমে খুঁজে দেখার চেষ্টায় হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে একটার সঙ্গে একটা মিলিয়ে সামগ্রিক মানদ- তৈরির কোনও মান তো সাহিত্যে নেই। থাকার কথা না।

সৈয়দ শামসুল হকের কয়েকটি গল্প তো যে কোনও সময়ই মনে আসে, ‘তাস’, ‘কবি’, ‘ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে’, ‘মানুষ’। কিন্তু এই মনে থাকা তো শুধু গল্পের পাঠক হিসেবে। কিন্তু একইসঙ্গে তার ছোটোগল্পের পরিমিতিবোধ ও গল্পভাষায় যে নতুনত্ব--- তার কালকে মাথায় রাখলে ষাটের দশকের শুরুর দিকে কয়েকজন উল্লেখ্য গল্পলেখকের আবির্ভাবের আগে একমাত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ বাদে ওই প্রচেষ্টা ছিল ব্যতিক্রম। তবে, তিনি সাহিত্যিকজীবনের দ্বিতীয় পর্বে গল্পে সেভাবে মনোযোগ দেননি। এমনকি বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণের পরে আর একটিও বিশাল আয়তন উপন্যাস তিনি লেখেননি। সেই আয়োজন তাঁর হাতে ছিল।

তবে, এই সময়ে বছরে কয়েকটি উপন্যাস রচনার পাশাপাশি প্রচুর ব্যক্তিগত প্রবন্ধ লিখেছেন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত সাহিত্যিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। শুধু হৃৎকলমের টানেই নয়, ওটি তার অতিখ্যাত রচনা, এর বাইরে বাংলার মুখ, মার্জিনে মন্তব্য কি জলেশ্বরীর দিনপত্রী বাদে আরও অসংখ্য লেখার মুখোমুখি আমরা হয়েছি--- যার ভিতর দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক বারবার নিজেকে মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে।
মঞ্চনাটক কাব্যনাটকের বাইরে মুহূর্তে মনে আসা এইসমস্ত লেখাপত্তরের সামনে বাংলা সাহিত্যের একজন লেখককে দাঁড় করালে সেই ছবি কেমন হয়? শুরুতে যে দশকের প্রসঙ্গ উল্লিখিত, তা তো শুধু লেখকের শুরুকে মাথায় রাখার জন্যে। কিন্তু যে লেখককে পাঁচ দশক বাদেও তরুণতর লেখক সাহিত্যের যে কোনও মাধ্যামে লিখবার শুরুতেই অবশ্যপাঠ্য, প্রতিদ্বন্দ্বী আর সমকালীন হিসাবে মাথায় রাখে--- তাকে সামগ্রিক বিচারের বাইরেই তো সাহিত্যের আলাদা আলাদা মাধ্যমে গুরত্বপূর্ণ লেখক হিসাবে মান্য। সৈয়দ শামসুল হক কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক অনুবাদ ব্যক্তিগত প্রবন্ধ কি সাহিত্যিক কলামে তরুণতর লেখকের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। পঞ্চাশের নীরবতার চুঁইয়ে নামার মতো লেপটে থাকেন!

২০০৫
[লেখকের 'উচ্চারণের ক্রমশ সাহস' (২০১৬) বই থেকে সংগৃহিত]

আপনার মন্তব্য